আঙুলে আঙুল পর্ব ১৮

0
385

আঙুলে আঙুল
পর্ব (১৮)

” আমি আইনি ব্যবস্থা করতে পারব। কিন্ত আমার মনে হচ্ছে, বেশিদিন জেলে আটকে রাখা যাবে না। এই ধরনের ছেলেগুলো শোধরানোর পরিবর্তে আরও বেশি উগ্র হয়ে যায়। মিয়া ভাইয়ের ক্ষেত্রেও যদি তেমনটাই হয়, তাহলে অরুণিমার জন্য বিপদ হবে। ”

অসীউল্লাহ আগের চেয়েও অধিক ঘাবড়ে গেলেন। সভয়ে সুধালেন,
” তাহলে উপায়? ”

সঞ্জয়ানের গম্ভীর ভাব আরও দৃঢ় হলো। মুক্ত হাওয়ায় দৃষ্টি স্থির রেখে কিছুক্ষণ ভাবল। অত:পর টেনে টেনে বলল,
” দুটো উপায় আছে। ”
” কী কী উপায়? ”

অসীউল্লাহর চোখে-মুখে দারুন আগ্রহ। অভিব্যক্তিতে তাড়াহুড়া। ধৈর্যের অভাব।

” প্রথম উপায় হলো, পরিবার নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়া। ”
” আমাকেও যেতে হবে? ”
” হ্যাঁ। আমার মনে হয়, মিয়া ভাই শুধু অরুণিমাকে নয় আপনাদের সকলকেই নজরে রেখেছে। তাই কেউ একজন এখানে থাকলে তাকে অনুসরণ করে ঠিকই অরুণিমাকে খুঁজে বের করবে। আর একবার যদি বের করে ফেলে তাহলে সমস্যা বাড়বে। খারাপ কিছু ঘটিয়ে ফেলবে। ”

অসীউল্লাহ একটু শান্ত হলেন। মনে মনে বর্তমান ও ভবিষ্যতের হিসাব-নিকাশ করে বললেন,
” হুট করে সবাইকে নিয়ে যাওয়া তো সম্ভব না, স্যার। আপনি তো আমার সম্পর্কে সবই জানেন। ”

সঞ্জয়ান মাথা নেড়ে সায় দিল। সেও মনে মনে ধারণা করেছিল, তিনি রাজি হবেন না। তাই পরবর্তী উপায়টা উল্লেখ করল,
” তাহলে অরুণিমাকে বিয়ে দিয়ে দিন। ”

অসীউল্লাহর বুকের জমিন ভূমিকম্পের মতো ঝাঁকি খেল। প্রথমটার থেকেও এটা বেশি অসম্ভব ও কষ্টদায়ক বোধ হলো। অরুণিমা তার পরিবারকে এমনভাবে দেখাশোনা করছে, আর্থিকভাবে সাহায্য করছে যে, তিনি ভুলেই গেছিলেন অরুণিমা তার মেয়ে। ছেলে নয়। তাকেও একদিন বিয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে হবে। সঞ্জয়ান বলল,
” চাচা, আপনি সময় নিন। ভালো মতো ভাবুন, তারপর আমাকে জানাবেন। দুটোতেই পূর্ব প্রস্তুতির ব্যাপার আছে। সেটা আমি সামলে নিব। ”

অসীউল্লাহ খুব বেশি সময় নিলেন না। ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে বললেন,
” অরুণিমা মেয়ে মানুষ। বিয়ে তো এক সময় দিতেই হবে। সেটা যদি আজ হয়, বিপদ থেকে উদ্ধার হতে পারে তাহলে তাই হোক। ”

একটু থেমে পুনরায় বললেন,
” কিন্তু এত অল্প সময়ে ওর যোগ্য ছেলে পাব কোথায়? ”

সঞ্জয়ান জিজ্ঞেস করল,
” কেমন ছেলে চান, বলুন। আমার সাথে পরিচয় আছে এমন কয়েকজন বিয়েতে আগ্রহী। পাত্রী খুঁজছে। ”

অসীউল্লাহ গুরুত্বপূর্ণ আলাপটা শেষ করতে অনেকটা সময়ই ব্যয় করলেন। বেশ ভেবে ভেবে যে কিছু পছন্দ জানালেন তাতে সঞ্জয়ান বুঝতে পারল, তিনি পুলিশ কিংবা সামরিক বাহিনীতে কর্মরত আছে এমন ছেলে চাচ্ছেন। তার মতে, এই দলের ছেলেই তার মেয়েকে সকল আপদ-বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারবে, সুখে রাখতে পারবে। সে এই আলাপটায় আর আগ্রহ দেখাতে পারছে না। তাই ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল,
” আমার দুজন বন্ধু আছে। একজন পুলিশে আরেকজন সামরিকে। দুজনেই ভালো পদে আছে। অরুণিমার ছবি দিয়েন, আমিও ওদের ছবি আর জীবন বৃত্তান্ত দিব। দুই দিক থেকে পছন্দ হলে তবেই সামনাসামনি দেখা-সাক্ষাৎের ব্যবস্থা করা যাবে। ”

কৃতজ্ঞতার ভারে অসীউল্লাহর বুক ভারী হয়ে এলো। চোখদুটো চিকচিক করছে। মাথা নেড়ে কিছু একটা বলতে চাইলেন, সুযোগ পেলেন না। সঞ্জয়ান বলল,
” আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, চাচা। এবার আসি। ”

__________
অরুণিমা প্রতিদিনের মতো আজও কাজ শেষ করে বাবার সাথে বাড়ি যাচ্ছে। সহসা নজর পড়ল রাস্তার ওপাশে। একটা অল্প বয়সের ছেলে তাদের সমানে সমানে হাঁটছে। মাঝেমধ্যে এদিকে তাকাচ্ছেও। তার একবার মনে হলো, বাবাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে এই ছেলেটিকে চিনেন নাকি। পর মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলল। দূর থেকে চেহারা পুরোপুরি বুঝা না গেলেও চেনা লাগছে। কোথাও দেখেছে হয়তো। সে বাবার সাথে সামনে এগুতে এগুতে মনে করার চেষ্টা করছে, কোথায় দেখেছে। মস্তিষ্কে প্রচণ্ড চাপ দিয়েও যখন মনে করতে পারল না তখন এড়িয়ে যেতে চাইল। সম্পূর্ণরূপে ভূলে যেতে চাইল। বাবার সাথে কথা-বার্তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তে কানে অস্পষ্টভাবে একটা কণ্ঠস্বর ঢুকল। কণ্ঠধারী বলছে, ‘ মিয়া ভাইয়ের জন্য ডাব কাটো। পানি ঠাণ্ডা না হলে কিন্তু ব্যবসা বন্ধ। ‘ অরুণিমা চট করে পেছনে তাকাল। কণ্ঠটা অন্য কারও নয়, তাদের অনুসরণ করা ছেলেটিরই। মুখটায় আরেকবার তাকাতে ঝাপসা স্মৃতি স্পষ্ট হলো। মনে পড়ে গেল, এই ছেলেটিকে মিয়া ভাইয়ের ক্লাবেই দেখেছিল। পূর্বে কথা হয়নি তাই মস্তিষ্কে ঠিকমতো বসতে পারেনি। অরুণিমা অজান্তেই দাঁড়িয়ে পড়েছিল। ছেলেটিও রাস্তার অন্য পাশ থেকে তার দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে ছিল। দুজনের নীরব দৃষ্টি মিলে থাকল অনেক্ষণ।

” ডাব খাবি, মা? ”

বাবার প্রশ্ন শুনে অরুণিমার দৃষ্টি নড়ল। মনোযোগ সরল। ভ্যান ভর্তি ডাবের দিকে চেয়ে উত্তর করল,
” না। ”

অসীউল্লাহ মৃদু হেসে বললেন,
” আমার কাছে চাইতে লজ্জা করছে? ”
” লজ্জা করবে কেন? ”
” বড় হয়ে গেছিল যে! ”

অরুণিমা বাসার দিকে মুখ করে বলল,
” লজ্জা করছে না, আমার সত্যি খেতে ইচ্ছে করছে না, বাবা। চলো। ”
” তুই যা, আমি আসছি। ”

অসীউল্লাহ মেয়ের বাঁধা শুনলেন না। দ্রুত কদমে রাস্তা পার হয়ে ডাবওয়ালার কাছে পৌঁছে গেলেন। অরুণিমাও বাবাকে একা ফেলে বাসায় যেতে সা হস পেল না। আড় চোখে তাকাল সেই ছেলেটির দিকে। সে ডাব নিয়ে রাস্তা পার হয়ে তার দিকে হেঁটে আসছে। যত নিকটে আসছে অরুণিমার বুকের কাঁ পন ততই বাড়ছে। এতদিন বেশ ছিল, মিয়া ভাইকে যেমন আশপাশে দেখেনি তার ছেলেপিলেকেও না। আজ হঠাৎ করে তার পিছু নিয়েছে কেন? ছেলেটি তার পাশে এসে থামল। এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে কেনা ডাব খাচ্ছে। অরুণিমা ভীত মনে ভাবছে, ‘ ডাব তো মিয়া ভাইয়ের জন্যে কিনেছে। তাহলে এই ছেলে খাচ্ছে কেন? তাহলে কি মিয়া ভাইয়ের নাম করে আমার মনোযোগ আকর্ষণ করতে চেয়েছিল? ‘

” বাসায় যেতে বললাম না? যাসনি কেন? ”

অরুণিমা খানিক হকচকিয়ে গেল। বাবার এক হাত চেপে ধরে বলল,
” তোমাকে রেখে যেতে ইচ্ছে করছিল না, বাবা। ”

অসীউল্লাহ মেয়ের কান্ডে হেসে ফেললেন। ডাব হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
” একটাই এনেছি। শেষ কর। তারপর বাসায় ঢুকি। ”

অরুণিমা বিনা বাক্যে ডাব খেতে শুরু করল। অসীউল্লাহ চুপচাপ মেয়ের খাওয়া দেখছেন। দেখতে দেখতে সঞ্জয়ানের প্রস্তাবের কথা স্মরণ হলো। বাসায় যাওয়ার ধৈর্য হলো না। মেয়ের এই খুশি সময়টুকুতে বিয়ের কথাটা তুললেন। অরুণিমার ডাব খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। বিস্ফারিত নেত্রে বাবার দিকে চেয়ে থাকল কয়েক মুহূর্ত। বাবাকে কিছু বলার আগে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল পাশে। ছেলেটি নেই। সে ধপ করে নিশ্বাস ফেলল। ঘোর বি পদ থেকে র ক্ষা পেল যেন! তারপরে ডাব ফেলে দিয়ে বাবাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল বাসায়। পথের মধ্যে শুধু বলল,
” এসব কথা বাইরে কেন? বাসায়ও তো বলা যায়। ”

অসীউল্লাহ বাসায় গিয়ে জামা-কাপড়ও বদলালেন না। মেয়েকে নিজের ঘরে টেনে নিয়ে দুয়ার এঁটে দিলেন। খাটে বসিয়ে সঞ্জয়ানের সাথে হওয়া গুরুত্বপূর্ণ আলাপের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করলেন। অরুণিমা সবটা শোনার পর শুধাল,
” সঞ্জয়ান স্যারও চান, আমি বিয়ে করি? ”

অসীউল্লাহ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝালে সে পুনরায় বলল,
” কিন্তু বাবা, আমি এখন বিয়ে করে চলে গেলে তোমার উপর অনেক চাপ পড়বে। ”
” সে আমি সামলে নিব। তাছাড়া তুই তো আর সারাজীবন আমাদের সাথে থাকবি না। তাহলে এখন আটকে রেখে কী লাভ। সঞ্জয়ান স্যার নিজে পাত্র খুঁজে দিবেন। ভালোই হবে। আমি নিশ্চিন্তে তোকে বিদায় করতে পারব। ”

অরুণিমার বিয়েতে মত নেই। বাবার সামনে না ও করতে পারছে না। তারমধ্যে সঞ্জয়ানও এটাই চায়। এই কয়দিনে তাকে কাছ থেকে দেখেছে, জেনেছে। বাবার মুখে শুনে শুনে যতটা ভালো মনে করেছিল, তার থেকেও অধিক ভালো হিসেবে প্রমাণ পেয়েছে। উচ্চ মনস্তাত্ত্বিক লোক। ভালো-মন্দের পার্থক্যটা খুব ভালো করে বুঝে, মানে। জাতে ভেদাভেদ খুঁজে না। প্রয়োজনে হাজির, জানপ্রাণ দিয়ে দিতে রাজি। অথচ ঠিক করে তাকিয়ে দেখেও না যার জন্য এতকিছু সে তার আপন কেউ নাকি। বিপরীতে প্রত্যাশাও নেই। অরুণিমা দৃষ্টি নত করে বলল,
” তোমাদের যা ভালো মনে হয়, তাই করো। আমি আপত্তি করব না। ”

___________
অসীউল্লাহর হাতে চারটে ছবি। প্রথম ছবির ছেলেটাকে তার ভীষণ পছন্দ হয়ে গেল। পরবর্তী ছবিগুলো দেখার প্রয়োজন মনে করল না। সঞ্জয়ানকে জানাল এই ছেলেটির সাথে দেখা করতে চায়। সে উত্তরে বলল, মিয়া ভাইয়ের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিচ্ছে। তাই এখন ছেলেপক্ষকে বাড়িতে ডাকা ঠিক হবে না। পাত্র ও পাত্রী আলাদা কোথাও দেখা করে প্রাথমিক আলাপ সারুক। অসীউল্লাহ তার এই পরামর্শটাকে যৌক্তিক মনে করে রাজি হয়ে গেলেন। তার দেওয়া ঠিকানা ও সময়টা মেয়েকে বলে দিলেন। অরুণিমা সেই ঠিকানার উদ্দেশ্যে পরের দিন বিকেল বেলা রওনা হলো। কলেজ থেকে বেরিয়ে একটা খালি রিকশা ডেকে নিল। একটা কফি হাউসের সামনে নেমে পড়ে ভাড়া মেটানোর সময় দৃষ্টি গিয়ে পড়ল রাস্তার অপর পাশে। মুহূর্তে তার বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠল। সেই ছেলেটি! আজও তাকে অনুসরণ করছে। অরুণিমার ইচ্ছে হলো, যেই রিকশায় করে এসেছে সেই রিকশায় করে ফিরে যায়। তেমনটা সম্ভব হলো না। ভাড়া মেটানো অবস্থায় অপরিচিত পুরুষ কণ্ঠ পেল,
” আসসালামু আলাইকুম। ”

অরুণিমা পেছন ফিরল। একটা সম্পূর্ণ অচেনা মানুষ। গায়ে পুলিশের পোষাক। ঠোঁটে হাসি থাকা সত্ত্বেও মুখের ভাবটা ভীষণ গম্ভীর। অচেনা মানুষটি নরম স্বরেই জিজ্ঞেস করল,
” অরুণিমা? ”
” জি। ”
” আমি অহীদুল। এসআই অহীদুল ইসলাম। ”

অরুণিমা নাম শুনে বুঝতে পারল, সে এই অহীদুলের সাথেই দেখা করতে এসেছে। সংকোচে বলল,
” সরি, আমার একটু দেরি হয়ে গিয়েছে। ”
” একটু না পুরো বিশ মিনিট দেরি করেছেন। আমি এক ঘণ্টার সময় নিয়ে এসেছিলাম। সেখান থেকে বিশ মিনিট অলরেডি চলে গেল। ”

তার বাক্যভাবে আফসোস-আক্ষেপের স্পর্শ। অরুণিমার মনে অনুতাপের ধোঁয়া ছড়িয়ে দিল। জোর করেও আর কোনো কথা বের করতে পারল না গলা দিয়ে। অহীদুল নিজেই বলল,
” ভেতরে গিয়ে বসি? কফি চলে এসেছে। ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। ”

অরুণিমা ঘুরে দাঁড়াল। অহীদুলের পেছন পেছন ভেতরে ঢোকার পূর্বে তাকে অনুসরণ করে আসা ছেলেটি তড়িঘড়িতে ভেতরে ঢুকে পড়ল।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here