অস্তিত্ব,পর্ব:৬+৭

0
934

#অস্তিত্ব
#পর্বঃ০৬
#বনলতা

রাত অনেক হয়ে গিয়েছে।বাতাসি এখনও জেগে আছে।এই বড়বাড়িতে শুধু একজনেরই হুকুম চলে সেটা হলো বাতাসি বিনি।বয়স ষাট পাড় তবুও তেজ কমেনি।পাঁচ ছেলে।একটা মেয়েও নেই।তবুও কেউ কখনও কোনোদিন একটা মেয়ের জন্য আফসোস করতে দেখেনি।বিছানায় বসে বাতাসি পান ছেঁচে গুড়ো করছে।সামনে তার পাঁচ ছেলে।অদুরে সোফায় তমাল বসে আছে।অতিরিক্ত রাগে বাতাসি হিতাহিত ঙ্গান হারিয়ে ফেলে।কিন্তু আজ সে চুপ আছে।ধপ ধপ করে পান ছেঁচার শব্দ আর লাল চোখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে খুব রেগে আছে সে।

আজ অবদি এই বাড়িতে কেউ ওর বিরুদ্ধে কথা বলেনি।কিন্তু সবারই একটা করে দুর্বলতা থাকে।বাতাসিরও আছে। সে নাতি-নাতনীদের অনেক বেশি ভালোবাসে।সবসময় চোখে হারায়।শুধু ওই জাদুকরী মায়ার জন্য এত আদরের নাতীকে পাঁচবছর দুরে রেখেছিলো।এত আদর আর ভালোবাসার দাম তমাল আজ এইভাবে দিবে তা জানা ছিলো না ওর।বিপদে মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়।এই কথা ভালোই জানা আছে বাতাসির।সে বসে থেকে আপন মনে একটু আগে বলা তমালের কথা গুলো ভাবছে।

বাহিরে এশার কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। বিরক্ত হয়ে উঠল সে।তমালের মা কে ডেকে বললেন সবাইকে খেতে দিতে।আগে যেন ওর ছেলে আর নাতিনাতনিরা খায়।তমাল উঠে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো।গায়ের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো।তাতে পুরো ঘর কেঁপে উঠল।সবার দৃষ্টিতে শুধু ঘর কাপলেও বাতাসির চোখে ধরা পড়ল পুরো বড়বাড়ি কাপছে তার সাথে কাঁপছে এত দিনে তিলে তিলে গড়ে তোলা অহংকার এর অনামিশা।

” খবরদার জিনিসপত্রের সাথে রাগ দেখাবি না তমাল”
চড়া গলায় বলে উঠল তমালের মা।

আজ এতবছর হয়ে গেলো এই বাড়িতে এসেছে সে।এই বাড়িতে প্রবেশের সাথে সাথে যেন ইচ্ছে আবদার এর সুতো চিরোজীবনের মতো কেটে গিয়েছে।আজ অবদি সাহস হয়নি নিজের মতো চলা বা শ্বাশুড়ির হুকুমের এক অক্ষর পরিবর্তন করা।এতবছর কলুর বলদের মতো এই সংসারে খেটেই গেছে সে।পরিবর্তে দুবেলা খাবার আর কাপড় ছাড়া কিছুই পায়নি।জীবন আর সংসারের সাথে এই যুদ্ধে বড় ক্লান্ত তিনি।জীবনের এই সন্ধিক্ষণে এসে একটু শান্তি চাওয়াটা কি অপরাধ। এখন তার একটু শান্তি চাই।একটু।

————————-

সবাই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।বাতাসি বিনি রাতে ভাত খায়না।বাতি নিভিয়ে ফ্যানটা ছেড়ে দিয়ে বসে আছে সে।পাশেই শুয়ে আছে মিতু।ওর মেজ ছেলের মেয়ে।বাতাসির শক্তির সাথে সাথে বুদ্ধিটা কমেনি।বরং বয়সের সাথে সাথে তা দ্বিগুণ বেড়েছে।তমাল আজ সাফ জানিয়ে দিয়েছে সে মায়াকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবেনা।যদি কেউ রাজি না থাকে ও নিজেই মায়াকে বিয়ে করে ওর সাথে নিয়ে যাবে।

দিনদিন তমালের রাগ আর জেদ পাল্লা দিয়ে বেড়ে যাচ্ছে। মনে হয় এবার কড়া ধাতুর তাবিজ করেছে।বাতাসি বুঝে যাচ্ছে তমালের কথায় রাজি না হলে এই বড়বাড়ি ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হয়ে যাবে।

“মা আসব,”

“আয়,বাতিটা জ্বালিয়ে দরজা লাগিয়ে দিয়ে আয়।”

মায়ের পায়ের কাছে বসে পড়ে আসলাম শেখ।সে সবার ছোট।কিন্তু অতিরিক্ত রাগ তার।মায়ের মতো রেগে গেলে হুশ থাকে না।

“বাবা আসলাম।আমার বড় শখ একটা পাখি খাচায় ধরার। বড়ই মায়াবী নাকি পাখিটা।ইচ্ছেটা অনেক আগেই ছিলো।কিন্তু আজ কেন জানি তা পুরন করতে ইচ্ছে করছে।ওই যে রুপকথার গল্পে যেমন করে রাক্ষসীর প্রাণভোমড়া টিয়া পাখির প্রাণ নেয়।পাখিটা কেমন ছটফট করে।আমারও ইচ্ছে করে বাপ।বয়স হয়ে গেছে। আর কতদিনই বা বাঁচব। শেষ ইচ্ছেটা পুরন করবি না বাপ।”বাতাসির চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গাল দিয়ে গড়িয়ে যায়।

মায়ের চোখে পানি।কলিজাটা ধুক করে ওঠে আসলামের।মায়ের পায়ে চুমু খায় আসলাম।মা ভক্ত সে।সামান্য একটা পাখির জন্য মায়ের চোখে পানি সে কিছুতেই মেনে নেবে না।

“শুধু ছানা পাখি কেনো মা।তুমি যদি বলো পাখির বাসা,মা পাখি বাবা পাখি এমনকি গাছসহ উপড়িয়ে ফেলব।” দৃঢ়তার সাথে বলে ওঠে আসলাম।

বাতাসির চোখ চিকচিক করে ওঠে।মনে বয়ে যায় প্রশান্তির হাওয়া।না ছেলে তার পাল্টায়নি।আজও ওমনই আছে।

চলবে,,,,,

# অস্তিত্ব
#পর্বঃ০৭
#বনলতা

নিজের ঘরে শুয়ে আছে আশা।আজ খুব করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার।নিয়তি কেন বারেবারে মনের বিপরিতে যায়।সে তো এমনটা চায়নি।তবে কেনো এমন হবে আর কেনই বা সে কষ্ট পাবে।সেদিন মামার বাসায় গিয়ে আশা জানতে পারে ওর মামারা ওর জন্য সমন্ধ দেখেছে।একটা সুপাত্রের খোজও পেয়েছে।তাই হাতছাড়া করেনি।ছবিতে ছেলের বাড়ির লোকেরা আশাকে দেখেই পছন্দ করেছে। তবুও নিয়ম রক্ষার্থে ঘটা করে দেখে গিয়েছে সেদিন।

সবকিছু এত তাড়াতাড়ি ঘটে গিয়েছে যে আশা কিছু বুঝে উঠতে পারেনি।আর আগে থেকে জানালেও কি বা করত সে।ও কি পারত মামাদের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়েতে না করতে।আর তা করলে কি পরিনতি হতো তা স্পষ্ট জানা আছে আশার।বিয়েটা কাল ঠিক করা হয়েছে।

বুকের ভিতরে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। ভোতা মস্তিষ্ক বারবার জানান দিচ্ছে কাঁদতে হবে তার।এখন কান্নাটা খুব জরুরি। নিজের ভেতরের কষ্ট গুলোকে কান্নার পানি দিয়ে ধুয়ে মুছে এক করে দিতে হবে।কিন্তু সে কাদছে না।এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে হাতে রাখা ছবিটার দিকে।ছবিতে ওরা ছয়জনই আছে।কি মধুর ছিলো সেইদিনগুলি।এছবিটা কলেজে ভর্তির সময় তোলা।

আচ্ছা বিয়ের পরও কি আশা এমনই থাকবে নাকি পাল্টে যাবে।ওকি পারবে মায়াদের সাথে আগের মতোন ঘুরতে ফিরতে,আড্ডা দিতে।নাকি সংসার আর স্বামীর মন পুষিয়ে চলতে হবে।ও কি ভুলে যাবে বন্ধুমহলের কথা। ব্যাস্ত হয়ে যাবে আপন সংসারে।মনে পড়বে না এই বন্ধুদের অস্তিত্বের কথা।আর ভাবতে পারে না সে।

আজ আশা বড় অপরাধী। ওর মতো অপরাধ কি কেউ করেছে কখনও।না শুনেছে কখনও।ও তো ভালোবেসেছে। খুব করে ভালোবেসেছে।না চাইতেও বারবার মুগ্ধ হয়েছে।কিন্তু কখনও বলেনি।ভালোবেসেছে আপন মনে।বন্ধুত্বের মাঝে ভালোবাসা টানতে নেই।এতে শুধু বন্ধুত্ব নষ্ট হয়না,সাথে বিশ্বাস টাও মরে যায়।আশা তাকে ভালোবেসেছে কিন্তু কখনও বলার ইচ্ছে করেনি।

বিছানায় শুয়ে আছে অন্তী।আশার পুরো দশ বছরের ছোট অন্তী।আস্তে করে বিছানা থেকে নেমে আসে সে।আজ পুর্নিমা। বাহিরে স্নিগ্ধ মনোরম পরিবেশ।চারদিকে যেন জোসনার বৃষ্টি হচ্ছে। ঝিঝি পোকার ডাক আর মাঝে মাঝে দুর থেকে ভেসে আসছে কুকুরের চিৎকার।

আধু রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়,
মনে পড়ে মোরে প্রিয়।

চাঁদ হয়ে রবো আকাশের গায়
বাতায়নও খুলে দিও।

ভুলিনাই….

আর গাইতে পারেনা আশা।ফুপিয়ে কেদে ওঠে সে।ভালোবাসার যুদ্ধে আজ সে পরাজিত সৈনিক। সত্যি কি আধো রাতে ঘুম ভেঙে গেলে কারো কল্পনায় থাকবে সে।নাকি ভালোবাসাটা নিছক একতরফা।

——————————————-

হলুদ স্টেজে বসে আছে আশা। গায়ে দামী হলুদের শাড়িআর কাচা ফুলের গহনা।মিষ্টি পারফিউম এর গন্ধে ভুরভুর করছে চারিপাশ।গাড়ি থেকে নেমে ওর দিকেই আসছে মায়ারা।মনে হচ্ছে হলুদ পরী।

মায়া আর রোজা সেম ডিজাইনের শাড়ি গহনা পড়েছে।শাড়ির জমিন হলুদ এবং পাড়গুলো ফিরোজা রংয়ের।ব্লাউজ ও ফিরোজা রংয়ের।কোমর ছুঁই ছুঁই চুলগুলোতে কাচা বেলি ফুলের মালা।একদম টুইন লাগছে ওদের।শান্তার গায়ে লেহেঙ্গা। সাদা আর হলুদের কম্বিনেশন। মাঝে মাঝে স্টোন বসানো।মাথায় টিকলি আর ফ্রেঞ্চ বিনুনি করা।কানে ইয়া বড়ো স্টোনের ইয়ার রিং। কিন্তু চোখে চশমাটা আছেই।ইমরান আর মুহিন এর গায়ে পান্জাবী।

দুর থেকে দেখে অবাক হয় আশার মা ভেবেছিলো ওরা আসবে না।বিয়ের আগেরদিন রাতে বললে যেখানে আত্মীয় রাই আসে না।সেখানে বন্ধুরা কেমনে আসে।কিছু সময়ের জন্য ওদের ওপরে শ্রদ্ধা হয় উনার।সত্যি বন্ধুত্ব এমনই হয়।যেখানে অভিমান আছে ঠিকই কিন্তু অভিযোগ নেই।আর থাকলেও তা ধুসর।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here