#আঙুলে_আঙুল
#পর্ব (৩)
কিছু সময়ের মধ্যে স্বপন ও অরুণিমা একটি ক্লাবের সামনে এসে দাঁড়াল। স্বপন বলল,
” মিয়া ভাই ভেতরে মিটিং করছে। আপনি দাঁড়ান, আমি ভেতরে গিয়ে আপনার কথা বলছি। ”
অরুণিমা বেঁকে বসল। দুই হাত বুকের খানিক নিচে বেঁধে গম্ভীর স্বরে বলল,
” আমার এত সময় নেই। এখান থেকেই ডাকো। ”
স্বপন কিছু একটা বলতে চাইল। তার পূর্বে অরুণিমা বলল,
” আমার কথা শুনবে না তো? ঠিক আছে, মিয়া ভাই আসুক। নালিশটা ঠিকমতোই করব। ”
তার এই মিথ্যা রাগ ও শাসানো স্বপনকে ভয় পায়িয়ে দিল। অসহায় চোখে চেয়ে থেকে বলল,
” ঠিক আছে, ডাকছি। ”
” জলদি। ”
স্বপন কাচের তৈরি রুদ্ধদ্বারে আঘাত করতে করতে উঁচু স্বরে ডাকল,
” মিয়া ভাই? ও মিয়া ভাই। বাইরে আসুন তাড়াতাড়ি। ”
তার এই ডাকাডাকির তোপে পড়ে ভেতর থেকে কেউ একজন দরজা খুলে দাঁড়াল। অত্যন্ত বিরক্তি নিয়ে ঝাড়ি মারতে গিয়ে থমকে গেল। দৃষ্টিখানা অরুণিমার মুখে পড়তে সে স্তম্ভিত হলো। বিস্মিত স্বরে উচ্চারণ করল,
” ভাবি! ”
ঠিক তখনই দরজা মেলে দাঁড়ানো ছেলেটির পেছনে আরেকটি ছেলে এসে দাঁড়াল। মুখের ভাব রুষ্ট, গম্ভীর। ঠোঁটের মাঝে জ্বলন্ত সিগারেট। প্রথম ছেলেটির বাহুতে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলল,
” সর তো দেখি, এত বড় সাহস কার, আমাকে বাইরে বেরুতে বলে! ”
স্বপনের কলিজা শুকিয়ে এলো। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দ বাজছে। অরুণিমার দিকে করুণ দৃষ্টিতে এক ঝলক চেয়ে বলল,
” মিয়া ভাই, আমি স্বপন। ”
মিয়া ভাই তখন সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে নাক-মুখ দিয়ে। পরিচয় পেয়ে সশরীরে বাইরে বেরিয়ে এলো। রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাতে স্বপন ভয়ে কাঁপতে লাগল। কাঁপা স্বরে দ্রুত বলল,
” ভাবি দেখা করতে আসছে। ”
” কোন ভাবি? ”
স্বপন ঘাড় বাঁকিয়ে পেছনে তাকাল। অরুণিমা কয়েক কদম দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে হাত উঁচিয়ে বলল,
” অরুণিমা ভাবি। ”
মিয়া ভাই অরুণিমার দিকে তাকাল। সেও তার দিকে চেয়ে থাকায় দৃষ্টি সংযোগ ঘটল প্রথমবারের মতো। অরুণিমা সামান্য অপ্রতিভ হলেও দৃষ্টি কাঁপল না একবারের জন্যও। হৃৎস্পন্দনের গতি বেড়ে গেলেও বাইরে প্রকাশ পেল না। অবিচলিত ভাবে সামনে এগিয়ে আসল। প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,
” আপনি মিয়া ভাই? ”
মিয়া ভাইয়ের সিগারেট শেষ হওয়ার পথে। চাইলে ফেলে দিতে পারে, ফেলল না। শেষ অংশটা ঠোঁটজোড়ার মাঝে চেপে ধরে স্বপনের গেঞ্জির কলার চেপে ধরল একহাতে। নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল,
” তোদের ভাবি আসছে, আগে খবর দিবি না? পরিচয় পর্বটা আরও সুন্দর করে শেষ করা যেত! সাজগোজ, গুছানোরও তো একটা ব্যাপার আছে। আপ্যায়নটা করব কী দিয়ে? গাধা একটা! ”
স্বপনকে ঠেলে আগের জায়গায় পাঠিয়ে অরুণিমার দিকে তাকাল। হাত দিয়ে এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করতে করতে এগিয়ে এলো। মৃদু হেসে বলল,
” জি, আমি মিয়া ভাই। ”
এটুকু বলে ক্লাবের বাইরে, ভেতরে থাকা ছেলেপুলেদের দিকে তাকিয়ে বলল,
” ওদের জন্য মিয়া ভাই। তোমার জন্য না। তোমার কাছে মাইমূন। শুধু মাইমূন। ”
অরুণিমাকে জবাবে কিছু বলার সুযোগ দিল না। সকলের উদ্দেশ্যে বলল,
” তোরা এখনও ভেতরে কী করছিস, পাজির দল? ভাবির জন্য চা-বিস্কুটের ব্যবস্থা কর। ”
আদেশ পেয়ে সকলে বাইরে বেরিয়ে এলো। দল বেঁধে ছুটে গেল রাস্তার ঐপাশে। মাইমূন সামনে অগ্রসর হতে হতে বলল,
” ভেতরে এসো। ”
অরুণিমা ঠিক করল ভেতরে যাবে না। যা বলার বাইরে থেকে বলবে। পরক্ষণে মনে পড়ল, এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বললে মানুষ খারাপ ভাববে। তাই ভেতরে ঢুকল। মাইমূন একটা চেয়ার টেনে বসার জন্য ইশারা করল। সে বসল না। তার দিকে আর তাকালও না। অন্য দিকে চেয়ে বলল,
” স্বপন বলল, আপনি নাকি বলেছেন আমাকে ভাবি ডাকার জন্য? ”
” হ্যাঁ, আমিই বলেছি। ”
অরুণিমা না চাইতেও দৃষ্টি ফিরে এলো মাইমূনের দিকে। এমন অকপটে সত্যি স্বীকারোক্তি পেয়ে সে অবাক হয়েছে। সে ভেবেছিল, প্রথমে অস্বীকার করবে। মিথ্যা কাহিনি বানাবে। তেমনটা না হওয়াতে যেমন আশ্চর্য হলো তেমন মুগ্ধও হলো। সত্যও যে মানুষকে দুর্বল করে দিতে পারে এর প্রমাণই হয়তো এই মিয়া ভাই।
“কেন বলেছেন? ”
অরুণিমা টের পেল, তার গলার স্বরে জোর কমে এসেছে। হৃৎস্পন্দনের গতি তীব্র হতে তীব্রতর হচ্ছে। হাত-পা কাঁপছে মৃদু।
মাইমূনের কাছে পানির বোতল ছিল। গ্লাসে পানি ঢালতে গিয়েও থেমে গেল। বোতলটা অরুণিমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
” ওরা আমার ছোটভাইয়ের মতো। সেই হিসেবে আমার বউ ওদের ভাবি হয়। ”
” আমি আপনার বউ? ”
” এখনও হওনি। কিছুদিনের মধ্যে হবে। ”
অরুণিমার গলার ভেতরটা শুকিয়ে এসেছিল। পানির তৃষ্ণা অনুভব করলেও বোতলটা নিল না। ফিরিয়ে দিয়ে বলল,
” কীভাবে জানলেন? ”
” ভবিষ্যত অনুমান করে। ”
” আপনি জ্যোতিষী? ”
” আমি জ্যোতিষী না। আমার মন জ্যোতিষী। ”
অরুণিমা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। মাইমূন দ্রুত বলল,
” রাগ করছ? করো। ভালোবাসা প্রকাশের এটিও একটি মাধ্যম। ”
” আমি রাগ করছি না। বিরক্ত হচ্ছি। এসব প্রেম-ভালোবাসা আমার পছন্দ নয়। ”
” কেন? ”
সে উত্তর দিল না। অনুরোধের সুরে বলল,
” আপনার ছেলেপিলেদের বলবেন, আমাকে যেন আর বিরক্ত না করে। ”
মাইমূন আগ্রহের সাথে সুধাল,
” তাহলে কি আমি বিরক্ত করব? ”
” না, আপনিও করবেন না। ”
” তাহলে কী করব? ”
” কিছু করবেন না। আমরা এ পাড়ায় নতুন। আমার বাবা প্রেশারের রুগী। আমাদের নিয়ে সারাক্ষণই চিন্তা করেন। আমি চাই না, আমার জন্য কোনো সমস্যাই পড়ুক। কেউ দুটো কথা শোনাক। ”
অরুণিমার এই সহজ নিষেধটাকে উপেক্ষা করার সাধ্য হচ্ছে না তার। কাতর স্বরে বলল,
” আমি তোমাকে খুব পছন্দ করি, ভালোবাসি। ”
” প্রেম নিবেদন করছেন? ”
” না। আমার ভালোবাসা নিবেদনের অবস্থানে নেই। তার থেকেও এগিয়ে। যতটা এগুলে ফিরে আসা যায় না। ”
অরুণিমা কোনো উত্তর দিল না। বেরিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে হতে বলল,
” আশা করছি, আমার অনুরোধটা রাখবেন। ”
মাইমূন এগিয়ে এসে কাচের দরজাটা টেনে ধরল। অরুণিমা বাইরে পা ফেলতে সে ডেকে ওঠল,
” শোন। ”
অরুণিমা পেছন ফিরল। সে বলল,
” একটা ফুলের নাম বলো তো। ”
” কেন? ”
” সন্ধ্যায় একটি পার্টির আয়োজন আছে। বিশেষ অতিথি হবেন, আমাদের চেয়ারম্যান সাহেব। ঠিক করেছি, তাকে ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানাব। কিন্তু ফুল ঠিক করতে পারিনি এখনও। যদি সাহায্য করতে। ”
” সাহায্য করলে আমার অনুরোধ রাখবেন? ”
” সবগুলো না। কিছু কিছু রাখব। ”
অরুণিমা রাগ চোখে তাকাল। ফুলের নাম না বলেই চলে গেল।
__________
সন্ধ্যার আযান পড়তে শূভ্রা পড়ার টেবিলে গিয়ে বসল। বই-খাতা বের করতে গিয়ে দেখে ব্যাগ নেই। পুরো রুমে তল্লাশি চালিয়েও পেল না। বাধ্য হয়ে নিয়াজকে জিজ্ঞেস করল,
” আমার ব্যাগ পাচ্ছি না। দেখেছিস? ”
সে একমনে বই পড়ছে। মুখ না তুলে বলল,
” বাবা নিয়ে গেছে। ”
” কেন? ”
” আমি কীভাবে বলব? বাবা কি আমাকে বলে নিয়েছে? ”
তার কণ্ঠস্বর ও মুখের ভাবে স্পষ্ট বিরক্ত। শুভ্রাও বেশ চটে আছে। হন্তদন্ত হয়ে ছুটল বাবার রুমে। অসীউল্লাহ সন্ধ্যার চা খাচ্ছিলেন। সহসা শুনতে পেলেন,
” তুমি আমার ব্যাগ নিয়েছ? ”
তিনি এক পলক তাকালেন মেয়ের দিকে। তারপর শান্ত স্বরে বললেন,
” হ্যাঁ। ”
” কেন নিয়েছ? তাড়াতাড়ি দেও। আমার পড়া বাকি। ”
” কিসের পড়া বাকি? ডায়রী তুলেছিস? ”
শূভ্রা একটু নরম হলো। ইতস্তত করে বলল,
” তুলেছিই তো। ”
” কিভাবে তুললি? তুই তো আজকে ক্লাসেই যাসনি। তোর না নানি মারা গিয়েছে? ”
কথাটা বলে চায়ের কাপটা হাত থেকে রাখলেন। স্ত্রীকে ডেকে বললেন,
” তোমার মা মারা গেছে। দেখতে যাবে না? ”
নাজিয়া বেগম বিস্মিত হলেন। বললেন,
” পাগল হলে নাকি? আমার মা তো মারা গেছে, অনেক বছর হলো। ”
অসীউল্লাহ বিদ্রুপ করে বললেন,
” একবার মারা গেলে কি আবার মারা যাওয়া যায় না? ”
তিনি উত্তর দেওয়ার সুযোগ পেলেন না। শূভ্রা বলল,
” বাবা, তুমি আবার আমার ক্লাসে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছ? ”
” নাহলে জানতাম কী করে, আমার মেয়ে মৃত মানুষকে মেরে ফেলে ক্লাস ফাঁকি দিচ্ছে কী করে। ”
চলবে