অশান্ত বসন্ত পর্ব-৩৩

0
624

#অশান্ত বসন্ত।
(৩৩ পর্ব)
জয়া চক্রবর্তী।
********************

চোখের কোনে ছলকে ওঠা জলের জন্য গাড়ি চালাতে অসুবিধা হচ্ছিলো বরুণ সাহার। হাতের পিছনটা দিয়ে চোখ দুটো মুছে নিলো।

মানুষের জীবনটা সত্যিই বড়ো অদ্ভুত, প্রথমে তো সে জন্মগ্রহণ করে পৃথিবীতে আসে,পরিবেশ আর পরিস্থিতি কিছু লোকজনকে একান্ত আপন ভাবায়, তারপর আবার তাদের জীবন থেকে সরিয়ে দিয়ে বারবার একা করে দেয়।

খুশি তো আর কিনতে পারা যায়না।যদি খুশি কিনতে পারা যেতো তাহলেও হয়তো বরুণ সাহার সেই দোকানে পৌঁছোবার আগেই খুশি শেষ হয়ে যেতো।

দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো বরুণ সাহা। ভেবেছিলো কখনো নিজের কথা ভাববেনা।কাজের মধ্যেই ডুবে থাকবে রাত দিন।ছিলোও সেই ভাবেই।কিন্তু কিভাবে যেন শিখাকে ভালো লেগে গেলো।শিখার চোখ দুটো আবার ভেসে উঠলো চোখের সামনে।

বহ্নির চোখেমুখে স্পষ্ট যে বরুন সাহাকে ওর দিদিয়ার জীবনের অংশ করতে ও বিন্দুমাত্র আগ্রহী নয়।এদিকে শিখাকে ছাড়া ভাবতে পারছে না কিছু।

না কিচ্ছু ভালো লাগছেনা ওর,কিচ্ছুনা।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সাড়ে বারোটা বাজে।বহ্নির কথা শুনে বেরিয়ে এসেছিলো পার্টি থেকে।তখন থেকেই উদ্দেশ্য বিহীন ভাবে গাড়ি চালাচ্ছে।

আর নিজেকে নিজে নানা প্রশ্নে জর্জরিত করে চলেছে। অথচ কোনো উত্তর পাচ্ছেনা।হয়তো জীবনে সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হয় না,জীবনে সব অপমানের জবাবও দিতে হয় না।জীবনে সব না পাওয়াগুলোকে একটা সময় মেনে নিতে হয়।

তবে এই বাতিলের খাতায় রাখা হিসাবগুলো কখন যে কিভাবে চেপে বসবে সেটাও বোঝা মুশকিল।
ফোনটা বেজে উঠলো বরুন সাহার।তাকিয়ে দেখলো,মায়ের ফোন।নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হলো।

এতো রাত অবধি মাকে জাগিয়ে রাখবার জন্য।ফোনটা রিসিভ করে মাকে নিশ্চিন্ত করে বাড়ির অভিমুখে গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে নিলো।

জন্ম ও মৃত্যুর অধিকার মানুষের হাতে না থাকলেও বিয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ তো অবশ্যই থাকে।তবে সেই নিয়ন্ত্রণ অন্যের ওপর চাপানো যে অন্যায় সেটা পল্লবের কথাতে পরিস্কার ভাবে উপলব্ধি করতে পেরে বহ্নি ঠিক করে অফিস থেকে ফিরে পল্লবকে নিয়ে বরুণ সাহার বাড়িতে যাবে।

কিছু জিনিস বরুণ সাহার কাছে আগেই পরিস্কার করে দেওয়া দরকার, অন্ধ আবেগের বশে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে পরে পস্তানোর চাইতে।

প্রতিটি মানুষের কিছু আশা থাকে মনের মানুষটিকে ঘিরে,তার বাস্তবতা যখন হতাশ করে তখন বিচ্ছেদের আগুনে জ্বলে নিজের অপরিনামদর্শীতার জন্য হা-হুতাশই সম্বল হয়।

দিদিয়ার খামতি গুলোকে প্রথম প্রথম মেনে নিতে পারলেও পরে হয়তো এটাই বরুন সাহার বিরক্তির কারন হয়ে উঠবে।তাছাড়া বিয়ে দুটো মানুষের সাথে হলেও তাদের পরিবার গুলোর ভুমিকা তো আর অস্বীকার করা যায়না।তাদের ইচ্ছে ভাবনা আশা স্বপ্ন সব জড়িয়ে থাকে।

তবে বহ্নি চায় না বরুণ সাহা হঠাৎ আবেগে ভেসে গিয়ে বিয়ের মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে পরে নিজের সিদ্ধান্তের জন্য নিজেই অনুতপ্ত হন।কারন সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার দিদিয়া।

তাছাড়া যেখানে উনি চাইলেই যে কোনো সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের শিক্ষিতা মেয়েকে নিজের জীবন সঙ্গিনী রূপে পেতে পারেন,সেখানে এই ধরনের প্রস্তাব দিলেন এটাই ভাবাচ্ছে বহ্নিকে।

টিফিন টাইমে বহ্নির মেসেজ দেখে মনটা খুশিতে ভরে উঠলো পল্লবের।বরুন সাহাকে ফোন করে জানালো যে আজকেই অফিস ফেরত বহ্নিকে নিয়ে বরুণ সাহার বাড়িতে যাবে,সময় করে উনি যেন বাড়ির এড্রেসটা হোয়াটসঅ্যাপ করে দেন।

তারপর বহ্নিকে মেসেজের উত্তরের সাথে দুটো লাভ রিএক্ট পাঠিয়ে দিলো।এই বিয়েটা হলে সত্যিই ভালো থাকবে শিখা।বহ্নি যে ওর কথার গুরুত্ব দিয়ে বরুণ সাহার সাথে কথা বলতে ওর বাড়িতে যাচ্ছে এটাই অনেক পল্লবের কাছে।

বরুণ সাহার মা কাজের মেয়েকে দিয়ে ওদের ঝকঝকে ফ্ল্যাটটা আরো একবার ঝারিয়ে রাখলো।আজ ওনার সত্যিই খুশির সীমানা নেই।ঠিক করলেন মিষ্টির সাথে লুচি ছোলারডাল বানিয়ে দেবেন।অফিস ফেরত আসছে যখন খিদেও তো পাবে ওদের।

বহ্নি একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরে দিদিয়াকে জানালো যে আজকেই বরুণ সাহার বাড়িতে যাবে,তাড়াতাড়ি দিদিয়াকেও তৈরি হয়ে নিতে।কথাটা শুনে এক গাল হাসির সাথে বহ্নিকে জড়িয়ে ধরলো ওর দিদিয়া ।
বহ্নি বুঝতে পারে কতোটা খুশি হয়েছে দিদিয়া ওর কথায়।

কলিংবেল বাজাতেই বরুণ সাহা এসে দরজা খুললো।পল্লব আর বহ্নির সাথে শিখাকে দেখে ভীষণ ভালো লাগলো বরুণ সাহার।

ওদের নিয়ে বসবার ঘরে ঢুকে পরিচয় করিয়ে দিলো মায়ের সাথে। শিখা আজকে হলুদ রঙের শিফন পরে।স্নিগ্ধতা যেন টপকে পরছে ওর শরীর থেকে।বরুন সাহার মা শিখাকে নিজের পাশে বসালেন।

তারপর বহ্নিকে বললেন,’আমি জানি তুমি খুব চিন্তিত তোমার দিদিয়াকে নিয়ে,তবে এই কথাটা আমাদের দুজনের তরফ থেকে দিতে পারি যে তোমার দিদিয়ার কোনো রকম অমর্যাদা হবেনা এই বাড়িতে’।

বহ্নি বললো,’অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু আমার অনেক কিছু বলবার আছে যে আপনাদের।আমি চাইবো কোনো কিছুই গোপনীয় না থাকুক’।

এরপর বহ্নি সেই ছোটোবেলা থেকে শুরু করে একে একে সমস্ত ঘটনা জানালো ওদের।বরুন সাহার মা উঠে এসে বহ্নির হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন,’ভরসা রাখতে পারো আমাদের ওপর,তোমার দিদিয়া ভালো থাকবে এখানে’।

বরুণ সাহা বললেন,’এবার বুঝতে পারছি কেন গতকাল ওই ভাবে রেগে গিয়েছিলেন।নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন এই বিষয়ে যে আমি ছাড়বার জন্য হাত ধরছিনা।তবে আমি চাইবো বিয়েতে আপনাদের বাবাও উপস্থিত থাকুন’।
বরুণ সাহার কথায় শিখার মুখটা নিমেষে শুকিয়ে গেলো।

বহ্নি বললো,’কেন চাইছেন উনি থাকুক?আমরা তো ওনার সাথে যোগাযোগ রাখতে চাইনা।’
বরুণ সাহা বলেন,’প্লিজ ওনাকে আসতে দিন বিয়েতে।শিখার বাকি জড়তাটাও কেটে যাবে উনি আসলে,এই কথাটা আমি ডাক্তার হিসেবে বলছি’।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here