#আফিম_বড্ড_নেশালো
পর্বঃ১০
লেখিকাঃমাহযাবীন
“একসাথে থাকার চেয়ে,একসাথে ভালো থাকাটাই খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ।একই সাথে রয়েও যদি সেথায় মানসিক প্রশান্তি না থাকে তবে একসাথে থাকাটা বৃথা নয় কি?” ২৪ বছর আগে এই প্রশ্ন জেগেছিলো সানিয়া বেগমের মনে।এর উত্তর খুঁজে পাওয়ার পরেই তিনি আফিমের বাবা আরহাম ইবনানের সাথে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তে উপনীত হন।
তাদের বিয়ে টা হয়ে ছিলো পারিবারিক ভাবে।বিয়ের আগে তারা শুধু একে-অপরের রুপ এবং কিছু গুণাবলী সম্বন্ধে জানারই সুযোগ পেয়েছিলেন।অতঃপর বিয়ের পর পরিলক্ষিত হয়,প্রতিটি জিনিসেই তাদের ভিন্ন মত,তাদের মুগ্ধতা ভিন্ন জিনিসে।সব জিনিসেই দুজনের ভিন্ন মত হওয়ায় একজনকে তো সমঝোতা করতেই হতো।আর সেই একজন টা ছিলেন সানিয়া বেগম।নিজের ইচ্ছে,চাওয়া-পাওয়া সব কিছু নিজের মাঝে চেপে তিনি আরহাম সাহেবের ইচ্ছেকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন।হয়তো এটিই তার সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো।একটি সম্পর্কে যখন সবসময়ই একতরফা সমঝোতা হয় তখন সমঝোতা করা মানুষটির অনুভূতির মৃত্যু ঘটে।সে মানুষটি কখনোই সে সম্পর্কে থেকে খুশি থাকতে পারে না।আর যে মানুষটি নিজেই খুশি নয় সে অন্যকে কিভাবে খুশি রাখবে!আরহাম সাহেব স্ত্রী হিসেবে যেরূপ নারী চেয়েছিলেন তেমনটি তো মোটেও ছিলেন না সানিয়া বেগম।তাই মনের দিক দিয়ে সেও এই সম্পর্কে সুখে ছিলেন না।এর মানে এমনটি মোটেও নয় যে তিনি সানিয়া বেগমের সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করতেন বা সানিয়া বেগমকে স্ত্রী হিসেবে যোগ্য মূল্য বা সম্মান করেননি।
আফিমের বয়স যখন ১০ তখন সানিয়া বেগম একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নেন।একটিই তো জীবন!একে সমঝোতা বা বিনা সুখ,প্রশান্তিতে কাটিয়ে দেওয়াটা বোকামী মাত্র।তাই তিনি আরহাম সাহেবকে তালাকের প্রস্তাব দেন।এ প্রস্তাবে আরহাম সাহেব প্রথমে অবাক হলেও পরে সম্মতি দেন।অতঃপর নিজের বিদেশ যাওয়ার ইচ্ছেতে বিদেশ গমন করেন।তার ২ বছর পর আরহাম সাহেব তার মাকে জানান তিনি ওখানের এক বাংলাদেশী মেয়েকে পছন্দ করেছেন এবং বিয়ে করতে চান।
সানিয়া বেগম এবং আরহাম সাহেবরের মাঝে পার্থক্য এতোটুকুই যে আরহাম সাহেব তার নতুন জীবন সঙ্গীর মাঝে সুখ খুঁজে নিয়েছেন এবং সানিয়া বেগম সুখ খুঁজে নিয়েছেন নিজের পুত্রের মাঝে।
সানিয়া বেগম,আফিমকে শিখিয়েছেন সৎ মাকেও সম্মান করতে এবং নিজের সৎ বোনকেও আদর করতে।সানিয়া বেগম কখনোই আফিমের কাছে এসব বিষয়ের জটিলতা উপস্থাপন করেননি বরং এসকল বিষয় তিনি যথেষ্ট চতুরতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে আফিমের কাছে সহজ এবং স্বাভাবিক বিষয় হিসেবেই উপস্থাপন করেছেন।সেই সাথে তিনি কখনোই আফিমকে নিজের কষ্টের প্রত্যক্ষদর্শী করেন নাই।বরং আফিমের মনে তার পিতার প্রতি সম্মানটা যেনো বজায় থাকে সে বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য রেখেছেন।এসবের একটিই কারণ।তা হলো সানিয়া বেগম কখনোই চান নি তার ছেলে কোনোভাবে কষ্ট পাক বা তার ছেলের মনে এসব বিষয় কোনোভাবে দাগ কাটুক।মায়ের কষ্ট কোনো সন্তানই সহ্য করতে পারে না।তাই হয়তো আফিমের তার পিতার প্রতি ক্ষোভ বা বিরূপ ধারণা তৈরি হতো যা একটি শিশু মনের উপর খারাপ প্রভাব ফেলে।আফিমের মায়ের বুদ্ধিমত্তা এবং সচেতনতার জন্যেই আফিমের শৈশবে তার পিতা-মাতার আলাদা হওয়ায় তেমন গাঢ় এবং বাজে প্রভাব পরেনি এবং সেই সাথে আফিমের এসব বিষয় মেনে নিতে তেমন কষ্টও হয়নি।
আফিম যেমন তার সৎ মা ও বোনকে ভালো জানে ঠিক তেমনই তার সৎ মা,বোনও তাকে যথেষ্ট ভালো জানে।তাদের সবার মাঝেই একটা ভালো সম্পর্ক বিদ্যমান।সেই সাথে সম্পত্তি নিয়েও কোনো ভেজাল নেই।কারণ আরহাম সাহেব তার বাংলাদেশের কোম্পানি আফিমের নামে করে দিয়েছেন এবং ইউএসএ তে তার চলমান ব্যবসার উত্তরাধিকারী তার কন্যা সন্তান।
!!
আফিমের অফিসে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং থাকায় সে বলতে গেলে সারাদিনই ব্যস্ততায় কাটায়।যেখামে সন্ধ্যেতেই বাড়ি ফেরে সে সেখানে আজ রাত ৮ বাজার পর বাড়ি ফিরেছে।গোসল সেরে নিচে আসতেই আফিমের মনে পরে আজ নাফিয়ার নিজের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিলো।মনে হতেই আফিম দ্রুত দাদীর রুমের দিকে অগ্রসর হয়।কেমন যেনো ভয় ভয় লাগছে তার।নাফিয়াকে শেষ একটি বারের জন্যে হলেও সে দেখতে চায় নাহলে আগামী ৪/৫ দিনের এ দূরত্ব যেনো তার জন্যে অসহনীয় হয়ে উঠবে।তড়িৎগতিতে দাদীর কক্ষে প্রবেশ করতেই এক শীতল বাতাস এসে ছুঁয়ে আফিমের হৃদয়টাকে মুহূর্তেই শান্ত করে দেয়।
বিছানায় দাদীর পেছনে বসে দাদীর মাথায় তেল দিতে দিতে গল্প করছে নাফিয়া।অর্থাৎ নাফিয়া এখনো যায়নি।আফিম শীতল চাহনিতে তাকিয়ে রয় তার দিকে।
হটাৎ আফিমকে দেখে চমকে যায় নাফিয়া।সেই সাথে আফিমের চাহনিতে কেমন যেনো একটু লজ্জাও লাগে তার।সে নিরবে দাদীর পেছন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আফিমের দিকে অগ্রসর হয়।নাফিয়া উঠতেই চোখ খুলে তাকান দাদী।দেখেন তার পোতা এসেছে কিন্তু নাফিয়াকে আফিমের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে সে আর কিছু বলেন না।
নাফিয়া আফিমের একটু কাছে গিয়ে বলে ওঠে,
-আফিম,আপনি কি আমায় একটু আমার বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিবেন?আসলে আমি নিজেই যেতে পারতাম কিন্তু এখন তো রাত হয়ে গিয়েছে!
এতোটুকু বলে একটু থেমে সে আবারও বলে ওঠে,
-বিকেলেও যেতে পারতাম কিন্তু ভাবলাম আজের দিনটা শেষ করেই যাই!
নাফিয়ার কথায় একটি চোরামো ভাব বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছে আফিম।নাফিয়া যে তার সাথে দেখা না করে যেতে চায়নি বলেই রাত অব্দি অপেক্ষা করেছে তা বুঝতে আফিমের বেশি বেগ পেতে হলো না।সে ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বলে ওঠে,
-ইয়াহ শিউর,মিস.শেখ।
!!
গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে আছে আফিম,পাশের সিটেই নাফিয়া।আফিমের গাড়ি চালানোর গতি কিছুটা এমন যে,
“এ পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হবে,তুমি বলো তো!”
বিষয়টি নাফিয়ার বেশ ভালোই লাগছে।জানালা খোলা থাকায় ফুরফুরে বাতাস এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে সেই সাথে রাতের শহরে একা একই গাড়িতে প্রিয় মানুষটির সাথে।সময়টি উপভোগ করার মতো।আফিম গাড়ি চালানোর মাঝেই আড়চোখে বেশ ক’বার দেখে নিয়েছে নাফিয়াকে।নাফিয়াও এর বিপরীত নয়।সে ও লুকিয়ে লুকিয়ে ক’বার দেখে নিয়েছে আফিমকে।
হটাৎ নাফিয়ার কানে সঙ্গীতের শব্দ ভেসে আসে।
“এখন তো সময় ভালোবাসার,
এ দুটি হৃদয় কাছে আসার,
তুমি যে একা আমিও যে একা,
লাগে যে ভালো,
ও প্রিয় ও প্রিয়”
এ মুহূর্তের জন্যেই যেনো এ গানটি তৈরি করা হয়েছিলো।এই মুহূর্তে এমন গানে নাফিয়ার বেশ ভালো লাগছে যার বহিঃপ্রকাশ তার ঠোঁটে বিরাজ করছে।সে ঠোঁটে এক চিলতে হাসি নিয়েই আফিমের দিকে তাকায়।আফিমও একই সময় তাকায় নাফিয়ার দিকে।উভয়ের চোখাচোখি হতেই নাফিয়া খানিকটা লজ্জা নিয়ে জানালার বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।আর আফিম ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে ড্রাইভিং এ মনোনিবেশ করে।
অবশেষে পৌঁছে যায় তারা নাফিয়ার বাড়ির সামনে।নাফিয়া গাড়ি হতে নামতেই আফিমও গাড়ি হতে বেরিয়ে আসে।নাফিয়া,আফিমের কাছে এসে ঠোঁটে হাসি নিয়ে বলে ওঠে,
-ধন্যবাদ আফিম।
-হাও বরিং!
ব্রু কুঁচকে তাকায় নাফিয়া।আফিম বলে ওঠে,
-আই ডোন্ট ওয়ান্ট থ্যাংকস লাইক দিস।
-তো কিভাবে চাইছেন?
নাফিয়ার প্রশ্ন শুনে আফিম বাঁকা হেসে নাফিয়ার কোমর জড়িয়ে ধরে নাফিয়াকে নিজের কাছে নিয়ে আসে।চকমে আফিমের দিকে বেশ বড় বড় চোখ করে তাকায় নাফিয়া।আফিম বাঁকা হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বলে ওঠে,
-ঠিক এতোটা কাছে এসে (ঠোঁটের দিকে ইশারা করে)এখানে স্পর্শ এঁকে ধন্যবাদ বলতে হয়।
চোখ আরো বড় করে নাফিয়া বলে ওঠে,
-ছিঃ আফিম! কতোটা লুচু আপনি।
-আমি লুচু?(এক ব্রু উঁচু করে বলে আফিম)
-একদম।(মজা করেই বলে ওঠে নাফিয়া)
-তাহলে তো একটু লুচুগীরি করতেই হয়।
বলেই নাফিয়ার ঠোঁটের দিকে এগিয়ে যেতে আরম্ভ করে আফিম।আবারও নাফিয়ার হৃৎস্পন্দন ধীরে ধীরে বেড়ে যাচ্ছে।নাফিয়া মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
-কোন অধিকারে?
-হু?(নাফিয়ার ঠোঁটের অনেকটা কাছে থেকেই বলে ওঠে আফিম)
-কোন অধিকারে এতোটা কাছে আসা?
ঠোঁটে হাসি রেখেই আফিম বলে ওঠে,
-আমার আগে অন্য কোনো ছেলের সাথে মিশেছো?অন্য কোনো ছেলের সাথে রাতে একা ছাঁদে থেকেছো?ঘোড়ায় চড়েছো?ড্যান্স করেছো?
-উহু।
-অন্য কোনো ছেলের এতোটা কাছে এসেছো?
-উহু।
-তবে কোন অধিকারে আমাকে নিজের এতোটা কাছে আসার অনুমতি দেও?
আফিমের করা প্রশ্নে নিশ্চুপ হয়ে যায় নাফিয়া।এর উত্তর কি?এর উত্তর কি এই যে,আফিমের কাছে আসা টা তার ভালো লাগে!আফিম তার কাছে আসলেই তার হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায় এবং সে এক অন্য রকম আনন্দানুভূতি অনুভব করে!সে এ সময় গুলো খুব করে উপভোগ করে!আফিম কাছে আসায় তার যে অনুভূতি হয় সে অনুভব সে বারংবার চায়।কিন্তু এসব অনুভূতির কারণ কি?
নাফিয়াকে নিশ্চুপ দেখে আফিম আর কিছু বলে না।টুপ করে নাফিয়ার নাকে একটা চুমু বসিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,
-টেক কেয়ার।
কথাটি বলে নাফিয়াকে ছেড়ে দিয়ে আফিম নিজ গাড়িতে যেয়ে বসে পরে।নাফিয়ার ঘোরের মাঝেই যেনো সব হলো।ঘোর কাটতেই দেখে আফিম গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে ঠোঁটে আলতো একটা হাসি নিয়ে নাফিয়াকে ইশারা করে বাড়ির ভেতরে যেতে বলে।নাফিয়া কিছুটা সময় আফিমের দিকে তাকিয়ে থেকে হুট করেই উল্টো দিকে ঘুরে নিজের বাড়ির দিকে অগ্রসর হয়।ঠোঁটে ফুটে ওঠে আলতো লজ্জারাঙ্গা হাসি।
চলবে।
[যারা রোম্যান্স চাচ্ছেন তারা একটু বিয়ে অব্দি অপেক্ষা করেন।?
আর যারা বলেন আমি গল্প দেওয়ায় অনিয়ম করি,তারা কি বোঝেন একটা গল্প লিখতে কতোটা সময় লাগে?সেই সাথে মানসিক অবস্থাও লেখার মতো থাকার দরকার হয়।আমি কখনোই ইচ্ছাকৃত গল্প দেরিতে দেই না বাধ্য হয়েই এমনটা করা লাগে।পাঠক-পাঠিকাদের অনুরোধ করছি,তারা যেনো আমার দিক টাও একটু ভেবে দেখে।? আজ কি একটা অবস্থায় গল্প লিখেছি তা শুধু আমি জানি।জানি না গল্প ঠিক মতো সাজাতে পেরেছি কিনা!]