আঙুলে আঙুল পর্ব ৩৮

0
351

#আঙুলপ_আঙুল
পব (৩৮)

প্রায় মিনিট সমান সময় অপেক্ষার পর দরজা খুলে দাঁড়ালেন এক মহিলা। সুতি শাড়ি জড়ানো শরীরটা বড্ড ক্লান্ত ও দুর্বল। আঁচল দিয়ে মাথার অর্ধেকটা ঢাকা। অনুজ্জ্বল মুখটায় ভালো করে চায়তে অরুণিমার মনে হলো, এই মুখটাকে সে দেখেনি কোনোদিন। অথচ এই বাসায় থাকছে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে। তার এই ভাবনার মধ্যে ফিসফিসে স্বর শুনতে পেল,
” আমার মা। ”

মাইমূনের মুখে কথাটা শুনে সে মৃদু চমকাল। উজ্জীবিত বদনে পাশ ঘুরে তাকাল তার দিকে। কিছু বলার পূর্বেই টের পেল, মাইমূনের মা দরজা থেকে সরে যাচ্ছেন। অরুণিমা চট করে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল মায়ের দিকে। সত্যি ধীর কদমে ক্লান্তভাবে হেঁটে চলে যাচ্ছেন ভেতরঘরে৷ সে অস্থিরচিত্তে বলল,
” চলে গেলেন যে? তোমাকে দেখে খুশি হোননি? ”
” হয়েছে। ”
” তাহলে কিছু বললেন না কেন? ”

তার কণ্ঠে সন্দেহ, কৌতূহল। সামান্য ভয়। মাইমূন মৃদু স্বরে বলল,
” বলার চেষ্টা করেছেন অনেক। কিন্তু আমার থেকে কোনোরূপ জবাব না পেয়ে চুপ হয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। ”
” এবার চুপ করা থাকা চলবে না। যাও, কথা বলো। ”
” না। দরকার নেই। তুমি চলো তো এখান থেকে। ”

অরুণিমা যাওয়ার জন্য প্রস্তুত নয়৷ সে আঁটসাঁট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে নিজের সিদ্ধান্ত অটুট রেখে বলল,
” না। যাব না। ”

মাইমূনের মুখে বিরক্তের ভাঁজ পড়ল। জে’দি মেয়েটির দিকে সম্পূর্ণ ঘুরে দাঁড়াল। অসহায়ভঙ্গিতে করুণ স্বরে বলল,
” এমন করে না। আমাকে বুঝার চেষ্টা করো। এটা আমার দ্বারা হবে না। ”
” হবে। চেষ্টা তো করো আগে। ”

এইটুকু নরম স্বরে বললেও পরক্ষণে গোঁ ধরে শ’ক্ত গলায় বলল,
” মায়ের সাথে পরিচিতি না হয়ে কোথাও যাব না। ”

এর বিপরীতে কোনোরূপ অভিব্যক্তি খুঁজে পেল না মাইমূন। শুধু চোখ মেলে একস্থির চেয়ে আছে সহানুভূতির আশায়, পেল না। অরুণিমা তাগিদ দিয়ে চলল,
” চলে যাচ্ছেন তো! ডাক দেও। ”

মাইমূন বুঝতে পারল এই মেয়ের হাত থেকে মুক্ত পাবে না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সে নিরূপায়! তাই বাধ্য হয়ে সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় বিরস গলায় উচ্চারণ করল,
” মা? ”

তার মা দাঁড়িয়ে পড়লেন। পেছন ফিরে তাকালেও উত্তর নিলেন না। সন্দেহজনক দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে থাকলে মাইমূন বলল,
” ও অরুণিমা। তোমার ছেলের বউ। ”

মায়ের সন্দেহ কেটে গেল মুহূর্তে। ক্ষণিকের জন্য বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন দূরে। অতঃপর বড় বড় কদম ফেলে দ্রুত হেঁটে এলেন ছেলের কাছে। আবেগে উত্তেজিত হয়ে মুখটা ছুঁয়ে বললেন,
” তুই আমার সাথে কথা বলছিস? ”

মাইমূন উত্তর দিল না। সে অখুশি, বিরক্ত। মায়ের হাতটা মুখ থেকে সরিয়ে দিল একটানে। তিনি এই আচরণটাকে গ্রাহ্যই করলেন না। আনন্দের অশ্রু ভর্তি চোখজোড়া নিয়ে বললেন,
” একটু আগে মা বলেও ডেকেছিস, তাই না? আমি তাহলে ভুল শুনিনি! ”

মাইমূন নিরুত্তর। বিরক্তের ভাব বাড়ছে। মায়ের সামনে থেকে সরে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়ল। অরুণিমার দিকে চেয়ে বলল,
” পরিচিতি হয়েছ? এবার চলো। ”

সে কিছু বলার আগে মা বললেন,
” এখনই যাবি? বসবি না একটু? ঘরে নতুন বউ এসেছে। মিষ্টি মুখে না দিলে হয়? আয়, বাবা। বউকে নিয়ে বসবি কিছুক্ষণ। ”

কথার মাঝে তিনি অরুণিমার হাত ধরে ফেললেন। একপ্রকার জোর করে ভেতরে টেনে আনলেন। বসার রুম ফাঁকা থাকা সত্ত্বেও তাকে নিয়ে চললেন নিজের রুমের দিকে। আদর ও যত্নের সাথে বিছানায় বসিয়ে দিতে অরুণিমা লাজুক চাহনি রেখে বলল,
” আমরা বিয়ে করিনি এখনও। ”

মাইমূন না চাইলেও বাসার ভেতরে ঢুকতে হলো। অরুণিমা ও মায়ের পেছন পেছন এই রুমের দরজা পর্যন্ত এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। তখনই কথাটা শুনে উত্তর করল,
” তাতে কী? একে-অপরকে ভালোবাসি। এরচেয়ে বড় কিছু আছে? ”

অরুণিমা দূর থেকে জবাব দিল,
” ভালোবাসলে স্বামী-স্ত্রী হয় না। এরজন্য বিয়ে করতে হয়। ”

মাইমূন এর উত্তর দেওয়ার সময় পেল না। দুজনের মাঝে আসলেন তার মা। বললেন,
” এখন ভালোবাসছ, পরে বিয়ে করবে। এই নিয়ে ঝ’গ’ড়া করার কী আছে? বসো, তোমরা। আমি নাস্তা-পানির ব্যবস্থা করছি। ”

তার এই মাঝে ঢুকে কথা বলা ও মিটমাট করে দেওয়ার ব্যাপারটি পছন্দ হলো না মাইমূনের। খানিক রা’গা’ন্বি’ত স্বরে বলল,
” আমরা ঝ’গ’ড়া করছি না। কখনও করিনি। ভবিষ্যতেও করব না৷ ”

তিনি মনখারাপ করলেন না। হেসে উঠে বললেন,
” ঠিক আছে, করিস না৷ এখন মেয়েটার পাশে গিয়ে শান্ত হয়ে বস। ”

মাইমূন চুপচাপ হেঁটে গিয়ে বসল। মা রুম থেকে বেরিয়ে পড়তে অরুণিমা বলল,
” দেখলে, মা কতটা খুশি হয়েছে? ”

সে এই প্রসঙ্গ এড়িয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,
” আমরা বিয়ে করিনি, এই কথাটা বললে কেন? ”
” মিথ্যা বলেছি কিছু? ”
” সত্য-মিথ্যা যাই হোক৷ আমার খারাপ লেগেছে। ”

মাইমূন মিথ্যা বলছে না। খারাপ লাগাটা পুরো মুখটায় ভেসে উঠেছে। অরুঙিমার চোখদুটিতে মায়া উপস্থিত হতে সে পুনরায় বলল,
” আমি কাল চলে যাব, ভালোবাসা। সেজন্য তোমার সাথে ভালো সময় কাটাতে চেয়েছিলাম আর তুমি! ”

তার স্মরণে এলো, মাইমূনের চাকরি ও গাজিপুরে চলে যাওয়ার ব্যাপারটি। মুহূর্তে তার বুকের ভেতর দরদ জড়ো হতে শুরু করল। অপরাধবোধ তৈরি হতে বলল,
” এখান থেকে বেরুই মন ভালো করে দিব। ”
” এখনই বেরুচ্ছ না কেন? তাহলেই তো আমার মন ভালো হয়ে যায়। তুমি যে কারণে এসেছ সেটা পূরণ হয়েছে। আর কিসের জন্য অপেক্ষা করছ। ”
” চাকরির খবর দাওনি। দোয়াও নেওনি৷ আমি চাই, তুমি দোয়া চেয়ে বিদায় নেও। ”

এরমধ্যে মা ট্রে হাতে রুমে প্রবেশ করলেন। ট্রে ভর্তি কাটা ফল, মিষ্টি ও সরবত। সরবতের গ্লাসটি অরুণিমার দিকে বাড়িয়ে বললেন,
” এসিটা ছেড়ে দিতে ভুলে গেছি একদম। গরমে কষ্ট হচ্ছে, না? রা’গ করো না। এখনই ছেড়ে দিচ্ছি। ”

পাশ থেকে মাইমূন বলল,
” ভুলে যাওনি, ইচ্ছে করেই বন্ধ করে রেখেছ। এমনই করে এসেছ সবসময়। ”

মা আশ্চর্য হলেন৷ ছেলের দিকে চেয়ে আছেন বিস্মিত বদনে। তাঁর এমন কোনে ঘটনা মনে পড়ছে না যেখানে ইচ্ছেকৃত এসি বা পাখা বন্ধ করে রেখেছে।

অরুণিমা অন্য একটি সরবতের গ্লাস এগিয়ে দেয় মাইমূনের দিকে। সে গ্রহণ করল না। উপরন্তু অরুণিমার হাতেরটাও কে’ড়ে নিয়ে ট্রে’তে ফিরিয়ে রাখল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে কাঠ স্বরে বলল,
” আমি চাকরি পেয়েছি। কাল গাজিপুর যাব। ইচ্ছে হয়তো দোয়া করো। ”

তার দিকে কোনোরূপ প্রতিক্রিয়ার আশা না করে অরুণিমার দিকে চাইল। মিনতির স্বরে বলল,
” এবার বেরুবে? মনে হচ্ছে, আমি দো’য’খে আছি। ”

___________
টানা সাতদিন জ্বরে ভুগেছে শূভ্রা। প্রথম দুইদিন সঞ্জয়ানের রুমে থাকলেও তিনদিনের দিন স্বর্ণলতা ছেলের বউকে নিজের রুমে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। যে ছেলে বাইরের কেউ অসুস্থ শুনলেও সেবাশুশ্রূষা করার চেষ্টা করে সেই ছেলে নিজের অসুস্থ বউয়ের দিকে ভালোভাবে তাকাচ্ছিল না। বলে-কয়ে তার হাত দিয়ে ওষুধ খাওয়ানো যাচ্ছিল না। প্রথমবার ডাক্তার বাড়ির ভেতর ডেকে আনলেও দ্বিতীয়বার রোগীকে নিয়ে হাসপাতাল যেতে হয়েছে। সেটাও সঞ্জয়ান করেছে মায়ের অসহ্য বকা খেয়ে। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠার পর একত্রে নাস্তা করতে বসেছে শূভ্রা। স্বর্ণলতা পাশের চেয়ারটি দখল করে আছেন। বউমার প্লেটের পাশে গরম দুধের গ্লাসটা রেখে বললেন,
” দুধটা খেয়ে নিও, মা। অনেক শুকিয়ে গেছ। শরীরটা এখনও দুর্বল। ”

তারপরে ছেলের দিকে চেয়ে বললেন,
” ঠিক বলেছি না? চোখদুটো গর্তে ঢুকে গেছে। মুখটা কালো হয়ে গেছে। ”

সঞ্জয়ান তাকানের প্রয়োজন মনে করল না। নিজের খাবার খেতে খেতে উত্তর করল,
” ও আগে থেকেই কালো। ”

শূভ্রা সবে খাবার প্লেটে হাত দিয়েছিল। স্বামীর মুখে এমন কথা শুনে অপমান বোধ করল। গাল ফুলিয়ে, চোখ রা’ঙি’য়ে তাকাল। স্বর্ণলতা ছেলেকে ধ’ম’ক দিয়ে বললেন,
” তুই কিন্তু মা’র খাবি আমার হাতে৷ ”

সে উত্তর করল,
” সত্য কথা বললেও আজকাল শাস্তি পেতে হয়! ”
” কী সত্যটা বলেছিস? আমার বউমার গায়ের রঙ মোটেও কালো নয়। ”
” সত্যকে মিথ্যার চোখে দেখলে অমনই মনে হবে। ”

স্বর্ণলতা মৃদু ক’ঠি’ন স্বরে প্রশ্ন করলেন,
” আমি মিথ্যার চোখে দেখছি? ”

সঞ্জয়ান নির্লিপ্ত স্বরে বলল,
” প্রমাণ চাই? তোমার আর ওর হাতটা একসঙ্গে করো। ”

তিনি হাত মেলালেন না। শূভ্রার গায়ের রঙ কালো না হলেও তার মতো ফর্সা নয়। প্রসঙ্গ বদলে বললেন,
” মেয়েটা এখানে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। বাবা-মাকে জানাতে দেয়নি দুশ্চিন্তা করবে তাই। ”
” এটাও মিথ্যা। জানাতে না দেওয়ার কারণ অন্য কিছু হবে। ও নিজেকে ছাড়া কাউকে নিয়ে চিন্তা করে না। ”

স্বর্ণলতা এবার একটু বেশি ক’ঠি’ন হলেন। গ’র’ম চোখে তাকিয়ে রু’ক্ষ স্বরে বললেন,
” সব ব্যাপারে উল্টোটা বলা বন্ধ কর। ”
” আচ্ছা করলাম। ”
” আজ কোথাও যাওয়ার থাকলে ফোন করে বলে দে, যেতে পারবি না। ”
” কেন? তুমি কোথাও যাবে, মা? ”
” আমি না। তুই যাবি। বউমাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাবি। ”

সঞ্জয়ান জোর দাবিতে নাকচ করতে চাইল, পারল না। মায়ের মুখে শুনল,
” আর একটা কথাও শুনতে চাই না। আমি যেতে বলেছি মানে যেতে হবে। ”

আদেশ শুনে তার বাকি খাবারটুকু খাওয়া হলো না। চুপচাপ চেয়ার সরিয়ে উঠে চলে গেল।

__________
শূভ্রাকে নিয়ে তাদের বাসায় পৌঁছাতে রাত হয়ে গেছে। সঞ্জয়ান জামাই আদর নিতে নিতে জিজ্ঞেস করল,
” অরুণিমাকে দেখছি না। বাসায় আসেনি এখনও? ”

নাজিয়া বেগম এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললেন,
” এসেছে তো। মনে হয়, ছাদে গেছে। ও কে কি দরকার? ডেকে পাঠাব? ”

প্রশ্নগুলো করে নিয়াজের দিকে তাকালেন। সে সঞ্জয়ানের পাশে বসে আছে। সঞ্জয়ানই ডেকে এনে হাতে বিস্কিট দিয়েছে। তার দিকে ইশারা করতে উঠে দাঁড়াল। রুম থেকে দৌড়ে বেরুতে ধরলে সঞ্জয়ান বলল,
” তোমাকে যেতে হবে না। আমি যাচ্ছি। গরম লাগছে, বাইরের হাওয়ায় শরীরটাও ঠান্ডা হবে। ”

বলতে বলতে সে উঠে দাঁড়াল। পরনের শার্টটা টান টান করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। নিয়াজ দৌড়ে আসে মূল দরজার কাছে। সিঁড়ি দেখিয়ে দিতে সঞ্জয়ান ধীর পদক্ষেপে সিঁড়ির ধাপ বেয়ে বেয়ে ছাদে উঠে আসে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here