#আঙুলে_আঙুল
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১৪)
অরুণিমা বাসায় ফিরে দেখল, শূভ্রা কাঁদছে। নিয়াজ তার বিছানায় বসে পড়ছে। চোখাচোখি হতে ইশারায় জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে। সে মুখেই উত্তর করল,
” ছোট আপুর পড়া বন্ধ। ”
অরুণিমা হিজাব খুলতে খুলতে প্রশ্ন করল,
” কেন? ”
” বাবার সাথে ঝগড়া করেছে। ”
অরুণিমার হিজাব খোলা শেষ। জর্জেটের ওড়নাটা বদলে পুরাতন ও সুতির ওড়না বুকে জড়িয়ে বলল,
” আবার? ”
নিয়াজ মুখে উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না৷ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে পড়ায় মনোযোগী হলো। অরুণিমা গোসলখানায় ঢুকে পড়ল। হাত-মুখ ধুয়ে এসে বসল শুভ্রার পাশে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
” আর কাঁদতে হবে না। আমি বাবার সাথে কথা বলছি। ”
দুই হাতে বোনের চোখের পানি মুছে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। সরাসরি বাবার রুমে না গিয়ে মায়ের সাথে দেখা করল। নাজিয়া বেগম রাতের রান্না গোছাচ্ছেন। সে পেছনে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বলল,
” মা, বাবার সাথে একটু কথা বলো তো। ”
” কোন ব্যাপারে? ”
” শূভ্রাকে নিয়ে। কথায় কথায় পড়া বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিলে কি পড়াশোনা হবে? মাথা বিগড়ে যাবে। ”
নাজিয়া বেগমের মেজাজ চওড়া হলো মুহূর্তে। ধমকের মতো করে বললেন,
” বিগড়ানোর বাকি কী আছে? ”
অরুণিমা একটু সতর্ক হলো। জিজ্ঞেস করল,
” শূভ্রা কী করেছে, মা? ”
” ও কেই জিজ্ঞেস কর। ”
মায়ের রাগের সীমা বহুদূর এগিয়ে গিয়েছে। অরুণিমা বুঝতে পেরে রান্নাঘর ত্যাগ করল চটজলদিতে। পায়ের গতি দ্রুত করে বাবার রুমে পৌঁছাল। শূভ্রার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে হলো না। তিনি নিজেই কলেজের ঘটনাটা শোনালেন। সবটা শোনার পর আপনমনে বিড়বিড় করল, ‘ মোবাইলের এত কী প্রয়োজন ছিল যে নিজেই কিনে ফেলেছে! টাকা পেল কোথায়? ‘ সন্দেহভাবটা প্রকাশ পেয়ে গেল। বাবাকে বলল,
” মোবাইলটা হয়তো শূভ্রার না। কোনো বন্ধুর হবে। ওর ব্যাগে রাখতে দিয়েছিল। ”
অসীউল্লাহ জোর দিয়ে বললেন,
” না। শূভ্রারই। ও নিজ মুখে স্বীকার করেছে। ”
” টাকা পেয়েছে কোথায়? ”
” তুই দিয়েছিস। ”
উত্তর শুনে অরুণিমা চমকাল, ঘাবড়ালও। বলতে চাইল, সে দেয়নি। কিন্তু বলা হলো না। তার আগেই মনে বাড়ি পড়ল। অনুমান করল, শূভ্রা বাঁচার জন্য মিথ্যা বলেছে। তাই চুপ করে থাকল। অসীউল্লাহ মেয়ের দিকে এগিয়ে এসে বললেন,
” তোর মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে, শূভ্রা তোকে ফাঁসিয়েছে। টাকাগুলো মোবাইলের জন্য না অন্য কিছুর জন্য চেয়ে নিয়েছে, তাই না? ”
অরুণিমা বাবার দিকে তাকাল। কী উত্তর করবে বুঝতে পারছে না। সে তো টাকাই দেয়নি। অসীউল্লাহও উত্তরের অপেক্ষা করলেন না। প্যাকেট করা মোবাইলটা মেয়ের হাতে দিয়ে বললেন,
” শূভ্রা জানে, তুই আমার কথার অমান্য করবি না কখনও। তাই মিথ্যা বলে টাকা নিয়ে মোবাইল কিনেছে। এখন ধরা খেয়ে তোর নাম বলছে। খুব চালাক হয়েছে মেয়েটা! ”
শেষ কথাটায় প্রশংসীয় নয় নিন্দার্হ বুঝাচ্ছে। অরুণিমা আগের ন্যায় অধোবদন হলে অসীউল্লাহ বললেন,
” মোবাইল যেহেতু কেনা হয়ে গিয়েছে সেহেতু এটা থাক। ফেরানোর দরকার নেই। তুই রেখে দে। ”
” আমি? ”
” হ্যাঁ, টাকা তোর। মোবাইলও তোর। ”
অরুণিমা মাথা তুলল। বোনের পক্ষ নিয়ে বলল,
” শূভ্রা শখ করে কিনেছে! আমি নিই কী করে? বাবা, মোবাইলটা ও কেই দেও। আমি বাইরে নিতে মানা করব। ”
” তুই মানা করলেই ও শুনবে? ”
বাবার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না। অসীউল্লাহ মুখ কঠিন করে বললেন,
” অনেক মাফ করেছি, আর নয়। আমি যখন বলেছি পড়া বন্ধ, তার মানে বন্ধই। ”
অরুণিমা কিছু একটা বলতে চাইল। তিনি বাঁধা দিয়ে বললেন,
” আমি ওর বাবা। ভালোবাসাটা যেমন বেশি, শাসনটাও তেমন কড়া। ”
বাবার কথার পিঠে আর কোনো কথা বলল না। তার মেজাজ এখন জ্বলন্ত কয়লার মতো। ঠাণ্ডা হলে আরেকবার অনুরোধ করে দেখবে। এমন পরিকল্পনা নিয়ে অরুণিমা নিজের রুমে ফিরে এলো। নিয়াজকে পানি আনতে বলে কৌশলে বের করল রুম থেকে। অত:পর শূভ্রাকে জিজ্ঞেস করল,
” মোবাইলটা সত্যি তোর? ”
কেঁদেকেটে শূভ্রার চোখ-মুখ ফুলে গেছে। গলা বসে গেছে। এই অবস্থায় উত্তর করল,
” হ্যাঁ। ”
” তুই কিনেছিস? টাকা পেলি কোথায়? ”
সে বন্ধু রোমানের কথা গোপন করে মিথ্যা বলল,
” জমিয়েছি। ”
অরুণিমার বুকে ও মুখে মায়ার হাওয়া বয়তে শুরু করল। দরদ ধরা পড়ছে চোখজোড়ায়। মেয়েটার মোবাইলের এত শখ যে, টিফিনের টাকা জমিয়ে মোবাইল কিনেছে! সে কান্না প্রায় গলায় বলল,
” কিন্তু বাবা তোকে এটা ব্যবহার করতে দিবে না! আরেকটু অপেক্ষা করতি, আমিই কিনে দিতাম। ”
শূভ্রা কিছু বলল না। বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে রইল। অরুণিমা অনেক্ষণ বোনের দিকে তাকিয়ে থাকল। ইচ্ছে হলো, মোবাইলটা এখনই তাকে দিয়ে দিতে। কিন্তু সাহস হলো না। বাবা জানলে, খুব রাগ করবে। কষ্ট পাবে। তাই সে নিজের ব্যবহার করা মোবাইলটা বোনের দিকে বাড়িয়ে বলল,
” তোরটা আমার কাছে থাক। তুই কিছুদিন আমারটা ব্যবহার কর। ”
আপুর এমন প্রস্তাব পেয়ে শূভ্রা ফুঁসে ওঠে বলল,
” তুমি নতুনটা নিয়ে আমাকে পুরানটা দিবে কেন? সারাজীবন কি পুরান জিনিস নিয়েই থাকতে হবে আমাকে? ”
অরুণিমা উত্তর করার সুযোগই পেল না। শূভ্রা আবার কেঁদে ওঠল। রাগ ও দুঃখ নিয়ে বলতে থাকল,
” বুঝ হওয়ার পর থেকে দেখছি, তোমার ব্যবহার করা জিনিসগুলোই আমাকে ব্যবহার করতে দিচ্ছে। কেন? আমি কি নতুন কিছু পাওয়ার অধিকার রাখি না? আমি এবাড়ির মেয়ে না?
” ভুল বুঝছিস, বোন। তুই এই বাড়িরই মেয়ে। ”
শূভ্রা বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। মুখ বাঁকিয়ে অন্যদিকে ছুটে যাচ্ছে। অরুণিমা পিছু ধরতে শুনল,
” আপু, মা খেতে ডাকছে। ”
সে পেছন ফিরল। নিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল,
” যা, আসছি। ”
ভাইকে বিদায় করে বোনের সাথে আরও কিছুক্ষণ কথা বলার ইচ্ছে ছিল। সেটা সম্ভব হলো না। শূভ্রা তাকে রেখে জোর কদমে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
_________
অরুণিমা মায়ের সাথে মিলে রাতের খাবার গুছিয়েছে। ভাই-বোনের সামনে ভাত ভর্তি প্লেট দিতে দিতে শুধাল,
” বাবাকে ডাকোনি, মা? ”
নাজিয়া বেগম রান্নাঘরের ভেতর থেকে জবাব দিলেন,
” তোর বাবা রুমে নেই। ”
” কোথায় গেছে? ”
” লেবু আনতে। ”
অরুণিমা দেয়াল ঘড়িটায় তাকাল। নয়টা পেরিয়েছে। এসময় সবজির দোকানগুলো বন্ধ করে দেয়। বিরক্ত স্বরে বলল,
” এত রাতে বাবাকে পাঠালে কেন? আমাকে বলতে। ”
” আমি পাঠাতে যাব কেন? তোর বাবা নিজেই গিয়েছে। ”
হাতে তরকারি ও নুনের বাটি নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে পুনরায় যোগ করলেন,
” এত রাতে যায়নি। আরও আগে গেছে। এতক্ষণে ফিরে আসার কথা। ”
” আসেনি তো! ”
মা, মেয়ে দুজনেই চিন্তায় পড়ল। উদ্বিগ্ন বদন নিয়ে নাজিয়া বেগম বললেন,
” কল করে দেখ, কতদূর আছে। ”
অরুণিমা তখনই রুমে ছুটে গেল। ফোনটা খুঁজে নিয়ে বাবার নাম্বারে কল ঢোকাল। প্রথম রিংয়েই ধরে ফেললেন। তাকে কিছু বলার সময় না দিয়ে ব্যস্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
” আবুল হোসেন হসপিটাল চিনিস? ”
বাবার মুখে হসপিটালের নাম শুনে আতঙ্কিত হলো। দ্রুত প্রশ্ন করল,
” হসপিটাল! হসপিটাল দিয়ে কী হবে? ”
” চিকিৎসা হবে। ”
অরুণিমার এবার নিশ্বাস বন্ধ হবার যোগাড়। শরীরে কাঁপন শুরু হওয়ার পথেই বলল,
” তুমি আবার জ্ঞান হারিয়েছ? একা গেলে কেন? আমাকে নিয়ে যেতে পারতে! ”
” আমি না অন্য একজন জ্ঞান হারিয়েছে। ”
” কার? ”
” এক মাতালের। নাম-ঠিকানা জানি না। আর জায়গা পেল না আমার রিকশার সামনে এসেই এক্সিডেন্ট করতে হলো! ”
অরুণিমা স্পষ্ট বুঝতে পারছে, তার বাবা জ্ঞানহীন মানুষটির উপর বিরক্ত। সে মোবাইল কানে ধরে ওড়না ও ব্যাগ গুছিয়ে নিল। তৈরি হতে হতে বাবাকে বলতে শুনল,
” বড় কোনো ক্ষতি তো দেখলাম না। শুধু কাঁধের দিকটা ছিলে গেছে। এতেই ছেলে অজ্ঞান! আবার ডাক্তার বলছে, রক্তও নাকি লাগবে। আমি এখন রক্ত কোথায় পাব? একা ফেলেও যেতে পারছি না। ”
অরুণিমা বাবাকে আশ্বাস দিল,
” চিন্তা করো না, বাবা। আমি আসছি। হসপিটাল কাছেই। দশ মিনিট লাগবে। ”
” তাড়াতাড়ি আয়, মা। চিন্তায় আমার প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে। ”
চলবে