#আঙুলে_আঙুল
পর্ব (৩৯)
” চিন্তিত মনে হচ্ছে। কোনো সমস্যা? ”
অসময়ে অপ্রত্যাশিত পুরুষ কণ্ঠে অরুণিমা ভয়ে চমকে ওঠল। এক কদম পাশে সরে গিয়ে তাকাল পুরুষ কণ্ঠের মালিকের দিকে। চিনতে পেরে বিস্ময় ঝরে পড়ল কণ্ঠ থেকে,
” আপনি! কখন এসেছেন? ”
সঞ্জয়ান আন্তরিক হাসে। জবাবে বলল,
” অনেক্ষণ হয়েছে। আসার পর তোমাকে দেখিনি। আন্টির কাছে জিজ্ঞেস করতে বলল, ছাদে আছ। ”
তার সহজ স্বীকারোক্তি! অরুণিমার কাঁধে শুকনা কাপড়। সেগুলোতে হাত রেখে বলল,
” এগুলো নিতে আসছিলাম। ”
একটু থেমে আবার বলল,
” আমাকে খুঁজছিলেন? কোনো দরকার? ”
” হ্যাঁ, একটু। ”
” বলুন। ”
সঞ্জয়ান রেলিংয়ের কাছে ঘেষে দাঁড়াল। দূরে অন্ধকার ছায়ার দিকে চেয়ে বলল,
” একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাচ্ছি। ”
” আমার সাথে? ”
সে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল অরুণিমার দিকে। মুখটা আগের চেয়েও শুকিয়ে গেছে। লাবণ্য ক্ষয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। নরম ও মসৃণ ত্বকে ময়লা ভাব। যেন কতকাল এখানটায় যত্ন পড়ে না! বলল,
” আগে তোমার সমস্যাটা শুনি। ”
” আমার কোনো সমস্যা নেই। ”
” আছে। বলতে চাচ্ছ না। কেন বলো তো? আমি তোমার বন্ধু নই? ”
” বন্ধু! ”
অরুণিমার চোখে, মুখে ও কণ্ঠে বিস্ময়ের আভা। সঞ্জয়ান বলল,
” হ্যাঁ। আমি তোমাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছি অনেক দিন ধরে। ”
” সেজন্যে আমার সাথে আলোচনা করতে এসেছেন? ”
” ধরে ফেলেছ। আমি তাহলে সঠিক মানুষটিকেই বন্ধু বানিয়েছি। ”
কথাটা বলতে বলতে সে একটু হাসল। অরুণিমাও সঙ্গ দেয়। হাসি ধরে রেখে একটুক্ষণ চুপ থাকে দুজন। তারপর সঞ্জয়ান বলল,
” এবার বলো। দেখি, সমস্যার সমাধান করা যায় নাকি। ”
অরুণিমা সঙ্গে সঙ্গে বলতে পারল না। আরও কিছু সময় চুপ থাকল। সংকোচ নিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
” মাইমূনের ফোন বন্ধ। ”
” কখন থেকে? ”
” কাল সকাল থেকে। ”
” বাসায় যাওনি? হতে পারে মোবাইলটা নষ্ট হয়ে গেছে কিংবা চুরি হয়েছে। ”
” বাসায় যেয়ে লাভ নেই। ও এখানে থাকে না। ”
সঞ্জয়ান গুরুত্ব বাড়াল। জিজ্ঞেস করল,
” তাহলে কোথায় থাকে? ”
অরুণিমার সংকোচ কেটে গেছে। মাইমূনের চাকরি পাওয়া ও চলে যাওয়ার পুরো ঘটনাটা খুলে বলল তাকে। সে সব শুনে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে থাকল কয়েক মুহূর্ত। অতঃপর অভিভূত হয়ে বলল,
” তোমরা তো প্রেমের ইতিহাস লিখছ! ”
” মজা করছেন? ”
” একদম না। কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি, এই ইতিহাসের প্রথম পাঠক ও দর্শক আমাকে বানানোর জন্য। ”
সঞ্জয়ান পকেট থেকে ফোন বের করল চটজলদিতে। অরুণিমার দিকে চেয়ে গম্ভীরমুখে বলল,
” ঠিকানাটা ঠিক করে বলো। ঐদিকে আমার লোক আছে। তোমাদের একটু উপকার করি। ”
” ও যদি রা’গ করে? ”
” রা’গ করার মতো উপকার করব না। শুধু তোমার দুশ্চিন্তার কারণটা তার কাছে দূত হিসেবে পাঠাব। ব্যস। ”
সে ঠিকানা দিল। সঞ্জয়ান দাঁড়িয়ে থেকে একজনকে কল দিল। কথা বলে ঠিকানাটাও জানিয়ে দিল। তারপর ফোন পকেটে রেখে বলল,
” চিন্তা করো না। যে তোমার জন্য জন্মস্থান ছেড়ে দিয়েছে সে আর যাইহোক অকারণে ফোন বন্ধ রাখবে না। ”
” জানি।
সঞ্জয়ান প্রত্যুত্তর করল না। গভীর চোখে চেয়ে থাকে অরুণিমার মুখটায়। অনুভব করে তার এই ‘ জানি ‘ শব্দটা উচ্চারণের পেছনে কী পরিমাণ আত্মবিশ্বাস লুকিয়ে আছে! ভালোবাসার মানুষের প্রতি এই বিশাল ওজনের বিশ্বাস ও ভরসাটায় তো সম্পর্ক ধরে রাখে। এগিয়ে নিতে উৎসাহ দেয়। বাঁধা এলে ভেঙে ফেলে। ঠিক যেমনটা অরুণিমা ও মাইমূন করছে।
” এবার আপনার আলোচনা শুরু করা যাক? ”
সঞ্জয়ান কিছুটা আনমনা হয়ে পড়েছিল। সচেতন হয়ে বলল,
” হ্যাঁ, করা যায়। সেজন্যই আসা। ”
” তাহলে বলুন, আলোচনার বিষয়বস্তু কী? ”
” শূভ্রা। ”
অরুণিমার ভ্রজোড়ার মাঝে ভাঁজ পড়ল। কপট রা’গ নিয়ে বলল,
” আপনার সাথে ও আবার খারাপ ব্যবহার করেছে? ”
” ভালো ব্যবহার করেছে কখনও? ”
বিদ্রুপ নিয়ে বাক্যটা শেষ করে পুনরায় বলল,
” এবার তার ব্যবহার না। বিয়ে নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি। ”
” বিয়ে? ”
” হ্যাঁ। আমি ভেবেছিলাম দুই পরিবারকে একত্রে নিয়ে কথাটা বলব। কিন্তু এখানে আসার পর মনে হলো আগে তোমার সাথে আলাপ করি। যদি সদুপদেশ পাই? ”
” যদি আমার জ্ঞানে থাকে অবশ্যই পাবেন৷ তার আগে সব শুনি? ”
দুজনের এই আলাপের মধ্যে নিয়াজ দৌড়ে উপরে আসল। দূর থেকে বলল,
” আপু, মা দুলাভাইকে খেতে ডাকছে। ”
অরুণিমা উত্তর করল,
” যা, আসছি। ”
সে চলে যেতে সঞ্জয়ান প্রশ্ন করল,
” ও কি আমাকে দুলাভাই বলল? ”
” হ্যাঁ। আর কাকে বলবে? ”
অরুণিমা খেয়াল করল তার মুখের ভাব একটু অন্য রকম হয়ে গেছে। তার কারণ আর যাই হোক খুশি বা আনন্দ নয়। জিজ্ঞেস করল,
” ডাকটা আপনার পছন্দ হয়নি? বড় বোনের বরকে গ্রামাঞ্চলে দুলাভাই ডাকে। ”
সঞ্জয়ান কিছু বলল না। চুপ করে দেখল, অরুণিমা মিটিমিটি হাসছে। ডাকটা পছন্দ হয়নি এমন নয়। কিন্তু গ্রহণ করতে কোথাও একটা বাঁধা পাচ্ছে। সেই বাঁধাটা ভুলে গেল অরুণিমার হাসি দেখে। মেয়েটার দুশ্চিন্তা অবশেষে কমল! পুনরায় আলাপ শুরু করতে বলল,
” শূভ্রা মনে হয় এই বিয়েটাকে মন থেকে মানতে পারছে না। ”
” হ্যাঁ, হঠাৎ করে হয়েছে তো তাই। ”
সঞ্জয়ান এবার সরাসরি বিয়ে ভাঙার বিষয়টি তুলে ধরতে চাইল, পারল না। অরুণিমা বাঁধা দিয়ে বলল,
” এখানে দুই-একদিন থাকবেন তো? ”
” হ্যাঁ। কেন? ”
” তাহলে এই ব্যাপারে পরে এক সময় কথা বলি? মা খাওয়ার জন্য ডেকে পাঠিয়েছেন। আমার জন্য দেরি হচ্ছে জানলে খুব রা’গ করবেন। ”
সঞ্জয়ান চায় না তার জন্য এই মেয়েটি ব’কা শুনোক। তাই সম্মতি দিয়ে বলল,
” আচ্ছা। চলো, নিচে যাই। ”
____________
শূভ্রা বাসায় এসে বাবার রুমে ঢুকে বসেছিল। সঞ্জয়ান রুম থেকে বেরুতে সে এই রুমে আসে। নিজের জিনিসপত্র ঠিকঠাক জায়গায় আছে নাকি নিয়াজ নষ্ট করে ফেলেছে তাই পরখ করে দেখছিল। তন্মধ্যে মা খাবারের জন্য ডাক পাঠায়। সেই উদ্দেশ্যে বেরুতে দেখে সঞ্জয়ান ও অরুণিমা আগে-পিছে বাসার ভেতর ঢুকছে। সে দাঁড়িয়ে পড়ে তৎক্ষনাৎ। সঞ্জয়ান কাছে আসতে নিচু স্বরে বলল,
” আপুর কোনো জিনিস আমি ব্যবহার করলে ফেরত চায় না কখনও। কিন্তু আমি খুব করে চাই আপনাকে ফেরত নিয়ে যাক। ”
সঞ্জয়ান তেজ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” আমি জিনিস? আমাকে তুমি ব্যবহার করছ? ”
” পুরোপুরি ব্যবহার করা হয়নি এখনও। আশা করছি, আপু ফেরত চাওয়ার পূর্বে পুরোপুরি ব্যবহার হয়ে যাবেন। ”
কথাটা বলে শূভ্রা চোখ মে’রে চলে গেল। অরুণিমা কাপড় রাখতে রুমে গিয়েছিল। ফিরে এসে দেখল, সঞ্জয়ান আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। বলল,
” দাঁড়িয়ে আছেন যে? শূভ্রা নিয়ে যায়নি আপনাকে? মেয়েটা এখনও শিখল না কিছু! বয়স কম তো। রা’গ করবেন না। আস্তে-ধীরে শিখে ফেলবে। আপনি আমার সাথে আসুন। ”
__________
অরুণিমাদের বাসায় দুটো রুম। এক রুমে দুই বিছানা। একটাতে নিয়াজ ঘুমায়। অন্যটায় শূভ্রা ও অরুণিমা ঘুমাত। আজ এখানে শুধু শূভ্রা ও সঞ্জয়ানের শোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ নিয়াজ ও অরুণিমা অপর রুমে মা-বাবার সাথে ঘুমাবে। সঞ্জয়ান খাওয়া শেষ করে রুমে চলে আসে। শূভ্রা আসে একটু পর। দরজা আটকে বলল,
” একটু নিচে দাঁড়ান তো। ”
সঞ্জয়ান প্রশ্ন করল না। নীঃশব্দে বিছানা থেকে নিচে নেমে দাঁড়াল। শূভ্রা এই সুযোগে হাতে করে নিয়ে আসা জগের পানিটুকু ঢেলে দিল বিছানার একপাশে৷ অন্যপাশে নিজে শুয়ে বলল,
” আমার সাথে ঘুমাতে হলে ভেজা বিছানায় শুতে হবে। ”
এই একই কাজ শুরু থেকে করে আসছে শূভ্রা। অন্য সময় প্র’তি’বাদ করেনি সে। রুমে থাকা আরাম কেদারায় শুয়ে পড়েছে চুপচাপ। এখানে সেই সুব্যবস্থা নেই। তন্মধ্যে সে এখানকার অতিথি। অপমানটা সহ্য করতে কষ্ট হলো। তাই শূভ্রাকে একটানে ভেজা স্থানে এনে বলল,
” ছাড় ও মাফ সবসময় পাওয়া যায় না। মাঝেমধ্যে লোকসান ও শাস্তি পেতে হয়। ”
শূভ্রা মানতে চাইল না। যু’দ্ধের জন্য উঠেপড়ে লাগল। সঞ্জয়ান টের পেয়ে সাবধান বাণী শুনাল,
” বেশি বাড়াবাড়ি করলে, মাথায় তুলে আছাড় মা’র’ব। এইটুকু তো শরীর! আছাড় খেয়ে বেগুন ভর্তা হয়ে যাবে। ”
হুমকি শুনে ভ’য় পেয়ে যায় শূভ্রা। এতদিনে বুঝতে পেরেছে, এই ছেলে যা বলে তা করে ছাড়ে। তার জন্য কোনো দয়া-মায়া নেই। তাই রা’গ হলেও কিছু বলল না। জে’দ ধরে ভেজা বিছানায় শুয়ে পড়ল।
তখন মাঝরাত। সঞ্জয়ান ঘুমিয়ে পড়েছে প্রায়। সেই সময় শুনল,
” শীত লাগছে, আপু। কম্বল দাও। ”
সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল পাশে। দুজনের রা’গা’রা’গির মধ্যে রুমের আলো নেভানো হয়নি। সেই আলোতে দেখল, শূভ্রা হাত-পা গুটিয়ে এমনভাবে শুয়েছে যে তার পাঁচ ফুটের শরীরটা দুই ফুটে রূপ নিয়েছে। চোখে পড়ার মতো থরথর করে কাঁপছে! তার মনে সন্দেহ জাগল। মাত্রই জ্বর থেকে উঠা মেয়েটা আবারও জ্বরে পড়ল না তো! সঞ্জয়ান সংশয় ও ভীতচিত্তে উঠে বসল। ইচ্ছে হলো, শূভ্রার গা ছুঁয়ে তাপমাত্রা পরখ করতে। হাত বাড়িয়েও ফিরিয়ে নিল বার বার। বেশ কিছু সময় এভাবে পার করে সিদ্ধান্ত নিল, অরুণিমাকে ডেকে আনবে। বোনকে দেখাবে। যদি সত্যি তেমন হয়, তাহলে শূভ্রার একটা ব্যবস্থা করা যাবে। সে সিদ্ধান্ত মতো দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো৷ পুরো অন্ধকার! কোনো আলো জ্বালানো নেই। সঞ্জয়ান রুমে ফেরত গিয়ে মোবাইলটা নিয়ে এলো। আলো জ্বেলে বাইরে পা রাখল। কয়েক কদম এগুতে অন্য রুমটি পায়। ভেতর থেকে আটকানো৷ সে ডাক দিতে গিয়েও থেমে গেল। ঘড়িতে দেখল, তিনটা পার হয়েছে। একজনকে ডাকতে চাইলেও সবাই জেগে যাবে। মাঝরাতে এরকম কাণ্ড ঘটানোর ইচ্ছেটা হলো না তার। তাই ফেরত এলো। শূভ্রা তখনও কাঁপছে! হাত-পায়ের লোম কাঁটার মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ সঞ্জয়ান পাত্তা দিবে না ভেবেও ডান হাতটা বাড়িয়ে রাখল শূভ্রার কপালে। মুহূর্তে বুকটা কেঁপে ওঠল। যা ভেবেছিল তাই। জ্বর উঠেছে। কারণ খুঁজতে গিয়ে মনে পড়ল, শূভ্রা ভেজা বিছানায় শুয়ে আছে। জ্বরটা হয়তো একারণেই নতুন করে এসেছে। এই মুহূর্তে তার কী করা উচিত বুঝতে পারছে না। কিছুটা বিব্রত, বুদ্ধিশূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল কতক্ষণ। তারপর কল দিল মাকে। ওপাশ থেকে রিসিভ হতে জ্বরের কথাটা বলতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
” তোর ব্যাগে যে ওর ওষুধগুলো দিয়েছিলাম খাওয়াসনি? ”
সঞ্জয়ানের মাথায় বাড়ি পড়ল যেন! স্মরণে এলো, ওষুধ তো দূর এখানে আসার পর ব্যাগের চেইনটাও খোলা হয়নি। এই সত্য স্বীকার করবে নাকি লুকাবে এই দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে গেল। স্বর্ণলতা অপেক্ষা করে ধ’ম’কে উঠলেন,
” বোবা হয়ে গেলি নাকি? উত্তর দিচ্ছিস না কেন? ”
সে ভ’য়ে শিউরে ওঠল। বাহানা সৃষ্টির ব্যস্ততার ভাব নিয়ে বলল,
” তোমাকে পরে কল দিচ্ছি, মা। ”
কলটা কেটে দৌড়ে ওষুধ বের করল। গ্লাসে পানি ভরে ডাকল,
” শূভ্রা? উঠো। ওষুধটা খেয়ে নাও। ”
সে ঘুমের ঘোরে অচেতনের মতো জবাব দিল,
” শীত করে তো! ”
” করবে না। ওষুধটা খাও, শীত চলে যাবে। ”
শূভ্রা নড়ল। উঠে বসতে গিয়ে একহাত গিয়ে লাগল সঞ্জয়ানের হাতে থাকা গ্লাসটিতে। অকস্মাৎ ধাক্কায় সেটি পড়ে গেল নিচে!
চলবে