অস্তিত্ব,পর্ব:২২

0
804

#অস্তিত্ব
#পর্বঃ২২
#বনলতা

বিধস্ত আসলাম ক্লান্ত চোখে একদৃষ্টে চেয়ে নিজের মেয়ের দিকে।কতই না শান্ত হয়ে শুয়ে আছে সে।বাবার সামনে থাকলে এশার মুখ কখনও বন্ধ থাকে না।অনবরত বকবক করেই যেতো।অথচ,আজ প্রাণপাখিটা চলে যাওয়ার সাথে সাথেই চঞ্চল এশা শান্ত, নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে।ফর্সা গলায় ওড়নার ফাঁস লেগে চামড়া ছিলে গেছে।সাথে হাতের নখের খামচির দাগ।হয়ত ফাঁস নেওয়ার পরে বাঁচার জন্য ছোটাছুটি করেছে।দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার থেকে বাঁচতেই হাত দিয়ে গলার ওড়নাটা খোলার চেষ্টা করেছিলো।আচ্ছা মরনের সময় কি অনেক কষ্ট হয়।এশারও কি ঠিক তেমনই কষ্ট হয়েছিলো যেমনটা মায়ার হয়েছিলো।এশাও কি বাঁচার জন্য আকুতি করেছিলো নিজেই নিজের কাছে যেমনটা মায়া তার কাছে করেছিলো।ঘুরে ওঠে আসলামের মাথা।মেয়ের মরা মুখ দেখা থেকে এখন অবদি তার শুধু সেই চাঁদনী রাতের কথাই মনে পড়ছে।কালো ওড়না,কলসি,দড়ি,কারো নিজের জীবন বাঁচার জন্য চোখের জল আর আকুতি আর তার সাথে ছিলো কারো প্রশান্তির হাসি।হাসিটা প্রশান্তির হলেও শব্দটা দানবীয় ছিলো।যা শুনলে কোনো সাহসী মানুষেরও কলিজা কাঁপত।

আজ সেদিনের মতো এখানে প্রায় সবই আছে।কিন্তু কেউ হাসছে না।গুনগুনিয়ে কাঁদছে সবাই।হঠাৎই এই গুনগুনিয়ে কান্না ছাঁপিয়ে কারো দমফাটা হাসির আওয়াজ শোনা গেলো।আশ্চর্য কেউ নেই।কে হাসছে।নাকি এটা মনের ভুল।মেয়েকে বুকে জড়িয়ে কেঁদে ওঠে আসলাম।নাহ্ হাসিটা থামেনি।মৃত মেয়েকে বুকে জড়িয়ে আসলাম অনুভব করে হাসির শব্দটা খুব কাছে থেকে আসছে।গায়ের লোমগুলো একেবারে খাঁড়া হয়ে গিয়েছে আসলামের।মৃত মানুষ কখনও কি হাসতে পারে।ভয়ে কন্ঠনালী শুকিয়ে ওঠে তার।আস্তে করে মেয়েকে বুক থেকে সরায়।এশার মুখের দিকে তাকাতে পারছে না সে।পারলে সে দৌড়ে পালায়।কিন্তু পালিয়ে যেতে পারছে না।শুকনো একটা ঢোক গিলে মেয়ের মুখের দিকে তাকায় সে।নাহ্ এশা হাসছে না।মরা মানুষ কখনও হাসতে পারে না।ওর মেয়েকে আজ ও হারিয়েছে। যেনো কলিজাটাই কেউ কেটে নিয়েছে।এত ব্যাথা সে কই রাখবে।হঠাৎই চোখটা তুলে দেখে ওর সামনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে।আর ওই হাসিটা ওই হাসছে।রাগে ফেটে পড়ে আসলাম।তার মেয়েটা মারা গেছে আজ
মরার বাড়িতে কেউ মন খুলে হাসে কখনও।লোকটা কি পাগল।

ভালো করে চেয়ে দেখে আসলাম। ওটা আর কেউ না ওটা ও নিজেই।নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না সে।

“কিরে, আসলাম শেখ।আজ কেমন লাগছে?

” কে,কে তুমি?”

“আমিই তুই,তুই আমি”

“কি চাই হাসছো কেনো? তুমি হাসছো কেনো?অন্ধ নাকি,দেখতে পাচ্ছো না আমার মেয়েটা মরে গেছে।এতটুকু মেয়ে আমার।হিরের টুকরো মেয়ে।ওর চাঁদের মতো মুখখানা আজ অমাবস্যার রাতের মতো হয়ে গিয়েছে। ” চিৎকার বলতে বলতে কেঁদে ওঠে আসলাম।

আরো জোড়ে হেসে ওঠে সে।ওর হাসিতে যেনো কানের তালা ফেটে যাচ্ছে আসলামের।দুহাত দিয়ে কান চেঁপে ধরে আসলাম।হাসি থামিয়ে ওর চারপাশে ঘুরতে থাকে ওরই দ্বিতীয় সত্তা।বলে ওঠে,

“আজ কেমন লাগছে আসলাম শেখ।কষ্ট লাগছে বুঝি।কেমন কষ্ট, কতটা কষ্ট, আর কোথায়ই বা হচ্ছে। আজ কেনো তোর চোখে পানি।আর আমার হাসিকেই বা ভৎসনা দেওয়ার তুই কে?মনে করে দেখ বহু বছর আগের কথা। এক সন্তানহারা পিতার আহাজারি দেখে কতই না শান্তি পেয়েছিলি তুই।সেদিন তুই ঠিক এই ভাবেই হেসেছিলি।তোর হাসিটা প্রতিধ্বনিত হয়েছিলো এই অহংকারমন্ডিত বড়বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে আর আমার এই হাসি শুধু তোর কানে তোরই আশে পাশে প্রতিধ্বনিত হবে।কেউ শুনতে পাবে না কেউ না আসলাম শেখ।নিজের মেয়ে তোর কাছে হিরের টুকরো হলে অন্যের মেয়ে ফেলনা নয়।তারাও তাদের বাবার কাছে মহামুল্যবান।মনে করে দ্যাখ
সেই রাতের কথা।ভালো করে মনে করে দ্যাখ………..” কুটিল হাসি হেসে ওঠে ওর দ্বিতীয় সত্তা।

ভাবনায় ডুব দেয় আসলাম।চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ওঠে সেদিনের সেই চাঁদনী রাত,নদীর পাড়,দুজন লোক,হাতে কলসি,দড়ি,চোখে মুখে উপচে পড়া খুশি,হাতে জলন্ত সিগারেট……….

কয়েক বছর আগে……….

প্রচন্ড গরমের পর আজই বৃষ্টি হয়েছে।নদীর পাড়টা তাই ঈষৎ পিচ্ছিল। বালু থাকার কারনে পুরোপুরি পিচ্ছিল হয়নি।পাড় দিয়ে হেঁটে যেতে তাই অতটা অসুবিধা হচ্ছে না তাদের।হঠাৎই উস্টা খেয়ে পড়ে যেতে লাগে কালু।পড়ার আগেই ধরে ফেলে আসলাম।পায়ের তলায় ইটের টুকরো তাতেই পা বেঁধেছে কালুর।

[গল্প পড়ার জন্য আমার আইডিতে ফলো দিয়ে রাখুন]

হাতের সিগারেট এ টান দেয় আসলাম।মুখ ভরে যায় নিকোটিনের ধোঁয়ায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে ফুস করে মুখভর্তি ধোঁয়াগুলো ছেড়ে দেয় সে।কালুর মাথায় হালকা থাপ্পড় মেরে বলে উঠে,

“এই ফকফকা চান্দের রাইতেও তুই চোক্ষে দেখিস না কালু,আন্ধার রাইত হইলে তো গাঙে চইলা যাইতি,”

ঈষৎ হেসে ওঠে কালু।পুর্নিমার চাঁদটা তার সম্পুর্ন জোসনা ছড়িয়ে আছে।তবুও কালুকে যেনো দেখাই যাচ্ছে না।গায়ের রংটা তার নিকষ কালো।তাই নামটা তার কালু।ভালো নাম আছে কিন্তু সে নামে কেউ ডাকে না।তবুও তার দাঁতগুলো স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। বোকার মতো মাথায় হাত বুলিয়ে বলে ওঠে কালু,

“সবই তো ঠিক রইছে,শুধু একটা কতা মাথায় ঘুরপাক খাইতাছে ভাইজান”

পুরোনো বটগাছটার শেকড় নদীর পাড়ের নিচ অবদি গিয়ে নদীর তলানিতে ঠেকেছে।শেকড়টা সাবধানে পেড়িয়ে ফিসফিস করে বলে ওঠে আসলাম,

“কি এমন কতা, যে তোর এখন এই সময় না জিগাইলেই না”

ভরসা পেয়ে কালু বলে ওঠে,

“ভাইজান,ছুডু মাইয়া।ওরে আমি দেকচি।হের নামডা যেমন মায়া তেমনি চোক্ষে মুক্ষে মায়া।জানে না মারলে হয়না।হুমকি ধামকি দিয়া ছাইড়া দ্যান।”

হাতের সিগারেটটা দুরে ছুড়ে ফেলে আসলাম।কালুর বকবকানি তার ভালে লাগছে না।কালু এমনই।অসময়ে বকবক বেশি করে তবুও কালুকেই সাথে নিয়ে এসেছে সে।অনেক বিশ্বস্ত সে।বাতাসি বিনিই বলছে কালুকে সাথে নিতে।

হেসে ওঠে আসলাম শেখ,কালুর দিকে তাকিয়ে আবার চলতে শুরু করে। চলতে চলতে বলে ওঠে,

“মাইয়াডা ভালা সেইডা আমিও জানি।চরিত্রে কোনো কালিঝুলি নাই।বড়ই আদব আছে।কিন্তু আমার আম্মাজানের তারে পছন্দ না। আম্মাজান চায়না সে তমালের জীবনে ক্যান চোক্ষের সামনেও যেন না থাকে।মাইয়াডার কলিজা বড়।ওতো বড়বাড়ির কলিজায় হাত দিছে।তার তুলনায় তো ওর জীবন হরন তুচ্ছ”।

মনে মনে চমকে ওঠে কালু।এতদিন ধরে অনেক অন্যায় কাজ করলেও কখনও কারোর প্রাণ নেয় নাই।আজ তার পুরো দেহো কাঁপতাছে।শক্তিহীন লাগছে।সাহস জুগিয়ে বলে ওঠে,

” ভাইজান, বড়আম্মারে একটু বোঝান।মাইয়াডাও ভালা।চান্দের লাকান ছুরত।আবার মোরশেদেরও ভালোই পয়সা হইছে।যা সম্পত্তি আছে তা দুই মাইয়াই পাইবো।মোখলেসের দুই পোলা কখনও আইবোনা ছুডু বোনগো মনে দুক্কু দিয়া সম্পত্তি নিতে।তাতে তমালও খুশি হইবো আর কাউরে জানে মারোন লাগবো না।বড় আম্মা আর কতদিন বাঁচবে। বয়স তো মেলাই হইলো,”

আসলামের মুখে রাগে যেনো আগুনের উল্কা।চোখদুটো দেখে মনে হচ্ছে অগ্নিবর্ষণ হবে।ভয়ে চুপসে যায় কালু।কন্ঠনালী শুকিয়ে যায়।আসলামের পা দুটো চেপে ধরে মুখটা ওপরে তুলে বলে উঠে,

“ভুল হইয়া গেছে ভাই,আর জীবনে কক্ষোনো কমু না,এইবারের মতো মাপ কইরা দ্যান।”

মানুষ ভয় পেলে চোখের মনি স্বাভাবিকের চেয়ে বড় হয়ে যায়।তাতে ভীতি ভাবটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।হাসলে এমনকি কাঁদলেও এমনটা হয়না।কেউ তাকে দেখে ভয় পেলে বা ক্ষমা চাইলে বড়ই আনন্দ লাগে আসলামের।কালুর থেকে পা দুটো ছাড়িয়ে দুপা সামনে গিয়ে থেমে যায় আসলাম, ভয়ংকর কন্ঠে বলে ওঠে,

“সামান্য শাস্তির ভয়ে যদি তুই এমন করিস তাইলে ওই মাইয়াডা প্রাণভয়ে না জানি কত্তবার পা ধরব,কতবার ক্ষমা চাইব,ভাবতেই কেমন জানি একখান প্রভাবশালী রাজা রাজা মনে হইতাছে।দাদার মুখে শুনছিলাম তার পুর্বপুরুষরা নাকি জমিদার আছিলো,তাইলে তাগো পুর্বপুরুষরা মনে হয় রাজাই আছিলো।অংকখান মিইলা গেলো না কালু।”

হো হো করে হেসে ওঠে আসলাম।ভয়ংকর বিদঘুটে হাসিটা নদীর ওপারে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এসে বারবার এপারে ধাক্কা খায়।কালু ভয় পেয়ে যায়।এটা কি মানুষ নাকি কোনো পিশাচ। কোনো মানুষ কি অন্য মানুষের অস্তিত্ব বিলীনে এতটা আনন্দ পায়।নিজের মনে প্রশ্ন গুলো ছুড়েও কোনো উত্তর পায়না কালু।আসলামের হাসিটা এখনও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে নদীর এপার ওপার।মনে হচ্ছে কোনো অশরীরী তার অপুর্ণ ইচ্ছে পুরন করতে মেতেছে।

#চলবে

[গল্প পড়ে কেমন লাগল তা কমেন্টে জানান আগের পর্বে সমস্যা ছিলো তাই লেখিকা দেননি।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here