#আঙুলে_আঙুল
পর্ব (৩৬)
ইকবালের রুমের প্রধান দরজা বাইরের দিকে। বারান্দার শেষ মাথায়। ছায়ানীড়ের ভেতর রুমে যেতে হলে অনেকটা হাঁটতে হবে। বেশ রাত হয়ে যাওয়ায় শূভ্রাকে সেদিক দিয়ে নিয়ে গেল না সে। স্বর্ণলতা ও তার রুমের মধ্যভর্তি দরজাটি ইশারা করে বলল,
” তুমি এগোও। আমি তোমার জিনিসপত্র নিয়ে আসছি। ”
শূভ্রার হাতে কাপড়ের ব্যাগ ছিল। সেটা বিছানায় রেখে আইফোন ও ব্লুটুথ হেডফোনটা নিয়ে দরজাটির দিকে এগুল। অন্যমনস্কতায় সিটকানিতে হাত দিয়ে মনে পড়ল, এটা নেই। সিটকানি নেই বিধায় এ ঘরে অন্যদের আসা-যাওয়া আটকাতে পারেনি। অন্যসময় এটা নিয়ে বিরক্ত ও রাগ হলেও এবার কৌতূহলী হলো। জিজ্ঞেস করল,
” এটা ভাঙল কিভাবে? ”
ইকবাল কাপড়ের ব্যাগ ও অন্যান্য জিনিস পিরামিডের আকারে গুছানোতে ব্যস্ত ছিল। মাথাটা হালকা উঁচু করে তাকাল শূভ্রার দিকে। পরক্ষণে দরজার সিকটানির ভাঙা অংশে চেয়ে থেকে বলল,
” এটা নিয়ে একটা মজার ঘটনা আছে। ”
শূভ্রার কৌতূহল দ্বিগুণ হলো। সম্পূর্ণ পেছন ঘুরে আগ্রহ নিয়ে তাকাল মামার দিকে। খানিক উত্তেজিত স্বরে সুধাল,
” কেমন মজার ঘটনা, মামা? ”
ইকবাল ঠোঁটের দুই কোণ টেনে মৃদু হাসল। সেই হাসির ঝলক চোখে ধরা পড়ল না। উপরন্তু উদাসে রূপ নিল। শূভ্রা গলাটা সামান্য সমুখে বাড়িয়ে ডাকল,
” মামা? শুনাবে না? ”
সে হাসি হাসি ঠোঁটদুটি নিয়ে মাথা ঝাঁকাল। জড়ো করা ব্যবহার্য পত্রগুলো দুই হাতে জড়িয়ে উঁচু করল এক টানে। শূভ্রার সামনে দিয়ে দরজার কাছে এগিয়ে বলল,
” এই বাড়ির বউমা হয়ে উঠো। কথা দিচ্ছি, অবসর সময় পেলে তোমার সাথে গল্প করতে বসে যাব। শুধু এই ঘটনা না আমার দেখা সব ঘটনাই বলব। ”
দরজা পেরুতে শাশুড়ির রুমে প্রবেশ করল শূভ্রা। স্বর্ণলতা ও সঞ্জয়ানকে একসঙ্গে বসা দেখতে পেল। তার স্মরণে এলো, খাবার টেবিলে মা তার ছেলেকে ডেকেছিল। হতে পারে সেই মিটিং করতে এসেছে। এসবে তার কোনো আগ্রহ নেই। দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বেরুনোর জন্য দরজা খুঁজতে তার নয়নজোড়া জুড়িয়ে গেল, কাঠের পাল্লার নিখুঁত ও মনকাড়া নকশায়। সে এমন মনোমুগ্ধকর দরজার কাজ দেখেনি আগে। যাত্রাপথে থেমে গেল। অনেকটা ঘোরের মধ্যে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুরো রুমটা পর্যবেক্ষণ করল গভীর দৃষ্টিতে। ঘরটা ইকবালের রুমের থেকে তিনগুণ বড় হবে। সেই তুলনায় আসবাবপত্র সীমিত। প্রধান আসবাবপত্রের মধ্যে শুধু আলমিরাহ, খাট ও বুকশেলফ। বই ভর্তি বুকশেল্ফের সামনে একটি ইজিচেয়ার। শূভ্রা এতক্ষণে খেয়াল করল খাটের আকার ও নকশা পালঙ্কের মতো। এটিও সে প্রথমবারের মতোই দর্শন করেছে। দাদির মুখে ছোটবেলা এমন খাটের কথা শুনেছিল, তাই চিনতে পারছে।
” দাঁড়িয়ে আছো কেন, মা? বসো। ”
স্বর্ণলতার আদুরে ও স্নেহপূর্ণ সম্ভাষণে শূভ্রার চোখের পলক পড়ল। শাশুড়ির দিকে তাকাতে তিনি পুনরায় বললেন,
” আমার পাশে এসে বসো। সঞ্জয়ানের সাথে কথা শেষ হলে দুজন একসাথে যেও। ”
তার চোখদুটির ভাষা বদলে গেল চট করে। সঞ্জয়ানের দিকে রা’গ চোখে চেয়ে বলল,
” অন্য সময় বসব। এখন আমার ঘুম পেয়েছে। ”
শূভ্রা কথাটা শেষ করে মুখ বাঁকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো মেঝেতে ভারী ও শসব্দের পদাঘাত ফেলে। সঞ্জয়ান তার এনেন আচরণ একদমই সহ্য করতে পারল না। মুহূর্তে রাগ উঠে গেল মাথার তালুতে। মায়ের সামনে থেকে উঠার জন্য তৈরি হতে তিনি হাত রাখলেন উরুতে। সামান্য বল প্রয়োগে বললেন,
” এখন কোথাও যাবি না। আমার কথা শেষ হয়নি। ”
” শুনব। আগে ওর তেজটা ভেঙে আসি। কত বড় সাহস তোমার কথা অমান্য করে! তুমি বসো, আমি শূভ্রাকে নিয়ে আসছি। ”
স্বর্ণলতা হাত সরিয়ে নিলেন। ছেলের মুখের দিকে একস্থির চেয়ে থেকে বললেন,
” শূভ্রা কি তোর বড় কোনো ক্ষ’তি করেছে? ”
সঞ্জয়ানের চাহনি আটকে ছিল দরজার পানে। সেটা ফিরিয়ে আনল মায়ের দিকে। প্রশ্নের উত্তরটা নিয়ে ভাবনা উদ্রেক হতে তিনি বললেন,
” উত্তর দিতে এত দেরি করছিস যে! তাহলে কি ধরে নিব ও তোর কোনো বড় ক্ষ’তি করেনি? সেরকম হলে ওর উপর তোর এত রাগ কেন? আমি খেয়াল করেছি, শূভ্রা তোর সামনে আসলে তুই সম্পূর্ণ বদলে যাস। খুব অধৈর্য, উগ্র ও বদমেজাজি ভাব থাকে। তুই তো এরকম না। তোর মধ্যে যে এত রাগ আছে, আমি বুঝতেই পারিনি কখনও। ”
সঞ্জয়ান দৃষ্টি নামিয়ে নিল। মাথা নত করতে গিয়েও করা হলো না। আচমকা বলল,
” অসম্মান করেছে, মা। এইটুকু একটা মেয়ে অথচ কথার কি ধা’র! জে’দ আর তে’জে ভরা শরীর। সামান্যতম ভদ্রতা নেই, বিনয় বলতে যে দুনিয়াতে কিছু আছে জানেই না হয়তো। ”
” এইটুকু? অনেক ছোট, তাই না? তাহলে তো ভালোই হলো। তুই শিখিয়ে-পড়িয়ে নিবি। ছোট দেখেই তো ভালো-মন্দটা বুঝতে পারছে না। ”
মায়ের এই কথাটা সহজভাবে গ্রহণ করতে পারল না। কিছুটা অসহায় ও হতাশ ভাবে বলল,
” তুমি বুঝতে পারছ না, মা। যতটা ছোট মনে করছ ততটাও না। শিখিয়ে-পড়ানোর মতো কাঁচা বয়স ও মাথা নয় ওর। বোকা-সোকাও নয়। বদ বুদ্ধির পাহাড় নিয়ে ঘুরে। ”
স্বর্ণলতা একটুক্ষণ চুপ থেকে সুধালেন,
” খুব খারাপ মেয়ে? ”
” হ্যাঁ, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। ”
” করতেও চাই না। আমি বিশ্বাস করি, খুব ভালো মানুষটা যেমন সবার কাছে ভালো হতে পারে না তেমন খুব খারাপ মানুষটাও সবার কাছে খারাপ না। কারও না কারও কাছে সে খুব ভালো। ”
সঞ্জয়ান একটু যেন টলে গেল। দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
” আমাকে কী করতে বলছ? ”
” সব ভুলে যা। মনে কর, শূভ্রার সাথে তোর আজই দেখা, প্রথম আলাপ। যেই ব্যবহারটা আমি পাই সেই একই ব্যবহারটা শূভ্রাকেও উপহার দে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই খারাপ মেয়েটা তোর কাছে ভালো হয়ে উঠবে। আর যদি না হয়, তাহলে তুই আমাকে যা করতে বলবি, তাই করব। ”
__________
সঞ্জয়ানের রুমে এসে শূভ্রা আরেক দফা মুগ্ধ হলো। অবাক চোখে আবিষ্কার করল, এই রুমের আকার ও সাজসজ্জা স্বর্ণলতার রুমটার মতোই। কোনো কিছুর কমতি নেই। সামান্য অদল-বদলও না। ইকবাল চলে যেতে সে সযত্নে সবকিছু ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখল। এরমধ্যে সঞ্জয়ানের আগমন ঘটল। সে অপ্রস্তুত ও ভীত দৃষ্টিতে তাকালেও দৃষ্টি জোড়া আটকে গেল তার পরনের সাদা পাঞ্জাবীতে। অনিচ্ছায় জিজ্ঞেস করে বসল,
” আপনি পাঞ্জাবীও পরেন? ”
সঞ্জয়ান নিজের পাঞ্জাবীর দিকে তাকাল। সাথে সাথে বিরক্ত জড়ো হলো পুরো মুখটায়। মনে মনে আওড়াল, ‘ পাঞ্জাবী পরিহিত মানুষকে জিজ্ঞেস করছে, পাঞ্জাবী পরে নাকি। আজব! ‘ সে নিঃশব্দে শূভ্রাকে পাশ কাটিয়ে আলমিরাহর কাছে গেল। ভেতর থেকে একটা সাদা রঙের টি-শার্ট বের করে তার সামনেই কাপড় বদলাতে শুরু করে দিল। শূভ্রার এসবে ধ্যান নেই। তার মন পড়ে আছে সন্ধ্যাবেলার সেই কৃষ্ণচূড়ার গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটির উপর। সেই সময় মুখটা পরিচিত মনে হলেও পরিচয়টা ধরতে পারেনি। এবার ধরতে পারল। মুখের আদল সঞ্জয়ানের মতো মনে হতে সে চিৎকার করে ওঠল,
” কখনও না। ওটা আপনি হতে পারেন না। একদমই না। ”
বলতে বলতে সে দৌড়ে এলো সঞ্জয়ানের কাছে। খুলে রাখা পাঞ্জাবীটা দূরে ছুঁড়ে বলল,
” এমন বিশ্রী রঙের পাঞ্জাবী আর কখনও পরবেন না। কালো কাউয়ার মতো দেখতে লাগে। ”
শূভ্রার এই অপ্রত্যাশিত আক্রমণটা দাঁত চেপে সহ্য করতে চেয়েও পারল না। তার দিকে ঘুরে বলল,
” আমাকে কাউয়ার মতো লাগে? আমার গায়ের রঙ কালো নাকি তোমার? মুখটা আয়নায় ঠিকমতো দেখেছ? আমাদের বাসায় ইঁদুরও এরচেয়ে সুন্দর। ”
এই প্রথম অপমানকে গায়ে মাখল না সে। আশপাশে চোখ ঘুরাতে ঘুরাতে টেনে টেনে সুধাল,
” আপনাদের বাসায় ইঁদুর আছে? ”
সঞ্জয়ানের প্যান্ট বদলানো বাকি ছিল। শূভ্রার সামনে থেকে সরতে সরতে বলল,
” আমার রুমেই তো আছে। পুরো পাঁচ ফুটের বেঁটে ইঁদুর। ”
শূভ্রা ইঁদুরকে ভীষণ ভ’য় পায়। তাই সঞ্জয়ানের খোঁচা মারা কথাটা ধরতে পারল না। এক লাফে বিছানায় উঠে বসল। একটা বালিশ টেনে নিয়ে চোখদুটি খিঁচে বন্ধ করে ফেলল। হাত-পা যতটা পারল গুটিয়ে নিয়ে একভাবে পড়ে থাকল। চোখ বন্ধ করে থাকতে থাকতে মনে পড়ল, আজ সে সঞ্জয়ানের রুমে আছে। তার খাটে ঘুমিয়েছে। তার বন্ধ চোখের পাতা খুলে গেল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, সঞ্জয়ান এখনও স্নাগার থেকে বেরোয়নি। সে শুয়া অবস্থায় গড়িয়ে গেল কর্ণানের রাখা ছোট টেবিলটার কাছে। পানিভর্তি জগটা এক হাতে টেনে এনে তার পাশের ফাঁকা জায়গাটা ভিজিয়ে দিল নির্দ্বিধায়। আগের মতো চোখ বন্ধ করে নিতে নিতে বলল,
” আমি ভ’য়ে ম’রে যাব তবুও সাজনা শাকের সাথে ঘুমাব না। ”
পরদিন সকালে সে ঘুম থেকে উঠতে পারল না। জ্বরে গা গুলিয়ে বিছানায় বমি করলে স্বর্ণলতা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। ছেলেকে ডাক্তারের কথা বললে সে জানাল,
” এসব ওর নাটক, মা। নিজের ইচ্ছে রাখতে মৃ’ত্যু’র অভিনয়ও করতে পারবে। ”
_____________
” আমি যদি সেলসম্যানের চাকরি করি, তোমার লজ্জা হবে? ”
মাইমূনের প্রশ্নটা শুনে কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল অরুণিমা। তাকে কাজে যেতে দেয়নি আজ। প্রতিদিন তাকে রিকশায় করে কলেজে দিয়ে আসে ও নিয়ে আসে মাইমূন। আজ যাওয়ার পথে রিকশা অন্যদিকে ঘুরায়। কোথায় যাচ্ছে জিজ্ঞেস করলে উত্তর পায় না অরুণিমা। অনেকটা সময় নীরব থেকে সহসা এমন প্রশ্ন করলে চিন্তা-ভাবনা থমকে যেতে বাধ্য। অরুণিমা সংশয় নিয়ে ফিরতি প্রশ্ন করল,
” তুমি সেলসম্যানের চাকরি করবে? ”
” তোমার লজ্জা না লাগলে করব। ”
” আমার লজ্জা লাগবে কেন? কয়েক মাস আগে আমিও এই চাকরি করেছি। ”
মাইমূন আজ তার ভালোবাসার দিকে চেয়ে কথা বলছে না। রাস্তার দিকে চেয়ে থেকে উত্তর করল,
” তোমার করা আর আমার করা এক নয়। মেয়েদের চাওয়া থাকে তার জীবনসঙ্গীর সামাজিক মর্যাদা তার চেয়ে একটু হলেও উঁচুতে থাক। ”
চলবে