আঙুলে আঙুল
পর্ব (৩৪)
ইকবালের রুমের সামনে এসে দাঁড়াল সঞ্জয়ান। দরজা বন্ধ। ভেতরে সাড়াশব্দ নেই। সে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল মামার দিকে। সহজে ধরা পড়ে না এমন রা’গ নিয়ে শান্ত স্বরে বলল,
” আবার দরজা বন্ধ করে দিয়েছে! একটা মানুষ এত খারাপ কিভাবে হয়, ইকবাল মামা। ”
তিনি সামান্য পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন মুখ গম্ভীর করে। সঞ্জয়ানের কথা শুনে পাশে এসে দাঁড়াল। মৃদু হেসে বলল,
” আবার না একবারই বন্ধ করেছে। আর খোলেনি।
সঞ্জয়ানের ভ্রুজোড়া বেঁকে গেল সন্দেহে। জিজ্ঞেস করল,
” তুমি বলেছিল, মা ওর সাথে দেখা করতে এসেছে। দরজা না খুললে দেখা হয়েছে কিভাবে? ”
” আপা অন্য দরজা দিয়ে ঢুকেছে। ”
” অন্য দরজা! ”
বিস্ময় সুরে শব্দ দুটো উচ্চারণ করতে করতে সম্পূর্ণ ঘুরে দাঁড়াল মামার দিকে। এই রুমের দরজা দেওয়া হয়েছে বারান্দার দিকে মুখ করে। অন্য কোনো দরজা আছে তার জানা নেই। দেখেছে বলেও মনে পড়ছে না। ইকবাল প্রত্যুত্তর করল,
” হ্যাঁ। এই রুমে ঢোকার আরেকটি দরজা আছে। সেটা এদিকে না, বাড়ির ভেতরে। ভাইজানদের রুম ও এই রুমের মধ্যস্থানে। ”
” বাবার রুম থেকে সরাসরি তোমার রুমে ঢোকার দরজা আছে? জানতাম না তো! চোখে পড়েনি কখনও। ”
” না পড়ারই কথা। আপা আলমিরাহ দিয়ে ঢেকে রেখেছে অনেক বছর হবে। ”
এই গুপ্ত দরজার প্রকাশটা সঞ্জয়ান স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছে না। অবিশ্বাস্য ঠেকছে। তার ছোট থেকে বড় হওয়া এই বাড়িতে। এত বছরেও তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি ছায়ানীড়ে। শুধু দেয়ালে রঙের উপর রঙ পড়েছে। আসবাবপত্র ভেঙে যাওয়ায় নতুনের ফরমায়েশ হয়েছে। এরমধ্যে এই দরজাটা কোথা থেকে আসল। আবার ঢেকে আড়াল করেও রাখা হয়েছে। তার এই ভাবনা-চিন্তার মধ্যে ইকবাল বলল,
” অনেক বছর বাদে এই দরজার ব্যবহার হয়েছে আজ। ”
মামার কথার প্রেক্ষিতে কিছু বলল না সঞ্জয়ান। চুপচাপ হেঁটে চলে গেল বাবার রুমের দিকে। সত্যি দরজা আছে কিনা স্বচক্ষে প্রমাণ নিবে। রুমে বাবা-মা কেউ নেই। সে ভেতরে ঢুকে আশ্চর্য হলো। আলমিরাহটা সরানো। তার স্থানে একটি লোহার দরজা নজরে পড়ছে। সঞ্জয়ান দরজা খোলার জন্য উদ্যত হতে শুনতে পেল,
” নতুন বউয়ের সাথে আগে আমি কথা বলি? ”
ইকবালের প্রশ্নটা শুনে সে থেমে গেল। পেছন ফিরে প্রশ্ন করল,
” কেন? ”
” মনে হচ্ছে, আপনার মেজাজ এখনও ঠিক হয়নি। নতুন বউয়ের মনের মধ্যে কী চলছে, আমরা কেউ জানি না। যদি আবার ঝামেলা সৃষ্টি করে। আপনাকে রাগিয়ে দেয়? এখন আপনারা শহরে না গ্রামে আছেন। এখানে খারাপ কথা বাতাসের আগে ছুটে। প্রমাণ তো পেলেনই কিছুক্ষণ আগে। ”
মামা অযৌক্তিত কিছু বলছে না। সবটাই যৌক্তিক, সত্য ও প্রমাণিত। নাহলে সকালে বউ বাড়িতে ঢুকে সন্ধ্যার মধ্যে পুলিশ হাজির করতে পারে? সে জিজ্ঞেস করল,
” তুমি আগে কথা বললে কী হবে? শূভ্রা তোমাকে চিনে না। ”
” চিনতে কতক্ষণ! আপনি আপার কাছে যান। আমি নতুন বউয়ের সাথে পরিচিত হয়ে আসি। ”
ইকবাল দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পাল্লা ভেজিয়ে দিল। সঞ্জয়ান কয়েক সেকেন্ড নীরব দাঁড়িয়ে থেকে সরে এলো।
শূভ্রা খাটের কিনার ধরে মেঝেতে বসে আছে। মাথার একপাশ কাত করে খাটে রেখে হাত দিয়ে কিছু আঁকিবুকি করছে। মুখের ভাব ও চোখের চাহনি উদাস, অন্যমনস্ক। আপন চিন্তায় মত্ত মেয়েটির কাছে এসে দাঁড়াল ইকবাল। নরম সুরে বলল,
” পরিবারের কথা মনে পড়ছে? ”
শূভ্রা চমকে তাকাল। অপ্রত্যাশিত পুরুষ মানুষ দেখে ঘাবড়ে যায় বেশ। সভয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দূরে সরে গিয়ে ভীত স্বরে সুধাল,
” কে আপনি? ”
” সম্পর্কে মামা শ্বশুর হই। ”
পরিচয় পেয়েও সামান্যতম ভয় কমল না শূভ্রার। স্ফুরিত দৃষ্টি জোড়া অস্থিরতায় ঘুরছে এদিক-ওদিক। সেই অবস্থায় বলল,
” এখানে কী? বেরিয়ে যান। ”
” মাত্রই এলাম। এখনই চলে যেতে বলছ? আমরা গল্প করব না? ”
” কিসের গল্প? ”
” তোমার নিজের গল্প। পরিবারের গল্প। ভালোবাসার মানুষদের নিয়ে গল্প। ”
শূভ্রার চঞ্চল দৃষ্টি আচঞ্চল হলো। একস্থিরভাবে আটকাল ইকবালের মুখটায়। এই সুযোগকে কাজে লাগাল সে। জিজ্ঞেস করল,
” তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন কে? বাবা নাকি মা? ”
প্রশ্নটা শুনে তার ভয়ের কাঁপুনিটা বন্ধ হয়ে গেল। আনমনা হয়ে গেল মূহুর্তে। চাহনি নিচে নামতে নামতে মেঝে স্পর্শ করতে বলল,
” বড় আপু। ”
” বড় আপু! বাবা-মায়ের চেয়েও বেশি ভালোবাসে সে? ”
শূভ্রা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝাতে ইকবাল বলল,
” বড় আপুর সাথে কথা বলবে? ”
প্রশ্নটা করতে করতে সে পকেট থেকে মোবাইল বের করল। শূভ্রার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল,
” নাম্বার মনে আছে? আমার মোবাইল থেকে কথা বলতে পার। আমি কিছু মনে করব না। ”
প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দিল না শূভ্রা। মোবাইলটা ছেঁ মেরে নিয়ে বলল,
” আপনি আমাকে মোবাইল দিলেন? ”
” হ্যাঁ দিলাম। তোমার যা যা লাগবে সব দিব। ”
” সত্যি? ”
” হ্যাঁ, চেয়ে দেখ। ”
শূভ্রার চোখে-মুখের দুঃখী ও ভীত ভাবটা মুছে গেছে ইতিমধ্যে। খুশির আলো ঝিলিক দিচ্ছে ঠোঁটের পার্শদ্বয়ে। কয়েক মিনিট পূর্বেও যে অপরিচিত ছিল, যার উপস্থিতি ভয়ের ছিল সেই মানুষটা পরিচিত হয়ে ওঠল। এতটাই পরিচিত যে তাকে হাত ধরে খাটে বসিয়ে বলল,
” আপনি তো অনেক ভালো। সাজনা শাকের মতো না। ”
” সাজনা শাক কে? ”
” আপনার ভাগ্নে। ”
____________
সঞ্জয়ান মায়ের সাথে কথা বলতে চেয়েছিল। খোঁজ পায়নি। পুরো ছায়ানীড়ে সন্ধান করা শেষে বাবার পাশে গিয়ে বসে। মুনসুর সাখাওয়াত বসার রুমে সোফায় বসে আছেন গম্ভীর মুখে। তাকে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করবে নাকি এই দ্বিধায় পড়ে গেছে সঞ্জয়ান। তার প্রতি বাবার ব্যবহার বরাবরই খিটখিটে। নরম ও সস্নেহে কথা বলেন খুব কমই। সেটাও মায়ের সামনে পেয়ে এসেছে সবসময়। এখন স্বর্ণলতা সামনে নেই। বাড়ির মধ্যেও নেই। তন্মধ্যে দুজনের মাঝে মনমালিন্য চলেছে। এই অবস্থায় তাকে নিয়ে কিছু বলা ঠিক হবে নাকি এই সংশয়ে ভুগছে।
” বাড়িতে বউ এলো অথচ একবারও সামনাসামনি কথা বলা হলো না। যাও, আমার বউমাকে ডেকে আন। একটু কথা বলি। ”
সঞ্জয়ান কী বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না। সেই সময় ইকবালের আগমন ঘটল। তার হাতে চায়ের কাপ ও বিস্কিট। টি-টেবিলে সেগুলো রাখতে রাখতে বলল,
” আজ থাক, ভাইজান। ওর মন ভালো নেই। শরীরটাও ক্লান্ত। বিশ্রামের প্রয়োজন। ”
মুনসুর সাখাওয়াত কপাল কুঁচকে তাকালেন তার দিকে। তারপরে ছেলের দিকে চেয়ে বললেন,
” অসুস্থ নাকি? ওষুধ-পত্র কিছু দিয়েছিস? ”
এবার ইকবাল উত্তর করল,
” অসুস্থ না। ঐ যে বললাম না, মন ভালো নেই? পরিবার ছেড়ে এতদূর আসছে…”
” তুই এত কথা বলছিস কেন? তোকে প্রশ্ন করেছি? ”
বাবার রাগ বেড়ে যাওয়ার ভয়ে সঞ্জয়ান পাশ থেকে দ্রুত বলল,
” শূভ্রার সাথে আমার কথা হয়নি, বাবা। তাই তোমার প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। ”
তারপরে মামার দিকে বলল,
” তোমার সাথে কথা হয়েছে? কী চাইছে সে? দরজা খুলেছে? ”
মুনসুর সাখাওয়াতের মনে পড়ল, শূভ্রা দরজা আটকে নিজেকে বন্দী রেখেছিল। সাথে মিথ্যা রটিয়ে বাড়িতে পুলিশ এনেছিল। ইকবাল ভাগ্নের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পূর্বে তিনি প্রশ্ন করলেন,
” বউয়ের সাথে তুই কথা বলতে গিয়েছিলি? কেন? সঞ্জু কোথায় ছিল? ”
” বাড়িতে ছিল। আমার মনে হয়েছিল, উনার আগে আমি কথা বলি। যদি মান ভাঙতে পারি! ”
উত্তরটা শুনে মুনসুর সাখাওয়াত প্রচন্ড রে’গে গেলেন। সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে বললেন,
” তোর কী মনে হয়? তুই বললে সব মেয়েরা মান ভেঙে ফেলবে? ”
” সব মেয়ে জানি না। কিন্তু যারা আমাকে বন্ধু ভাবে তারা অবশ্যই ভাঙবে। ”
” সঞ্জুর বউ তোর কোন জনমের বন্ধু? তোরা কি সমবয়সী? এক ক্লাসে পড়িস? নাকি এক পাড়ায় থাকিস? ”
” বন্ধু হওয়ার জন্য সমবয়সী হওয়া বাধ্যতামূলক নয়। এখন পিতা-মাতার সাথে সন্তানেরও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়। ”
” শূভ্রা তোর সন্তান নয়। ”
এই পর্যায়ে ইকবাল চুপ হয়ে গেল। ব্যথার একটা বাতাস ছুঁয়ে গেল বুকজুড়ে। সঞ্জয়ানের দিকে ব্যথিত নয়নে চেয়ে থাকলে মুনসুর সাখাওয়াত বললেন,
” এতই যদি মেয়েদের মান ভাঙার শখ তাহলে বিয়ে করে বউয়ের মান ভাঙ। ”
সঞ্জয়ান মামার দিকে তাকাল। বিয়ের কথা বললে এই মানুষটা নিষ্প্রাণ শক্ত বস্তুর মতো হয়ে যায়। এর কারণ তার কাছে স্পষ্ট না হলেও এত দিনে একটা অনুমান করেছে। তার ধারণা, ইকবাল মামা বিয়ে না করার পেছনে একটা বিশেষ কারণ আছে। সেই বিশেষ কারণটি হলো একটি নারী। যার সাথে প্রেমঘটিত সম্পর্ক হয়েছিল। হতে পারে তার অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে গেছে।
_____________
আজ অরুণিমা খুব খুশি। চোখে-মুখে আনন্দের দ্যুতি ঝিলিক দিচ্ছে। অল্পতে হাসছে। মন খুলে কথা বলছে। তার এই উচ্ছ্বসিত ও নিসংকোচ আচরণে বুঝা যাচ্ছে এতদিন সে কতটা যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে গেছে। একটা ভারি বোঝা বুকের মধ্যে সারাক্ষণ বয়ে বেড়িয়েছে। সেই ভারটা এখন আর নেই। মাইমূন এমন মুহূর্তের প্রত্যাশা করেছে সবসময়। আজ পেয়েও খুশি হতে পারছে না। মনে হচ্ছে অরুণিমার বুকের ভারটা তার বুকে স্থানান্তরিত হয়েছে।
” এত শক্ত প্রতিশ্রুতি না দিলে হতো না, ভালোবাসা? আমার খুব ভয় হচ্ছে। মনে হচ্ছে, এই জীবনে আমাদের বিয়ে হবে না। ”
অরুণিমার আজ ছুটি ছিল। তাই দুপুরের দিকে স্ব উদ্যোগে ছুটে এসেছে মাইমূনের বাসায়। থলে ভর্তি বাজার নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকতে এই কথাটি শুনতে পায়। সে একবিন্দুও ঘাবড়াল না। হাসিমুখে রান্নার কাজ শুরু করতে করতে বলল,
” মাঠে না নেমে হার স্বীকার করে নিলে? ”
মাইমূন তার কাছে এগিয়ে গেল। অস্থিরচিত্তে বলল,
” লড়ার মতো কোনো উপায় বাকি রেখেছে তোমার বাবা? ভালো চাকরির জন্য উচ্চ শিক্ষার সার্টিফিকেট প্রয়োজন। ব্যবসার জন্য টাকা। দুটোর একটাও আমার নেই। ”
” আমি তো আছি। এতে চলবে না তোমার? ”
” তুমি কী করবে? ”
অরুণিমা মৃদু হাসল। চোখের চাহনিতে রহস্য নিয়ে বলল,
” রান্নাটা শেষ করি। দুজন একসাথে খেতে খেতে বলব। ”
চলবে