আড়ালে অন্তরালে পর্ব ৩

0
655

#আড়ালে_অন্তরালে

#মাহমুদা_লিজা

পর্বঃ ৩

ছাদে কাপড় মেলে দিচ্ছিলো মায়া, কাপড়চোপড় সব নিজেকেই ধোয়া লাগে। তাও একটু উনিশ বিশ হলেই বকা আর মা ই র ফ্রি তার জন্য। মনে মনে আকুতি করে বলল – কার কাছে রেখে গেছ মা, যদি জানতে! সব কাজ করেও ঠিকঠাক ভাতই জোটে না মা। আমার মুক্তি চাই মা, মুক্তি চাই।

এসব ভাবতে ভাবতে তার মনে হলো সে ছাদে এসেছে অনেকক্ষণ আগে, এর জে র আবার না জানি কি দিয়ে টা ন তে হয়। এক ধাপ দুই ধাপ করে এগোতে এগোতে মিলনের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো মায়া। তার সাথে দেখা হওয়া লোকটা নাম কি যেন ভাবতে ভাবতে মনে পড়লো ফাহিম মির্জা এই ঘরেই আসতো। আজ দরজার বাহিরে ঝুলানো তালাটা বলে দিচ্ছে কেউ নেই আপাতত ভেতরে। কলেজের কথা মনে হতেই আবার দ্রুত পায়ে নিজের দরজায় চলে এলো। তড়িঘড়ি করে তাকে রেডি হতে দেখেই তাকে রাশেদা জিজ্ঞেস করলো – তা প্রতিদিন কলেজের নাম করে কোথায় কোথায় যাওয়া হয়?
এমন বি দ ঘু টে কথাগুলো আজকাল সয়ে গেছে মায়ার। তাচ্ছিল্যের হাসি ঠোঁটে টেনে বলল – আসছি ছোট মা।
রাশেদা বুঝতে পারলো তাকে করা মায়ার নীরব অপমান। পুরোটা বুঝেই দরজার সামনে যাওয়া মায়াকে হিজাবের উপর দিয়ে চুলগুলো ধরে টেনে পায়ের কাছে এনে বলল – আমার কথার জবাব না দিয়ে কই যাস? তোর ম রা মায়ের কাছে?

ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠছে মায়া, ক্ষীণ কন্ঠে কত কাকুতি মিনতি করছে ছেড়ে দেয়ার জন্য কিন্তু একের পর এক আ ঘা ত করেই যাচ্ছেন রাশেদা। সহ্যের সীমা অতিক্রম করে তিনি হঠাৎ মায়ার জামাটা টেনে ছিঁ ড়ে দিলেন। গলার কাছ থেকে বুক পর্যন্ত ছেঁ ড়া জামাটা মায়ার সকল কষ্ট ছাপিয়ে গেল। দুহাত দিয়ে নিজের আব্রু রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করছে সে। মায়ের চড়া গলা শুনে খানিকটা বিরক্ত নিয়ে ঘুম থেকে উঠে এসে দশম শ্রেণীতে পড়ুয়া মিরাজ যখন দেখলো রাশেদা মায়ার চোয়াল শক্ত করে ধরে আছেন তখনই সে শান্ত স্বরে বলল – আপাকে ছেড়ে দাও মা।

ছেলের কথা কানে না নিয়ে তিনি বলতে থাকলেন – স তী নে র মেয়েটা কলেজের নাম করে ফ ষ্টি ন ষ্টি করতে যায়। আর ঘরের কাজ করে তার জন্য আমাকে রান্না করে সাজিয়ে রাখতে হবে তিনি এসে গি ল বে ন বলে। আপদটার জন্য নিজের ছেলেমেয়ে দুটোকে ঠিকমত খাওয়াতে পারিনা, সেখানেও ভাগ বসাইতে আসিস।
মিরাজ আবার বলল – আপাকে ছেড়ে দাও।
রাশেদা ছেলেকে কপট শাসনের স্বরে বললেন – সৎ বোনের জন্য এত মায়া দেখাতে হবে না।
চোখ লাল হয়ে এল মিরাজের, স্বরটাকে উঁচিয়ে বলল – আপাকে এখনই ছেড়ে দাও, নিজের পাল্লায় আপাকে মাপতে যেওনা।
তবুও ছাড়লেন না রাশেদা, ধুম করে মায়ার পিঠে কিলটা বসিয়ে দিতেই আর্তনাদ করে উঠলো সে, তার মনে হচ্ছে নিশ্বাস যেন আটকে যাচ্ছে, সে যেন যুদ্ধ করে ভেতর থেকে বাতাসটা টেনে আনছে।
মিরাজের ধৈর্য্য ততক্ষণে শুন্যের কোটায়। একটানে বোনকে নিজের পিছনে নিয়ে মাকে বলল – কি বলোতো মা, মাঝে মাঝে তোমার মত নারীদের আচরণে মা ডাকটাই ক লু ষি ত হয়ে যাবে। আজকের পর থেকে আপার গায়ে তোমার আর একটা আ ঘা ত আমি সহ্য করব না, সোজা থানায় অভিযোগ করব। ভেবোনা এটা টিভি সিরিয়াল।
নিজের ছেলের মুখে আচানক কথা শুনে রাশেদা বললেন তুই আমার ছেলে হয়ে….
কথাটা শেষ করার আগেই মিরাজ বোনকে নিয়ে রুমের দিকে চলে গেলো।

_______

নিজের ডেস্কে বসে কাজ করছে ফাহিম। মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে তার। ভ্রুজোড়া কুঁচকে চোয়াল শক্ত করে কী-বোর্ডে শব্দ তুলছে সে। পুরো কাজটা সম্পন্ন করার পরও যখন সামান্য ভুলের জন্য সিনিয়র অফিসার কথা শোনায় তখন যে কোন স্টাফেরই নিজের প্রতি কনফিডেন্স কমে যায়। হাতের পিঠ দিয়ে কপালে জমে থাকা ফোঁটা ফোঁটা ঘামগুলো মুছলো ঠিকই কিন্তু সমস্ত রাগ যে কপালের উপর ঝারছে তা কপাল দেখলেই বোঝা যায়। হাতে থাকা ঘড়ির কোণাটা লেগে কপালের এপাশ থেকে ওপাশে আঁচড় লেগে ফোঁটা ফোঁটা র ক্ত জমেছে। রাগের কাছে ব্যাথাগুলো কিছুই নয়।
– ফাহিম ভাই, বোনাস শিট রেডি করেছি। স্যার বললো আপনার একটা সাইন লাগতো আর ফাইল রেডি করে অপারেশন ম্যানেজারের নিকট জমা দিয়ে আসতে বলল আপনাকে।

সাঈফের বলা কথাগুলো শুনে ফাহিম বলল – সাইন দিয়ে ফাইল রেডি করার দায়িত্ব আমার কিন্তু অপারেশন ম্যানেজারের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য সহকারী আছে। আমাকে ফাইল পৌঁছে দেয়ার জন্য এক্সট্রা টাকা দেওয়া হবে না।
ফাহিমের কথা শুনে সাঈফ গলা নামিয়ে বলল – আপনাকে আমার ভালো লাগে ফাহিম ভাই। কিভাবে পারেন সোজাসাপটা কথাগুলো বলতে?
ফাহিম এবার কী বোর্ড থেকে চোখ সরিয়ে সাঈফের দিকে তাকিয়ে বলল – কারণ আমি পুরুষ মানুষ, মেরুদণ্ড সোজা।
কথাটা বলে ফাহিম অফিস সহকারীকে উচ্চস্বরে ডেকে বলল – ফাইলটা অপারেশনের রুমে দিয়ে আসেন।
ফাহিমের এই স্পষ্টবাদীতায় যারপরনাই মুগ্ধ অফিস সহকারী জুয়েল। সবার কাছে প্রিয় ব্যক্তিত্ব হলেও অপারেশনের জন্য ফাহিম আপাদমস্তক অপদার্থ। জুয়েল এসে গলাটা নামিয়ে ফাহিমের একদম কাছাকাছি এসে বলল – স্যার! আজকে হাওয়া এত গরম কেন?
জুয়েলের কথা শুনে ফাহিম বলল – টয়লেটে যাওয়া আবশ্যক তাই।
সাঈফ আর জুয়েল দুজনেই হেসে উঠলো ফাহিমের কথায়। তাদের হাসিতে ফাহিমও ঠোঁট চেপে হেসে বলল – ফাইলটা দিয়ে আসেন। যেভাবে হাসছেন প্যান্টের উপর চা প পড়বে তো।

____

ড্রয়িংরুমে বসে টেলিভিশনে প্রচার হওয়া খবরটা মনোযোগ দিয়ে শুনছেন আশরাফ আহমেদ মানে মায়ার বাবা। আজকাল খবরগুলো শুনলেই ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে তার মন। শান্তির ছিটেফোঁটা নেই কোথাও যেন। সবজায়গায় শুধু অশান্তি আর নিষ্ঠুরতার জাল বিছানো। চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস নিতে গেলেও চোখের পাতায় চলে আসে বর্বরতার দৃশ্যপট। মেয়ের ডাকে ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলেন আশরাফ।
– চা এনেছি বাবা।
মেয়ের উচ্চারিত শব্দগুলো অনুসরণ করে তার মুখের দিকে তাকাতেই আঁতকে ওঠেন তিনি। মুখ ফুলে আছে মেয়ের। বিষাক্ত কোন পোঁকার আক্রমণে যেমন আক্রান্ত স্হান ফুলে যায় তেমনি ফুলে আছে মেয়ের মায়াভরা চোখ-মুখ-নাক-গাল। আশরাফ আহমেদের মনে পড়লো তিনিও ঘরে এমন বিষাক্ত পোকা এনেছেন যার কাজই এমন ভয়াবহ। অশান্তির ভয়ে রাশেদাকে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য করতে পারেন না তিনি। কিন্তু আজ সমস্ত সীমা যবনিকাপাত হয়েছে। গম্ভীর, রাগী পুরুষদের মত গর্জে উঠলেন তিনি – এ কি দশা তোর! আমাকে বলার প্রয়োজন বোধ করিস না? আমার যা বোঝার তা আমি বুঝে গেছি। তোকে আমি হোস্টেলে রেখে আসব আর ঘরটাকে কীটনাশক দিয়ে কীট মুক্ত করব।
বাবার কথার পিঠে কোন কথা বললো না মায়া, তার চোখ আঁটকে গেল টেলিভিশনের পর্দায়। বাবার কোন কথাই তার শ্রবণশক্তির কম্পাংক তৈরী করতে পারছে না যেন। খবরটা শুনে আর দৃশ্যটা দেখে শিউরে উঠলো সে। এত বিভীষিকা! এত ভয়ানক!
খবরটা তখনও পড়েই চলেছে পাঠিকা।
– হাসপাতালের সামনে কে বা কারা রেখে যায় তাদের। তাদের দুজনের পাশেই পাওয়া গেছে তাদের ছেদ কৃত অঙ্গুলি এবং জিহ্বার কা টা অংশ। গুরুতর আহত অসীম এবং প্রীতম নামের এই দুই ব্যক্তিকে হাসপাতাল কতৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তারা নিজেদের ব্যবসা দেখার পাশাপাশি বেসরকারিভাবে নিজ উদ্যোগে শখের বশে বিভিন্ন অনুসন্ধান করতেন। ধারণা করা হচ্ছে কোন গোপন তথ্য জেনে যাওয়ার কারণে তাদের এই অবস্থা হয়েছে।

এতটা বিভৎসতা দেখে নিজেকে আর সোজা রাখতে পারছেনা মায়া। তার হাত পা কাঁপছে ভয়ে। আশরাফ দ্রুত টেলিভিশনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে মেয়েকে সোফায় বসিয়ে পানি খেতে দিলেন। মায়ার খুব ইচ্ছে হচ্ছে তার এই ভয় পাওয়া মুখটা মায়ের আঁচলে লুকাতে কিন্তু মা তো নেই। কোনমতে দৌড়ে নিজের রুমে গিয়ে কাঁথার নিচে মুখ লুকালো সে। আশরাফ চেয়ে দেখলেন একই ছাদের তলায় থেকেও মেয়ে আর নিজের মধ্যে তৈরী হওয়া যোজন যোজন ভারী এক দেয়াল।

_____

টেলিভিশনে খবরটা মুরাদ দেখতে পেয়েছে। রিহানকে বলল – বেঘোরে নিজের প্রা ণ দিতে আসে কেন তারা? আমার কাজ সম্পর্কে না জেনেই তারা আমার পিছু নিয়েছে। তারা জানেনা স্বার্থে আঘাত লাগলে মায়াবী হরিণও হিং স্র হয়ে যায় সেখানে আমিতো স্বভাবতই নির্দয়।

মুরাদের কথা শেষ হতেই খবর এলো – ইমতিয়াজ ডাকছে তাকে।
খবর নিয়ে আসা লোকটাকে হাত উঠিয়ে থামতে বলল মুরাদ। তাকে বলল – ইমতিয়াজকে গিয়ে বলে দাও সকল তথ্য আমার জানা হয়েছে। আর লোকগুলো কবে নাগাদ কাজে নামবে তা যেন সে তাড়াতাড়ি আমাকে জানায়।
আগত মানুষটা বলল – বস একজন পুরুষের পুরুষত্ব শেষ করার কারণ?

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধ লোকটার দিকে তাকিয়ে মুরাদ বলল – তারা ধর্ষক।

প্রৌঢ় লোকটা বলল – তোমার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করার ধৃষ্টতা দেখিয়ে অন্যায় করেছি নিশ্চয়ই।

মুরাদ হাসলো কিনা বোঝা গেল না। কন্ঠটাকে নিচু করে বলল – সত্য জানার অধিকার সবার আছে চাচা। আমি তোমায় সম্মান করি। আমার নতুন জীবন দিয়েছিলে তুমি।
উত্তরটা শুনে প্রৌঢ়বয়সী ব্যক্তিটি খুশি হতে পারেনি। চোখে ফুটে উঠেছে খানিকটা ক্রোধ স্পষ্ট। তাই ফের জবাবটা এলো কিছুটা শক্ত কন্ঠে – এরকম অমানুষ বানাতে চাইনি তো!
ষাটোর্ধ লোকটার কন্ঠের তেজ আঁচ করে পরিস্থিতি সামাল দিতে মুরাদ মাথা নিচু করে বলল – চাচা সমাজে এসব লোকগুলো আর তামান্না রহমানের মত মহিলাগুলো সমাজকে শেষ করে দিচ্ছে। আচ্ছা চাচা তামান্না রহমানের বিশ্বাসঘাতকতায় চরমভাবে হতাশ হওয়া মেজর মাহতাব খান কি বিচার পেয়েছিলেন? তাহলে অন্যায় কে করছে চাচা? মেজর র‍্যাংকে আসা মাহতাব খানকে কেন চলে আসতে হলো সেই দাপটের জীবন ছেড়ে?

মুরাদের যুক্তির কাছে হেরে গিয়ে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলেন ষাটোর্ধ বৃদ্ধ লোকটা। লোকটার সাথে মুরাদের সম্পর্ক বুঝে উঠতে পারেনা রিহান। এতক্ষণ তাকিয়ে সব শুনলেও কিছুই মস্তিষ্কের নিউরণে ঢেউ খেলাতে পারেনি তার। তার চিন্তার সীমায় দাঁড়ি টানলো মুরাদ। তাকে বলল – আজ হাসপাতালে নিরুপমা আসবেই, আর আজই তার খেলায় তাকেই মাত দিতে হবে।
অপলক তাকিয়ে থেকে রিহান বলল – যদি না আসে?
মুরাদ উঠে দাঁড়ালো রিহানের সামনে, খানিকটা মেরুদণ্ড বাঁকা করে রিহানের দিকে ঝুঁকে বলল – আসবে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here