আঙুলে আঙুল পর্ব ১৬

0
452

আঙুলে আঙুল
পর্ব (১৬)

‘ আগে শুধু মনে রাজত্ব করেছ, এখন থেকে শরীরেও রাজত্ব করছ। এভাবে হুট করে আমার সবকিছু দখল করে নেওয়া কি ঠিক হলো? আমি যে দেউলিয়া হয়ে গেলাম! ভালোবাসা, আমাকে দেউলিয়া করে যে ঋণী বানিয়ে দিলে, এর যথাযথ সম্মান দিতে চাই। সেজন্য তোমার পাশে থাকা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইচ্ছে করছে, তোমাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভেঙে ফেলি। প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা এত কষ্ট! আগে জানলে কখনই করতাম না। ভালেবাসা, এই কষ্ট থেকে আমাকে মুক্তি দেও। তোমার পাশে থাকার অনুমতি দেও। কথা দিচ্ছি, শুধু পায়ে পা মিলিয়ে চলব। আঙুলে আঙুল রাখার বায়না করব না। বায়না তো মেয়েদের মানায়, তাই না? ‘ শোনো, আমার জ্ঞান ফেরার পর ডাক্তার বলেছিল, বাইরে আমার বউ দাঁড়িয়ে আছে। আমি গিয়ে পেলাম না কেন? তার জন্য আমি বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে রাজি আর সে কিনা কয়েক মিনিট অপেক্ষা করতে পারল না? এ তো ভারি অন্যায়! তাকে বলো আমার মনখারাপ হয়েছে। ‘

চিরকুটে লেখা মাইমূনের মনের কথাগুলো পড়া শেষ করে অরুণিমা দুমড়েমুচড়ে হাতের মুঠোয় চেপে রাখল। প্রতিশ্রুতি ভাঙার কথা বলে আবারও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। মানুষটা কি বোকা হয়ে গেল? অরুণিমা বিরক্ত নিয়ে ছেলেটির দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল,
” এটা নিয়ে কতদিন ধরে ঘুরছ? ”
” ছয় দিন। ”

অরুণিমা ছোট্ট নিশ্বাস ছাড়ল। যা ভেবেছিল তাই। মিয়া ভাই জেনে গেছে, সেই রক্ত দিয়েছে। সেজন্যই মাথায় চড়ে বসেছে। সে যেমন বিরক্ত হলো তেমন খুশিও হলো। মাথায় চড়ে বসলেও নিজ প্রতিশ্রুতি থেকে সরে যায়নি। যোগাযোগ তার সাথে ঠিকই করেছে। কিন্তু নিজের ইচ্ছায় নয়, অরুণিমার ইচ্ছায়। যদি না সে এই ছেলেটিকে ডাকত, কাগজখানা তার কাছে পৌঁছাত না। এই কৃতজ্ঞতায় দুমড়ানো কাগজটাকে টেনে টেনে ঠিক করার চেষ্টা করল। তারপর জিজ্ঞেস করল,
” তোমার কাছে কলম আছে? ”

ছেলেটি উত্তর দিল না। পকেট থেকে সরাসরি একটি কলম বের করে তার হাতে দিল। সে কাগজটি উল্টাল। অন্য পাশে লিখল, ‘ আগে নিজের যত্ন নিন। মদ, সিগারেট থেকে দূরে থাকুন। ‘ লেখা শেষে কাগজ ও কলম ছেলেটির হাতে দিয়ে বলল,
” তোমার মিয়া ভাইকে দিও। ”

সে মাথা নাড়িয়ে হাসিমুখে রাস্তা পার হলো। ক্লাবের ভেতর ঢুকতে অরুণিমার মনে প্রশ্ন জাগল, ‘ মিয়া ভাই সুস্থ হয়েছেন তো? জিজ্ঞেস করা হলো না! ‘

_____________
সঞ্জয়ানের সাথে দেখা হয়েছিল অনেক দিন আগে। এর মধ্যে তার দেওয়া প্রস্তাবটি অরুণিমা একদমই ভুলে গিয়েছিল। আজ মনে করিয়ে দিয়েছে তার বাবা। ক্যান্টিনের সকল কাজ সম্পূর্ণ। সাজানো-গোছানোও হয়েছে। এখন শুধু পরিচালকের দরকার। অসীউল্লাহ রাতের খাবার সামনে নিয়ে মেয়ের সাথে এই নিয়ে কথা বলছিলেন। সহসা প্রশ্ন করলেন,
” সঞ্জয়ান স্যার চাচ্ছেন আগামী সপ্তাহেই স্বর্ণলতার উদ্বোধন করতে। তুই কী বলিস? ”

অরুণিমা অবাক হয়ে বলল,
” আমি আবার কী বলব? ”
” তোর কিছু বলার নেই? ”

অরুণিমা এই বিষয়ে কথা বলতে অনিচ্ছুক, অনাগ্রহী। তাই বাবার মুখ থেকে চাহনি সরিয়ে নিল। দায়সারা গোছের মাথা নেড়ে ‘ না ‘ বুঝাতেই তিনি বললেন,
” কিন্তু সঞ্জয়ান স্যার যে, তোর মতামত চাইল? ”

অরুণিমার চোখদ্বয় আবারও বাবার দিকেই উদ্বেলিত হলো। কিছু একটা বলতে গিয়েও থমকে যেতে হলো। মনে পড়ল, সঞ্জয়ান তাকে স্বর্ণলতার দায়িত্ব দিতে চেয়েছিল। সে গুরুত্ব না দেখালেও, সঞ্জয়ান ঠিকই দেখিয়েছে। সেজন্যই আজ এই আলাপটা বাড়িতে বসেও করতে হচ্ছে। যদিও সে এই ব্যাপারটি বাবাকে বলেনি, কিন্তু অজানাও নেই। তিনি ঠিকই জানেন। হয়তো সঞ্জয়ানই বলেছে। অরুণিমাও আর ঘোরপ্যাঁচে গেল না। নি:সংকোচে মুক্ত স্বরে বলল,
” আমি উনার প্রস্তাবে রাজি না। বলে এসেছিলাম, তারপরও এটা নিয়ে কথা হচ্ছে। ”
” রাজি না কেন? ”

অসীউল্লাহর কণ্ঠে খানিক উত্তাপ। অরুণিমা টের পেল কিন্তু ঘাবড়াল না। শান্ত থেকেই জবাব দিল,
” আমার মনে হচ্ছে, উনি দয়া দেখাচ্ছেন। ”
” এটা দয়া নয়, সুযোগ। যেটা আমাদের প্রয়োজন। যদি এমনি এমনি টাকার বান্ডেল ছুঁড়ে মারত তাহলে দয়া হতো, করুণা হতো। তেমনটা তো করছেন না। তোকে কাজ দিচ্ছেন। গায়েগতরে খাটলে মাস শেষে বেতন পাবি। ”

অরুণিমা দৃষ্টি নিচু করল। একটু জোরাল স্বরে প্রত্যুত্তর করল,
” এই সুযোগটাও এখন দরকার নেই, বাবা। আমি আগে থেকেই একটা চাকরিতে আছি। বেতনও বাড়িয়েছে। ”
” বেতন বাড়িয়েছে? আমাকে বলিসনি তো! ”

বেতন সত্যি বেড়েছে নাকি অরুণিমা নিজেও নিশ্চিত নয়। তবে এই মাসের বেতনের টাকার সাথে পাঁচ হাজার অতিরিক্ত দিয়েছে। অন্য সময় বেতনটা হাতে হাতে দিলেও এবার খামে ভরে দিয়েছে। দোকানদার চাচার সামনে খাম খুলে টাকা গুণতে লজ্জা পাচ্ছিল, তাই খুলেনি। বাসায় এসে দেখে অতিরিক্ত পাঁচ হাজার টাকা। সে ভেবেছিল, কাল চাচার সাথে কথা নিশ্চিত হওয়ার পর বাবাকে বলবে। এখন বেফাঁসে বলে ফেলায় চিন্তায় পড়ে গেল। যদি বেতন না বাড়ে? চাচা ভুল করে এই টাকা দিয়ে থাকে তাহলে বাবাকে কী বলবে?

মেয়ের নীরব ভাবনার সাথে তাল মিলিয়ে বাবাও ভাবছিলেন। মলের মতো ক্যান্টিনে বারো ঘণ্টা কাজ করতে হবে না। শুধু কলেজের সময়টুকুই থাকবে। তাছাড়া অসীউল্লাহ নজরে রাখতে পারবে। প্রয়োজনে তার অবসর সময়টুকুতে মেয়ের কাজে সাহায্যও করতে পারবে। সঞ্জয়ান মানুষটা খুব ভালো। নম্র, ভদ্র, বিনয়ী। নির্লোভ ও নিরহংকারী ছেলে। এত বছর ধরে দেখছেন, কলেজে নিয়মিত যাতায়াত করতে, কখনও চরিত্রে দোষও পাননি। এমন মানুষের ছায়াতলে থাকতেও কপাল লাগে। সেই কপাল তার মেয়ের হয়েছে। সে না বুঝলেও তিনি তো বুঝছেন! নীরব ভাবনা সমাপ্তি করে তিনিই বললেন,
” বেতন কম না বেশি সেটা দেখে লাভ নেই। সঞ্জয়ান স্যারের দেওয়া চাকরিটাই তুই করবি। আমার চাওয়া এটাই। ”

অরুণিমা দ্বিমত প্রকাশ করতে চাইল। বাবার গম্ভীর মুখটায় তাকাতেই সে চাওয়া হারিয়ে গেল। চুপচাপ আনত বদনে খাওয়া শুরু করতে শুনল,
” আমি সঞ্জয়ান স্যারকে বলে দিচ্ছি, তুই রাজি। ”

____________

স্বর্ণলতার উদ্বোধনের তারিখ পড়েছিল সোমবার। টিফিন পিরিয়ডের সময়। ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষকগণ ও সঞ্জয়ানের দাওয়াত গ্রহণ করা কিছু গুণী ব্যক্তিদেরও আগমন ঘটেছে। শুরুতে অরুণিমা ভয় ও সংকোচ নিয়ে উপস্থিত হলেও ক্যান্টিনের ভেতর ঢুকতে সেটা কমে এসেছিল। এখানে সে একা নয়, আরও দুজন মহিলা ও পুরুষ আছে। তারাই রান্না-বান্না ও বেচাকেনায় থাকবে। অরুণিমা হলো তত্ত্বাবধায়ক। সঞ্জয়ান প্রথম থেকেই অরুণিমাকে সঙ্গ দিচ্ছে। তার আচরণে মনে হচ্ছে না সে মালিকপক্ষ। যেন অরুণিমার মতোই কেউ। বড্ড চেনা, পূর্বপরিচিত। দুজনের মধ্যে বেশ ভাব। সঞ্জয়ান গুণী ব্যক্তিদের বিদায় করে এসে অরুণিমার পাশে এসে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল,
” অরুণিমা, তোমার কি মনখারাপ? ”

ছাত্র-ছাত্রীদের ভেতরে ঢোকার অনুমতি পাওয়ামাত্র শূভ্রা ভিড় ঠেলে একদম সামনে দাঁড়ায়। আপুর দেখা পেতেই তার পিছু পিছু ঘুরছিল। সেসময় সঞ্জয়ান এখানে ছিল না। তাই চোখেও পড়েনি। এবার কণ্ঠ পেয়ে সে চমকে ওঠল। মুখটা দেখে নিয়ে আপুর পূর্বে সে উত্তর করল,
” জি। আপুর খুব মনখারাপ। ”

শূভ্রাকে সে অপছন্দ করলেও এবার এড়িয়ে গেল না। জিজ্ঞেস করল,
” কেন? ”
” মা, আজ সাজনা শাক রান্না করেনি যে তাই। ”

মুহূর্তে সঞ্জয়ানের চোখদুটো রক্তরাঙা হলো। দাঁতের পাটি সংলগ্ন স্থানটা শক্ত করে বলল,
” আবার বেয়াদবি করছ? এখনও শিক্ষা হয়নি তোমার? ”

অরুণিমা দুজনের মাঝে আছে। শূভ্রাকে ধমক দেওয়ার জন্য উদ্যত হলেও, দেওয়া হলো না। সঞ্জয়ানকে জিজ্ঞেস করে বসল,
” ও আগেও আপনার সাথে বেয়াদবি করেছে? ”
” হ্যাঁ, শুরু থেকেই করে আসছে। আমার তো বিশ্বাসই হয় না এই মেয়েটা তোমার বোন। না চেহারায় মিল, না ব্যবহারে। ”

শূভ্রা রাগে ফুঁসে উঠেও নিভে গেল। ছোটবেলা থেকে যে কথাটা মনে মনে ভেবে এসেছে, সেটা আজ বাইরের একজন সকলের সামনে এমন করে প্রকাশ করল? তাহলে কি সত্যি সে অন্য কারও মেয়ে? সঞ্জয়ান এখানে থেমে থাকল না। শূভ্রাকে যতবারই অন্যায় কাজে পেয়েছে ততবারই ভেবেছিল, চাচাকে বলে দিবে। কিন্তু একবারও বলেনি। অন্যভাবে সামাল দিয়েছে। সে চায়নি, চাচাকে কষ্ট দিতে, দুশ্চিন্তায় রাখতে। কিন্তু এবার নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারল না। অরুণিমাকে বিচার কাজে বসিয়ে দিয়ে একে একে শূভ্রার সবগুলো অন্যায় কাজগুলো বলতে লাগল।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here