জীবনে প্রথম ক্রাশ খাইলাম এক পোলারে দেইখা। পাশের বাসায় নতুন উঠেছে। মা আর ছেলে কথা বলতে আসছিলো। আমি কাকের মতো গান গেয়ে সবে মাত্র গোসল থেকে বের হইসি তখনই বসার রুম থেকে ডাক পড়ল। আম্মা সারাক্ষণ ডাকে। খাইতে গেলে ডাকে, ফোন টিপতে গেলে ডাকে, গোসল করতে গেলে ডাকে। ডাকের শেষ নাই। আমি তো মনে করলাম এখনও হুদাই ডাকতেসে। ওড়না ছাড়া চলে গেলাম। গিয়েই টাসকি খাইলাম। মা ছেলে আমার দিকে তাকাই আছে। আমি তো ভাবলাম মাটিটা একটু ফাঁক হইতো। ঢুইকা পড়তাম। যা হোক, মাটিতে না ঢুকে আপাতত এক দৌঁড়ে রুমে ঢুকলাম। ইস রে, একেবারে ফালুদা হয়ে গেলাম। আম্মা আবার ডাক দিল। এবার ওড়না পরে শালীন হয়েই বের হলাম। আমি যাইতেই আম্মা বলল, সালাম দে। পাশের বাসার আন্টি।
– আসসালামু আলাইকুম।
আন্টি থেকে চোখ আপনাআপনি ক্রাশের উপর পড়ল। আহা! কি মুখ! ঠিক যেন চেরি ফল। এ্যাঁ! হঠাৎ কিছু না ভেবেই বলে ফেললাম, আন্টি, ওনাকে কি কেউ মেরেছে? ছেলে কথা শুনে আমার দিকে বেকুবের মতো তাকালো। আন্টি হেসে বললেন, কেন?
– গাল গুলো কেমন লাল লাল হয়ে আছে! মনে হচ্ছে যেন চেরি ফল।
আম্মা আমার কথা শুনে মনে হয় ভেতরে ভেতরে আঁতকে উঠেছিল। আমি আর কিছু বললাম না। কারণ ততক্ষণে আমার নিজের গালই চেরি ফল হয়ে গেছে। যাগ্গে। সেই হল প্রথম দেখা।
তারপর রোজ সকালে দেখা হতো স্কুলে যাওয়ার সময়। আমার স্কুল আটটায়। তার কলেজ নয়টায়। সে বের হতো সাড়ে আটটায়। আমিও তক্কে তক্কে থাকতাম। দরজার কাচে চোখ লাগিয়ে রাখতাম। কখন বের হবে। আম্মা চিল্লাই বলতো, তুই কি স্কুল যাবি?
– এই তো বের হচ্ছি।
যেই না সে দরজা খুলত, আমিও দরজা খুলে বের হতাম। ফলে চোখাচোখি। আহা, কি এক অনুভূতি!!!! সে একবার তাকিয়েই চোখ নামিয়ে ফেলতো। তারপর আমার সামনে দিয়ে বেরিয়ে যেতো। আমিও পিছু পিছু বের হতাম। ও সাইকেলে চড়ে চলে যেতো আর আমি রিকশাকে ডাক দিতাম, এই খালি…… আহা খালি তো আমার মন! প্রেমহীন ভালোবাসা হীন খালি এই হূদয় পূর্ণ করো তোমার ভালোবাসায়!!!!
তবে এই ভালোবাসা বেশিদিন টিকলো না। একদিন আম্মা আব্বাকে বলেই ফেললো, আপনি একদিন ছোঁয়ার স্কুলে যাইয়েন তো।
– কেন?
– জেনে আসিয়েন তো স্কুল কি এক ঘন্টা পিছালো কি না। প্রায় দেখি মেয়ে সাড়ে আটটায় বের হয়।
ব্যাস!!!! আমার সব খালি হূদয়ে আম্মা পানি ঢেলে পূর্ণ করে দিল। আমি আগের মতো সাড়ে সাতটায় স্কুলের জন্য বের হতে লাগলাম। মাঝে এক সপ্তাহ আর দেখা নাই।
.
.
.
.
ছুটির দিনেও আম্মার অত্যাচার থেকে রেহাই নাই। শুক্রবার আম্মা আমাকে দিয়ে এক গাদা কাপড় ধোয়াইলো। কি আরামের একটা ঘুম দিতেসিলাম। ক্রাশের লগে আমার বিয়া। আমি কবুল বলে দিসি, সে দুইবার কবুল বলল, শেষ বারে এসে কইল, ছোঁয়া তুই উঠবি না পানি ঢালমু। আমি বেকুবের মতো ক্রাশের দিকে তাকাই কই, কি কও জামাই। বোধ করি স্বপ্নের কথা বাস্তবে বলে ফেলেছিলাম। তার ফলে আজকে কানটা মনে হয় দেড় হাত লম্বা হয়ে ঝুলছে। যাই হোক, আম্মা ছাদে পাঠাইলো কাপড় নিয়া। এইটা আমার বড়ো বিরক্ত লাগে। একগাদা কাপড় ধুইলেই দোতলা বেয়ে পাঁচতলার ছাদে যাইতে হয়। আমার মতো শুকনা মেয়ে মাসে এমন ব্যায়াম করলে তো আমসি হয়ে যাবো। তখন হালকা বাতাসেই উইড়া গিয়া উগান্ডায় পড়মু। হায় রে!!! কি কষ্ট!!!!! তবু সকল কষ্ট বুকে পাথর চাইপা ছাদে উঠলাম। ছাদে উঠতে উঠতে নিজেকে বাপ্পারাজের মতো দুঃখী লাগতেছিল। তাই মনের দুঃখে নিজে গান বানাই নিজেই কম্পোজ করে গাইতে লাগলাম-
”হায়রে দুঃখের সাগরের জীবন
কাপড় রোদে দিতে ছাদে যাওন
আর ভালা লাগে না।”
গাইতেসি আর কাপড় মেলতেসি। নিজের গান শুইনা নিজেরই কান্দন চলে আসতেছিলো। কিন্তু কিছু একটা দেখে সত্যিই খুশিতে কান্দন চলে আসলো। মনে মনে কইলাম, লাভ ইউ আম্মা। চোখের সামনে ক্রাশ আমার দিকে টাসকি খাইয়া খাঁড়াই আছে। তারে দেইখা এক মুহুর্ত ভাবলাম, সে কি আমার কোকিল কন্ঠ শুইনা ফেলল!!! যাগ্গে, শুনলে শুনসে। বৌয়ের কন্ঠ কেমন তা তো জামাইর জানা দরকার। তাই না! আমি গুন গুন করতে করতে কাপড় মেলতেসি আর সে মনোযোগ সহকারে ফোন টিপতেসে। আমি একই কাপড় কুঁচকাইতেসি, মেলতেসি আর তার দিকে তাকাই আছি। তার হুঁশ নাই। আমারও হুঁশ নাই যে এতক্ষণে খালি একটা বিছানার চাদর মেলসি। পাশ দিয়ে একটা কাক কা কা করে উড়ে যাইতেই হুঁশ হলো। তখন দ্রুত কাপড় সব মেলে দিয়া চলে আসতেছিলাম, সে আমারে পেছন থেকে মধুর স্বরে ডাকল, শুনুন।
কন্ঠ শুনে মনে লাড্ডু ফুটল৷ আহা!!! কি কন্ঠ!? গলা তো নয় যেন মধুর ঝর্ণা!!! আমি নিরীহ প্রাণীর মতো তার দিকে তাকালাম। সে কাছে এসে বলল, আমরা আসলে ওয়াই ফাই নিতে চাচ্ছিলাম। তখন আঙ্কেল মানে আপনার আব্বু বললেন যে আপনাদের রাউটারটা ইউজ করতে। আঙ্কেলকে পাসওয়ার্ডের কথা বলতেই উনি বললেন পাসওয়ার্ড নাকি আপনি জানেন। তাই ওয়াই ফাই পাসওয়ার্ডটা যদি দিতেন।
তার মধুর কন্ঠে আমার মাথায় তখনই সব দুষ্ট বুদ্ধি হাত পা ছুড়ে নাচতে নাচতে আসলো। ইচ্ছে করতেসে একটা ডিংকাচিকা নাচ দেই। কিন্তু ক্রাশের সামনে নাচাটা ঠিক হইবো না তাই নিজেকে সংযত করে বললাম, দিবো, কিন্তু আপনাকে কাছে আসতে হবে। সে আমার দিকে সন্ধিহান চোখে তাকিয়ে বলল, কেন? আমি চোরা চোরা ভাব নিয়ে বললাম, কেউ পাসওয়ার্ড শুনলে ভুল ভাবতে পারে। সে সোজা সরলের মতো বলল, এতে ভুল ভাবার কি আছে। পাসওয়ার্ডই তো চাইছি।
– আপনি সত্যিই চান আমি জনসম্মুখে বলি? আচ্ছা আপনি যখন চান তখন বলছি। I love you.
সে শোনার সাথে সাথে শক খেল। যেন আমি তারে কারেন্টের তারে প্যাঁচাই প্লাগে কানেকশান দিয়ে দিসি। সে বলল, কি? আমি মনে মনে বললাম, বয়রা হয়ে গেল নাকি!? আমি চিৎকার করে বললাম, I love you. সে আবারও আমারে প্রশ্ন করসে, I love you? তখনই যত বিপত্তি বাজলো। নিপার মা কাপড় শুকাড় দিতে আসছিলো। আমাদের আই লাভ ইউর চক্কর শুনে সেও একবার চরকির মতো চক্কর খেয়ে ‘ খালাম্মা গো’ কইতে কইতে চলে গেল। আমরা তার চিৎকারেই ভয় পেয়ে গেলাম। নিপার মা আমার ক্রাশের ঘরে কাম করে। ফলে একান ওকান হইতে সময় বেশি নাই। আমি দৌঁড়ে ছাদ থেকে নিচে নেমে এলাম। ঘরে ডুকতেই আম্মা চিক্কুর দিয়া কইল, কখন পাঠাইছি দুই খান কাপড় দিতে। তাতেই এক ঘন্টা লাগাইসে। আমার আম্মার কথায় হুঁশ নাই। আইসা আমিও সমান তালে চিল্লাই কইতেসি, আম্মা তোমার ফোন কই?
– ক্যান?
– কাম আছে। তাড়াতাড়ি, সময় বেশি নাই।
আমার হাব ভাব দেইখা আম্মা আমার থেকেও অস্থির হইয়া কইল, কি হইসে। এমন ছটফট করতেসোস ক্যান? আমার এখন কান দেয়ার সময় নাই। আগে ওয়াই ফাই পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করমু তারপর সব। নইলে একেবারে কেলেঙ্কারি হইয়া যাইবো।
আমি স্বস্তি হয়ে ফোনটা রাখতে না রাখতেই দরজার কলিং বেলের শব্দ। আম্মা এসে দরজা খুলতেই উঁকি দিয়ে দেখি ক্রাশের আম্মা বাইরে খাঁড়াই আছে। আমি তো সরমে শেষ। আইজকা ছলেবলে কৌশলে মনের কথা বইলা ফেললাম ক্রাশ রে। ওমা!!! ক্রাশও দেখি দাঁড়াই আছে লগে। আমি তো ডাবল সরমে পইড়া গেলাম। আম্মা ওনাদের ভেতরে আইসা বসতে বলল। আমি মনে মনে ডিংকাচিকা নাচতেসি এমন সময় আম্মার ডাক। আমি ধোঁয়া নিমপাতার মতো মুখ করে সবার সামনে দাঁড়াইলাম। ক্রাশ আমারে কইল, আপনি আমাকে যে পাসওয়ার্ড দিয়েছেন ওটা ভুল। আমি মনে মনে বললাম, হালা, বৌরে কেউ আপনি কয়? তোরে ভালোবাসার কতা কইসি। তওবা তওবা। শালা না জামাই। আমি মিষ্টি করে হেসে বললাম, আরে আর্ধেক শুনলে তো ভুল হবেই। আমি তো শুধু I love you বলে ফেলসি। ওটা সত্যি।
আন্টি একবার আমার আর একবার ছেলের মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন। আমার ক্রাশের দুই নাম্বার আত্মাটাও মনে হয় আমার কথা শুইনা আকাশে উড়াল দিলো। আম্মা আমার কান ধইরা কইল, মশকরা করিস? আমি কইলাম, আম্মু, আমি পুরা পাসওয়ার্ড দেওয়ার আগেই তো নিপা খালা এমন চিৎকার দিয়ে নিচে চলে এল। আমিও ভয় পেয়ে চলে এসেছি। আম্মা আরো জোরে কান মলে দিয়ে বলল, তাইলে পাসওয়ার্ড কি?
– আ…… কানটা ছাড়ো বলছি। I love you abbu.
ক্রাশ সাথে সাথে মোবাইলে পাসওয়ার্ড লিখে নিল। এতক্ষণে তার মুখে হাসি ফুটল। দুই আত্মা আবার তার দেহে প্রবেশ করল। সে মুখে হাসি টেনে বলল, ওয়াই ফাই কানেকশন হয়েছে আন্টি। ওনার কথা শুনেই যেন সবার প্রাণে পানি ফিরল। আন্টি বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। আমি মনে মনে বললাম, আলহামদুলিল্লাহ বলে লাভ নাই। এই পেত্মী থেকে আপনার পোলার মুক্তি নাই। ক্রাশ যেদিকে তাকাইবে, এই ছোঁয়াকে দেখিতে পাইবে।
চলবে…
#আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা♥
#সিজন_১
#পর্ব_১
#সাহেদা_আক্তার
বি.দ্র: অনেকেই গল্প কপি করে আসলে লেখকের নাম দেয় না। এই গল্পের ক্ষেত্রেও আমি এটা দেখেছি। ? কেউ কেউ নাম দিয়েছে। আর বাকিরা লেখকের নাম না দিয়েই ফেসবুকে পোস্ট করেছে। তাই আমার বিশেষ অনুরোধ, যদি কপি করতেই হয় তবে লেখকের নামসহ করবেন। ?