অস্তিত্ব,পর্ব:২৩

0
907

#অস্তিত্ব
#পর্বঃ২৩
#বনলতা

জোসনার আলোতে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে নদীর বাঁকের ওই বটগাছটা।ওরা প্রায় চলেই এসেছে। বটগাছটা পেড়িয়ে নদীর পাড় বেয়ে ওপরে উঠে যায় তারা।এখানে মস্ত বড় একটা তেতুল গাছ।গাছটার বয়স প্রায় একশত বছর হবে।পাকা তেতুল ঝুলছে গাছে।কালু গাছটা দেখে মনে মনে আয়াতুল কুরসী পড়তে থাকে।এখানে নাকি তেনাদের বাস।নাম নিতে নেই। না জানি কখন কি হয়।

সড়কে এসে দাড়ালো আসলাম আর কালু।একদম মোরশেদের বাড়ির সামনে।চারদিকে নিশুতি।দুরে দুএকটা নেড়ি কুকুরের আওয়াজ ভেসে আসছে।মায়াদের বাড়িটা রাস্তার একেবারে সাথে।অনেকখানি জায়গা জুড়ে দাড়িয়ে আছে ওদের বাড়ি।ঘরগুলো সব ইটের তৈরি। চারদিকে উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা।পুরো বাড়িতে রং করা।প্রাচীরের বাইরে জামগাছটায় তরতর করে কাঠবিড়ালির মতো উঠে যায় কালু।গাছের একটা ডাল দিয়ে সাবধানে অতি অনায়েসেই বাড়ির ভেতরে চলে যেতে পারবে সে। এতো সাবধানের মধ্যেও প্রাচীরের ওপরে উল্টো করে গেঁথে দেওয়া লোহায় পা খানিকটা কেটে যায় তার।লাল রক্ত মুহূর্তেই লেগে যায় ওখানে।উঠোনে নেমে এদিক ওদিক ভালো করে তাকিয়ে লোহার গেটটা অতি সাবধানে খুলে দেয়।আসলাম ভেতরে আসে।গেটটা আবারও লাগিয়ে দেয়।নকল চাবি দিয়ে মেইন দরজাটা খুলে মায়ার রুমের সামনে যায় ওরা।দরজাটা খুলে দেখে দুই বোন শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে।কোনো সাড়াশব্দ নেই।এই মুহুর্তের পর থেকে আর কখনও সাড়াশব্দ করবে না সে।ওয়ারড্রবের ওপরে এলোমেলো ভাবে শাড়িটা পড়ে আছে।টেবিলে বইখাতা সুন্দর করে গোছানো।কালুর জানটা কেঁপে ওঠে।মনে পড়ে যায় কিছু মাস আগের কথা।

এই অতসীপুর গ্রামটা একেবারে সরলরেখায় চলে গেছে।নদীর পাশে বাড়িঘর একসাড়িতে। আবার সাড়ির বাড়িঘরের পাশ দিয়ে গাড়ি চলাচলের জন্য রাস্তা। রাস্তার ওপারে একসাড়ি বাড়িঘর।এরই পাশ ঘেষে আবার বিল। বিলের একেবারে মাঝখানটাতে একটা প্রকাণ্ড শতবর্ষী বটগাছ আছে।গ্রাম থেকে খালি চোখে দেখা গেলেও বিলের ক্ষেতজমির মেঠোপথ ঘুরে ঘুরে সেখানে যেতে অনেক সময় লাগে।মোরশেদের একফালি জমি আছে ওখানে।দুরের জমি যে ফসলই আবাদ করে মৌসুম শেষে তা ঘরে তুলতে পারেনা।ওখানে একটা ছোটো বসতি আছে।ওরাই আবাদ নষ্ট করে।সেইবার মসুর কালাই বুনেছিলো জমিতে মোরশেদ। কালাই এর ফল ধরতেই লোকজন তুলে নিয়ে যেতে শুরু করেছিলো।তাই বাধ্য হয়ে মোরশেদ ফল পাকার আগেই কাঁচা ফল তুলতে ওখানে যায়।সাথে জাহানারা,নাজমা,মায়া,মিষ্টিসহ আরো দুইতিন জন যায়।ওই ছোটো বসতিতেই কালুর বাস।যদিও কাজের সুবাদে প্রায় সবসময় বড়বাড়িতেই থাকতে হয় তার।সেই শীতের সময়েও কেমন করে জানি কালুকে সাপে কামড় দেয়।ছোট বসতির এলাকাকে স্থানীয় ভাষায় “চাপড়” বলা হয়।চাপড়ে মোটমিলে ত্রিশ-পয়ত্রিশটা ঘর।এইতো মাত্র কয়দিন আগে বিদ্যুৎ এলো।বছরের ছয়মাস চাপড়ের লোকজন পানিবন্দী জীবন কাটায়। কোনো কোনো সময় বছরে তিন-চারমাস শুকনা রাস্তা -ঘাট পায় তারা।না ওখানকার লোকজন শিক্ষিত আর না ছোট বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারে।সেদিন মায়াই কালুর প্রাথমিক চিকিৎসা করেছিলো।পায়ের গোড়ালীর একটু ওপরে কামড়েছিলো সাপটা।মায়া তড়িঘড়ি করে আক্রান্ত স্থানের ওপরে দুই জায়গায় শক্ত করে বেঁধে দেয়। একটা ব্লেড আগুনে পুড়িয়ে সাপে কাটা স্থানটা একটু খানি কেটে চাপ দিয়ে অল্প রক্ত বের করে দেয়।মোরশেদ ফোন করে একটা ভ্যান ডেকে নিয়ে আসে।ভ্যানে কালুর মাথার কাছে মায়া বসে ছিলো।শীতে হাড়হীম করা বাতাস বয় চাপড়ে। সেই বাতাসের মধ্যেও মোরশেদ ভ্যান ঠেলে নিয়ে এসেছিলো আর মায়া নিজের চাদর দিয়ে কালুকে ঢেকে পুরো রাস্তা নিয়ে এসেছিলো।সেদিন ডাক্তার বলেছিলো
“শুধু মায়ার উসিলাই আল্লাহ তোমারে জানে বাচাইছে কালু।সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাইকো।মনে রাইখো মাইয়াডারে।আপনজনও এমন করে না কারো লাইগা।”

কেঁপে ওঠে কালুর হাত।যে হাত দিয়ে মায়া ওর চিকিৎসা করেছিলো।যে মায়া ওর জন্য এতকিছু করেছিলো আজ সেই কালু মায়ার জীবন প্রদীপ নেভাতে চাইছে।আসলাম মায়ারে গলায় কলসী বেঁধে পানিতে ভাসিয়ে দিতে চায়।এতে কষ্ট বেশি হবে।মায়াকে আজ মেরেই তবে দম নেবে আসলাম।কালু একে হাড়ে হাড়ে চেনে।

“কিরে কালু,অঙ্গান করতে এত্ত সময় লাগে ক্যান”

“ভাই এতকিছু না কইরা বুকে ছুরি চালাইয়া দেই,তাইলেই তো মইরা যাইব।এত কষ্ট কইরা টাইনা গাঙ্গের ঘাটে লওনের কোনো দরকার আছে”

“নিজের পরান বাঁচাইছিলো এই মাইয়া,তাই তি তোর দরদ উতলাইয়া পড়তাছে।শুইনা রাখ কালু, তুই কালু এমনি রইবি,কিন্তু তোরে বাপ কওনের লাইগা মাইয়াডা খালি থাকবোনা। আর আম্মাজানে এমনি সাধারণ ভাবে মারতে না কইছে”

কালুর হাত থেকে পড়ে যায় সাদা রুমাল আর একটা ছোটো বোতল।বোতলের গায়ে সুন্দর করে লেখা “ক্লোরোফর্ম”। যে এটা এতো সুন্দর করে লিখছে সেকি আদৌও জানে এটা কারো সুন্দর জীবন শেষ করছে।হয়তো জানে আবার হয়তো না।

বোতল থেকে রুমালে খানিকটা ক্লোরোফর্ম ঢেলে নেয় কালু। রুমালটা দিয়ে চেপে ধরে মায়ার মুখ।সচকিত হয় মায়া।ক্ষনিকের পর আবারও নিস্তেজ হয়ে পড়ে।মায়াকে ঘাড়ে তুলে নেয় কালু।মনে মনে ফরিয়াদ করে ওঠে,” আল্লাহ্ গো,কোনোদিন যদি এই পাপের পায়শচিত্ত করতে পারি,এই পাপ একটু হলেও কমাইয়া দিও।”

কালুই বোধহয় পৃথিবীতে প্রথম যে পাপ কাজ করার সময় তা উপলব্ধি করেও পরবর্তীতে তা প্রায়শ্চিত্তের ওয়াদা পাপের আগেই দিয়েছে।নিয়তি কি কূল কিনারা পাবে কখনও নাকি ভেসে ভেসে শুধু আপন আঁলয় খুজে বেড়াবে।

_____________________

রাত্রী দ্বী-প্রহর।আসলাম বসে আছে নদীর পাড়ের নিচে ঢালু জায়গায়।হাতে জলন্ত সিগারেট। একের পর এক টান দিয়ে যাচ্ছে তাতে।পাশেই কালু বসে জিরিয়ে নিচ্ছে। একটা প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে নিয়ে এতদুর অবদি আসা।তাও নদীর ঘাট,হালকা পিচ্ছিল তারপরেও রাতের বেলা।প্রকৃতি তাদের অনুকুলে।তবুও আজই এই কার্যসিদ্ধি করতেই হবে।তাদের পাশেই অবচেতন হয়ে পড়ে আছে মায়া।হাতদুটো আর মাথা বাদে পুরো শরীর বস্তার ভেতরে।চাঁদের আলোয় মুখখানা স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। কালু সেদিকে তাকাতে পারছে না।ওর মনে হচ্ছে ওই নিষ্পাপ মুখখানা চেঁচিয়ে বলে যাচ্ছে “তুমি বেঈমান,বড় বেঈমান,তোমার ভালো হবে না,কোনোদিনও না”

“ভাইজান কি করমু এহন।কলসি গলায় বাইন্ধা ফালায় দিমু,

” না,এখনই না।ওতো অঙ্গান হইছে।ধর একরকম মইরাই আছে।এহন মারলে কি ওর টের পাইবো না মনের জ্বালা মিটবো।আগে ওরে জাগাইয়া তোল”

কালু দুহাতে সামান্য পানি এনে ছুড়ে মারে মায়ার মুখে।কোনো সাড়াশব্দ নেই।আবারও পানির ঝাপটা মারে।ফলাফল শুণ্য।কালু ভয় পেয়ে যায়।কি করবে এখন।মায়া কি মারা গেলো তবে।কিন্তু কি ভাবে।সামান্য ক্লোরোফর্ম এ কি কেউ মারা যায়।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here