অস্তিত্ব,পর্ব:১২

0
805

#অস্তিত্ব
#পর্বঃ১২
#বনলতা

মায়ার ঘরের বিছানা-কাথা,বালিশ, পড়ার টেবিল,বই-খাতা এমনকি তোষক অবদি ওলট-পালট করে খুঁজে চলেছে জাহানারা।আধাঘন্টা যাবদ সারাঘর তন্নতন্ন করে খুঁজেও সন্দেহজনক কোনো কিছু খুঁজে পেলোনা সে।কোনো কাগজ,চিরকুট কিছুই লেখা নেই।এমনকি ফোনটাও বিছানায় পড়ে আছে।দিশেহারা হয়ে পড়ে জাহানারা।কাল রাত অবদি সব ঠিক ছিলো।মায়াও স্বাভাবিক ছিলো।ওর আচরণে বা কথাবার্তায় কোনো পিছুটান ছিলো না।

মেঝেতে বসে আছে জাহানারা।কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।মায়া নেই।ওর কলিজাই নেই।কিন্তু এখন তার থেকেও বেশি চিন্তা হচ্ছে পাড়াপ্রতিবেশি নিয়ে।এ কথা পাঁচ কান হলে মানসম্মান এর কিছু থাকবেনা।একদিকে মেয়ের চিন্তা অন্যদিকে সম্মানের ভয়।মধ্যবিত্ত পরিবারে মানসম্মান যেন কচুর পাতার পানি।একটু এদিক ওদিক হলেই সর্বনাশ।জাহানারার দুহাত দিয়ে শাড়িটা জড়িয়ে চুমু খেলো।এইতো এই শাড়িটাই কাল পড়ে ছিলো মায়া।দুচোখ দিয়ে পানি বেয়ে বেয়ে পড়ছে তার অনবরত।

হঠাৎই বিছানায় রাখা মায়ার ফোনটা বেজে ওঠে।মিষ্টি ফোনটা নিয়ে বলে ওঠে,”মা তমাল ভাইয়ার কল”।ফোনস্কীনে তমাল লেখাটা জ্বলজ্বল করছে।দ্রুতগতিতে ফোনটা রিসিভ করে জাহানারা।রাগমিশ্রিত কন্ঠে বলে ওঠে,

“তমাল,মায়া কোথায়।”

ওপাশ থেকে কি বলল তা শোনা গেলো না।হঠাৎই কান্নায় ভেঙে পড়ল জাহানারা।কান্নামাখা কন্ঠে বলে,

“বাবা আমার মেয়েটা জীবনে বহু কষ্ট পেয়েছে। আজ একটু শান্তি দাও।আজ ওকে দেখতে লোকজন আসবে।আত্নীয়-স্বজন সবাইকে দাওয়াত দেওয়া হইছে।একটু পরে সবাই চলে আসবে।আমার মেয়েটারে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও বাবা।”

কলটা কেটে গিয়েছে। হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দেয় জাহানারা।

——————————-

নদীর পাড়ে অনেক মানুষের ভীড়।শিহাবদের কথা অনুযায়ী সবাই নদীর পাড়ে এসে জড়ো হয়।শিহাবরা মিথ্যে বলেনি।সত্যি সত্যিই নদীতে চুল ভেসে ছিলো।একজন সাহস করে বড় একটা লাঠি দিয়ে হালকা ঠেলা দেয়। ভেসে থাকা বড় বড় চুলের দুপাশে দুখানা হাত ভেসে ওঠে।ভয়ে আতংকে চেঁচিয়ে ওঠে উপস্থিত সবাই।

মায়ার বড় চাচা মোখলেস বাজার থেকে বাড়ি ফিরছেন।হাতে ইয়া বড় ব্যাগ।ব্যাগে আছে মিষ্টি আম।বাজার থেকেই কিনে বাড়ির দিকে রওনা হয়েছে।উত্তর পাড়া ছেড়ে কিছু দুর এগুতেই সড়ক থেকে দেখতে পায় নদীর পাড়ে অনেক মানুষের ভীড়। ভয়ে চেঁচিয়ে উঠছে কেউ কেউ।

নিতান্তই কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে সড়ক থেকে নেমে নদীর পাড়ে যায় মোখলেস।ভীড় ঠেলে দেখার চেষ্টা করে।একটা লাশ পানিতে ভেসে আছে।কোনো মেয়ের লাশ হবে হয়তো।মাথার চুলগুলো দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। পকেট থেকে ফোনটা বের করে ফোন লাগায় পুলিশ স্টেশন এ। খবরটা জানিয়ে আরো পাড়ের কাছে যায় সে।নদীর পানি শুকিয়ে হাটুঅবদি।স্রোত নেই।স্রোত থাকলে এতক্ষণ লাশটা ভেসে চলে যেত কোথায়। তার ঠিক ঠিকানা নেই।

আহারে কোন মায়ের কোল না জানি খালি হলো।মোখলেসের গলায় আফসোসের সুর। আরো খানিকটা কাছে গিয়ে দেখার চেষ্টা করে সে।

—————————–

বারান্দায় বসে আছে মায়ার মা।গুনগুনিয়ে কাঁদছে সে।মিষ্টিও কাঁদছে। পাশেই দাড়িয়ে আছে মায়ার জেঠিমা নাজমা। কড়া গলায় কথা শুনাচ্ছে জাহানারাকে।আজ মায়ার উধাও হওয়ার পিছনে জাহানারার হাত আছে।ঘরের মেয়ে ঘরে নেই,আর তা মা হয়ে জানবে না এ কেমন কথা।নাজমার চিল্লাচিল্লিতে পাড়ার আরও মহিলা এসে উপস্থিত হয়েছে। আঁচলে মুখ গুজে জাহানারাকে সান্তনা জানালেও আড়ালে সবাই ছি ছি করতে ভুল করছেনা।

হঠাৎই গেটটা খুলে প্রবেশ করে তমাল।এই পরিস্থিতিতে তমালের উপস্থিতি যেন আগুনে ঘি ঢালার মতো।কড়া গলায় কিছু কথা শোনানোর জন্য নাজমা তেড়ে গেলেও তমালের হাবভাব দেখে থমকে যায়।মায়া যদি তমালের সাথেই যায় তাহলে তমালে কি সাহস হয় এখানে আসার।তমাল কোনো ভণিতা ছাড়াই বলে ওঠে,

“মায়াকে কখন থেকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না চাচি,”

————————–

নদীর পাড়ের ভীড় ক্রমশ বেড়েই চলেছে।মোখলেস মিয়ার আহাজারিতে আকাশ-পাতাল ভারী হয়ে যাচ্ছে। গলা ছেড়ে বাচ্চাদের মতো কান্না করে যাচ্ছেন তিনি।তিন-চারজন মিলে তাকে বাধা দিচ্ছে বারবার পানিতে নেমে যাওয়া থেকে।

“ও মা,মা রে,তোর কি হলো,আমি কাকে মা বলে ডাকব,ও মা রে ,,,,,,,,,,”
কলিজাটা ছিড়ে যাচ্ছে মোখলেসের। ও হাতের আংটি দেখেই চিনতে পেরেছে।

মোখলেস মিয়ার দুই ছেলে কোনো মেয়ে নাই।নিজের সন্তানের চেয়েও বেশি ভালোবাসে ভাইয়ের মেয়েদুটোকে।মায়াকে একটু বেশিই ভালোবাসত।মায়া দেখতে অবিকল মোখলেসের মায়ের মতো।কথা-বার্তা, চালচলন হাসি সব,সবই তার মায়ের মতো।তাইত ভালোবাসার ভাগটাও তার বেশি।কদিন আগেই মায়াকে একটা সোনার আংটি বানিয়ে দিয়েছিলো সে।একটু আগে সে যখন ভালো করে দেখার জন্য পানির একেবারে কিনারায় আসে,তখনই আংটির দিকে নজর যায় তার।

ঝনাৎ করে গেটটা খুলে কেউ দৌড়ে বাড়িতে ঢোকে।তড়িঘড়ি করে গিয়ে দাড়ায় মায়াদের বাড়ির উঠোনে।দৌড়ানোর জন্য ধুঁকিয়ে গেছে সে।হাঁপাতে হাঁপাতে বলে ওঠে,

“তাড়াতাড়ি নদীর ঘাটে চলেন,নদীতে কারজানি লাশ ভেসে আছে।নদীর পাড়ে মোখলেস চাচা কান্নাকাটি করতেছে,,,,,,,,,,

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here