আঙুলে আঙুল পর্ব ৩৩

0
337

#আঙুলে_আঙুল
পর্ব (৩২)

টিফিনের শেষ ঘণ্টা পড়ে যাওয়ায় ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাসের দিকে ছুটছে। শিক্ষকগণও অফিস কক্ষ থেকে বেরিয়ে পড়েছেন। বারান্দায় আর দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। সকলের আসা-যাওয়ার মধ্যে পড়ে গেছে দুজন। অরুণিমা বারান্দা থেকে বেরুতে চাইল। ফাঁকা মাঠটা চোখের ইশারায় দেখাল মাইমূনকে। সে পেছন পেছন হেঁটে গিয়ে দাঁড়াল তার ভালোবাসার কাছে। মধ্যাহ্নের সূর্যের উত্তাপ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে। চোখের পলকে ঘামের দানা জমে গেল অরুণিমার নাকের চূড়ায়। চোখ মেলে থাকা কষ্টকর। কুঁচকে আসতে আসছে চোখের পাপড়ির নরম দেয়ালগুলো। সে আকাশের দিকে মুখ করে বলল,
” এই রোদে ছেলেমেয়েগুলো বসে ছিল কিভাবে? আমার তো ঘাম বেরুচ্ছে! ভালোবাসা, ঐদিকটায় চলো। গাছের ছায়া আছে। ”

মাইমূনের দেখানো স্থানটার দিকে ঘাড় ফেরালেও এগুনোর আগ্রহ নেই অরুণিমার ভাবভঙ্গিতে। বলল,
” আমার কাজ আছে। গল্প করার সময় নেই। তুমি এখন যাও। পরে দেখা করব। ”
” যেমন করে বিদায় করো তেমন করে ডাক পাঠাও না। ”

তার কণ্ঠে অভিমানের আভাস। একের পর এক অভিযোগ পেয়েও অরুণিমার আচরণে বদল আসছে না। সে বুঝতে পারে, অনুতপ্তও হয়। যার রেশটা মাইমূনের উপস্থিত পর্যন্তই স্থায়ী হয়। সে চলে গেলে অনুতপ্তের আ’গু’ন ধপ করে নিভে যায়। ছাইয়ের ছিটেফোঁটাও থাকে না। অরুণিমার দৃষ্টি হালকা হয়। ঘাসের দিকে স্থির হতে মাইমূন বলল,
” চলে যাচ্ছি। ইচ্ছে হয় তো, আমার প্রিয় খাবার ছুঁয়ে দেখ। ”

অরুণিমা কথা বাড়াল না। চুপচাপ খাবারের বাটি হাতে নিল। মাইমূনকে এখানে রেখে স্বর্ণলতা ক্যান্টিনের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। পা বাড়াবে সেই সময় নজরে পড়ল বাবাকে। হাতে হাজিরা খাতা ও কিছু কাগজপত্র। বাবার চোখে চোখ রেখে আপনমনে বিড়বিড় করল, ‘ আমরা দুজনেই দুজনের বিশ্বাস ভেঙেছি, কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু পার্থক্যটা কোথায় জানো, বাবা? আমি সত্যি বলেছিলাম আর তুমি মিথ্যা। মিথ্যা বলে আমাকে বিয়ের পিড়িতে বসিয়েছিলে আর এখন ভালো মানুষটাকে আমার চোখে খারাপ বানাতে চাচ্ছ। ‘ শেষ বাক্যটা উচ্চারণ করামাত্র বুকের ভেতরটা কেঁ’পে ওঠল। ঝড়ো হাওয়ার মতো দুলে ওঠল পুরো শরীর। চড়কির ন্যায় মাথার ভেতরটাও চক্কর দিচ্ছে। বাবাসহ চারপাশটা আবছা হয়ে আসতে মৃদু স্বরে বলল,
” আমাকে ধরো। ”

কারও ধরার অপেক্ষা করল না। হাতের বাটিটা ফেলে দিল। ডান হাতটা পেছনে নিয়ে শক্ত কিছু অনুসন্ধান করছে মরিয়া হয়ে। মাইমূন এক লাফে তার নিকট চলে এলো। হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে কিছু একটা বলল। যার একটা শব্দও অরুণিমার কানে পৌঁছাল না। সে জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ল মাইমূনের শ’ক্ত শরীরটায়।

অরুণিমা জ্ঞান ফিরে পেয়ে বুঝল, সে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে। আশ্চর্যের মুখ করে তড়ি-ঘড়িতে উঠে বসতে দেখল, তার শিয়রের কাছে বাবা বসে আছেন চেয়ার পেতে। গত কয়েক দিনে বাবা তার রুমে ঢুকেনি। সামনে আসেনি। নিজ থেকে কথা বলেনি। আজ সেই বাবা তার পাশে মাথার কাছে বসে আছে। চোখে, মুখে উদ্বিগ্নের ছায়া। মুখটা শুকনো, অন্যমনস্ক। চেতনা ফিরল নার্সের গলা পেয়ে। তিনি বলছেন,
” বলেছিলাম না তেমন কিছু হয়নি? এখনই জ্ঞান ফিরবে। মিলল আমার কথা? ”

অসীউল্লাহ নার্সের দিকে এক ঝলক চেয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন। অরুণিমা তখনও নার্সের দিকে চেয়ে আছে। সে তার কাছে হেঁটে এসে অভিযোগের সুরে বলল,
” এত বার করে বললাম, এটা প্রাইভেট হসপিটাল, ভর্তি করাবেন না। শুধু শুধু টাকা নষ্ট হবে। শুনল না। জোর করে ভর্তি করাল। এখন বসে বসে টাকা গুণুণ। ”

অরুণিমা বুঝতে পারল, শেষ কথাটা তার বাবার উদ্দেশ্যে বলেছে। নার্স বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,
” উনি সম্পূর্ণ সুস্থ। আমি স্যারকে পাঠাচ্ছি। আজই ছুটি নিবেন। নাহলে টাকা গুণে শেষ করতে পারবেন না। সুস্থ মানুষটাও অসুস্থ হয়ে যাবে। ”

সে বেরিয়ে যেতে অরুণিমা বলল,
” আমাকে এখানে এনেছ কেন, বাবা? আবার ভর্তিও করেছ? নিশ্চয় অনেক টাকা বিল হয়েছে। শোধ করবে কিভাবে? ”

অসীউল্লাহ বিরক্ত স্বরে বললেন,
” আমি করিনি, তোর গু’ণ্ডাটা করেছে। বে’য়া’দব একটা! আমার কথা শোনে? কত করে বললাম, সরকারি হাসপাতালে নিয়ে চলো। পাত্তাই দিল না। ”
” আমাকে মাইমূন নিয়ে এসেছে? ”
” হ্যাঁ। ”
” তোমাকেও? ”
” কী আশ্চর্য! আমাকে আনতে যাবে কেন? আমি কি তোর মতো জ্ঞান হারিয়েছি? ”

কথাটা ধ’ম’কের মতো শোনালেও অরুণিমা ভ’য় পেল না। আগ্রহসহিত জিজ্ঞেস করল,
” তুমি নিজ থেকে এসেছ, বাবা? ”
” আসব না? চোখের সামনে তুই জ্ঞান হারালি আর আমি মুখ বাঁকিয়ে চলে যাব? ”

অরুণিমার বুকের ভেতরটা আবারও দুলে ওঠল। এবার আনন্দের, খুশির। তার বাবা তাকে পুরোপুরি ত্যাগ করেনি। এখনও ভালোবাসে। যত্ন করে। পরোয়া করে। সে আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারল না। বাবাকে জড়িয়ে ধরল আচমকা। চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল,
” আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। ”

অসীউল্লাহ দ্বিধা নিয়ে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেও জোরের সাথে উত্তর করলেন,
” জানি। ”
” আমাকে দূরে সরিয়ে দিও না। খুব কষ্ট হয়। মনে হয়, মরে যাই। ”
” আমি দূরে সরাতে চাইনি। তুই নিজেই সরি গেছিস। ”

অরুণিমা আগের চেয়ে আরও শ’ক্ত করে জড়িয়ে ধরল জন্মদাতাকে। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” ক্ষমা করে দাও। আর কখনও তোমার কথার বাইরে যাব না। ”

অসীউল্লাহ চুপ হয়ে গেলেন। মেয়ের মাথা থেকে হাত সরিয়ে নিলেন। আড় চোখে তাকালেন দরজার কাছটায়। মাইমূনের ছায়া দেখা যাচ্ছে। ছেলেটা আধ ঘণ্টা ধরে ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। অরুণিমা যখন অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল তখন ছেলেটা এত ভ’য় পেয়েছিল যে, লোহার মতো শক্ত হয়ে গেছিল! হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে নিথর শরীরটা আলগোছে ধরে রেখেছিল। তিনি বিপদ টের পেয়ে বাধ্য হয়ে যখন জিজ্ঞেস করলেন, ‘ কী হয়েছে ওর? ‘ সে বোকার মতো উত্তর করেছিল, ‘ জানি না। ‘ তারপর তিনিই এগিয়ে আসেন। মেয়ের শরীর হাতিয়ে জানান, জ্ঞান হারিয়েছে। এই যে জানতে পারল? ব্যস! তারপর দুনিয়া ভুলে গেল। অরুণিমাকে কাঁধে করে দৌড়ে দৌড়ে এই হাসপাতালে পৌঁছাল। অথচ কলেজ থেকে বেরুলেই রিকশা, অটো পাওয়া যায়। ঐ মুহূর্তের জন্য সে ভুলেই গেছিল পৃথিবীতে এমন যান যন্ত্রের আবিষ্কার হয়েছে। ব্যবহার হচ্ছে যুগ যুগ ধরে।

” তোর গু’ণ্ডা’টাকে ভেতরে ডাক। ”

অরুণিমা বাবাকে ছাড়ল। চোখের পানি মুছতে মুছতে সুধাল,
” ও কি বাইরে আছে? ”
” হ্যাঁ। ঐ তো দাঁড়িয়ে আছে। ”

বাবার চোখের ইশারা পেয়ে সে দরজার দিকে তাকাল। ছায়াটা নজরে আসতে বলল,
” ভেতরে এসো। বাবা কথা বলবে তোমার সাথে। ”

মাইমূন ভেতরে এলো। অসীউল্লাহর দিকে নজর দেওয়ার ধৈর্য হলো না। নিজের ভালোবাসার কাছে এগুতে এগুতে বলল,
” আমাকে স্বাস্থ সচেতনের উপদেশ দিয়ে নিজেই অসচেতন হয়ে পড়েছ। ওখানে আর থাকতে হবে না। আমার সাথে চলো। আজ থেকে তুমি আমার সাথে থাকবে, আমার বাড়িতে। ”
” বিয়ে না করেই একসাথে থাকবে? ”

প্রশ্নটা অসীউল্লাহর কাছ থেকে ছুটে এলো। মাইমূন তার দিকে ফিরতে তিনি বিদ্রুপের সুরে বললেন,
” তোমার থেকে এমনটাই আশা করা যায়। ধর্ম কর্মহীন ছেলেরা সামাজিকতা মানে নাকি! ”

অরুণিমা বুঝতে পারল, বাবা আবার রে’গে যাচ্ছেন। ক’ঠো’র হয়ে পড়ছেন। তাই দ্রুত দুজনের মাঝে কথা বলল,
” বাবা, তুমি ভুল বুঝছ। আমাকে নিয়ে অনেক চিন্তা হচ্ছে তাই এরকম বলে ফেলেছে। ”

মাইমূন কিছু একটা বলতে চাইল। অরুণিমা চোখ রা’ঙা’তে সে চুপ হয়ে গেল। অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে আঁটসাঁট দেহে দাঁড়িয়ে থাকল। অসীউল্লাহ তখনই কিছু বললেন না। নীরবে ভাবলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর মেয়ের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন,
” তুই এই ছেলেকেই বিয়ে করবি? এটাই কি তোর শেষ সিদ্ধান্ত? ”

মাইমূনকে এই প্রথম গু’ণ্ডা’র পরিবর্তে ছেলে হিসেবে সম্বোধন করেছেন। অরুণিমা একটু সাহস পেল। প্রত্যুত্তরে বলল,
” হ্যাঁ। কিন্তু তোমার মত নিয়ে। ”
” আমি মত না দিলে করবি না? ”
” না। ”
” যদি কখনই না দিই, তাহলে? ”
” সারা জীবন অবিবাহিত থাকব। ”
” ঠিক তো? ”

প্রশ্নটা সূঁচের মতো আ’ঘা’ত করল অরুণিমাকে। তার বাবা কি চাচ্ছে, সে আজীবন অবিবাহিতই থাকুক? সে ব্যথিত মনে উত্তর করল,
” হ্যাঁ। ”
” তুই যে এখনও আমাকে এত গুরুত্ব দিস জেনে খুশি হলাম। এর উপহার হিসেবে তোকে ক্ষমা করে দিব। কিন্তু এই ছেলেকে আমার মেয়ের জামাই হিসেবে মানতে পারছি না। ”
” কেন পারছ না? ”
” সেটা কি তোর অজানা, অরু? ”

অরুণিমা চিন্তায় পড়ে গেল। অস্থিরচিত্তে তাকাল মাইমূনের দিকে। সে এখনও অন্য দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে চেয়ে বলল,
” দয়া করে মেনে নাও। দেখ, বিয়ে হলে ও বদলে যাবে। ”
” যদি বদলেই যাবে তাহলে বিয়ের পরে কেন? এখনই বদলাক। ”

অরুণিমার দৃষ্টি ফিরে এলো বাবার মুখটায়। তিনি পুনরায় বললেন,
” তুই বলেছিলি না, নেশা থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে? পুরোপুরি সরেছে? না সরলেও এখন সরতে হবে। শুধু নেশা থেকে না সকল খারাপ দিক থেকে সরে আসতে হবে। দলবল নিয়ে না ঘুরে চাকরি করতে হবে। ভদ্রলোক হতে হবে। তবেই আমি বিয়ের মত দিব। ”
” চাকরি! ওর তো পড়াশোনা সম্পূর্ণ হয়নি, বাবা। ”
” তাহলে ব্যবসা করুক। তবে এখানে শর্ত আছে আমার। ”
” কী শর্ত? ”
” ওর বাবার কাছ থেকে কোনো সাহায্য নিতে পারবে না। রাজনীতীর ক্ষ’ম’তার দা’প’টও দেখাতে পারবে না। যা করবে নিজ যোগ্যতায়। বুদ্ধি ও গায়ের জো’র খাটিয়ে। ”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here