আঙুলে আঙুল পর্ব ২৭

0
364

আঙুলে আঙুল
পর্ব (২৭)

দুই ঘণ্টা যাবৎ শূভ্রা ও সঞ্জয়ান এক রুমে একসাথে আছে। এরমধ্যে এক সেকেন্ডের জন্যও শূভ্রার কান্না বন্ধ হয়নি। অবিরাম সেই কান্নার শব্দ ক্ষীণ হয়ে আসলেও কানে বাজছে খুব। সঞ্জয়ান দূরে দাঁড়িয়েও লক্ষ্য করল, মেয়েটা কাঁপছে। চোখ, মুখ ভিজে লাল হয়ে গেছে। হেঁচকি উঠামাত্র সে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। বিরক্ত ও বিস্ময় নিয়ে স্বগোতোক্তি করল, ‘ একটা মানুষ এতক্ষণ কাঁদে কিভাবে? ক্লান্তি লাগে না? ‘ সে দরজার দিকে মুখ করে দাঁড়াল। সিটকানি খুলতে গিয়ে মনে পড়ল, ঐপাশটায় বাবা চেয়ার নিয়ে বসেছিল। এখনও আছে নাকি বুঝার জন্য দরজায় আড়ি পাতল। তখনই মায়ের গলা শুনতে পেল। তিনি বলছেন,
” এখানে বসে ঝিমুচ্ছেন যে! রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ুন। ”

এবার বাবার গলা ভেসে এলো। তিনি উত্তরে বলছেন,
” আমি যাই আর তোমার ছেলে ফাঁকি দিক, তাই না? ”
” কাকে ফাঁকি দিবে? ”
” নিজেকে। ”
” কিভাবে? ”
” সে তুমি বুঝবে না। যাও এখান থেকে। ”

সঞ্জয়ান জানে, তার মা কখনও বাবার সাথে তর্ক করে না। উঁচু স্বরে কথাও বলে না। যদি মনে হয় তিনি ভুল বলছেন তাহলে মা চুপ থাকেন। পরবর্তীতে নিজের মতো করে ভুলটা সুধরে দেন। তাই ভাবল, মা চলে যাবে। কিন্তু যাননি। তার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে জিজ্ঞেস করলেন,
” বুঝব না কেন? ”
” অল্প বয়সে বিবাহের সুধা পান করলে বাসর রাতের সুমিষ্ট স্বাদ অনুভব করতে পারে না। তুমি পারনি, তোমার ছেলেও পারবে না। ”
” আমার ছেলে কি অল্প বয়সে করেছে? আবারও ওর বয়স ভুলে যাচ্ছেন। ”
” ভুলে যাইনি। শরীরের নয় ওর মনের বয়সের কথা বলছি। তাছাড়া আমার সাথে তুলনা করলে তো শরীরের বয়সও কম হয়। ঠিক বললাম তো, আদুরী? ”

এখানে কথা-বার্তা থেমে গেল। সঞ্জয়ানেরও মনোযোগ সরে গেল। আপনচিন্তায় বিভোর হয়ে যাচ্ছে, প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে অজান্তেই, ‘ মনেরও বয়স হয়! সেই বয়স বাড়ানোর কৌশল কেমন? নিয়ম কী হয়? ‘ অচেতন হয়ে অসাবধানে হাঁটার ফলে বিছানার সাথে ধাক্কা খেল অকস্মাৎ! শব্দটা হালকা হলেও শূভ্রা ভয়ে চমকে ওঠল। অশ্রু ভর্তি চোখ জোড়া মেলে চেয়ে আছে সঞ্জয়ানের দিকে। জিজ্ঞাস্য দৃষ্টি। সে প্রথমে হকচকিয়ে গেল। পর মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
” এখনও কোনো উপায় খুঁজে পাইনি। ”

সমুদ্রের জলে সূর্যের আলো পড়লে যেমন ঝিলিক দিয়ে উঠে শূভ্রার চোখের অশ্রুরাও তেমন ঝিলিক দিয়ে উঠে কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। ক্লান্ত অথচ তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
” আমি বাড়ি যাব। ”

সঞ্জয়ানের ভেতরটা বাতাসের মতো দুলে ওঠল। নিজের অপরাধটা প্রাণ ও শরীরসহ সমুখে দেখা দিচ্ছে যেন! ভুলের ভেলায় ভেসে বিশাল মাপের অন্যায় নামক সমুদ্রে পতিত হওয়া মুহূর্তটা মস্তিষ্কে আরও একবার বিজলির মতো জ্বলে ওঠল। সে অস্থির কিন্তু নরম স্বরে বলল,
” তুমি কোনো উপায় পেলে, বলো আমাকে। ”

তার বাক্যার্থে সন্ধি তৈরির ইচ্ছা। দুষ্কর্মটা ঢাকার প্রচেষ্টা। আরও কিছু মুহূর্ত কেটে গেল চুপচাপ, নীরবে। কান্নার শব্দটা একেবারে মিইয়ে এসেছে। সঞ্জয়ান আড়চোখে তাকাল পাশে। সে ধীর কদমে বিছানার এককোণে বসেছিল উপায় খোঁজার মাঝে। শূভ্রার উল্টোপাশে। দূরত্ব মেপে নিয়ে। দেখল, কান্না থামার সঙ্গে চোখের পানিও ফুরিয়ে এসেছে। চোখ বন্ধ করে ঝিমুচ্ছে। একপাশে হেলছে একটু একটু করে। যেকোনো মুহূর্তে পড়ে যাবে। সঞ্জয়ান সাবধান করতে চেয়ে বলে ফেলল,
” শাড়িটা বদলে ঘুমাও। ”

শূভ্রা আবারও ভয়ে চমকে ওঠল। উদ্ভ্রান্তের মতো চারপাশে দৃষ্টি বুলাচ্ছে। সঞ্জয়ান পাশ থেকে বলল,
” ভূত না আমি কথা বলেছি। ”

শূভ্রা অবোধের মতো চেয়ে আছে। মুহূর্তটাকে মাথায় সেঁট করার সময় পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে পাল না। তার চোখে ঘুমের ঝাঁপি নেমে এলো। চোখজোড়া আলগোছে বন্ধ হতে শুরু করলে সঞ্জয়ান পুনরায় বলল,
” শাড়িটা বদলে ঘুমাও। ”

বন্ধ চোখজোড়া খুলে গেলেও মস্তিষ্ক সজাগ হলো না ঠিকমতো। অশান্ত, অভদ্র মেয়েটা প্রথমবারের মতো সঞ্জয়ানের কথা শুনল। বিনাবাক্যে আদেশ পালনে তৎপর হলো। গোসল খানার দিকে হাঁটা ধরলে সঞ্জয়ান পিছু ডাকল,
” দাঁড়াও। ”

শূভ্রা থামল। সঞ্জয়ান বিছানা থেকে উঠে নিজের আলমিরাহ’র দিকে ছুটে চলল ব্যস্ত চালে। তার মন বলছে, মা-বাবা এত আয়োজন করেছে, মেয়ের কাপড়-চোপড়ের ব্যবস্থাও করে থাকবে। তেমন হয়ে থাকলে, কাপড় তার আলমিরাহতেই থাকবে। সে চট করে পাল্লা মেলল। নিচের তাক ছেড়ে উপরের তাকে চোখ যেতেই তার মনের ভাবনা সত্যি হয়ে গেল। ভাঁজ করে রাখা তিনটা সুতির শাড়ি। সে একটা ছোঁ মেরে নিয়ে শূভ্রার দিকে বাড়িয়ে বলল,
” এটা পরো। ”

কথাটা বলেই বুঝল, শূভ্রার কানে ঢোকেনি। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। সঞ্জয়ান মৃদু স্বরে ডাকল,
” শূভ্রা? ”

এক ডাকে কাজ হলো। সে চোখ মেলেছে। সঞ্জয়ান শাড়িটা এগিয়ে দিয়ে আরও একবার বলল,
” এটা পরে আসো। ”

শূভ্রা কাপড় নিয়ে সামনে এগুনোর পরিবর্তে বুকে জড়িয়ে ধরে আবারও চোখ বন্ধ করে ফেলল। এই পর্যায়ে বিরক্তের ছায়া নামল সঞ্জয়ানের মুখজুড়ে। ইচ্ছে হলো ধমক দিতে। পরক্ষণে দমিয়ে ফেলল। আশঙ্কা করল, ঘুম ভেঙে গেলে এই মেয়ে কান্না-কাটি জুড়ে দিবে। বাড়ি যাওয়ার জেদ ধরবে। তাই রাগ সংবরণ করে নরম স্বরে বলল,
” এটা পরে এসে ঘুমাও। বিছানা সাজানোই আছে। ”

বেশ কয়েক বার বলার পর শূভ্রা স্নাগারে ঢুকল। সঞ্জয়ান বিশাল বড় ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করতে পেরেছে এমনভাবে শান্তির নিশ্বাস ফেলল। উপলব্ধি করল, এমন নিশ্বাস তার ব্যবসা সামলাতে গিয়েও ফেলতে হয় না। সে ক্লান্তভাবে বিছানায় এসে বসল। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকতে তার চোখদুটিও ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে এলো। পুরোপুরি ডুবে যাওয়ার আগে মনে পড়ল শূভ্রার কথা। ঘুম ছুটে গেল তৎক্ষনাৎ। ঝটিতে তাকাল স্নাগারের দিকে। দরজাটা বন্ধ। মেয়েটা এখনও বেরুচ্ছে না কেন? শাড়ি বদলাতে এত সময় লাগে? সে ঠিক করল, শূভ্রাকে ডাকবে। দরজা পর্যন্ত গিয়েও থেমে গেল। শাড়ি পরায় তার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। কাপড়ের দৈর্ঘ্য বেশ! সময় লাগতেও পারে। সে নিজেই নিজেকে আশা দিয়ে শান্তকরণ করল। কিন্তু বেশিক্ষণ টিকল না। প্রায় আধ ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরও শূভ্রা বেরুচ্ছে না। সে ভয় পেয়ে গেল। একই সাথে অনুমান করল, এই মেয়ে ভেতরেই ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই দরজায় আঘাত করে ডাকল,
” শূভ্রা? দরজা খোল। জলদি। ”

লাগাতার দরজা ধাক্কানোর শব্দের মধ্যে আরেকটা শব্দও মিশে গেল। সেই শব্দটা সঞ্জয়ানের কানে গেল না। ডাকাডাকি থামল, শূভ্রা বেরিয়ে এলে। তার আধো চোখ মেলে কান্না প্রায় গলায় বলল,
” আপনি আমার রুমে কী করছেন? বাজারে যান। বি’র’ক্ত করবেন না। ”

বলতে বলতে সে বিছানার দিকে দৌড়ে গেল। বালিশের প্রয়োজনবোধও করল না। এলোমেলোভাবে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল ধপাস শব্দে। সঞ্জয়ান নিজ জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে আছে। অবাক চোখে চেয়ে দেখছে শূভ্রাকে। শাড়ি, গয়না কিছু খুলেনি। আগের মতোই পরে আছে সব। তাহলে এতক্ষণ ভেতরে কী করছিল? ভাবনাগুলো মস্তিষ্কে উদ্ভুত হতে ঠোঁটদুটি অজান্তেই উত্তর করল, ‘ ঘুমাচ্ছিল। ‘ তারও বেজায় ঘুম পেয়েছে। চোখের পলক মেলে রাখা দায়। সে ভেবেই পাচ্ছে না, হুট করে এমন দুর্দমনীয় ঘুম এলো কোত্থেকে। তার তো রাত জাগা অভ্যাস আছে। সঞ্জয়ান নিজের ঘুমের জায়গা খুঁজতে ব্যস্ত হলো। শূভ্রা বিছানায় এমনভাবে শুয়েযে যে, সে ঘুমাতে চাইলে বেকায়দায় পড়ে যাবে। অন্য কোথাও শুতে হবে। বাইরে? বাবা আছে যে! নিশ্চিত, বাবার সাথে মাও আছে। তাহলে উপায়? একমাত্র মেঝে। সে অসন্তুষ্ট মনে নিচে বিছানা করল। শোয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। সেই মুহূর্তে তার নজর গিয়ে পড়ল শূভ্রার পায়ে। বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে লাল রঙের তরল বেয়ে পড়ছে। আলতা? না, র’ক্ত। সঞ্জয়ান ভয় পেয়ে গেল। হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল ঠিক শূভ্রার পায়ের কাছে। আলতো স্পর্শ করতে গিয়ে সর্বাঙ্গ শিরশির করে ওঠল! একটু নয় অনেকটায় জ’খ’ম হয়ে গেছে। নখটা উল্টে গেছে সম্পূর্ণ। থে’ত’লে যাওয়া মাংসটাও র’ক্তে ডুবে আছে। এখনই চিকিৎসা প্রয়োজন। নাহলে র’ক্ত ঝরেই যাবে। সঞ্জয়ান অনিচ্ছায় দৌড়ে গিয়ে ক্লিনজার, মলম, তুলো ও ব্যান্ডেজ নিয়ে এলো। ক্লিনজার দিয়ে তুলো ভিজিয়ে আ’ঘা’তে স্পর্শ করতে শূভ্রা নড়ে ওঠল। পা টেনে নিয়ে গড়িয়ে গেল বিছানার মাঝামাঝি। অগত্যা সঞ্জয়ানকে বিছানায় বসতে হলো। শূভ্রার পায়ের র’ক্ত পরিষ্কার করতে নিলে সে আবারও টেনে নিল। এবার সে শক্ত করে পা চেপে ধরল। টেনে এনে রাখল নিজের কোলে। র’ক্ত পরিষ্কার করে মলম লাগানোর সময় শূভ্রা পিটপিটে তাকাল। পা সরিয়ে নেওয়ার জন্য মোচড়ামুচড়ি শুরু করে চিৎকার করল,
” সাজনা শাক! ছাড়ুন, আমি ঘুমাব। ”

সে ছাড়ল না। ব্যান্ডেজটা এত শক্ত করে বাঁধল যে শূভ্রা ঘুমের ঘোরেও ব্যা’থা’য় কাতরে ওঠল। ক্ষীণ স্বরে আ’র্ত’চিৎকার করল।

____________

অরুণিমা ভেবেছিল, বিয়ে ভেঙে দেওয়ায় হয়তো সঞ্জয়ান তাকে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দিবে। স্বর্ণলতায় ঢোকা নিষেধ করে দিবে। তেমনটা হয়নি। স্বর্ণলতার সামনে দাঁড়াতে, অন্যান্য কর্মচারীরা সাদরে গ্রহণ করে। তার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে নিজেদের কাজে মশগুল হয়। অনেক দিন পর কাজে প্রবেশ করায় একটু সমস্যা হচ্ছিল, ভুল হচ্ছিল। অন্যরা সেটাকেও খুশিমনে সামলে নেয়। নতুন করে শিখিয়ে দেয়। অদৃশ্যভাবে এদের মধ্যে সঞ্জয়ানের ছায়াটাকেই দেখতে পেয়েছে। কাজ শেষে যখন বাইরে বেরুল তখনই মনটা খারাপ হয়ে গেল। আগের মতো বাবা তার অপেক্ষায় নেই। সে মাথা নিচু করে শ্বাসরুদ্ধ করে কলেজের ফটকের দিকে এগুচ্ছে। সহসা মাইমূনের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। অরুণিমা থমকে গেল। পেছন ফিরতে দেখল, সে কলেজের প্রশাসনিক ভবন থেকে বেরিয়ে আসছে। দ্রুত কদমে তার সামনে এসে দাঁড়াতে জিজ্ঞেস করল,
” তুমি? ”

মাইমূন হালকা হেসে বলল,
” তোমার অপেক্ষা করছিলাম। ”
” এখানে? কেন? ”

মাইমূন সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যুত্তর করল না। অরুণিমার মুখের দিকে গভীর দৃষ্টি রেখে বলল,
” তুমি খুশি হওনি? আমি ভেবেছিলাম, খুব খুশি হবে। ”

অরুণিমা অপ্রস্তুত হেসে বলল,
” তোমাকে এখানে দেখিনি কখনও। ”
” তোমার মানা ছিল, তাই আসিনি। দেখনি। ”

চলবে

[ মা অসুস্থ, হাসপাতালে ছোটাছুটি চলছে। তাই লেখার সময় করে উঠতে পারিনি। আশা করছি, আমার ভালোবাসার পাঠকগণ বুঝবেন। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here