আঙুলে আঙুল পর্ব ২০

0
404

আঙুলে আঙুল
পর্ব (২০)

অরুণিমার মোবাইল বন্ধ পেয়ে সঞ্জয়ানের মনে যে দুশ্চিন্তার ঝড় ওঠেছিল, তা থামাতে কল দিয়ে বসে অসীউল্লাহকে। তিনি চিন্তিত স্বরে জানান, অরুণিমা অসুস্থ। জ্বর-ঠাণ্ডায় একদম কাহিল! বিছানা থেকে উঠতে পারছে না। যদি কিছু দিন ছুটি পাওয়া যায়, তাহলে মেয়েটা সুস্থ হয়ে ফিরবে। সঞ্জয়ান সঙ্গে সঙ্গে ছুটি মঞ্জুর করে ও পরবর্তী দিনই তাকে দেখতে আসে বাসায়। অরুণিমার সাথে দেখা হওয়ার পূর্বে শূভ্রার সাথে দেখা হয়ে যায়। মেজাজটাও বিগড়ে যায়। নাহলে যে বাড়িতে অরুণিমার মতো মিষ্টি মেয়ে থাকে সেই বাড়িতে রুক্ষ ভাষায় কথা বলে কেউ? অন্যরা বললেও সে কখনই বলত না।

নাজিয়া বেগম বিস্কুটের প্যাকেটটা আঁচলের তলায় লুকিয়ে ঘরে ঢুকলেন। সঞ্জয়ানের সামনে দিয়ে লাজুক ভঙ্গিতে হেঁটে যেতে ধরলে সে বলল,
” চাচি, আমি অরুণিমাকে দেখতে এসেছিলাম। যদি ওর কাছে নিয়ে যেতেন। ”

এমন বিনয়ীসহিত অনুরোধ শুনে তিনি থামলেন। ম্লান স্বরে বললেন,
” ও তো বাসায় নেই, বাবা। ”

সঞ্জয়ান বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল। বিস্ময়াপন্ন হয়ে সুধাল,
” কোথায় গেছে? ”
” ডাক্তার দেখাতে। ”
” একা? ”
” না। ওর বাবার সঙ্গে। ”

সঞ্জয়ানের চিন্তা ভাব দূর হলো। টুলে বসল ধীরে ধীরে। মনে মনে ঠিক করল, অরুণিমার সাথে অসীউল্লাহকেও কয়েক দিন ছুটি পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিবে। প্রায় আধ ঘণ্টা পর অসীউল্লাহ মেয়েকে নিয়ে বাড়িতে ফিরলেন। তাকে ভেতর রুমে রেখে এসে সঞ্জয়ানের সামনে এসে দাঁড়ালেন। সে কুশল বিনিময় সম্পন্ন করে জিজ্ঞেস করল,
” ডাক্তার কী বলেছে, চাচা? ”
” ওষুধপত্র দিয়েছে। নিয়ম করে খাওয়ালেই এক-দুই দিনের মধ্যে সেরে যাবে। ”

বেশ কিছুক্ষণ কথা-বার্তা চালিয়ে যাওয়ার পর কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটি এলো। অরুণিমার সান্নিধ্যে দাঁড়ানোর সুযোগ পেল। সঞ্জয়ান কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে বলল,
” জ্বরটা কি ভয় থেকে এলো? ”

অরুণিমা চাহনি উপরে তুলল। ক্লান্ত চোখ জোড়ায় অসীম বিস্ময়! বিচলিত স্বরে সুধাাল,
” ভয় পাব কেন? ”

অসুস্থ হওয়ায় মাইমূনের বিষয়টা সরাসরি তুলল না। বলল
” অহীদুলের জন্য। নিশ্চয় খারাপ ব্যবহার করেছে? ”

অরুণিমার বিচলিত ভাবটা ঢাকা পড়ল। শুকনো ঠোঁটজোড়া টেনে হাসার চেষ্টা করে বলল,
” না, খারাপ ব্যবহার করেননি। পুলিশ মানুষরা তো একটু অমন হয়। ”
” পছন্দ হয়েছে? ”

অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন শুনে অরুণিমা বিব্রত বোধ করছে। দৃষ্টি নামিয়ে নিল। পুরো শরীরটা হালকা নাড়িয়ে ভালো করে বসার চেষ্টা করছে এমন ভাব। সঞ্জয়ান উত্তরের আশায় থাকলেও ধৈর্য হারিয়ে ফেলল। নিজ থেকেই বলল,
” আমি শুনেছি, মিয়া ভাইকে নিয়ে অহীদুলের মনে একটা ভুল ধারণা তৈরি হয়েছে। এর জন্য দায়ী আমি। আমার আগে থেকে এই বিষয়টা বলে রাখা উচিত ছিল। তুমি চিন্তা করো না, আমি সব ঠিক করে দিব। ”
” প্রয়োজন নেই। ”

সঞ্জয়ান প্রথম থেকেই অরুণিমার দিকে চেয়ে ছিল। এবার দৃষ্টিটা আরও প্রখর ও অভিনিষ্ট হলো। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,
” বুঝতে পারিনি। কিসের প্রয়োজন নেই? ”

অরুণিমা দুর্বল স্বরে পরিষ্কার ভাবে বলল,
” আপনার দায়ের ভার কমানোর প্রয়োজন নেই। আপনার এই পুলিশ বন্ধুটি একটু বেশিই সময় সচেতন মানুষ। আমি হয়তো মানিয়ে নিতে পারব না। ”

সঞ্জয়ান মনে মনে বলল, ‘ ঠিক সময়ে তোমাকে নয়, অহীদুলকেই মানিয়ে নেওয়ার অস্থিরতায় ভোগাবে। ‘ সামনাসামনি বলল,
” ভেবে বলছ? ”

উত্তরটা মুখে এলো না। মাথা কিঞ্চিৎ দুলাতে সঞ্জয়ান রুম থেকে বেরিয়ে আসে। অসীউল্লাহ বাইরে থেকে কথা-বার্তা শুনেছিলেন। তিনি বললেন,
” আমার মেয়ের পছন্দ না হলে বাদ দিন, স্যার। আরও পাত্র আছে। ”
” আগে সুস্থ হোক, তারপর নাহয় অন্য পাত্রের ছবি দেখাবেন। ”

পরের দিন এক ভ্যান সাজনা গাছের কচি পাতা পাঠিয়ে দিল অরুণিমাদের বাসায়। তাই দিয়ে নাজিয়া বেগম তিনবেলা ভাজা বড়া, ভাজি, ঝোল করে রেঁধে দিচ্ছেন শূভ্রার পাতে। প্রতিবেলায় একই জিনিস দেখে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠল। বিরক্ত ঝাড়তে অসীউল্লাহ আশ্চর্যের মুখ বানিয়ে বললেন,
” এটা না তোর প্রিয়? তাহলে রাগ দেখাচ্ছিস কেন? ”

শূভ্রা তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করল,
” এ কথাটা তোমাকে কে বলেছে, বাবা? ”
” সঞ্জয়ান স্যার। তার কাছে নাকি খেতে চেয়েছিস তাই বেশি করে পাঠিয়েছে। ”

মেয়ের দিক থেকে মুখ সরিয়ে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন,
” শেষ হওয়ার আগে আমাকে জানিও। স্যার বলেছেন, আবার পাঠাবেন। ”

___________

অরুণিমা পুরোপুরি সুস্থ। ক্যান্টিনের কাজে যোগ দিয়েছে গতকাল থেকে। অসীউল্লাহ রাতের খাওয়া শেষ করে মেয়েকে ডেকে আনলেন নিজ রুমে। অহীদুলের ছবি ও জীবন বৃত্তান্ত ফেলে দিলেন তার সম্মুখে। বাকি তিনজনের ছবি একত্রে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
” দেখ তো মা কাকে পছন্দ হয়। ”

অরুণিমার মুখমণ্ডলে ক্লান্তভাব লক্ষ্যে আসে। অনাগ্রহের চাহনি রেখে বলল,
” তুমি দেখ, বাবা। তোমার পছন্দই আমার পছন্দ। ”

অসীউল্লাহ খুশি হলেন। চোখে ও ঠোঁটে গর্বের দ্যুতি প্রকাশ হলো। বুকের ভেতরটা পরিপূর্ণ হলো অপরিমেয় কৃতজ্ঞতা ও তৃপ্তির ওজনে।

অরুণিমার সামনে বাবা ছবিগুলো এক এক করে দেখছিলেন। এই দৃশ্যটি তার দু’খানা নয়ন সয়তে পারল না। কোথাও বেলের কাঁটার আঘাতের মতো ব্যথা অনুভব করছে। যাকে প্রশ্রয় দেওয়ার মতো সাহস হলো না। অনুমতি না নিয়ে চট করে সরে এলো।

__________

সঞ্জয়ান ঘুমাতে যাওয়ার পূর্বে আধ ঘণ্টার মতো বাবার রুমে বসে থাকে। এই সময়টায় স্বর্ণলতা স্বামী সেবায় ভীষণ ব্যস্ত থাকেন। মুনসুর সাখাওয়াত দুইবার গোসল করায় অভ্যস্ত। বয়স বাড়ার সাথে সাথে নানান রোগে আক্রান্ত হয়েছেন তিনি। এগুলোর মধ্যে সর্দি ও টনসিল ফুলে যাওয়ার সমস্যাটাও আছে। এজন্য রাতে গোসল করতে দেন না স্বর্ণলতা। মুনসুর সাখাওয়াতের মনের শান্তির জন্য নরম কাপড় ভিজিয়ে গলা থেকে কোমড় অবধি মুছে দেন। আজও তাই করছিলেন। হঠাৎ বললেন,
” ঐদিকের খবর কী? আমরা কবে যাচ্ছি? ”

শুরুতে সঞ্জয়ান বুঝতে পারেনি। সংশয় নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” কোন দিকে? কোথায় যাবে? ”
” তোর শ্বশুরবাড়িতে। বিয়ের তারিখ ঠিক করতে হবে না? নাকি আমাদের ছাড়া বিয়েটাও করে ফেলবি? ”

স্বর্ণলতার রসিকতায় মৃদু হাসল সে। সলজ্জায় বলল,
” এমনটা কখনও হবে না, মা। ”
” তাহলে নতুন কিছু বলছিস না যে? ”

সঞ্জয়ান নিরুত্তর। নিজেকে অরুণিমার অযোগ্য হিসেবে সনাক্ত করার পরও যাচাই করার সুযোগটা হাত ছাড়া করেনি। অসীউল্লাহকে দেওয়া চারটি ছবির মধ্যে একটা তার। বড্ড যত্ন ও সাজসজ্জা করে তুলেছে। ছাব্বিশ বছরে অর্জন করা সকল গুণ ও দক্ষতাও কাগজে ছাপা অক্ষরে লিপিবদ্ধ করেছে। তবুও ডাক পড়েনি। তার ধারণাই হয়তো ঠিক ছিল, অসীউল্লাহর মেয়ের সামনে সে অযোগ্য, অপছন্দনীয়। তালিকার বহির্ভূত! এই প্রথম নিজের কাজ নিয়ে আফসোস হচ্ছে। মায়ের উপর রাগ হচ্ছে। কেন সে, ব্যবসাতে উৎসাহিত না করে পুলিশ কিংবা সামরিক বাহিনির প্রতি প্রলুব্ধ করল না!

” তোর ফোন বাজছে। ”

মায়ের কণ্ঠ পেয়ে কেঁপে ওঠল। আপন ভাবনায় মশগুল হয়ে চেতনা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল সে। দ্রুত হস্তে পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে অরুণিমার বাবার কল। ধরতে ওপাশ থেকে শুনতে পেল,
” স্যার, ভুল করে আপনার বন্ধুর পরিবর্তে আপনার ছবি দিয়ে ফেলেছেন। ”

সঞ্জয়ানের বুকের রক্ত ছলকে ওঠল বুঝি! সূচ ঢোকার মতো অনুভূতি হলো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলল। লজ্জা ও বেহাপনার সর্বোচ্চ ডালটায় উঠে চড়ে বলল,
” ভুল করে না, ইচ্ছে করেই দিয়েছি। ”

এবার ঐপাশটাও কয়েক সেকেন্ডের জন্য নিশ্চুপ, শব্দহীন হয়ে গেল। আচমকা নীরবতা ভেঙে এলো,
” আপনিও কি…”

কথাটা সম্পন্ন হলো না। সঞ্জয়ান টের পেল অর্ধ সম্পন্ন বাক্য উচ্চারিত মানুষটার গলা কাঁপছে। সে দ্রুত জানাল,
” হ্যাঁ। যদি আপনারা রাজি থাকেন। ”
” রাজি হব না কেন? এ যে আমাদের পরম সৌভাগ্য! ”

অসীউল্লাহর মতো সঞ্জয়ানেরও নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে। আবেগপ্রবণ হলেও বিবেচনার নিয়ন্ত্রণ হারায়নি। বিচক্ষণের গুণটাকে প্রয়োগ করে বলল,
” শুধু আপনি রাজি হলে হবে না, চাচা। অরুণিমার মত জানাটা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। ”
” আপনাকে ফিরিয়ে দেওয়ার সাহস আছে ওর? আমার তো মনে হয়, মনে মনে আপনাকেই পছন্দ। সেজন্যই অন্য ছেলেকে পছন্দ হচ্ছে না। বিয়ে করতে রাজিও হয়েছিল আপনার কথায়। ”

অরুণিনা তাকে চাই। মনে মনে তাকে পছন্দ করে রেখেছে। কথাগুলো এত ভালো লাগল! এতদিন মনের মধ্যে যে অনিশ্চয়তা ও অশান্তি নিয়ে ঘুরছিল তা এক নিমিষেই ধূলোর মতো মিলিয়ে গেল। মনের গোপন ও বিলাসপূর্ণ বাগানটায় বসন্তের হাওয়া বয়তে শুরু করেছে, কোকিলও তো ডাকছে! সঞ্জয়ান চোখ বন্ধ করে সেই হাওয়া থেকে প্রেমের ঘ্রাণ টেনে নিল, কোকিলের কণ্ঠে ভালোবাসার গান শুনতে শুনতে বলল,
” আমি কালই অরুণিমার সাথে দেখা করতে চাই। ”
” অবশ্যই করবেন। কখন আসবেন বলুন, আমিও বাসায় থাকার চেষ্টা করব। ”
” বাসায় না, বাইরে। আপনি দয়া করে অরুণিমাকে আমার কথা বলবেন না। চমকে দিতে চাই। ”
” আপনি যেটা ভালো মনে করেন। আমার মেয়েটাকে তো আগেই আপনার হাতে তুলে দিয়ে ছিলাম। এবার সাক্ষী নিয়ে সারাজীবনের দায়িত্ব দেওয়ার অপেক্ষায়। ”

______________
অরুণিমা ক্যান্টিন বন্ধ করে কলেজ থেকে বেরিয়ে এসেছে। রাস্তা ফাঁকা। তেমন লোকজন নেই, খালি রিকশাও না। সে একপাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। আজও তাকে সেই কফি হাউজটায় যেতে হবে। অহীদুলের মতো অন্য একটি অপরিচিত ছেলের সাথে দেখা করতে হবে। ভাবতেই পেটের ভেতরটায় মোচড় দিয়ে ওঠল, জোর করে অপছন্দ খাবার খেলে যেমন হয় ঠিক তেমন! রিকশার অপেক্ষা করতে করতে একটা ভয়ঙ্কর দৃশ্য বিজলির মতো মস্তিষ্কে জ্বলে উঠে হারিয়ে গেল। দৃশ্যটা কাল রাতের ঘুমের মধ্যে দেখা স্বপ্নের অংশ। যার কেন্দ্রিয় চরিত্রে ছিল মিয়া ভাই। মিয়া ভাইকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছে, কথাটা যতবার মনে পড়েছে ততবারই শিউরে ওঠেছে। মাত্রই আরও একবার শিউরে ওঠল। অরুণিমা হাতের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে দেখল, ছুরির ফলার মতো সবকটা লোম দাঁড়িয়ে গেছে। ঠিক যেন, মিয়া ভাইয়ের গলায় ধরে রাখা ছুরিটা! সে চোখ বন্ধ করে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা সিনেমার মতো চলতে লাগল। একটা বিশাল ও উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় হাঁটু গেঁড়ে বসে আছে মাইমূন। তার চোখদুটো সূর্যের মতো তীক্ষ্ণ ও উত্তপ্ত। চাহনিতে ব্রহ্মাণ্ড পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ক্ষমতা। সেই মানুষের গলায় ছুরি ধরে আছে একটি নারী হাত। মুখটা অরুণিমার দৃষ্টি সীমার বাইরে হলেও মাইমূন ঠিক চিনে। তাই তো চেঁচিয়ে বলছে, ‘ আমাকে শেষ করে দাও, নাহয় আমার সাথে সাথে পুরো পৃথিবী ধ্বংস করে দিব। ‘

চলবে

[ ভেবেছিলাম এই পর্বে বর্তমান সামনে আসবে। কিন্তু আসেনি, মাঝে-মধ্যে কাহিনি আমার ইচ্ছার বাইরেও ছুটে যায়। আজও তেমনটায় হয়েছে। আগামী পর্বে বর্তমান আসবে ইনশাআল্লাহ। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here