#আঙুলে_আঙুল
#পর্ব (৪)
” কাল থেকে কলেজে যেতে হবে না। তোর পড়ালেখা বন্ধ। ”
বাবার এমন সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারল না শূভ্রা। চড়া গলায় প্রতিবাদ করল,
” তুমি আমার পড়ালেখা বন্ধ করতে পার না, বাবা। ”
অসীউল্লাহ এবার দাঁড়িয়ে পড়লেন। রাগে তার চোখের রঙ বদলে গেছে। হনুস্তম্ভ কাঁপছে। ভর্ৎসনায় জানতে চাইলেন,
” তাহলে কে পারবে? তোর অন্য বাবা? ”
শূভ্রার হিতাহিতজ্ঞান লোপ পেয়েছে যেন! বাবার চেয়েও উঁচু স্বরে উত্তর করল,
” হ্যাঁ, অন্য বাবারাই পারবে। ”
নাজিয়া বেগম বাবা-মেয়ের এই আকস্মিক রাগ, তর্ক, পাল্টা-জবাব আর সহ্য করতে পারছেন না। পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে যাওয়ার আগেই সামলে নিতে চাইলেন। স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন,
” একদিন স্কুল ফাঁকি দিয়েছে বলে পড়ালেখা বন্ধ করে দিবে? এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না, বুঝিয়ে বলো। আর এমন করবে না। ”
অসীউল্লাহ তার এই কথাকে গুরুত্ব দিলেন না। ক্রোধ নিয়ে বললেন,
” কেমন মুখে মুখে কথা বলছে দেখছ? ইচ্ছে করছে, চড়িয়ে সবকটা দাঁত ফেলে দিই। পড়াশোনা দিয়ে কী হবে যদি ব্যবহারটাই না শিখে? ”
” আহ! ছাড়ো না। ছোট তো, বড় হতে হতে ঠিক শিখে নিবে। ”
” আর কবে শিখবে নাজিয়া? পরের বাড়ি যাওয়ার পর? আমাদের অরুণিমা তো এমন নয়। আজ অবধি গলা উঁচু করে কথা বলেনি। যা বলি, নির্দ্বিধায় মেনে নেয়। অভিযোগ করেনি কখনও। পড়াশোনা, চাকরি দুটোই সামলাচ্ছে। ”
নাজিয়া বেগম হাসার চেষ্টা করলেন। ছোট মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন,
” শূভ্রাও সামলাবে। অরুণিমার মতো এও তো আমাদেরই সন্তান। চিন্তা করো না এত। ”
অসীউল্লাহর রাগ একটু কমল। চেয়ারে বসতে বসতে বললেন,
” তাই যেন হয়। ”
নাজিয়া নিজেদের রুমে গেলেন। মেয়ের ব্যাগটা এনে দিয়ে বললেন,
” আর কখনও বাবার সাথে তর্ক করবি না। দেখিসই তো মানুষটার শরীর দিন দিন খারাপ হচ্ছে। ”
শূভ্রা কোনোরূপ উত্তর করল না। নীরবে চলে যেতে চাইলে অসীউল্লাহ পিছু ডাকলেন। বললেন,
” তোর আইডি কার্ড কলেজের অফিস রুমে জমা আছে। কাল গিয়ে চেয়ে আনবি। ”
সে এবারও উত্তর করল না। পড়ার টেবিলের দিকে এগুতে এগুতে মনে পড়ল, আজ সকালের ঘটনা। নতুন কলেজে নতুন বন্ধুরা ঠিক করে একসাথে হলে ছবি দেখতে যাবে। শূভ্রা জানে, তার বাবাকে বললে অনুমতি পাবে না। তাই মিথ্যা দরখাস্ত লিখে ক্লাসের মাঝে ছুটি নিয়েছিল। ব্যাপারটা এখানেই চুকে যেতে পারত, যাইনি। কপাল খারাপ, হল থেকে বেরুতেই এক আগন্তুকের সাথে দেখা। জিজ্ঞেস করলেন,
” তুমি রুহানিয়া সরকারি কলেজের স্টুডেন্ট না? এখানে কী করছ? ”
শুভ্রা চমকাল। চকিত দৃষ্টিতে আগন্তুকের মুখটার দিকে তাকায়। মুহূর্তে জমে আসে শরীর ও মন। এই মানুষটার সাথে পরিচয় না থাকলেও অপরিচিত নয়। কলেজে বেশ কয়েকবার দেখেছে। স্যারদের সাথে মেলামেশা করলেও শিক্ষক নয়, অন্য কিছু। নামটা ঠিক মনে নেই। কিন্তু দুই-একবার শুনেছে। নামটা একটু কঠিন, অন্যরকম। সে তৎক্ষনাৎ কোনো জবাব দিতে পারেনি। ভয়ে-ত্রস্তচিত্তে দৌড়ে পালিয়েছিল। তখনই কি আইডি কার্ডটা পড়েছিল? সেই মানুষটার নজরে পড়ায় কুড়িয়েছিল? হতে পারে। নাহলে তার আইডি কার্ড অফিসে গেল কী করে? তার স্পষ্ট মনে আছে, কলেজ থেকে বেরিয়ে খুলে ফেলেছিল যাতে কেউ চিনতে না পারে। কলেজ থেকে হলের দূরত্ব মোটামুটি ভালোই। ড্রেস দেখেই চট করে চিনে ফেলার কথা না। একমাত্র তিনিই চিনেছেন। শূভ্রা ভেবে নিল, কার্ডটা জমা দিতে গিয়ে তার নামে নালিশও করেছে। নাহলে বাবা এত তদারকি করবে কেন?
_________
অরুণিমা মল থেকে ফিরেছে সন্ধ্যার পর। এসেই বুঝে গেল, বাসার মধ্যে কিছু একটা হয়েছে। মাকে জিজ্ঞেস করতে তিনি বাবা-মেয়ের ঝগড়ার ঘটনাটি উল্লেখ করলেন। সে প্রথমে বাবা ও পরে বোনের সাথে দেখা করল। শূভ্রা তখন বইয়ে মুখ গুঁজে অন্য কিছু ভাবছে। অরুণিমা মাথায় হাত রেখে বলল,
” তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আসছে। ”
শূভ্রার মলিন মুখে দ্যুতি দেখা গেল। উৎসাহ নিয়ে বলল,
” মোবাইল? ”
অরুণিমার মনখারাপ হলো। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকে মেয়েটা মোবাইলের জন্য পাগল হয়েছে। সে কিছু টাকা জমিয়ে ফেললেও কিনতে পারছে না। বাবার অনুমতি নেই। বোনের গালে হাত রেখে বলল,
” না, অন্যকিছু। ”
শূভ্রার আনন্দিত মুখটা পাংশুটে হয়ে গেল। বইয়ের মধ্যে ধ্যানমগ্ন হতে হতে বলল,
” আমার অন্য সারপ্রাইজ লাগবে না। নিয়াজকে দিয়ে দাও। ”
অরুণিমা মজা করে বলল,
” ঠিক তো? ”
” হ্যাঁ। ”
” পরে দুঃখ করিস না যেন। ”
” করব না৷ ”
নিয়াজ বিছানায় বসে অংক করছিল। নিজের নাম শুনে মুখ তুলে তাকাল। সারপ্রাইজের কথা শুনে বলল,
” কী সারপ্রাইজ, আপু? ”
” আসলেই দেখবি। ”
তার ধৈর্য্য হচ্ছে না। বলল,
” কখন আসবে? কে নিয়ে আসবে? বাবা? ”
” না, কুরিয়ারে আসবে। অনলাইন থেকে অর্ডার দিয়েছি। ”
অরুণিমা কাপড় বদলে রান্নাঘরের দিকে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। তখনই দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। সে পথ বদলে ফেলল। দরজা মেলে দাঁড়াতে একটি লোক জিজ্ঞেস করল,
” অরুণিমা ম্যাম, আছেন? ”
” জি, আমি অরুণিমা। ”
পরিচয় পেয়ে লোকটি মিষ্টি হাসল। একটি ফুলের তোড়া এগিয়ে দিয়ে বলল,
” এটি আপনার জন্য। ”
অরুণিমার ভ্রূদ্বয় কুঁচকে গেল। সময় নিয়ে ফুলের তোড়াটা পর্যবেক্ষণ করল। গাঢ় বেগুনি রঙের অর্কিডগুলো এত সুন্দর ও আদুরে লাগছে যে, চোখ দুটিতে আনন্দ ঝলমল করে ওঠল। নাকের কাছে নিয়ে মিষ্টি সুবাসটা টেনে নিতে সারাদিনের ক্লান্তভাব দূর হয়ে গেল। মস্তিষ্ক সতেজ ও চঞ্চল হয়ে উঠতে মনে পড়ল, সে ফুল নয় পিৎজা অর্ডার করেছিল। গত সপ্তাহে টিভিতে ইন্ডিয়ান বিজ্ঞাপন দেখে শূভ্রা ও নিয়াজ দুজনেই এটি খেতে না পারার আফসোস প্রকাশ করেছিল। তাদের সেই আফসোস দূর করার জন্য বেতন হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি দামি রেস্টুরেন্ট থেকে সকলের জন্য পিৎজা অর্ডার করেছে। অরুণিমা ফুলের তোড়া ফেরত দিতে দিতে বলল,
” আপনারা ভুল ঠিকানায় এসেছেন হয়তো। এটা আমি অর্ডার করিনি। ”
লোকটি হিসাববই বের করল। কিছু একটা খতিয়ে দেখে বলল,
” না, ঠিক ঠিকানায় এসেছি। আপনি অর্ডার না করলে অন্য কেউ করেছে। কিন্তু ঠিকানা এটাই। আমাদের এখানেই পৌঁছে দিতে বলা হয়েছে। ”
” অন্যকেউ কে? ”
” আমি বলতে পারছি না, ম্যাম। দেখেন, ফুলের সাথে চিরকুট আছে হয়তো। ”
অরুণিমা তোড়াটি ঘুরেফিরে দেখতে লাগল। সত্যি একটি চিরকুট পাওয়া গেল। তাতে লেখা,
‘ আমার জ্যোতিষী মন বলল, এই ফুলের রঙ ও গন্ধটা তোমার খুব পছন্দ হবে। তাই পাঠালাম। ‘
চিরকুটে নাম না থাকা সত্ত্বেও অরুণিমার মনে মাইমূনের মুখটা ভেসে ওঠল। ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত করার সময় পেল না। কোথাও থেকে শূভ্রা দৌড়ে এলো। ফুলের তোড়াটা কেড়ে নিয়ে বলল,
” কী সুন্দর! আপু, এটা আমার জন্য? ”
তার পিছু পিছু নিয়াজও এসেছে৷ এবার ফুলের তোড়া তার হাতে চলে গেল। ভেতর ঘরে দৌড় দিতে দিতে বলল,
” না, এটা আমার জন্য। ”
শূভ্রা তার পিছু পিছু দৌড়াচ্ছে আর চিৎকার করছে। একবার আপুর কাছে নালিশ করছে, আরেকবার মায়ের কাছে। বাবার সাথে রাগের ব্যাপারটিও ভুলে গেছে। তাকে ডেকেও বলল, নিয়াজ তার ফুল চুরি করে পালাচ্ছে। অরুণিমা দূর থেকে ভাই-বোনের খুনসুটি দেখতে দেখতে নিজের নাম দস্তখত করল। অতঃপর চিরকুটটা ছিঁড়ে ফেলল কয়েক টুকরায়। হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে মনে মনে বলল,
” ভাগ্যিস, ওরা এটি দেখতে পায়নি! ”
দরজা আটকাতে আটকাতে আরও ভাবল, কাল মলে যাওয়ার আগে মিয়া ভাইয়ের সাথে দেখা করবে। সে ফুল পাঠিয়েছে, অরুণিমা কাঁটা দিয়ে আসবে।
চলবে