আড়ালে অন্তরালে পর্ব ১১+১২

0
433

#আড়ালে_অন্তরালে

#মাহমুদা_লিজা

পর্বঃ১১

মধ্যরাতে ফোনের কর্কশ আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল জামশেদ রহমানের। ফোনটা হাতে নিয়ে বিশ্রী একটা শব্দ উচ্চারণ করে দেখলো আননোন নাম্বার।
কিছু একটা ভেবে কলটা রিসিভ করে কানে লাগাতেই ওপাশ থেকে বলল – কেমন আছেন?
জামশেদ আবারও বিশ্রী ভাষাটা উচ্চারণ করে বলল – কে, এত রাতে ফোন দিয়ে জিগায় কেমন আছেন?
অশালীন শব্দটা শুনেও ওপাশের মানুষটা বিন্দুমাত্র রাগলো না। বরং শীতল কন্ঠে বলল – তামান্না রহমান কেমন আছেন? আমি তার ছেলে মুরাদ বলছি। তিনি ভালো আছেন কিনা তা জানতে চাই।

জামশেদ রহমান ঘামতে শুরু করলেন। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন – তামান্নার একটাই ছেলে, মুরাদ নামে তার কোন সন্তান নেই।
ফোনের ওপাশ থেকে হো হো শব্দে কানফাটানো হাসি শুনে জামশেদ বলল – তামাশা!
ফিরতি জবাব এলো – আপনার জন্য একটা গুড নিউজ আছে। সাদমানকে কব্জা করে ফেলেছি।
জামশেদ আর শুয়ে থাকতে পারলেন না। শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেছে তার। হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন – তোরে পাইলে কিন্তু…..
কথা শেষ হওয়ার আগেই ওপাশ থেকে বলল – জানেন মিস্টার জামশেদ রহমান, ঐ বেচারাকে টোটালি সুন্নাতে খৎনা করানো হয়েছে। মানে সমূলে উৎপাটন।

জামশেদ চিৎকার করে বলে উঠলো – তোকে জ মে ডাকছে।
ফিরতি জবাবে ভিরমি খেল জামশেদ। হাঁপানী রোগীদের মত কাশতে কাশতে বলল – তুই মাহতাব খানের ছেলে?
কোন জবাব এলোনা। হ্যালো হ্যালো বলার পরও জবাব না আসায় কান থেকে ফোনটা নামিয়ে দেখলো কল ডিসকানেকটেড।

_____

ভোরের কাছাকাছি সময়টায় বুকের উপর ভারী কিছু অনুভব হতেই ঘুম উবে গেল ফাহিমের। অন্ধকার হাতড়ে ফোনটা হাতে নিয়ে টর্চ জ্বা লা তে ই দেখলো মায়ার একটা হাত তার বুকের উপর রাখা। ফাহিম হাতটা সরিয়ে দিলোনা। মায়া তার অনেকটাই কাছে সরে এসেছিল। তার ইচ্ছে করল মায়াকে বুকে জড়িয়ে নিতে। কিছু একটা ভেবে তার ইচ্ছেটা বুকেই চেপে রাখলো। ফোনের টর্চটা মায়ার মুখের উপর পড়তেই ফাহিম হেসে দিল। খুব কষ্টে হাসিটা চেপে রেখে সে নিজে নিজেই বলল উপন্যাসের পুরুষগুলো নাকি বউয়ের ঘুমন্ত চেহারা দেখে প্রেমে পড়ে, আর আমি আমার বউয়ের ঘুমন্ত চেহারা দেখে ভয় পাইছি। চুলগুলো এলোমেলো করে কি করছে! কেউ দেখলে বলবে শ্যাওড়া গাছ থেকে নেমে এসেছে।
আনমনে এসব বলে মায়ার চুলগুলো মুখ থেকে সরিয়ে দিল ফাহিম। হঠাৎ তার চোখ পড়ল মায়ার বা হাতটার আঙ্গুলে। কোন কিছুর আঘাত স্পষ্ট। হাতের কব্জিটায় মোটা আঘাতের চিহ্ন। মায়ার প্রতি করা রাশেদা বেগমের বি ভৎ স আঘাতগুলো দেখে নিজেকে আর আঁটকে রাখতে পারলো না সে। ঘুমন্ত ঐ এক রত্তি মেয়েটাকে এক ঝটকায় টেনে বুকে জড়িয়ে নিল।

আচমকা হেঁচকা টানে ঘুম ভেঙে গেল মায়ার। ঘুম ঘুম চোখে সে শুধালো – এভাবে ঘুমের মধ্যে টানাটানি করছেন কেন? শরীরটা কাঁপছে আমার।
মায়াকে ব্যাপারটা বুঝতে না দিয়ে ফাহিম বলল – প্রেম উতলে উঠেছে বউ। তোমার ঐ বাউলা চুলের দোলায় আমার প্রেম ডগমগ হয়ে উঠেছে।

ফাহিমের হেয়ালিপনায় মায়া লজ্জা পেয়ে বলল – আস্তাগফিরুল্লাহ। কি অভদ্র আপনি!
ফাহিমের হাসিটা এবার দ্বিগুণ হলো। মুখটা মায়ার কানের কাছে নিয়ে বলল – অভদ্র হয়ে কি লাভ হলো? এত সুন্দর পুতুলের বা চ্চা আমার পাশে শুয়ে আছে অথচ একটা চুমুও খেতে পারলাম না। আহা! কষ্ট কই রাখি।
মায়ার ইচ্ছে হচ্ছে উঠে পালাতে, লজ্জায় তার কান গরম হয়ে গেছে। লোকটার মুখে কিছুই আটকায় না।
ফাহিমকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে একেবারে খাটের কিনারায় গিয়ে উল্টোপাশে মুখ করে শুয়ে পড়লো সে। ফাহিম বাঁধা দিলোনা। মুখ উঁচু করে বলল – আজ গ্রামে যাব বাবার কাছে। তৈরী হয়ে নাও। ওখানে গেলে না হয় বউ সাজিয়ে বাকি চুমুটুমু দেয়া হবে। লাল বেনারসী কিনেছে বাবা।
আর থেমে থাকতে পারলো না মায়া। চেঁচিয়ে বলে উঠলো – আপনি খুব নির্লজ্জ। মুখে কোন লাগামই নেই।
ফাহিমও থামলো না। পাল্টা উত্তর দিল – মুখে লাগাম না থাকলে চুমু কার্য সিদ্ধি করে নিতাম।
ফাহিমের সাথে কথায় না পেরে মায়া উঠে গিয়ে বারান্দায় বসলো। ফাহিমের হাসি যেন থামছেই না। তার মায়াবতীকে এতটুকু জ্বা লা তে তার ভালোই লাগছে।

চলবে…

#আড়ালে_অন্তরালে

#মাহমুদা_লিজা

পর্বঃ১২

সকাল সকাল কলিংবেলের শব্দ পেয়ে দরজাটা খুলে যারপরনাই বিরক্ত তামান্না। মুখে বিরক্তিসূচক উফ শব্দটা উচ্চারণ করতেই তার দৃষ্টি নামল দরজার সামনে ছোট্ট বক্সটার দিকে। বক্সটার উপর প্রেরকের কোন ঠিকানা নেই কিন্তু প্রাপকের নাম আছে স্পষ্ট অক্ষরে। জামশেদ রহমান নামটা জ্বলজ্বল করছিল প্রাপকের নামের স্হানে।
তামান্না স্বামীকে ডেকে বললেন – তোমার পার্সেল এসেছে।
জামশেদ অবাক হয়ে বললেন – আমি তো কিছু অর্ডার করিনি।
বক্সটার দিকে ইঙ্গিত করে তামান্না বলল – ঐ যে।
বক্সটা ভয়ে ভয়ে তুলে নিয়ে জামশেদ কাঁপা কাঁপা হাতে বক্সটা খুলতেই ছিটকে সরে গেলেন। গা গুলিয়ে উঠল তার। আবারও বক্সটায় চোখ রাখলেন তিনি। সাদা এক টুকরো কাগজ রাখা সেখানে। জায়গায় জায়গায় লাল বর্ণ হয়ে আছে।
কাগজটা হাতে নিয়ে দেখলেন তাতে লেখা – সাদমানের খৎনা উপলক্ষে আপনার জন্য সামান্য উপহার। তার বিশেষ এই অঙ্গটি আপনার কাজে লাগবে। সে অবশ্য এখন পুরুষত্ব ত্যাগ করে রাস্তায় তালি মে রে মে/রে টাকা তুলবে।

চিরকুটটা পড়ে আবার বক্সের দিকে তাকিয়ে জামশেদ দেখলেন সাদমানের বিশেষ অঙ্গটি বাজেভাবে থেঁতলানো। তামান্না অপলক তাকিয়ে রয়েছে স্বামীর দিকে। চোখে হাজারো উৎকন্ঠা, মনে হাজারো প্রশ্ন। স্ত্রীর দিকে অনিভূতিহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে জামশেদ বলল – এসব কি?

_______

নিজে তৈরী হয়ে মায়াকে তাগাদা দিচ্ছে ফাহিম। বাবা বারবার বলেছে তাড়াতাড়ি রওনা দিতে। সবাই আগ্রহভরে অপেক্ষা করছে নতুন বউ দেখার জন্য।

এদিকে শাড়িটাকে এদিক সেদিক ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বহু চেষ্টা করেও শাড়ি পরতে না পেরে কাঁদো কাঁদো গলায় ফাহিমকে বলল – আমি শাড়ি পরতে জানিনা, মা থাকলে শিখিয়ে দিত। আমারতো মা নেই।
ফাহিম চেয়েছিল আজ যেন মায়া শাড়ি পরে শ্বশুরবাড়িতে যায়। মায়ার কন্ঠে আক্ষেপের স্বরটা ফাহিমকে দূর্বল করলেও সে বুঝতে দিলো না। হাসিমুখে বলল – তাহলে থ্রি-পিস পরে নাও।
মায়াও দৌড়ে গিয়ে চট করে থ্রি-পিস পরে তৈরী হয়ে নিল। চোখেমুখে তার খানিক ভয় হলেও মনে বেশ উচ্ছ্বাস তার। মাথায় ঘোমটা দিয়ে রুম থেকে বের হতেই দেখলো ফাহিম ফোনে মগ্ন। মায়া ছোট্ট করে বলল – আমি তৈরী।

মায়ার কথায় ধ্যান ফিরতেই চোখ তুলে তাকালো ফাহিম। কালো জামাটায় সাদামাটা মেয়েটাকে কি মায়াবী লাগছে। কালো ঘোমটার মাঝে তার ছোট্ট আদলখানা যেন আকাশের বুকে এক ফালি জোছনা।
সপ্রতিভ হেসে ফাহিম বলল – জোছনাকুমারী, তুমি কি আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছ? নাকি এভাবে তোমার মায়ায় জড়িয়ে মে|রে ফেলার ফন্দি আঁটছ?

অবলীলায় বলে দেয়া ফাহিমের অনুভূতিগুলো যেন মায়াকে একদম নুইয়ে দিল লজ্জায়। পায়ের নখ দিয়ে ফ্লোরে কি যেন আঁকতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে। লজ্জা পেলেও মনটা পুলকিত হয়ে উঠেছে তার। অর্ধাঙ্গিনীকে ফাহিম কতটা ভালবাসে তার কথায়ই ফুটে ওঠে সব।

পরিস্থিতি সামাল দিতে মায়া বলল – আমিতো জানিনা আপনার বাড়ি কোথায়? কোথায় যাব আমরা?

ফাহিম হেসে উঠলো মায়ার কথায়। মায়া অবাক চেয়ে দেখছে তার হাসি। সারাক্ষণ একটা হাসি লেগেই থাকে লোকটার মুখে। গজদাঁতে নাকি মেয়েদের সুন্দর লাগে! কিন্তু মায়া মনে মনে ভাবে গজদাঁতটা ছেলেদেরই মানায়।
ফাহিম হেসেই জবাব দিল – আমরা পটিয়া যাব মায়া। চল, চল।

কিছু একটা ভেবে মায়া বলল – আমি অতদূর বাস জার্নি করতে পারিনা। ছোট বেলায় খুব বমি হত। বড় হওয়ার পর জানিনাতো অভ্যেস বদলেছে কিনা!

মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে মায়ার সব কথা শুনল ফাহিম। মৃদুস্বরে বলল – ট্রেনের টিকেট বুক করেছি মায়া। আমিও বাস জার্নিতে অভ্যস্ত নই। মাথা ধরে আমার। আচ্ছা এসো এখন।

ঘর থেকে বেরিয়ে দরজাটা ভালমতো তালাবদ্ধ করে ফাহিম এগিয়ে গেল সিঁড়ির দিকে। এক ধাপ দু ধাপ করে নামতে শুরু করল সে। পেছন পেছন মায়াও নামছে তাকে অনুসরণ করে।
বাড়ির মূল ফটক পেরিয়ে রাস্তায় এসে স্টেশনের উদ্দেশ্যে রিকশা ভাড়া করল ফাহিম। মায়াকে উঠিয়ে এবার নিজে উঠল। মায়া খেয়াল করছে তার প্রতি ফাহিমের করা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কেয়ারগুলো।
মায়ার মনে ভয় কাজ করছে। শ্বশুরবাড়ি কেমন হয়! এই ভয়ে সে মোটামুটি চিন্তিত। হঠাৎ খেয়াল করলো শক্ত হাতের তালুর নিচে তার কোমল হাতজোড়া জায়গা করে নিয়েছে।
মায়া তাকালো ফাহিমের দিকে। দেখলো ফাহিম তাকিয়ে আছে সামনে কিন্তু তার ভরসার হাতটা মায়াকে আশ্বস্ত করছে যেন।
হঠাৎই ফাহিম তার মুখখানা মায়ার কানের কাছে এনে বলল – ভালবাসি!
আবার উদাস হয়ে সে সামনে দৃষ্টি রাখলেও মায়া চমকিত ভাবটা তখনো কাটেনি। এই লোকটা যখন তখন নির্দ্বিধায় সব বলে দেয় কেন? মায়া এবার লজ্জা পেলো না আর। নিজেকে প্রবোধ দিল স্বামীর মুখ থেকে এই কথাটা শুনতে সবাই উন্মুখ থাকে, সেখানে ফাহিম তাকে অবলীলায় বলে দিয়েছে। এ তো তার জন্য আনন্দের ব্যাপার, লজ্জা পাবে কেন সে!

চলবে……

(আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাইছি কারণ শারীরিক অসুস্থতার জন্য নিয়মিত গল্প দিতে পারছিনা।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here