অস্তিত্ব,পর্ব:২৬

0
1150

#অস্তিত্ব
#পর্বঃ২৬
#বনলতা

ঘড়ির কাটা বারোটার ঘর পেরিয়ে গেছে।যোহরের নামাযের পর মসজিদ সংলগ্ন কেন্দ্রীয় গোরস্থানে লাশ কবর দেওয়া হবে।ইতিমধ্যে মাইকিং করে এলাকাবাসীকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।হাসপাতাল থেকে এনে এশাকে আনার পর গোসল করিয়ে খাটিয়াতে রাখা হয়েছে। কাউকে আর দেখতে দেওয়া হয়নি।এশার বড় মামা একটু আগেই এসেছে।আসলাম কাল থেকে সেই এক কাপড়ে আছে।আসলাম বসে আছে পোস্ট মর্টেম এর রিপোর্ট দেখার জন্য। এশার বড় মামা কামরুল আলী রিপোর্টটা হাতে ক্ষণকাল চেয়ে থাকে খাটিয়ার দিকে।

আকাশের দিকে নিঃশ্বাস ফেলে।ফুলের মতো একটা মেয়ে।জীবন শুরুর আগেই শেষ হয়ে গেলো।আজ যদি তারা একটু সচেতন হতো তবে এমন ঘটনা আজ দেখতে হতোনা।আর কাকেই বা দোষ দেবে সবই নিয়তির লিখন।

“তমাল বাপ, কি লেখা আছে রিপোর্টে? কে মারছে আমার এশারে,” উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করে আসলাম।চোখদুটো চিকচিক করে ওঠ তার।একটা খুন করেও যে শাস্তি,দুইটা করলেও সেই শাস্তিই হবে।আসলাম আজ এককোপে খুনির মাথা দুভাগ করে দিয়ে জেলে গিয়ে পচে মরবে।শুধু একবার নামটা জানুক।

“কেউ মারে নাই।রিপোর্টে লেখা আছে এশার কয়েকমাসের এই মানসিক অবস্থা আর দুশ্চিন্তার কারনে ধীরে ধীরে ডিপ্রেশনে যায়।যার অধিক মাত্রার জন্য মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।তাই সুইসাইড করে”।

” এই চুপ কর,চুপ” আসলাম তমালের মুখে আঙুল চেপে বলে ওঠে।

“কয় টাকা ঘুস দিছোস ডাক্তার আর পুলিশগো।কিসের বদলা শুরু করছোস।আমারে দুধের পোলা মনে করছোস,?”

“এশা আমার বোন হয়।ভালোবাসি তারে।আমি মানুষ। তোমার মতো অমানুষ নই”

“ভালোবাসার লাইগা এতদিন পর্যন্ত বউ, বাপ-মা মাইনা লস নাই।আর আমার এশাতো নিজের বইন লাগে না তোর।ক্যান মিছা কস তুই?”

আক্রোশে রাগে ফেটে পড়ে তমাল।পা দিয়ে কাঠের চেয়ারে জোড়ে লাথি মারে।আশেপাশের লোকজন স্তম্ভিত হয়ে যায়।চিল্লিয়ে সারাবাড়ি মাথায় তুলে তমাল।গুনগুনিয়ে কান্না ছাপিয়ে তা শোনা যায় সর্বত্র। বলে ওঠে,

“আমি ক্যান ডাক্তাররে টাকা দিমু?আর ওরাই ক্যান আমার কথা শুনব,এশার তো ডিপ্রেশনে নিজেই মরছে”

আসলাম তমালের কাছে এগিয়ে আসে।ওর চোখে চোখ রেখে কান্নামিশ্রিত শীতল গলায় বলে ওঠে,

“মনে নাই মায়া মইরা যাওয়ার পরে ডাক্তারে কি কইছিলো?আমি, এই আমি এই দুইহাতে টাকা দিছিলাম ওগো,সেইদিনও কিন্তু ডাক্তার রিপোর্ট বানাইছিলো মায়া নিজেই ডুইবা মরছে।কিন্তু ও তো নিজে নিজে মরে নাই।ওরে তো মারছিলাম আমি।একেবারে জানে শেষ কইরা দিছিলাম। ”

দুর থেকে এগুলো দেখে অবাক নয়নে চেয়ে থাকে কলির মা আমিনা।মুখে আঁচল গুজে কাঁদতে থাকে তিনি।এই এতবছর তার মেয়েটা কত কি সহ্য করে থেকে গিয়েছে এই সংসারে।এরা কি মানুষ। নিজেদের স্বার্থে কারো জীবনও শেষ করে দিতে পারে।সম্পত্তি আর সুদর্শন ছেলে দেখে বিয়ে দিয়েছিল তারা।এত কিছুর মাঝে কখনও টেরই পায়নি তার মেয়েটা আদৌও সুখে আছে তো।

________

যোহরের নামায শেষে সবাই খাটিয়া নিয়ে গোরস্তানের দিকে রওনা হয়।আসলাম টেনে ধরে খাটিয়া।ও নিয়ে যেতে দেবে না এশাকে।তমাল টেনে ধরে রাখে আসলামকে।তমালকে ছিটকে দিয়ে যেতে চায় আসলাম।ওরা এশাকে নিয়ে যতদুরে যেতে থাকে আসলামের চিৎকার আরো বেশি হয়।মনে হয় তার কলিজা ওর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।

জানাযায় অনেক মানুষের ঢল।পাশের বড় মাঠে সবাই জানাযার নামাজ পড়তে শুরু করে।বাড়ির মেয়েরা বাড়ির বারান্দায় বসে আছে।উঠোনের মধ্যিখানে বসে আছে আসলাম।তাকে সামাল দিয়ে আছে তমাল।তাদেরকে অবাক করে দিয়ে উঠোনে ওদের পাশে বসে পড়ে চারজন পুরুষ।চারজনের চোখেই পানি।জানাযার নামাজ শেষে কবর দেওয়ার উদ্দেশ্যে সবাই লাশ নিয়ে যায়।কবর দেওয়া প্রায় শেষের দিকে, এমন সময় খুব জোড়ে বৃষ্টি শুরু হয়।তাড়াহুড়ো করে কবর দিয়ে সবাই চলে আসে।

চারদিকে বৃষ্টি হচ্ছে। তুমুল বৃষ্টির সাথে বাতাস শুরু হয়।এই বৃষ্টির মধ্যে উঠোনের মধ্যে ঠাঁই বসে থেকে কাকা ভেজা হচ্ছে ছয়জন পুরুষ। পুরুষ মানুষের চোখের পানি সহজে দেখা যায়না।অতি কষ্টে সংবরণ হারিয়ে ফেলে তখন তারা কাঁদে। আজ এই বৃষ্টিতে ওদের চোখের পানি ধুয়ে মুছে যাচ্ছে। কিন্তু শেষ আর হচ্ছে না।নিরবে যেমন আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়ছে এই জমিনের বুকে তেমনি নিরবে ওদের চোখ থেকে অনবরত পানি ঝরে পড়ছে গাল বেয়ে।

বৃষ্টির এই ঝমঝম শব্দ আর বাতাসের শো শো শব্দকে ছাপিয়ে হঠাৎ বিকট শব্দে বাজ পড়ে দুরে কোথাও।মাটি কেঁপে ওঠে।নিরবতা ভেঙে একসাথে কথা বলে ওঠে দুটি কন্ঠ,

“এখন আমার মাইয়া থাকলে কইতো, আব্বা আকাশ কি এহন ভাইঙ্গা পড়বো আমার ওপর”

একসঙ্গে বলে আবার একসঙ্গেই থেমে যায় তারা। বিস্ফোরিত নয়নে তারা দুজনে চেয়ে থাকে একে ওপরের দিকে।চোখদুটোতে কি অপার বিস্ময়।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here