আড়ালে অন্তরালে পর্ব ২১

0
412

#আড়ালে_অন্তরালে

#মাহমুদা_লিজা

পর্বঃ২১

বসার ঘরে সোফায় বসে ফোন স্ক্রল করছিল রায়হান। আয়েশা আর মাহতাব খান যার যার ঘরে রয়েছেন। আয়েশা অবশ্য বারবার বসার ঘরে এসে দরজাটা খুলে দেখে তার ভাই এসেছে কিনা। রায়হানের ধমক খেয়ে ফিরে যায় নিজের ঘরে। ফের আসে, ফের যায়।
রায়হান অনবরত টাইপিং এ ব্যস্ত। তানভীরের অবস্থা জানার জন্য সে ব্যাকুল হয়ে আছে। তার মনে পড়ল তানভীরের বলা কথাটা। বারবার রায়হানকে বলেছে ইমতিয়াজ এবং রিহান কোনমতে যেন থানার আশেপাশে না যায় কিংবা তার খবর নেয়ার চেষ্টা না করে।
তাতে কি আর থেমে থাকে তারা! বারবার রায়হানকে মেসেজ করছে। ইমতিয়াজতো রায়হানকে বারবার বলছে একবার যেন মুরাদের সাথে দেখা করার সুযোগ করে দেয়া হয়।
রায়হানও তাকে কড়াভাবে নিষেধ করছে থানার আশেপাশে না যেতে।
এরমধ্যেই এলো কাংখিত সংবাদটি। স্বস্তির নিশ্বাস নিল যেন। মেসেজটা আবার পড়ল –

“সবকিছু ঠিকঠাক। এস আইকে সরানো হয়েছে। মিস্টার তানভীরও এখন ঠিক আছে। সকাল দশটায় তাকে ঢাকার উদ্দেশ্যে নেয়া হবে। সম্পূর্ণভাবে দুশ্চিন্তা মুক্ত হতে পারেন। সকল প্রমাণ সঠিক জায়গায় পেশ করা হয়েছে। অঘোষিত মুক্তি হয়ে আছে, এখন শুধু আনুষ্ঠানিকতা বাকি”।

মেসেজটা পড়ে সৃষ্টিকর্তার দরবারে শুকরিয়া আদায় করল রায়হান। ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি ঝুলছে যেন। রায়হান খবরটা ইমতিয়াজ এবং রিহানকে জানিয়ে দিল। হাত থেকে ফোনটা রেখে সোফার পেছনের দেয়ালটায় মাথা ঠেকিয়ে তানভীরের কথা ভাবছে। কারো পায়ের আওয়াজে সতর্ক হলো সে। অন্ধকারে একটা অবয়ব রুমটার দিকে আসছে। পা টিপে টিপে চলা অবয়বটাকে চিনতে বেগ পেতে হলোনা রায়হানের। তার মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। সেও সোফা ছেড়ে উঠে পা টিপে চলা অবয়বটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো একদম। গমগমে কন্ঠে বলল – এখনো ঘুমাসনি? ঠাঁটিয়ে কানে একটা লাগাবো?
অন্ধকারে আচমকা অমন কাঠখোট্টা ভাষায় ভূত দেখার চেয়ে বেশি ভয় পেল আয়েশা। ভূউউত বলে চিৎকার করার আগেই তার মুখ চেপে ধরে রায়হান বলল – এতদিন ধরে তক্কে তক্কে ছিলাম, আজ হাতে পেয়েছি। ঘা-ড় ম’ট’কে খাব।
কথাটা বলেই আয়েশার মুখ থেকে হাত নামিয়ে রায়হান আবার বলল – আয় দেখি, আমার কাছে আয়। আগে চোখগুলো তু’লে বল খেলি।
কথাগুলো কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই আয়েশার শ্বাস নেয়ার গতি দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। বিড়বিড় করে দোয়া পাঠ করতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলছে সে। তবুও সামনে থেকে ভূত সরছে না বিধায় আয়েশা কাঁপা কাঁপা স্বরে বলতে লাগল – আজকে ভূতের বিয়ে, ঝাঁটার বাড়ি দিয়ে। ভূতের মুখ কালা, মা’ই’র দেয়ার আগে পালা।
আয়েশার অমন অদ্ভুত কবিতা শুনে রায়হানের খুব জোর হাসি পেল। সে বুঝতে হাসি আটকানো কঠিন কাজ। এখন যদি হো হো করে হাসা যেত তাহলে মনে হয় দমটা এই যাত্রায় বেঁচে যেত। খুব কষ্টে হাসি চেপে রায়হান বলল – ফাজলামি রেখে বল এত রাতে এখানে কি?
আয়েশা তখনও ভূত ভেবে বলল – রায়হান ভাই, ও রায়হান ভাই, কই আপনি? ভূউউত, ভূউউত।
খানিকটা গলা উঁচিয়ে কথাটা বলতেই রায়হানের হাসি এবার আর বাঁধ মানছে না। ফিক করে হেসে বলল – রায়হান টায়হান বুঝিনা। তোকে আজ বিয়ে করে ভূতের রাজ্যে নিয়ে যাব। কোন শা*লা তোকে বাঁচাবে?
ফিরতি জবাব না পেয়ে রায়হান যেই ফোনের টর্চটা অন করবে তার আগেই কিছু একটা পড়ার শব্দ পেল। তড়িঘড়ি করে টর্চ অন করতেই দেখল আয়েশা নিচে লুটিয়ে পড়েছে। হাসির চোটে নিজেকে স্হির রাখতে পারছে না রায়হান। একদিকে তানভীরের মুক্তির খবর অন্যদিকে নিজের প্রিয়দর্শিনীর বাঘিনী রূপের আড়ালে যে পুরাটাই বিড়ালের রূপ তা ভেবে হেসেই সারা সে।
কোনমতে নিজেকে সামলে এক গ্লাস পানি এনে আয়েশার চোখে মুখে ছিটিয়ে দেয়ার আগেই আবার মাথায় দুষ্টবুদ্ধি চাপলো তার। ধুম করে গ্লাসের সব পানি একসাথেই ঢেলে দিল আয়েশার মুখে। হুড়মুড় করে লাফিয়ে উঠে রায়হানকে সামনে দেখে তার হাত আঁকড়ে ধরে বলল – ভূউউত, ভূউউত আসছে।
রায়হান মুখটা গম্ভীর করে বলল – নিজের রুম রেখে
এখানে এসে গড়াগড়ি দিচ্ছিস কেন?
আয়েশা এদিক সেদিক তাকিয়ে বলল – ভূউউত।
রায়হান আরো গম্ভীর ভাব নিয়ে বলল – তুই ভূতে ভয় পাস না বরং ভূত তোকে দেখে পালাবে।
রায়হানের বাঁকা কথাগুলোও আয়েশার গায়ে লাগছেনা। তার মনে এখন একটাই উদ্দেশ্য, যে করেই হোক, সব কথা শুনে হলেও ভূতের হাত থেকে বাঁচতে হবে।

অসহায় চাহনি নিয়ে রায়হানের পানে তাকালো সে। কাঁদো কাঁদো ভঙ্গি করে বলল – জীবনে আপনার সাথে ঝগড়া করব না, দয়া করে ভূতের হাত থেকে বাঁচান।
আয়েশার কথায় রায়হানের মোটেও হাসি পেলনা বরং হাত ধরে তাকে টেনে তুলে বলল – আমি আছিতো, ভূত তোর ধারে কাছেই আসবে না।
আবেগে গদগদ হয়ে আয়েশা প্রায় রায়হানকে জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছিল, পরক্ষণেই থেমে গিয়ে বলল – আমি আসি।
অন্যদিকে রায়হান নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে, সে যেন অপেক্ষা করছে কখন আয়েশাটা তাকে জড়িয়ে ধরবে।
আয়েশা দ্রুত গতিতে সিঁড়ি বেয়ে উঠলো। ভাইয়ের ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দরজাটা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই দেখল মায়া খাটের পাশে ফ্লোরে বসে আছে। আলোটাও জ্বালানো। চোখ মুখ ফুলে গেছে। আয়েশা বেশ বুঝতে পারছে মায়া এতক্ষণ কান্না করেছে। মায়ার কাঁধে হাত রেখে আয়েশা বলল – চিন্তা করোনা ভাবী। আমার ভাই তাড়াতাড়ি ফিরবে। রায়হান ভাই বলল।
মায়া ঈষৎ হেসে বলল – ঘুমাওনি? তোমার ভাই এসে যদি শুনে তুমি ঘুমাওনি তাহলে কান মলে দিবে।
আয়েশা বুঝতে পারল মায়া একা থাকতে চাইছে। তাই কথা না বাড়িয়ে সে মায়াকে শুভ রাত্রি জানিয়ে নিচে নেমে এলো।

____

সিদ্ধান্ত বদলে মাহতাব খান ও আয়েশাকে ঢাকা যেতে দিলো না রায়হান। সে মায়াকে একাই স্টেশনে এনে গাড়ি ধরিয়ে দিয়ে গেল। মাহতাব খানকে জানানো হয়েছে যে তানভীরের অঘোষিত মুক্তি হয়ে গেছে, আনুষ্ঠানিকতাটাই শুধু বাকি।
শারীরিক অসুস্থতার কারণে তানভীরকে ঢাকা নেওয়া হয়নি। ঢাকায় সকল প্রমাণ ও দলিল দেখে স্হানীয় থানার ওসি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি মামলাটা কোর্টে উঠাবেন না। সমস্ত প্রমাণ হাতে পাওয়ার পর মামলাটা কোর্টে উঠানো মানে অযথাই সময় নষ্ট। তিনি বরং নিরুপমাকে বললেন সাদমানের এই মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য। তানভীরের মুক্তির আদেশ নিয়ে আবার চট্টগ্রাম ছুটলো নিরুপমা। রাত দশটা নাগাদ থানায় আদেশ জমা করতে সক্ষম হয় সে। সেই অবশ্য ইন্সপেক্টর আহসানকে অনুরোধ করেছে যেন তানভীরকে ঢাকা না নেয়া হয়। আর তখনই শারীরিক অসুস্থতার নাটকটা সাজিয়ে নেন আহসান। আহসানকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তানভীরের মুক্তির আদেশটা তার সামনে রেখে নিরুপমা বলল – তাকে এবার মুক্তি দিন। সে মুক্ত আকাশে উড়বে। তাকে বন্দী করে রাখবেন না।
রায়হান, ইমতিয়াজ এবং রিহান অপেক্ষা করছে কখন তানভীর বেরিয়ে আসবে।

রাত্রি তখন এগারটা বেজে আঠার মিনিট। সকল ফরমালিটি শেষ করে দ্রুত পায়ে নিরুপমা বেরিয়ে গেল। তার আজকের পোশাকটা ছিল সম্পূর্ণ ধূসর রঙা। রায়হান দেখল মেয়েটা হন্তদন্ত পায়ে বেরিয়ে গেছে। তার মিনিট দুয়েক পরেই বেরিয়ে এলো তানভীর। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে সে। তাকে দুপাশ থেকে দুজন পুলিশ ধরে রেখেছে। তাকে ধরতে যাওয়ার মুহূর্তে রায়হানের ফোনে মেসেজ টিউনটা বাজলো। ফোন আনলক করে মেসেজটা ওপেন করতেই রায়হান দেখল তাতে লেখা – খুব শীঘ্রই থানার সামনে থেকে বেরিয়ে যান। কোন অবস্থাতেই তাকে গাড়ি থেকে নামতে দিবেন না।

ফোনটা পকেটে রেখেই রায়হান আগলে নিল তানভীরকে। ইমতিয়াজ আর রিহান দেখছে তানভীরের আঘাতগুলো।
রায়হান উদ্বিগ্ন হয়ে বলল – ওরা তোকে আঘাত করেছে?
মাথা নিচু করে তানভীর বলল – হয়ত মে:রে ফেলতে চেয়েছে।
গাড়িতে তানভীরকে বসিয়ে দিয়ে নিজে তার পাশে বসল। ইমতিয়াজ বসল তার বামে। রিহান ছিল ফ্রন্ট সিটে। গাড়িতে বসেই রায়হান বলল – বাড়ি যাব, তাড়াতাড়ি চালান। রাস্তায় কোনমতে গাড়ি থামাবেন না।
ড্রাইভারও মাথা নাড়িয়ে সায় দিল। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দ্রুত গতিতে চলা শুরু করল। তার মনটা বড্ড আনচান করছে। কোন আসন্ন বিপদের আশংকায় সে ব্যাকুল।
তখনই তানভীর জিজ্ঞেস করল – মায়া কোথায়, কেমন আছে? ও কি কেঁদেছে?
রায়হান তাকে আশ্বস্ত করে বলল – ওকে ঢাকায় পৌঁছে দিয়েছি। হালকা কেঁদেছে পরে আমি অবশ্য বললাম তুই শীঘ্রই মুক্তি পাবি। এখন ওকে বলাও যাবে না যে তুই মুক্ত। তোর এই হাল দেখলে সে দিশা হারাবে।
ইমতিয়াজ উচ্চ স্বরে আন্দোলিত হয়ে বলল – তানভীর তোমার মুক্তির খবর প্রচার হচ্ছে, তোমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। সাদমানকে পুলিশ খুঁজছে।
সবাই আনন্দিত হলেও রায়হান কিছু একটা নিয়ে ভয় পাচ্ছে।
রায়হানের আশংকা সত্যি হলো যেন। তার সবকিছু অন্ধকার লাগছে। ফোনে আসা মেসেজটা পড়ে সে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছে। সে এটা চায়নি। তানভীরের দিকে এক নজর তাকিয়ে চাপা নিশ্বাস ফেলে মেসেজটার উত্তর দিলো সে। তাকিয়ে দেখছে তানভীরের মুখে আনন্দের হাসি, সে আধৌ জানেও না কি ঘটে গিয়েছে।

রায়হান ফের মেসেজ পাঠাল সেই নাম্বারে – সে বেঁচে আছে তো? বাঁচবে তো?

উত্তর এলো – এখনো বলা যাচ্ছে না। তানভীরকে পৌঁছে তাড়াতাড়ি আসবেন।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here