অস্তিত্ব,পর্ব:১৫+১৬

0
665

#অস্তিত্ব
#পর্বঃ১৫
#বনলতা

সারাটা দিন সুর্য তার তেজস্বী রৌদ্রস্নাতে সকলকে স্নান করিয়ে শেষ বিকেলের পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। দুপুরের হলুদ আভা শেষ বিকেলে রক্তিম বর্ণ ধারন করেছে।একটু পরেই মাগরিবের আযান হবে চারদিকে। একটা দিনের পরিসমাপ্তি ঘটল আজ। পৃথিবীর এই গর্ভ থেকে আরও একটা দিন হারিয়ে গেলো। আচ্ছা আজ কি শুধুই একটা দিনের অস্তিত্ব হারালো। না হারায়নি।

আজ একটা দিনের সাথে সাথে অনেক কিছুই হারিয়েছে ।একটা মেয়ের জীবনের অস্তিত্ব হারিয়েছে ।একজন পিতামাতা তাদের মেয়েকে হারিয়েছে।এক অবুঝ ছোট বোন তার সর্বক্ষণের সাথী হারিয়েছে। এক প্রেমিক পুরুষ প্রেয়সীকে হারিয়েছে। একদল হরিণীর মতো চঞ্চল বন্ধুরা তাদের একাংশ হারিয়েছে।এই এতএত হারানোর মধ্যে দিয়েই কেউ আবার তার শত্রুকে হারিয়ে বিজয়ের হাসি হেসেছে। এটাই মানবজীবন।যার একদিকে গড়ন অন্যদিকে ভাঙন।

__________________________

চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার তারই মাঝে দুই তরুন ক্ষিপ্র গতিতে ধেয়ে আসছে।বাড়ির কাছাকাছি এসেই গেটের সামনে গিয়ে জোড়ে জোড়ে কড়াঘাত করতে লাগল।মিষ্টি দৌড় গিয়ে দরজাটা খুলে দিলো।উঠোনে ইলেক্ট্রিসিটির আলোয় দেখা গেলো দুই তরুনের মুখ।সারা শরীর ঘেমেনেয়ে একাকার।দুই তরুনের মুখের অবয়ব একই রকমের।দুজনই শ্যামলা বর্ণের।গলায় কালো একটা তিল।চুল গুলো এলোমেলো।গায়ের কালো টি-শার্টটি একদম ভেজা।হাতে একটা কালো ছোটো ব্যাগ।দুজনের মধ্যে কে শামীম আর কে শাহীন তা কখনোই বুঝে উঠতে পারে না মিষ্টি। কিন্তু আজ এই দুই ভাইয়ের মধ্যে আলাদা করার অবুঝ মনটা আর নেই মিষ্টির।

আজ এই একদিনেই মিষ্টি হঠাৎ বড় হয়ে গিয়েছে। এইতো আজ সকালেই মায়াকে যখন খুজে পাওয়া যাচ্ছিলো না, কতজন কত কটু কথা শুনিয়েছে।তখন মিষ্টির চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিলো, “যে এত বাজে কথা বলো না।আমার আপু বাজে নয়।” কিন্তু সে বলতে পারেনি।ওতো ছোটো। খুব ছোটো। কিন্তু এখন এই একদিনেই মিষ্টি যেন বড় হয়ে গিয়েছে। মায়া সবসময়ই বলত,মিষ্টি তুই বড় কবে হবি,”।মিষ্টি আজ বড় হয়েছে। কিন্তু দেখার জন্য মায়া আর নেই।কেউ অস্তিত্ব বিলীন করে দিয়েছে এই পৃথিবীর বুক থেকে।

শামীম আর শাহীন দুজন জমজ ভাই।ওদের নিজের কোনো বোন বা ভাই নেই।মায়া আর মিষ্টিকে তারা এতটাই ভালোবাসে যে ওদেরকে কেউ দেখলে বুঝতেই পারে না যে ওরা চাচাতো ভাইবোন।শামীমকে জড়িয়ে ধরে মিষ্টি।শক্ত করে জড়িয়ে রাখে শামীম তাকে। আজ সকাল থেকে শুরু হওয়া কান্নার উৎসবে যোগ হয় আরো এক পর্ব। কান্না যেন থামতেই চায়না।মিষ্টিও কাঁদছে শামীমও কাঁদছে। ভাইদের কলিজা হচ্ছে বোন আর বোনদের আদর ভালোবাসা আর মিষ্টি মিষ্টি শাসনের কেন্দ্রস্থল হচ্ছে তাদের ভাইয়েরা।

বারান্দার জালচৌকিতে বসে আছে মোরশেদ, মোখলেস, জাহানারা, নাজমা আরও আশেপাশে আত্মীয় স্বজনরা। শামীম-শাহীনকে দেখেই কেঁদে ওঠে মোখলেস।দুই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে নাজমা।মোরশেদ ঠাঁই বসে আছে।মুখে কোনো কথা নেই।শুণ্য চোখে চেয়ে থাকে উঠোনের এককোণে কলম করে রাখা গোলাপ কুড়ির দিকে,যা মাত্র দুইদিন আগেই মায়া এনেছিলো।কথা ছিলো চারা ভালো ভাবে হলে ওখানেই মাটিতে পুতে রাখা হবে।

শামীম উঠে আসে জাহানারার কাছে। বারান্দায় ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে তার সামনে।হাতদুটো মুঠোয় পুরে নেয়।চোখের পানি মুছে সংযত হয়ে জিজ্ঞেস করে।পুরো ঘটনা জানতে চায়।জাহানারা জবাব দেয়না।উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে শুধু। ভয় পেয়ে যায় শামীম।বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে ওঠে জাহানারার। স্তভিত ফিরে কেঁদে ওঠে সে।কান্নামিশ্রিত কন্ঠে পুরোটা বলা শুরু করে।

আশার বিয়ের বাড়ি থেকে আসতে আসতে অনেক রাত হয়ে যায় কাল।আজ মায়াকে দেখতে লোকজন আসার কথা ছিলো।তাই কেউ ঘুমায়নি।নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করছিলো।মায়া বাড়িতে যাওয়ার পর সবাই খেতে বসেছিলো।মায়া খেতে চায়নি।তবুও জাহানারার জোরাজুরিতে সামান্য মুখে দেয়।তারপর যে যার মতো ঘুমিয়ে পড়ে। ব্যাস এতটুকুই। সকালে উঠে আর মায়াকে খুজে পাওয়া যায়নি।

এই রাতে আর কেউ কিছু মুখে নিলো না।আরো একটা নির্ঘুম রাত কেটে গেলো।কাল পুর্নিমা ছিলো।আজ চাঁদটা পুরোটা উঠেনি।সারা পৃথিবীর লোকজন যখন ব্যাস্ত ঘুমের দেশে তখনও কেউ কেউ জেগে আছে। শুধু অবস্থানটা ভিন্ন। কেউ জেগে থেকে মাতাল হয়ে কারো দেহ কেটে ছিড়ে ছিন্ন ভিন্ন করছে তো কেউ কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে।

_______________________

পুব আকাশে উঁকি দিচ্ছে সুর্য। আরো একটা নতুন দিনের সূচনা হলো।কারো হতাশার শুরু আবার কারও বা সৌভাগ্যের শুরু।হতাশা,দুঃখ বা সৌভাগ্য যেটাই হোক না কেন সবই তো আমাদের নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। যিনি সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী তিনিই তো আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন।

আজ সকাল দশটায় সদর হাসপাতালে যেতে হবে।পোস্ট মর্টেম শেষে ওরা লাশ হস্তান্তর করবে পরিবার পরিজনের কাছে।শামীম আর শাহীন দুজনেই রওনা দিয়েছে সদরে।

#চলবে

#অস্তিত্ব
#পর্বঃ১৬
#বনলতা

হাসপাতালের সংকীর্ণ গলি দিয়ে ভেতরে যাচ্ছে শামীম।শাহীন দরকারী কাগজ পত্রে সই স্বাক্ষর দিচ্ছে। নিজেদের মানুষ অথচ তাকে নিজেদের সাথে নিতে কতই না কিছু করতে হচ্ছে। এখানে পদে পদে ঝামেলা।অত্যন্ত সন্তপর্ণে সবকিছু মিটমাট করতে হচ্ছে। একটু কথার এদিক সেদিক হলেই জবাব দিতে হচ্ছে নানা প্রশ্নের।যেন নিজেরাই বড় অপরাধী।

হাসপাতালের এদিকটায় মনে হচ্ছে একটু বেশিই। মৃদু ফিনাইলের গন্ধ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। দরজার ওপরে ছোট করে লেখা, “মর্গ,এমন পরিবেশে সকলেরই গা ছমছম করে উঠবে। কিন্তু শামীম নির্বিকার। কোনো ভয়ের নুন্যতম ছিটেফোঁটা নেই তার মধ্যে। সামনে পুলিশের লোকটা যাচ্ছে আর তাকে অনুসরণ করেই শামীম চলছে।হঠাৎই থেমে যায় পুলিশের লোকটি।তাতেই মাথাটা উঁচু করে সামনে কি আছে তা দেখার চেষ্টা করে সে।মর্গের নিচ থেকে এক মানুষ অবদি এমন উচু এক আলমারি মতো।না আলমারি বললে ভুল হবে।ওয়ারড্রবের মতো একটা থাক টেনে বের করে এনে রাখল সামনে।শামীম শুণ্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।

দরকারী কাগজ পত্রে সাক্ষর শেষে শাহীনও রওনা হয় মর্গের দিকে।মর্গের ভেতরে ঢুকে বুঝে উঠতে পারেনা কোন দিকে যাবে সে।একটা রুমের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে সে।ভেতরে দুজন মানুষ আর একটা মৃতদেহ।লোকটা মাত্র লাশটার কপালে কাটার ঠেকিয়ে হাতুরি দিয়ে বাড়ি দেবে।তখনই তাদের নজরে আসে শাহীন। উৎকটগন্ধে মাতোয়ারা হয়ে আছে পুরো রুম।রেগে ওঠে লোকদুটো।শাহীন দরজা ঠেলে বের হয়ে আসে।

বাহিরে এসে ফোন করে শামীমকে।জেনে নেয় কোথায় যেতে হবে।এতক্ষণ শাহীনের জন্যই অপেক্ষা করছিলো পুলিশের লোকটা। ও যেতেই ব্যাস্ত ভঙ্গিতে মুখ থেকে সাদা কাপড় সরিয়ে দেয়।ফর্সা চেহারাটা একেবারে বিবর্ন হয়ে গিয়েছে। কপালে রগেরগে সেলাই দেখাই যাচ্ছে। সাধারণ কমদামী সুতো দিয়ে সেলাই করা।এই অবস্থা দেখার মতো নয়।লাশটা বুঝে নিয়ে বেরিয়ে আসে দুইভাই।চোখেরপানি যেন শুকিয়ে গেছে আজ।বুকটা ফেটে যাচ্ছে অথচ চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে না।ইচ্ছে করছে বুকের ভেতরে জড়িয়ে রেখে চিৎকার করে কাঁদতে। বলতে ইচ্ছে করছে কেন এমন হলো।কার কি ক্ষতি করেছিলো তাদের এই অবুঝ বোন।মর্গ থেকে বের হয়ে একটা লাশবাহী গাড়িতে উঠিয়ে নেয় মায়াকে।রওনা দেয় বাড়ির উদ্দেশ্যে।

কথায় আছে,”মানুষ মরলে বাঘ হয়,আর বাঘ মরলে মানুষ হয়,”

_______________________

একটু আগেই মুয়াজ্জিন মসজিদে মাইক দিয়ে পুরো এলাকাবাসীকে জানিয়ে দিয়েছে জানাযার নির্ধারিত সময়।গোরস্থানে কবর খনন করা হচ্ছে। মসজিদ থেকে খাটিয়া নিয়ে বাড়িতে আনা হয়েছে।বড়ই পাতা দিয়ে পানি গরম করার আয়োজন ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে। বাজার থেকে আতর,সুরমা,গোলাপজল আর কাফনের কাপড়ও আনা হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আজ বাড়ির চেহারা পাল্টে যেতো।খাটিয়ার বদলে পালকি আসত।কবর খনন বাদে চুলো খনন হতো।বরই পাতা আর পানি গরম করা বাদে হলুদ দিয়ে বিয়ের গোসল হতো।কাফনের সাদা কাপড়ের জায়গায় থাকত লাল বেনারশী।আতর সুরমার জায়গায় দামী দামী কসমেটিকস থাকত।গোলাপজল এর বদলে পারফিউম থাকত।মায়ার লাশের জন্য অপেক্ষার জায়গায় বরের গাড়ির অপেক্ষা করত সবাই। আশ্চর্য একটা মৃত্যু কতকিছু পাল্টে দিলো।

লাশবাহী গাড়ির সাথে সাথে পুলিশের গাড়িকেও আসতে দেখা গেলো।বাড়ির সামনে গিয়ে থামল গাড়িটা।লোকজনের ভীড় এড়িয়ে লাশ নামানোই দায় হয়ে পড়ল।তাড়াতাড়ি করে মায়াকে শেষ গোসলের জন্য নিয়ে যাওয়া হলো।উঠোনের এক কোনে চেয়ারে বসে আছে পুলিশের অফিসার।সামনে আরো গন্যমান্য লোকজন বসে আছে।পাশেই দাড়িয়ে আছে ইমরান,মুহিন,শাহীন,শামীম।শান্তা একটু দুরে মায়ার মায়ের কাছে বসে আছে।

অফিসার লোকটি মায়ার পোস্ট মর্টাম এর রিপোর্ট দেয় ইদ্রিস এর হাতে।ইদ্রিস গ্রামের একজন প্রভাবশালী ব্যাক্তি এবং কলেজের প্রফেসর। অনুসন্ধানী চোখে দেখতে থাকে পুরো রিপোর্ট। রিপোর্ট এ লেখা আছে মায়ার শরীরে কোনো প্রকার ধস্তাধস্তি বা হাতাহাতির চিহ্ন পাওয়া যায়নি।ওড়নাটা হাতে বাধা ছিলোনা বরং শরীর থেকে খুলে গিয়ে হাতে পেচিয়ে ছিলো।মোটকথা এটা খুন নয়।বরং আত্মহত্যা। কারন মায়া কদিন ধরেই অনেক ডিপ্রেশনে ছিলো।যার কারনে সে নিজেই গলায় কলসি বেঁধে আত্মহত্যা করেছে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ইদ্রিস। সে জানত এমনটাই হবে।সমাজের রাঘব বোয়ালের কাছে চুনিপুটিরা হাতের ময়লা।

মোরশেদ মোখলেস এর দিকে চেয়ে অফিসারটা জানতে চায় তারা কাউকে সন্দেহ করে নাকি।কাউকে বাদী করে কোনো পুলিশ কেস করতে চায় নাকি।অদ্ভুত পৃথিবীর এই চরম লীলাখেলায় বাকরুদ্ধ তারা।চোখের সামনে দিবালোকের ন্যায় পরিস্কার এটা খুন।এমনকি তারা এটাও জানে কে বা কারা এই কাজ করতে পারে।

শামীম নিরবতা ভেঙে বলে উঠে লাশ দাফন-কাফনের পর তারা সিদ্ধান্ত নেবে।এদিকে সময় হয়ে এসেছে।মায়াকে গোসল শেষে খাটিয়াতে এনে রাখা হয়েছে।কোরআন শরীফ পাঠের গুনগুন আওয়াজ হচ্ছে। দুর দুরান্ত থেকে লোকজন আসছে। একটু পরেই জানাযা হবে।শেষ বারের মতোন সবাই দেখে নিচ্ছে মায়াকে।এই দেখাই শেষ দেখা।এত দেখছে তবু তৃষ্ণা মিটছে না।আর কখনও দেখা হবে না।কখনও না। এর পরে হাজারও চিৎকার আর আহাজারি করলেও ক্ষণিকের জন্যও দেখা মিলবেনা তার।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here