#অস্তিত্ব
#পর্বঃ১১
#বনলতা
চারদিকে ফজর এর আজান দিয়েছে কিছুক্ষণ আগে। মায়ার বাবা মোরশেদ আলী মসজিদ থেকে নামায পড়ে এসেছে মাত্র। মায়ার মা জাহানাটা বেগম এর নামায পড়া হয় নাই এখনও।তাই মায়ার বাবা রান্নাঘর থেকে বাজার করা বড় ব্যাগটা আর টাকা নিয়ে বেড়িয়ে গেলেন।আজ ছেলেপক্ষের লোকেরা আসবেন।উনি যাচ্ছেন সদরে।ভালো টাকটা দই আর মিষ্টি কিনতে।মাছ মাংসসহ অন্যান্য বাজারপাতি কালই করেছেন।শুধু মিষ্টি আর দই আনা হয়নি।ফ্রিজে রাখা মিষ্টি আর দই খেয়ে তৃপ্তি হয়না মায়া আর মিষ্টির।ওরা দুবোন মিষ্টি খেতে খুব ভালোবাসে।মায়ার মা দই বানাতে পারেন।খুব স্বাদ হয় সেই দই।কিন্তু বাসায় বানাতে গেলে পর্যাপ্ত সময় লাগে।সময়ের অভাবে কিনে আনতে হচ্ছে।
নামায শেষে প্রতিদিন কোরআন শরিফ তেলওয়াত করেন জাহানারা।আজও তেলওয়াত করছেন।কোরআন এমনই এক কিতাব বা তেলওয়াতে অনাবিল আনন্দের প্রশান্তি অনুভব হয়।কিন্তু আজ কেন জানি তার মনটা উসখুস করছে।কিছুক্ষণ তেলওয়াত করার পর তিনি উঠে পড়লেন।অন্যদিন এতক্ষণ মায়া উঠে নামায পড়ে নিতো।আজ কোনো সাড়া শব্দ নেই।মনে হয় ঘুমিয়ে আছে।কাল আশাদের ওখান থেকে বাড়ি আসতেই অনেক রাত হয়েছিলো। ওয়ারড্রবের ওপর কোরআন শরিফ রেখে পা বাড়ান মায়ার রুমের দিকে।
পশ্চিমাকাশে হালকা লাল আভা তাও হালকা অন্ধকারের জন্য অস্পষ্ট লাগছে।মায়ার দরজায় টোকা দিতে গিয়ে খেয়াল করলেন দরজা খোলা।মিষ্টি ঘুমিয়ে আছে বিছানায়।পুরো রুমের কোথাও মায়া নেই।তবে কি মায়া ওয়াশরুমে।জাহানারা মনে ভাবলেন মায়া মনে হয় ওয়াশরুমে। তাই আর তাকে না ডেকে চলে আসে ঘরের বাহিরে।খোয়ারে হাস মুরগী গুলো ডাক পেড়ে চেঁচানো শুরু হয়ে গিয়েছে।উঠোনে গিয়ে খোয়ারের মুরগীগুলো ছেড়ে দিতেই জাহানারা খেয়াল করলেন ওদের বাড়ির চারপাশে যে প্রাচীর দেওয়া আছে তাতে মই লাগানো।আৎকে ওঠেন তিনি।প্রাচীরের ওপরে ছোট ছোট লোহা উপুর করে গেঁথে দেওয়া হয়েছে।যাতে সহজে কেউ বাড়িতে প্রবেশ করতে না পারে।ওই লোহাতে লাল রক্তের মতো কি জানি লেগে আছে।
কাছে গিয়ে ভালো করে দেখে নেয় সে।এতো রক্ত!রক্ত কই থেকে আসল।সকাল থেকেই মনটা তার কেমন জানি করছে।অজানা আংশকায় বুকটা ধরফর ধরফর করছে।এতক্ষণ এই ভাবনাগুলোকে আকাশকুসুম ভাবলেও এখন তা জোড় করেও মাথা থেকে সরাতে পারছেননা তিনি।তড়িঘড়ি করে খোঁয়ারটা আবারও ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করল সে।নাহ্!হাঁস মুরগী এমনকি ডিমগুলো সবই ঠিক আছে।তাহলে এগুলো কিসের আলামত।
দৌড়ে ঘরে প্রবেশ করে সে।তড়িৎ গতিতে এঘর-ওঘর,আলমারি,ওয়ারড্রব, টাকা,মায়ার জন্য গড়িয়ে আনা গয়না সব দেখলেন উনি।নাহ্ সবই ঠিক আছে।কিছুই হারায়নি।একটা জিনিসপত্রও এদিক থেকে ওদিক সরেনি।
“আল্লাহ্ আমার সুখের সংসারে এ কোন দুঃখের নিশানা,যদি চোরই আসে তাহলে কিছু নেবে না কেন।মিষ্টিও তো ঘরে শুয়ে আছে।আর মায়……….,,
আর বলতে পারেনা জাহানারা। ওতো সব দেখল কিন্তু মায়াকে তো কোথায় দেখলো না।সব আছে মায়া নাই।শোয়ার ঘর,রান্নাঘর,পুরোনো হাড়িপাতিল রাখার ঘর,এমনকি গোয়ালঘর অবদি হাঁতিয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে জাহানারা মায়াকে।
নাই মায়া কোথাও নাই।পুরো বাড়ি জুড়ে কোথাও মায়ার #অস্তিত্ব নাই।পিঁড়িতে বসে পড়ে জাহানারা।মিষ্টিকে ডাকতে থাকে।ঘুমে বিভোর থাকা মিষ্টি মায়ের আচমকা কান্নার সুরে বেড়িয়ে আসে ঘরের বাহিরে।
———————————–
ঘুম থেকে উঠেই আশা দেখে ইফতি পাশে নেই। ও তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হয়ে নামায আদায় করে নেয়।নামায শেষে সারা ঘরময় পায়চারি করতে থাকে।কি করবে ভেবে পায়না সে।এখনকি ও বাহিরে যাবে।নাকি পরে যাবে।নতুন মানুষ আর নতুন পরিবেশ,ভীষণ অস্বস্তি হয় আশার।মনে হচ্ছে অনেক আগেই তার বিয়ে করে এখানে আসা উচিত ছিলো।যাতে এখন লজ্জা পাওয়া থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যেত।পুরাতন হওয়ার সুবাদে তাহলে তার লজ্জা কম লাগত।পরক্ষণেই নিজের বোকা বোকা ভাবনায় নিজেই বোকা বনে যায় সে।
একটু পরেই দরজা খুলে ঘরে আসে ছোট একটা মেয়ে বয়স বারো তেরো হবে হয়ত।ভারি মিষ্টি দেখতে।এসেই আশাকে নিয়ে গেলো বাহিরে।আশা বাড়িটা দেখে অবাক হয়।এমন বাড়ি তাদের কাছে রাজপ্রাসাদ এর মতো।মেয়ের ভালো থাকার জন্য ওরা ভুল বাড়ি দেখেনি।কিন্তু আদৌও কি অর্থে সুখ মেলে।
আশার শ্বাশুড় বড় রাশভারি মানুষ।দরকারের বেশি একটা কথাও বলেনা।কিন্ত ওর শ্বাশুড়ি বড়ই ভালো।মুখ থেকে হাসি সরতেই চায়না।কিন্তু বেচারি আবার শ্বাসকষ্টের রোগী।সর্বদা ইনহেলার সাথে নিয়ে থাকেন।ফর্সা মোটামুটি গোলগাল চেহারার মানুষটা অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠেন
।তবুও আশার মন ভুলাতে কতই না হাসি আর মজার কথা বলছে।একটু পর ইফতি ও আসে।মা ছেলে মিলে গল্প চলছে আর হাসছে।আশা অবাক নয়নে চেয়ে আছে।কত ভালো মানুষ এরা।ও কি পারবে নিজের আবেগকে মাটিচাপা দিয়ে এই নিষ্পাপ হাসিতে মত্ত থাকা মানুষগুলোকে নিয়ে সুখে থাকেতে।ওদের মুখে হাসি ফুটাতে।
—————————-
পাড়ার সবচেয়ে দুরন্ত ছেলেপুলের যে দল আছে তাতে ক্ষুদে লিডার হচ্ছে শিহাব।ওদের দুরন্তপনা শুরু হয় সকালে আর শেষ হয় সঁন্ধা পর্যন্ত। সারাদিন দৌড়ঝাপ করা,নদীতে সাতার কাটা,গাছে চড়ে চুরি করে আম পাড়া,বরই পাড়া, এমন হাজারো কর্ম করে বেড়ায় তারা।
দুরের গ্রাম থেকে কিছুলোক ক’দিন হলো এই গ্রামে এসেছে।মুলত ওদের গ্রামে গ্রীষ্মের আগেই নদীর পানি শুকিয়ে যায়।আর এখনও গ্রীষ্মের মাঝামাঝি। তাই ওরা ওদের হাঁসের বহর নিয়ে এখানে তাবু গেঁড়েছে।তাতেই শিহাবদের লিস্টে নতুন কাজ যোগ হয়েছে।প্রতিদিন সকালে ওরা হাসগুলো ছেড়ে দেয়। তখন হাসগুলো পানিতে না নেমে পাড়ে কিছুক্ষণ বসে থাকে।শিহাব আর ওর বয়সী ছেলেগুলো তখন লাগাতার হাসগুলোকে ঢিঁল ছুড়তে থাকে।
আজও তারা ঢিঁল ছুঁড়তেই ব্যস্ত ছিলো। হঠাৎ দেখে এতগুলো হাঁসের ঝাঁপাঝাপিতে পানির নিচে থেকে বড় বড় চুল ভেসে ওঠে।শিহাবরা অতি দুরন্ত হলেও কখনও এই জায়গাটায় নামেনি।এই জায়গাটা অন্য জায়গা থেকে কিছুটা হলেও ভিন্ন আছে।এই জায়গায় পানি কখনও শুকায় না।আরো অনেক কাহিনী।চিৎকার করে ওঠে ছেলেগুলো।সারাদিন ওর চিৎকার করেই বেড়ায়।কিন্তু আজকের চিৎকারে ছিলো ভয় আর সাহায্যের আকুতি।প্রাণের ভয়ে ছেলেগুলো প্রাণপ্রণে দৌড়াতে থাকে।বুড়ির চুল ভেসে উঠেছে।ওরা তো বুড়িকে না জেনেই ঢিঁল ছুড়েছে।ওরা তো জানত না যে বুড়ি ওখানেই আসবে।
দৌড়াতে দৌড়াতে নদীর পাড় থেকে সড়কে এসে সামনের দোকানে গিয়ে কাঁদতে থাকে তারা।সাত-আট জনের ছোট্ট কাফেলা।সকলের চোখে পানি।চোখেমুখে আতংক।সকলের মুখে একটাই কথা,আমি বুঝতে পারিনি,আমি ইচ্ছে করে ঢিঁল মারিনি।প্রাণভয়ে ভীত হয়ে তারা লুকাতে চাইছে।উপস্থিত সকলেই যারপরনাই বিস্মিত হয়।এই ছোট ছোট ছেলেরা যারা কোনোকিছুতে ভয় পায় না তাদের আজ কি হলো।কিই বা দেখেছে ওরা।আর কাকেই বা ঢিঁল মেরেছে।
চলবে