আঙুলে আঙুল পর্ব ৭

0
558

আঙুলে আঙুল

পর্ব (৭)

নিজের নামের এমন বিকৃতি উচ্চারণে সঞ্জয়ান হতভম্ব হলো। পর মুহূর্তে দাঁতের পাটি সংলগ্ন শক্ত হয়ে এলো। ক্রোধে চোখজোড়া জ্বলে উঠলেও সংযত করে বলল,
” প্রথমত, আমার নাম সঞ্জয়ান সাখাওয়াত। সাজনা শাক নয়। দ্বিতীয়ত, সাজনা একটি সবজি। শাক নয়। একাদশ শ্রেণির ছাত্রী হয়ে সবজি ও শাকের মধ্যে পার্থক্য বুঝ না? তুমি রুহানিয়াতে চান্স পেলে কীভাবে? ”

অপমান ফিরে পেয়ে শূভ্রার মন ও মস্তিষ্ক দুই জায়গায় বহ্নিশিখা জ্বলে ওঠল। যার উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ার পূর্বে সঞ্জয়ান বলল,
” তোমার শুধু মেধা নয়, ব্যবহারেও সমস্যা আছে। কার সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় এই শিক্ষাটা এখনও হয়নি। ”
” চুরির শিক্ষাটাও হয়নি। যেটা আপনার হয়েছে। ”
” মানে? ”
” আপনি চোর। আমার আইডি কার্ড চুরি করেছেন। ”

সঞ্জয়ান থতমত খেল। সরাসরি দোষারোপ করায় বিচলিতও হলো। কপালের মাঝে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করল,
” আমি আইডি কার্ড চুরি করেছি? মিথ্যা আরোপ দিচ্ছ কেন? সমস্যা কী তোমার? ”

শূভ্রা কাঁধের ব্যাগের ফিতাটা ঠিক করে নিয়ে দৃঢ় স্বরে বলল
” মিথ্যা না সত্যি। সেদিন হলের সামনে আমার আইডি কার্ড পড়ে গেছিল। আপনি কুড়িয়েছেন, কিন্তু অফিসে জমা দেননি। আবার বাবার কাছে নালিশ ঠিকই করেছেন। কেন? ”

সঞ্জয়ানের মনে পড়ল, সেদিন সত্যি সে মেয়েটির আইডি কার্ড পেয়েছিল। সেখানে মেয়েটির বাবার নাম লেখা থাকায় বুঝতে পারে শূভ্রা অসীউল্লাহর মেয়ে। অসীউল্লাহ কেরানি পদে থাকলেও সে মন থেকে খুব শ্রদ্ধা ও সম্মান করে। কলেজে আসলে দেখা করে, কথাও বলে। এই সাধারণ সম্পর্ক থেকে তার পরিবার ও পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কেও জানে। এর আগে কারও সাথে দেখা হয়নি। সেই প্রথম শূভ্রার সাথে দেখা। অসীউল্লাহ এত কষ্ট করে মেয়েদের পড়াশোনা করাচ্ছেন, আর মেয়ে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে হলে এসে ছবি দেখছে। ঘটনাটি তার একদমই পছন্দ হয়নি। তাই সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রীর বাবাকে কল দেয়। কিন্তু নালিশটা করা হয়নি। ভেবেছিল, পরে এক সময় মেয়েটিকে ডেকে কথা বলবে। বুঝাবে। কল যেহেতু করেই ফেলেছে, সেহেতু আইডি কার্ডের কথাই তুলেছে ও বলেছে, অফিস রুমে জমা দিবে। শূভ্রা যেন নিয়ে নেয়। এরমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়ে যাওয়ায় কলেজে যাওয়া হয়নি। আইডি কার্ডটিও জমা দেওয়া হয়নি। সে মনে মনে দোষ স্বীকার করলেও সামনাসামনি প্রকাশ করল না। বলল,
” কাল জমা দিব। এখন আমার সাথে নেই। ”

শূভ্রাও মানার পাত্রী নয়। গোঁ ধরে বলল,
” আমার আজই চাই। নাহলে চিৎকার-চেঁচামেচি করব। ”

এই সময় সঞ্জয়ানের ব্যক্তিগত গাড়িটি এসে দাঁড়াল পাশে। ড্রাইভার নেমে এসে দরজা খুলে দিলে সে বলল,
” যা খুশি করো। আমি কোনো যাদুকর নই যে, তুমি বললে যাদু দিয়ে আইডি কার্ডটি হাজির করব। ”

বলতে বলতে সঞ্জয়ান গাড়ির মধ্যে বসে পড়ল। ড্রাইভার ছুটে চলার পূর্বে বলল,
” তোমার ক্লাস করতে কোনো অসুবিধা হবে না। আমি কল করে বলে দিব। ”

রাগে-ক্ষোভে শূভ্রার অন্তরের ভেতর জ্বালা ধরে গেল। ঘন ঘন তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
” করব। কিছু তো একটা করবই। ”

__________

সকালের নাস্তা শেষ করে অরুণিমা তৈরি হচ্ছে। আয়নায় মুখটার দিকে তাকাতে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ডানগালে ব্রনগুলো এখন বাম গালেও ছড়িয়েছে! একটা বড় হয়ে বেশ ফুলেছে। ভেতরে সাদা তরল জমে আছে। এত বিশ্রী দেখাচ্ছে! অরুণিমা সেটাতে হাত লাগাতে নাজিয়া বেগম ধমকে ওঠলেন,
” আবার খুঁটছিস? নিষেধ করেছি না? দাগ হলে বুঝবি। পুরো মুখে ছড়াবে তো। ”

অরুণিমা হাত সরিয়ে নিল। ভার স্বরে বলল,
” মেকাপ করব কিভাবে? দেখা যাবে তো, মা। ”

নাজিয়া বেগম কাছে এগিয়ে এলেন। মেয়ের মুখটা ভালো করে দেখে বললেন,
” তুই তো দেখতে, এমনি অনেক সুন্দর। মাশ-আল্লাহ! এসব ছাইপাঁশ না মাখলে হয় না? ”

অরুণিমা হেসে ফেলল। বলল,
” না, হয় না। আমার কাজই তো এটা। সেজেগুজে দোকানে বসে থাকা। নাহলে কাস্টমার বিশ্বাস করবে, ভালো জিনিস বিক্রি করছি? নিজেকে মেখে বিশ্বাস করাতে হয়। ”

নাজিয়া বেগম কিছু একটা বলতে চাইলেন। তার আগেই শূভ্রা ঘুম ঘুম কণ্ঠে বলল,
” আমার আই-লাইনারটা শেষ হয়ে গেছে। আপু, নিয়ে এসো তো। ”

অরুণিমা অবাক স্বরে বলল,
” গত সপ্তাহে না এনে দিলাম, এর মধ্যে শেষ? ”

শূভ্রার ঘুম উড়ে গেছে। কাঁথার তলে চোখ বন্ধ করা অবস্থায় মনে পড়ল, শেষ হয়নি। ব্যাগে ছিল, হারিয়ে গেছে। আমতা আমতা করে বলল,
” আমি কি মিথ্যা বলছি? তুমি এত জেরা করছ কেন, আপু? তোমার দোকানে কি অভাব পড়েছে? কষ্ট করে শুধু এনে দিবে। ”

অরুণিমা স্মরণ করে দিল,
” ওটা আমার দোকান নয়। আমি কর্মচারী। ”

শূভ্রা শোয়া থেকে উঠে বসল। শ্রুতিকটু গলায় বলল,
” একটা আই-লাইনারের জন্য কথা শোনাচ্ছ? ”

নাজিয়া বেগম দ্রুত কদমে ছোট মেয়ের কাছে গেলেন। মাথায় হালকা চাপড় মেরে বললেন,
” কয়টা বাজে দেখেছিস? নাস্তা দেওয়া আছে, জলদি খেয়ে তৈরি হ। কলেজের দেরি হয়ে যাচ্ছে। ”

মেয়ের শরীর থেকে কাঁথাটা টেনে ভাঁজ করতে করতে বড় মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
” নতুন আনতে হবে কেন? তোর আছে না? ওটা থেকে দিবে। পরে এক সময় কিনে দিস। ”

শূভ্রা সঙ্গে সঙ্গে তেজে উঠে বলল,
” না, দিব না। আপুর ব্যবহার করা জিনিস আমি দিব না, নিবও না। যদি নতুন দিতে পার দেও, নাহয় দিও না। ”

সে গোসলখানায় ঢুকে শব্দ করে দরজা আটকে দিল। নাজিয়া বেগম মেয়ের কাণ্ডে অবাক হয়েছেন। হতভম্ব গলায় বললেন,
” ওর ব্যবহারটা দেখেছিস? দিন দিন খারাপই হচ্ছে। তোর বাবাকে বুঝাতে বুঝাতে আমারই ধৈর্যের সীমা পার হয়ে যাচ্ছে। কোন দিন না গায়ে হাত তুলে বসি। ”

অরুণিমা মায়ের কাছে এগিয়ে এলো। শান্ত স্বরে ভরসা দিয়ে বলল,
” চিন্তা করো না। আমি ওর সাথে কথা বলব। মনে হয়, কোনো ঝামেলা হয়েছে। ভয়ে আমাদের বলতে পারছে না। ”
” তাই যেন হয়। শীঘ্রই কথা বলে ঠিক কর। ”

নাজিয়া বেগম রুম থেকে চলে গেলেন। অরুণিমা সাজসামগ্রীর কাছে চলে গেল। আয়নায় তাকাতে মনে হলো, মাইমূন তার এই মেকাপের যাদুতেই হয়তো মুগ্ধ হয়েছে। কৃত্রিম সৌন্দর্যের জন্যই এতসব পাগলামি। এগুলো বন্ধ করতে হলে এই সাজ থেকে কিছুদিনের জন্য দূরে থাকতে হবে। অরুণিমা ভাবনামতো, প্রয়োজনীয় সাজ সামগ্রী ঝটপট ব্যাগে ভরে নিল। বাসা থেকে বেরিয়ে কিছুদূর হেঁটে যেতেই মাইমূনের ক্লাবটি পড়ল। বাইরে থেকে বুঝা যাচ্ছে, ভেতরে বেশ কয়েকজন আছে। কিছু সময় পর পর কেউ বের হচ্ছে, ঢুকছে। কিন্তু ভুল করেও কেউ তার দিকে তাকাচ্ছে না। অরুণিমা প্রায় মিনিটের মতো সময় নিয়ে ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে থাকল। তবুও কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারল না। অবশেষে বাধ্য হয়ে ডাকল,
” এই ছেলে, শোনো। ”

ছেলেটি মাত্রই ক্লাবের ভেতর থেকে বেরিয়েছে। চোখ-মুখ গম্ভীর। অঙ্গভঙ্গিতে ব্যস্তভাব। এক মুহূর্ত দ্বিধায় জড়িয়ে এগিয়ে এলো। সালাম প্রদর্শন করে সুধাল,
” ভাবি, কিছু বলবেন? ”

অরুণিমা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পেরে ধারণা করেছিল, তারা হয়তো তাকে ভুলে গেছে। অথবা মিয়া ভাই ‘ ভাবি ‘ ডাকতে নিষেধ করেছে। সেই ধারণা ভুল হওয়ায় একটু বিরক্ত হলো। জিজ্ঞেস করল,
” মিয়া ভাই আছেন? ”
” জি। ডাকব? ”

অরুণিমা উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,
” আজ অনেক মানুষ দেখছি যে। ”

ছেলেটির মুখের গম্ভীর ভাব কেটে গেল। স্মিত হেসে বলল,
” হ্যাঁ, মিটিং হচ্ছে। ”
” কিসের? ”
” মিয়া ভাইয়ের ক্যাম্পাস থেকে বড় ভাইরা এসেছেন। ”

অরুণিমার কৌতূহল বাড়ল। পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
” কেন? ”

ছেলেটি উত্তর দিতে গিয়েও থেমে গেল। কিছু একটা ভেবে বলল,
” ভাবি কি আর কিছু বলবেন? খুব ব্যস্ত আছি। ”

অরুণিমাও আর কথা বাড়াল না। হাতঘড়িতে চোখ বুলাল দ্রুত। অনেকটা সময় পার করে ফেলেছে। এখনই না এগুলে নয়। সে চটপটে ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে দিল ছেলেটির হাতে। বলল,
” আমার নাম করে, এটা মিয়া ভাইকে দিবে। বলবে, জরুরি। ”

চলবে

[ প্রিয় পাঠকদের সহায়তা পেজে রিচ বাড়ছে। কিন্তু পুরোপুরি ঠিক হয়নি। তাই বলব, কিছুদিন আপনাদের সকলের রেসপন্স আশা করছি। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here