#আফিম_বড্ড_নেশালো
পর্বঃ১৪
লেখিকাঃমাহযাবীন
বিয়ের আগে মেয়েদের মনে নানান অনুভূতিরা বাসা বাঁধে।তাদের মনে ভয়,সংশয় এবং অস্থিরতার অনুভূতি যেমন জায়গা করে নেয় ঠিক তেমনই আরেকটি হচ্ছে লজ্জানুভূতি।
জীবনের একটি নতুন অধ্যায়ে পা রাখবার জন্যে যেমন অধীরতা কাজ করে ঠিক তেমনই এক নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে চলতে পারবে কিনা এ নিয়ে থাকে ভয় এবং সংশয়।
অতি প্রিয় ও কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে নিজের করে পাওয়ার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় কি আদৌও?যত বারই নাফিয়া ভাবছে সে মিস.শেখ হতে মিসেস.আফিম ইবনানে পরিণত হবে ততবারই এক তীব্র সুখ অনুভব করছে সে।সেই সাথে আছে উত্তেজনা,প্রশান্তি,মুগ্ধতা ও লজ্জা।এতো এতো সুন্দর অনুভূতির মাঝে ভয়,সংশয় ও অস্থিরতাও রয়েছে।
সেন্টমার্টিনের বুকে নির্মিত ব্লু মেরিন রিসোর্টের একটি কক্ষের জানালার ধারে দাঁড়িয়ে অনুভূতির সাগরে সাঁতরাতে ব্যস্ত নাফিয়া।রাত পোহাতেই শুরু হবে তার বিয়ের প্রস্তুতি।সন্ধ্যের মধ্যেই সে শেখ পরিবারের মেয়ে হতে ইবনান পরিবারের পুত্রবধূতে পরিণত হবে।একটি জিনিস ভেবে ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে নাফিয়ার।আর তা হলো,এতোদিন তাদের প্রেমের সাক্ষী ছিলো আকাশ,বাতাস,চাঁদ ও তারা।আর এখন এদের সাথে সমুদ্রও যোগ হয়েছে।তাদের ভালোবাসার পূর্ণতা পাবার গল্পটা সমুদ্রের বুকেও লিখে যাবে তারা।
হটাৎই নাফিয়ার ফোনটি বেজে ওঠে।ফোনটি হাতে নিতেই দেখতে পায় “অভিরতি” [Addiction] লিখে সেভ করা নাম্বার হতে কল আসছে।ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে নাফিয়া কলটি রিসিভ করে কানে ধরে।কিন্তু ফোনের ওপাশ হতে কোনো শব্দ আসে না।কিছুটা সময় এভাবেই নিরব থাকবার পর ফোনের ওপাশ হতে মৃদু কন্ঠস্বর ভেসে আসে,
-This is not fair,Miss. Sheikh![এটি ঠিক নয়,মিস.শেখ]
-কোনটি?
-১০ দিনে একটি বারও দেখা করোনি।
-বিয়ের আগ অব্দি দেখা করা নিষেধ।
-Do you think that i care about this?[তোমার মনে হয় আমি এর পরোয়া করি?]
-কালই তো বিয়ে।
উত্তরে কিছু বলে না আফিম।আবারও উভয়ের মাঝে নিরাবতা বিরাজ করছে।এরা একে-অপরের কন্ঠস্বরের থেকে নিঃশ্বাসের শব্দই যেনো বেশি উপভোগ করে।ঠিক যেমন ঠোঁটে উচ্চারিত হওয়া শব্দগুলোর থেকে চোখে ভেসে ওঠা অনুভূতিগুলোই উপলব্ধি করায় মত্ত হতে পছন্দ করে এরা।
নিরাবতা ভেঙে আফিম বলে ওঠে,
-রুম হতে বেরোতে পারবে?
-উহু।
-ইচ্ছে করেই করছো।
উত্তরে মুচকি হাসে নাফিয়া।আফিম মিথ্যে বলেনি।সে সত্যিই ইচ্ছে করেই এ দশ দিন আফিমের সাথে দেখা করেনি।আসলে দূরত্ব কাছে আসার আনন্দকে কয়েকশত গুণ বৃদ্ধি করে দেয়।আফিমকে এতোটা দিন ধরে না দেখে থাকতে নাফিয়ার কম খারাপ লাগছে না কিন্তু কাল যখন একেবারে আফিম তার হয়ে যাবে এবং ১০ দিনের তৃষ্ণার্ত চোখ আফিমের দর্শন করবে তখনের অনুভূতিটি হবে এক অন্য রকম প্রশান্তির।
অনেকটা সময় উভয়ই নিরাবতা পালন করবার পর নাফিয়া বলে ওঠে,
-কাল পূর্ণিমা রাত!
-হু।
-জানতেন?
-হু।
-ইচ্ছে করেই বিয়ে এ দিনে ঠিক করেছেন,নয় কি?
-কাল জানতে পারবে।শুভ রাত্রি!
বলেই ফোনটি কেটে দেয় আফিম।
!!
সেন্টমার্টিনের নামকরা একটি রিসোর্ট ব্লু মেরিন।যা ফেরিঘাটের কাছেই অবস্থিত।রিসোর্টটি যেমন বড় ঠিক তেমনই সুন্দর।এ রিসোর্টের ৩য় তলায় বুফেট রেস্টুরেন্টের মতো খাবার ব্যবস্থা আছে।সেই সাথে আছে থাকার জন্যে কক্ষের ব্যবস্থাও।পুরো তৃতীয় তলা বুক করে নিয়েছেন অভ্র সাহেব।মেয়ের বিয়ে বলে কথা!
ঘাড়ে ঋণের বোঝা থাকতেও তিনি তার দুই কন্যার বিয়ের জন্য জমিয়ে রাখা ৮ লাখ টাকার একটি টাকাও কখনো খরচ করেননি।৪ লাখ টাকা করে ৮ লাখ টাকা দুই কন্যার বিয়েতে ব্যয় করবেন বলে জমিয়ে রেখেছিলেন।নাফিয়ার জন্যে যখন আফিমের প্রস্তাব আসে তখন সম্মতি দেওয়ার সময় চিন্তায় কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছিলো তার।এতো বড় পরিবারের সাথে সম্বন্ধ করতে চলেছেন, বিয়ের খরচ উঠাতে পারবেন তো!বিষয়টি প্রথম দিকে যতটা কঠিন লাগছিলো তার কাছে পরে আরো কঠিন মনে হয়েছিলো যখন আফিম সেন্টমার্টিনে বিয়ে করবার আবদার করে।কিন্তু এখন যেনো চিন্তের ছিতে ফুটাও নেই অভ্র সাহেবের।বিয়েতে মেহমান বলতে শুধু আফিমের খালার পরিবার এবং চাচার পরিবার।মামা আর ফুপু নেই আফিমের।আর নাফিয়ার তরফ থেকে শুধুই তার মামার পরিবার।কারণ খালা,চাচা,ফুফু কোনোটিই নেই তার।
রিসোর্টে প্রতিটি মেহমানের কক্ষ ভাড়া এবং খাওয়ার খরচ ব্যতীত তেমন কোনো খরচ করতে হচ্ছে না অভ্র সাহেবের।আফিমের পরিবার কোনো শর্তও দেয়নি তাকে।এমন কি নাফিয়ার বিয়ের কাপড় নাফিয়াকে সাথে নিয়ে সানিয়া বেগমই কিনে দিয়েছিলেন।আফিমকে যে নাফিয়ার পরিবার কিছু দেয়নি এমনটি নয়।আফিমকে নিয়ে অভ্র সাহেব গিয়েছিলেন কেনাকাটা করতে।মোট ৪০ হাজার ওখানে খরচ করে এসেছিলেন তিনি
বিয়ের জন্য দুটি রুম সুন্দর করে সাজানো হয়েছে।একটি ছেলেদের জন্য এবং অপরটি মেয়েদের জন্য।আর একটি রুম বিশেষভাবে সাজানো হয়েছে।যাকে বলে বাসর ঘর।
সন্ধ্যে ঠিক সাড়ে ৭ টা।নাফিয়াকে সাজিয়ে বসানো হয়েছে মেয়েদের জন্যে সাজিয়ে রাখা কক্ষটিতে।অন্যদিকে আফিমও বিয়ের শেরওয়ানিতে বর সেজে অপেক্ষার প্রহর গুনছে।বধু বেশে তার প্রিয়াকে দেখতে কতোটা মনোমুগ্ধকর লাগতে পারে তা কল্পনায় আনতে বারংবার ব্যর্থ হচ্ছে সে।অপেক্ষা যেনো পুরোচ্ছেই না।
রাত ৮ টায় কাজী সাহেব উপস্থিত হন বিয়ে পড়াতে।প্রথমে আফিমকে কবুল বলতে বলা হলে সে তড়িৎ গতিতে বলে ওঠে,”কবুল”।যেনো কয়েক সেকেন্ড বিলম্বে উত্তর দিলে তার বউ ভেগে যাবে।উপস্থিত বড় বুজুর্গ ব্যক্তিসহ আফিমের কাজিনসরা শব্দ করে হেসে ওঠে।সেই সাথে অনেকে তো বলেই বসে,”তাড়া দেখছিস!এখন দিয়েই বৌ পাগলা”।এদের হাসি বা কথায় বিন্দু পরিমাণ ভ্রুক্ষেপ করে না আফিম।সে তো দ্রুত বিয়ে টা সেরে তার মিস.শেখকে দেখতে চায়।
এদিকে নাফিয়াকে কবুল বলতে বলা হলে মেয়েটি অনুভূতির সাগরে সাঁতরাতে সাঁতরাতে বেশ সময় নিয়েই বলে “কবুল”।
অবশেষে চারিদিকে “আলহামদুলিল্লাহ”, “আলহামদুলিল্লাহ” শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।সবার মাঝে সে কি আনন্দ,উল্লাস!
!!
বাসর ঘরে লাল গোলাপ দিয়ে সাজানো বিছানাটিতে চুপটি করে বসে আছে নাফিয়া আফিমের অপেক্ষায়।পুরো ১০ দিন পার হয়ে ১১ দিনের দিন লোকটিকে দেখবে সে।হৃদয় জোরে জোরে স্পন্দিত হয়ে জানান দিচ্ছে সে কতোটা ব্যকুল তার প্রিয়র দর্শন পেতে।অপেক্ষার প্রহর বেশি লম্বা হলো না।৫/৬ জন মেয়ে কাজিনস সহ কক্ষে প্রবেশ করলো আফিম।নাফিয়ার দিকে চোখ যেতেই থমকে দাঁড়ালো সে।সিঁদুর লাল রঙের বেনারসি শাড়িতে একটি রূপসী নিজেকে জড়িয়ে বসে আছে।যার চোখে গাঢ় কালো কাজল,ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক,খোঁপায় গুজা ফুল।আফিমের হৃৎস্পন্দন ক্রমশ বেড়ে চলছে।পুরো পৃথিবীটা যেনো তার জন্যে থেমে গিয়েছে আর সে চোখ ভরে দেখে নিচ্ছে তার সদ্য বিয়ে করা এই মায়াবীনিকে।
কক্ষে উপস্থিত কাজিনসরা হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে আফিম ও নাফিয়া উভয়ের একে-অপরের দিকে হা হয়ে তাকিয়ে থাকা দেখে।হটাৎ একজন গিয়ে আফিমকে ধাক্কা দিয়ে বলে ওঠে,
“সারা রাত পরে আছে।তখন নাহয় ইচ্ছে মত দেখে নিস।তোর বউকে কেউ তুলে নিয়ে যাবে না।এখন যেয়ে তার পাশে বস এবং আমাদের ছবি তুলতে দে।” ধ্যান ভাঙতেই আফিম কন্ঠে বিরক্তি নিয়ে বলে ওঠে,
-বিয়ে করছি কি তোদের সাথে ছবি তোলার জন্য?যা বের হো আমার রুম থেকে।আমার বৌয়ের সাথে শান্তিতে থাকতে দে।
কাজিনদের মাঝে আবারও হাসির রোল পরে যায়।সবাই নানা কথা বলে মজা করতে আরম্ভ করে।আর এদিকে বেচারি নাফিয়া লজ্জায় লাল,নীল হচ্ছে।
চলবে।
[