আঙুলে আঙুল পর্ব ১৩

0
436

#আঙুলে_আঙুল
#পর্ব (১৩)

অরুণিমাকে নিয়ে সঞ্জয়ান কলেজের পশ্চিম দিকটায় হেঁটে এলো। এখানে ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতি কম। আশপাশটা নীরব। অন্য জায়গার মতো পরিচ্ছন্ন নয়। ইট, বালুর স্তূপ পড়ে আছে। লোহা ও কাঠের ছড়াছড়ি। অরুণিমা খেয়াল করল সামনে একটি নির্মাণাধীন ঘর। চারপাশে দেয়াল তুললেও ছাদ করা হয়নি এখনও। সেই ছাদহীন ঘরটার মধ্যেই কয়েকজন পুরুষ ও মহিলা ভাত খাচ্ছে। পরনের মলিন ও ঘামে ভেজা কাপড় দেখেই বুঝা যাচ্ছে এনারাই এই ঘরটি সম্পূর্ণ তৈরি করার কাজে লিপ্ত আছেন।

” এটা ক্যান্টিন হবে। আমার মায়ের নামে করছি। ”

সঞ্জয়ানের কথার পিঠে অরুণিমা কোনো কথা বলল না। শুধু একবার কথা বলা মানুষটির মুখটির দিকে চাইল। পর মুহূর্তে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে পুনরায় শুনল,
” স্বর্ণলতা। ”

অরুণিমা বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করার মতো উচ্চারণ করল,
” জি? ”

সঞ্জয়ান নির্মাণাধীন ঘরটা থেকে চোখ সরিয়ে আনল তার প্রশ্নকর্ত্রীর দিকে। মিষ্টি হেসে বলল,
” আমার মায়ের নাম স্বর্ণলতা। ক্যান্টিনের নামও স্বর্ণলতা রাখব। ”
” শুধু স্বর্ণলতা? ”
” হ্যাঁ। আমার মায়ের পরিচয় আমার মা-ই। অন্য কিছুর প্রয়োজন পড়ে না। ”

অরুণিমা বিস্মিত হলো। এমন অজেয় জয়কে অর্জন করা নারীটির ব্যাপারে কৌতূহলী হলো। তাকে দেখা ও জানার জন্য দুর্দমনীয় উৎসাহটা প্রকাশ পেল শুধু হাসিতে। শব্দ সাজিয়ে প্রশ্ন করা হলো না, ইচ্ছে প্রকাশ হলো না। শুধু বলল,
” সুন্দর। ”
” আমার মায়ের দায়িত্ব নিবে? ”

অরুণিমা চমকাল। বিস্ফারিত নেত্রে চাইলে সঞ্জয়ান বলল,
” স্বর্ণলতার দায়িত্ব নিবে? ”

প্রশ্নের অর্থটা বুঝতে পারার পরও অরুণিমার দৃষ্টি বদলাল না। চোখের পলক পড়ল না। পূর্বের মতো চাহনি রেখেই সুধাল,
” আমি? ”

সঞ্জয়ান হাসি মুখে বলল,
” জি, তুমি। এখানের প্রত্যেকটা ছেলে-মেয়ে মেধাবী। সেই মেধাকে উন্নত করার জন্য স্বাস্থ্য ঠিক রাখা জরুরি। আর স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য সঠিক খাদ্য। অরুণিমা, আমি চাই এখানের খাবারগুলো স্বাস্থ্যসম্মত ও স্বল্পমূল্যের হবে। তার জন্য আমার একজন বিশ্বস্ত ও সুহৃদয়ের মানুষ চাই৷ সেই মানুষটি যদি মায়ের জাত হয় তাহলে আমি নিশ্চিন্তে স্বর্ণলতার দায়িত্ব অর্পণ করতে পারব। ”

অরুণিমার ভ্রূর মাঝে ভাঁজ পড়ল। ঠোঁটের হাসিখানা মুছে গেল। পুরো মুখজুড়ে অসন্তুষ্টের ছায়া নেমে এলো। সঞ্জয়ান টের পেয়ে বলল,
” এর বিনিময়ে তুমি যা চাও, তাই দেওয়া হবে। ”
” এজন্য আমার সিভি চেয়েছেন? ”

সঞ্জয়ান এতক্ষণ ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে তৈরি করা ঘরটির দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার সম্পূর্ণ ঘুরে দাঁড়াল অরুণিমার দিকে। বলল,
” না। ওটা এমনি বলেছিলাম। এই দায়িত্বের জন্য কাগজের প্রয়োজন নেই। ”
” প্রয়োজন পড়লেও আপনি পেতেন না। ”
” তুমি কি আমার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিচ্ছ? ”

অরুণিমা সরাসরি উত্তর দিতে পারল না। এই মানুষটাকে সে সম্মান করে, শ্রদ্ধাও। উপরে উপরে না, একদম মন থেকে। সঞ্জয়ান তার নীরবতার অর্থ বুঝতে পারলেও হার স্বীকার করল না। বলল,
” এতে কিন্তু তোমারও অনেক সুবিধা আছে। বাবার কাছাকাছি থাকতে পারবে সারাক্ষণ। আল্লাহ না করুক, আবারও যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন তোমাকে কারও কল পেয়ে ছুটে আসতে হবে না। ”

সে অরুণিমার মুখের দিকে তাকাল। মুখের ভাব একটুও বদলায়নি। পুনরায় বলল,
” শূভ্রাও তো এখানে পড়ে, তাই না? ওকেও চোখে চোখে রাখতে পারবে। ”
” শূভ্রার সাথে আপনার পরিচয় আছে? ”

সঞ্জয়ান এক মুহূর্তের জন্য থামল। চোখে-মুখের হাসি, বিনয়ভাব হারিয়ে গেল এক নিমিষে। এই মেয়েটার সাথে পরিচয় হওয়ার মুহূর্তটুকু একদমই মনে করতে চায় না সে। মেয়েটাকেও না।

” আপু? ”

একটি ভিন্ন মেয়ে কণ্ঠে অরুণিমা ও সঞ্জয়ান দুজনেই চমকাল। একই সাথে পেছনেও তাকাল। মেয়েটি আর কেউ নয়, শূভ্রা। ছোটবোনকে দেখে অরুণিমা যতটা খুশি হলো সঞ্জয়ান ততটাই অখুশি হলো। শূভ্রা কয়েক হাত দূর থেকে আপুকে খুঁজে পেয়েছে। এবার দৌড়ে একদম এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,
” কখন এসেছ? আমার সাথে দেখা করোনি যে? ”

তার কণ্ঠে একই সাথে উচ্ছাস, অভিমান। অরুণিমা বোনের স্কার্পটা মাথায় তুলে দিল। স্নেহাতুর গলায় বলল,
” খুঁজেছিলাম, পাইনি। কোথায় ছিলি? ”

শূভ্রা হাত নেড়ে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। সহসা কিছু মনে পড়েছে এমনভঙ্গিতে বলল,
” আপু, পঞ্চাশটা টাকা দাও তো। ”
” পঞ্চাশ টাকা? কী করবি? ”
” লাগবে। দেও না। ”

অরুণিমার মনখারাপ হয়ে গেল। তার কাছে পঞ্চাশ টাকা নেই। পঁচিশ টাকা আছে। সেখান থেকে পনেরো টাকা লাগবে মলে ফেরত যেতে। বাকি দশ টাকা দেওয়া যায়। কিন্তু মেয়েটা কি এতে খুশি হবে?

তার ভাবনার মধ্যে সঞ্জয়ানের গলা পেল,
” এই নেও। ”

শূভ্রা বাঁকা চোখে তাকাল সঞ্জয়ানের বাড়িয়ে দেওয়া পঞ্চাশ টাকার নোটটির দিকে। বলল,
” আপনার টাকা নিব কেন? ”
” আমার টাকা না, তোমার আপুর টাকা। ”
” আমার আপুর টাকা আপনার কাছে রাখে? ”
” না। আমার দরকার ছিল, তাই নিয়েছিলাম। এখন ফিরিয়ে দিচ্ছি। ”

শূভ্রা এক ঝলক আপুর দিকে তাকাল। তারপরে নির্দ্বিধায় টাকা নিয়ে মাঠের ভেতর চলে গেল। অরুণিমা লজ্জিত মুখে বলল,
” আমি কাল বাবার কাছে পাঠিয়ে দিব। ”
” আমি তোমার হাত থেকে নিব। ”
” আবার কলেজে আসব? সময় নেই। বাবার কাছ থেকে নিয়েন, প্লিজ? ”

সঞ্জয়ান মৃদু হাসল। দুই হাত পকেটে পুরে বলল,
” আমার মায়ের দায়িত্ব নিচ্ছ, আমাদের দেখা তো হবেই। সময় নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। ওটা আমার দায়িত্বে থাক। তুমি বরঞ্চ আমার মায়ের যত্ন নিয়ে ভাবো। ”

অরুণিমাকে রেখে সঞ্জয়ান হাঁটা ধরল। কলেজের মাঠ ও গেইট পেরিয়ে রাস্তায় নেমে এলো। ফুটপাত ধরে একটু এগুলে একটি চায়ের দোকান। পা দুটোকে সেদিকেই চালিয়ে নিল। দোকানে কোনো লোকজন নেই। দূর থেকে একটা মেয়েকে দেখা যাচ্ছে। পরনে রুহানিয়া কলেজের পোষাক। সে হাতঘড়িটা দেখল, টিফিন পিরিয়ড শেষের দিকে। এই সময় মেয়েটি বাইরে কী করছে? সে কৌতূহলবশত দ্রুত কদমে দোকানের একদম কাছাকাছি পৌঁছাল। তখনই শুনল,
” আমি বেনসন চেয়েছি, আপনি ডার্বি দিয়েছেন কেন? মেয়ে দেখে কী ভেবেছেন? আমি চিনি না? ঠকিয়ে দিবেন? ”

দোকানদার মুখ কালো করে বেনসনের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করলে মেয়েটি পুনরায় বলল,
” একটা না, দুইটা দিন। ”

কণ্ঠ শুনে মেয়েটিকে চিনে ফেলেছে। নাম ধরে ধমক দিতে চেয়েও দিল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। শূভ্রা সিগারেটের দাম শোধ করে পেছনে ঘুরতে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠল। সিগারেটসহ হাতটা জামার আড়ালে লুকিয়ে মাথা নিচু করে ফেলল চটজলদি। একবার ইচ্ছে করল, সিগারেট দুটো ফেলে দৌড় দেয়। পরক্ষণে মত বদলাল। দোকানদারকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য তৈরি হতে গিয়েও থেমে গেল। মনে পড়ে গেল, অনেক দিন আগের কথা। এই লোকটা তাকে ধমকেছে, নালিশ করেছে। সে কেন এনাকে সম্মান দেখাবে? দেখাবে না। শূভ্রা মাথা উঁচু করল। সঞ্জয়ানের চোখে চোখ রেখে একটা সিগারেট মুখে নিল। একপাশে ঠোঁট টেনে বিদ্রুপাত্মক হাসল ও উদ্ধত চালে হেঁটে চলে গেল গেইটের দিকে।

________

টিফিন পিরিয়ডের পর প্রথম ক্লাসে স্যারের সঙ্গে অসীউল্লাহকে দেখা গেল। শূভ্রা প্রথম দিকের দ্বিতীয় সারিতে বসেছে। বাবাকে দেখেই বুঝে ফেলল, সঞ্জয়ান তার নামে আবারও নালিশ করেছে। কিন্তু এবার সে জিতে যাবে। কারণ, সিগারেট তার কাছে নেই। সে খায়নি, ফলে মুখে গন্ধও হবে না।

অসীউল্লাহ স্যারের ইশারা পেয়ে তল্লাশি শুরু করল। প্রথমে ছেলেদের ব্যাগ ও তাদের পকেট ভালো করে খোঁজ চালাল। তাদের শেষ হতে মেয়েদের দিকে শুরু করল। মেয়েদের বেলায় শুধু ব্যাগটাই দেখছিল। শূভ্রার কাছে আসতে সে নিজে ব্যাগের চেইন খুলে দিতে চাইল। অসীউল্লাহ থামিয়ে ব্যাগটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলেন। চেইন খুলে ভেতরে হাত দিতে তার মুখের ভাব কঠিন হলো। মুহূর্তেই চোখের বর্ণ রক্তিম হলো। ফিসফিসে কিন্তু কাঁপন ধরানোর মতো করে বলল,
” ছুটি হলে বাসায় যাবি। আজ প্রাইভেটে যেতে হবে না। ”

ভয়ে শূভ্রার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এলো। গলা শুকিয়ে গেলো। বুকের ভেতর অবিরত কম্পিত হচ্ছে। বাবা বাকি মেয়েদের ব্যাগ পরীক্ষা করে বেরিয়ে যেতে সে নিজের ব্যাগের ভেতর হাত ঢোকাল। তার স্পষ্ট মনে আছে, সিগারেট দুটো তার বন্ধু স্বপনকে দিয়েছে। তাহলে ব্যাগে আসল কী করে? হাতের মধ্যে একটা চারকোণা শক্ত বাক্স আসতে তার বুকের জমিনে ভূমিকম্প সংঘটিত হলো। সিগারেট লুকালেও মোবাইলটা লুকানো হয়নি। বাবা সিগারেট না মোবাইল পেয়ে অগ্নিশর্মা হয়েছে। যেটা বাবা নয়, তার বন্ধু রোমান উপহার দিয়েছে।

চলবে

#’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here