(৩০ আর ৩১ পর্ব দুটো একসাথে)
**************************************
#অশান্ত বসন্ত।
(৩০ পর্ব)
জয়া চক্রবর্তী।
********************
সকাল থেকে একেই প্রচন্ড বৃষ্টি তার ওপর সৃঞ্জয় কোনো মেসেজই করেনি পিউকে। অথচ আজকেই দেখা করবার কথা ছিলো। সৃঞ্জয়কে ফোন করবে কি! কিন্তু সৃঞ্জয়ের তো নিজেরই ফোন করা উচিত ছিলো।
প্রায় পাঁচটা বাজতে চললো। কিছু না জানালে কি করে চলবে! আসতে না পারলে জানিয়ে দিতে পারতো। বরুন দাকেও আটকে রেখেছি বের হবো বলে! কি যে করে না ছেলেটা!’ এসব নানান ভাবনায় অস্থির হয়ে ঘরের মধ্যেই পায়চারি করছিলো পিউ।
ঠিক তখনই বেজে উঠলো ফোনটা। পিউ ছুটে গিয়ে ফোনটা ধরে ‘হেলো’ বলতেই সৃঞ্জয় বললো,’চলে এসো, আমি তোমাদের ফ্ল্যাটের বাইরেই আছি’।
পিউ বললো,’মানে কি? সকাল থেকে মেসেজ করোনি,আমার মেসেজের রিপ্লাই ও দাওনি, ফোনটা পর্যন্ত সুইচ অফ করে রেখেছো। এভাবে হয় নাকি!’
সৃঞ্জয় বললো,’যাহ বাবা!কাল রাতেই তো কথা হলো, বিকেল পাঁচটায় তোমাদের ফ্ল্যাটের বাইরে থেকে তোমায় পিক আপ করবো।আমি কি করে বুঝবো তুমি ভুলে যাবে?’,পিউ বললো,’ভুলবো কেন?কিন্তু তা বলে সকালে একবার কনফার্ম করবেনা?যেভাবে বৃষ্টি পরছিলো আজ।আচ্ছা তুমি ওপরে চলে এসো।আমি রেডি হয়ে নিয়ে বের হচ্ছি’।
সৃঞ্জয় বললো, তুমি রেডি হয়ে নীচে এসো।গাড়ির ভিতর বসে অপেক্ষা করতে আমার কোনো অসুবিধা নেই।আমি গেলে তো আবার চা কফির অফার করবে।এসব করতে গিয়ে দেরি হয়ে যাবে’।
পিউ বললো,’বেশ ওয়েট করো, আসছি’।আলনা থেকে নীল রঙের সালোয়ারকামিজটা নিয়ে চটপট পরে নিলো পিউ,চুলটা আঁচড়ে নিয়ে ক্যাচার দিয়ে আটকে, হালকা লিপস্টিক দিয়ে রেডি হয়ে নিলো।
বাইরের ঘরে দেখলো বরুন সাহা সোফায় হেলান দিয়ে বই পড়ছে।শিখাদি জানালার সামনে চেয়ারে বসে একমনে আঁকছে।
পিউ বললো,’বরুনদা আমি বের হচ্ছি, সৃঞ্জয় নীচে অপেক্ষা করছে।দাদা সাতটা নাগাদ চলে আসবে।পারলে থেকে যেও প্লিজ’।বরুণ সাহা হেসে বললো, ‘সাবধানে যেও’।
ঠিক এই মুহুর্তটারই অপেক্ষা করছিলো বরুণ সাহা। ভালো লাগারা জমাট বেঁধে কখন যেন ভালোবাসায় পরিনত হয়েছে।সারা দুপুর বই নিয়ে বসে থাকলেও বইয়ের আড়াল থেকে শুধু শিখাকেই দেখে গেছে।
বরুণ সাহার আজ মনে হচ্ছে,
‘বাকি আছে আরো অনেক কিছুর,
অনেক না পাওয়া শিহরনের স্বাদ,
বাকি আছে নতুন করে কাউকে
ভালোবাসা দেওয়ার এবং
পাওয়ার অধিকার’।
কথা বলার জন্যই শিখার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো বরুণ সাহা। “কিছু বলবো বলে এসেছিলেম, রইনু চেয়ে না বলে” ঠিক এই অনুভূতিটি আচ্ছন্ন করে দিলো বরুন সাহাকে।অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন শিখার আঁকার দিকে।
দীপক বলছিলো বটে,দারুণ আঁকার হাত মেয়েটার।কিন্তু এতোটা সুন্দর সেটা বুঝতে পারেনি।
একটা সময় ছিলো বরুন সাহা নিজেও আঁকা আঁকি করতো মনের তাগিদে।
আসলে শিল্প হলো অপ্রয়োজনের প্রয়োজন। শুধু শিক্ষার্থীর জন্যই শিল্পের নিয়ম কানুনের বাঁধাধরা নিয়ম থাকে।কিন্তু শিল্পীর সৃজনশীল মন কোনো বাঁধা মানেনা।কোনো নিয়ম কানুন মানেনা।তাই সৃষ্টি সেখানে নিজের তালেই নেচে বেড়ায়।আসলে এই প্রয়োজনটুকুর মধ্যেই আছে শিল্প সৃষ্টির আসল রহস্য।
এই প্রয়োজনের তাগিদেই শিল্পী তার তুলির আঁকড়ে বিশ্বপ্রকৃতির অধরা রূপকে অবয়ব দিতে একটার পর একটা সৃষ্টি চালিয়ে যায়।
মুখ থেকে বেরিয়ে আসলো, ‘অসাধারণ ‘,শিখা চমকে দাঁড়িয়ে পরলো।বরুন সাহা বললেন,তোমার চোখ দুটো যতটা সুন্দর, ঠিক ততোটাই সুন্দর তোমার আঁকার হাত’।
শিখা কি বলবে বুঝতে না পেরে মাথা নীচু করলো।বরুণ সাহা বললো,’কিছু প্রশ্নের কোনো উওর হয় না জানো।এই যে এতো বছর ধরে এতো পেশেন্ট নিয়ে ঘাটাঘাটি করেছি,তাদের মুখের ভাষা এনেছি,ভাষার জড়তা কাটিয়ে তাদের আত্মনির্ভর করেছি,অথচ সেই আমি হঠাৎই কেন তোমার চোখে নিজের ভাষা হারিয়ে ফেললাম? ‘
শিখা ধীরে ধীরে চোখ দুটো মেলে পূর্ন দৃষ্টিতে তাকালো বরুন সাহার দিকে।
‘দুমাস বাদে আমাকে আর তোমার প্রয়োজন পরবে না।তোমার স্পিচ থেরাপিস্ট হিসেবে এটা আমার জয়ের উপহার।অথচ তোমার সাথে দেখা হবেনা এই ভাবনাতে কেন এতো উতলা হয়ে উঠি?’
একটু থেমে নিয়ে আবার বললেন,’আমি বিপত্নীক হলেও কখনো মনে হয়নি আবার নতুন করে জীবনটাকে সাজাবো,অথচ আমার জীবনের সেই বিশেষ জায়গাটায় তোমাকেই কেন দেখতে চায় মন?’,বরুন সাহার কথায় শিখার চোখ দুটো জলে ভরে যায়।
বরুন সাহা বলে,’প্লিজ কেঁদোনা।আমি বুঝিনি তোমায় কষ্ট দিয়ে ফেলবো।বুঝলে আমি হয়তো এসব জানাতাম না তোমায়,কিন্তু না জানিয়ে ও যে পারছিনা’,শিখা কোনো কথা না বলে বরুন সাহার বুকে মুখ গুজে দেয়।ভালো লাগার প্রবল বৃষ্টিতে ভিজে যেতে থাকে দুটো মন,শব্দের আর কোনো প্রয়োজন হয়না।
(চলবে)
#অশান্ত বসন্ত।
(৩১ পর্ব)
জয়া চক্রবর্তী
*******************
“এমনি করে যায় যদি দিন যাক না/মন উড়েছে উড়ুক নারে/ মেলে দিয়ে গানের পাখনা” গানটা গাড়ির মিউজিক সিস্টেমে চলছে, স্টিয়ারিং হাতে সৃঞ্জয়, পাশে হাওয়াতে এলোমেলো চুলে বসে পিউ।
সৃঞ্জয়ের চোখ বারবার খেলা করছে পিউয়ের চোখে, মুখে,চুলে।পিউ বুঝতে পারছে সৃঞ্জয় ওকেই দেখছে।
তাই একটা আড়ষ্ট ভাব কাজ করছে ওর মধ্যে। সৃঞ্জয় হঠাৎ বলে উঠলো,’লজ্জা পাচ্ছো না ভয় পাচ্ছো?’
পিউ হেসে বললো,’না না লজ্জা,ভয় কোনোটাই পাচ্ছিনা’।
এদিকে পিউয়ের গলা শুকিয়ে কাঠ।কোনোরকমে বললো,’জলের বোতল আনা উচিত ছিলো’।সৃঞ্জয় হেসে নিজের জলের বোতলটা এগিয়ে দিলো।
পিউ ঢকঢক করে কিছুটা জল গলায় ঢেলে নিলো।
সৃঞ্জয় বললো,’কোথায় যাবে বলো?কোনো কফিশপে যাই আমরা?’পিউ একটু চুপ থেকে নিজেকে গুছিয়ে নিলো।আসলে ওর ইচ্ছে ছিলো প্রিয় মানুষটির সাথে ট্রেনে করে যেতে যেতে হঠাৎই দুরের কোনো অচেনা স্টেশনে নেমে পরবে,তারপর একসাথে হারিয়ে যাবে দুজন’।
সৃঞ্জয়কে হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটিং এর সময় একদিন বলেছিলো ওর এই ইচ্ছের কথা।তাতে সৃঞ্জয় জানিয়েছিলো,ও ট্রেনে কমফোর্টেবল নয়,তাই
পিউকে গাড়িতেই একটু এডজাস্ট করে নিতে হবে।
পিউকে চুপ করে থাকতে দেখে সৃঞ্জয় আবার জিজ্ঞেস করলো,’জানালে না কোথায় যেতে চাও?’
পিউ বললো,’চাই গাড়িটা কোনো খালি জায়গায় দাঁড় করিয়ে নিজেরা পায়ে হেঁটে যাবো মানে ওই উদ্দেশ্য বিহীন যাত্রা আর কি! তারপর ক্লান্ত হলে পথের পাশের কোনো চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে ভাঁড়ে করে চা আর প্রজাপতি বিস্কুট’।
সৃঞ্জয় হাসলো।বললো,’ বেশ তাই হবে।দুজনে হেঁটে হেঁটে অনেকটা দূর যাবো।আচ্ছা পিউ হাত ধরা যাবে তো?’, পিউ সৃঞ্জয়ের কথা বলার ভঙ্গিমায় হেসে ফেললো।
সেদিন পিউয়ের কথা মতোই নির্জন রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়েছিলো সৃঞ্জয় ,তারপর দুজনে গাড়ি থেকে নেমে নিজেদের হাত মুঠোয় ভরে , হারিয়ে গিয়েছিল শুধু হারাবার জন্যই।
ওদের দুজনের চোখ মুখ দেখলে যে কেউ বুঝে যেতো যে ওই মুহূর্তে ওরা সব পেয়ে গেছির দেশে পৌঁছে গেছে।
রাতে আর সেদিন ঘুম আসেনি কারো চোখে।সারা রাত নিজেদের মিউট রেখে ভিডিও কলে নির্নিমেষ চেয়ে ছিলো দুজন।
প্রত্যেকের জীবনে এমন একজন আসে যাকে বাদ দিলে বা বাদ দেওয়ায় কথা ভাবলেও শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়,যাকে বাদ দিতে গেলে বেঁচে থাকা অর্থহীন মনে হয়,মনে হয় তাকে না পেলে বুঝিবা শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে।
সে পাশে থাকলে শ্বাস প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যায়,চোখ বুজে যায় আবেশে,দূরে যাওয়ার ভাবনাটাও শূন্যতার সৃষ্টি করে মনে অথচ দুরেই তো যেতে হবে পিউকে ছেড়ে।মেয়েটাকে ওর স্বপ্ন গড়বার সুযোগ আর সময়টা তো দিতেই হবে।
পিউয়ের সাথে পরিচয়ের মেয়াদ খুব বেশি নয়।দেখাও হয়েছে মাত্র হাতে গোনা কয়েকদিন।কিন্তু মনে হচ্ছে যেন কতো জন্ম ধরে পরিচয় দুজনের। ভীষণ রকম অস্থিরতা ঘিরে ধরেছে সৃঞ্জয়কে যখন থেকে ট্রান্সফার লেটারটা হাতে পেয়েছে।
ওকে ওদের আমেরিকার ব্রাঞ্চের হেড করে পাঠানো হচ্ছে।আগে হলে খুশি হতো কারণ নিজেও তো সৃঞ্জয় এটাই চাইতো।কতো পরিশ্রম করেছে এই দিনটা দেখবার জন্য।দিন রাত এক করে কাজ করে গেছে। অথচ ফল পাওয়ার পর মনে হচ্ছে এটা ওর জিৎ নয় হার।
ঘরে ফিরে ফ্রেস হয়ে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পরলো সৃঞ্জয়। আজ অফিস ছুটি হওয়ার পর সোজা বাড়ি চলে এসেছে। ‘কিরে অসময়ে শুয়ে আছিস যে?’,মায়ের কথার উত্তর দেয়না সৃঞ্জয়।
‘পিউ ফোন করেছিলো আমায়।ফোন ধরছিস না কেন ওর?’,এবার সৃঞ্জয় বললো, ‘আমার মাথাটা একটু টিপে দেবে মা?’,অঞ্জনা তাড়াতাড়ি এসে ছেলের কপালে গলায় হাত ছোঁয়ায়,তারপর জ্বর আসেনি দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে কপাল টিপে দিতে বসে।
সৃঞ্জয় জানায় ওর ট্রান্সফারের কথাটা।অঞ্জনা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে বললো,’এটা তো দারুণ খবর।মুখ ভার করে শুয়ে আছিস কেন?সেই কবে থেকে তো পরিশ্রম করছিলিস।পিউকে জানিয়েছিস?দাঁড়া ফোন করছি আমি,তোর বাবাকেও জানাই গিয়ে’।
পিউকে ফোন করতেই অপর প্রান্তে থেকে উদবিগ্ন গলাতে হেলো বলে উঠলো পিউ।অঞ্জনা সৃঞ্জয়ের হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
সৃঞ্জয় হেলো বলতেই পিউ রীতিমতো অভিযোগের বন্যা বইয়ে দেয় ফোন না করার জন্য,ফোন না ধরার জন্য।
সৃঞ্জয় চুপচাপ সব কথা শোনে।তারপর জানায় নিজের ট্রান্সফারের কথাটা।এবার পিউ ও নির্বাক হয়ে যায়। ফোনটা কেটে দিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকে বেশ কিছুটা সময়।
তারপর সোজা চলে যায় দাদাভাইয়ের ঘরে।পল্লব একমনে কাজ করছিলো ল্যাপটপে। পিউ এসে বললো,’আচ্ছা দাদাভাই আমি তো বিদেশের ইউনিভার্সিটিতে ও মাস্টার্স এর জন্য এপ্লাই করতে পারি’।পল্লব বললো,’ তা পারিস।কিন্তু হঠাৎ দেশের প্রতি বিদ্বেষ জন্মানোর কারনটা কি শুনি?’
‘সৃঞ্জয় ট্রান্সফার হয়ে গেছে ওদের আমেরিকার ব্রাঞ্চে।ভাবছি ও যাওয়ার আগেই আমাদের রেজেষ্ট্রিটা সেরে নেবো।তারপর আমিও ওখানের ইউনিভার্সিটিগুলোতে মাস্টার্সের জন্য এপ্লাই করবো,মনে হচ্ছে হয়ে যাবে’।
পল্লব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে পিউয়ের দিকে।ওর সেই ছোট্ট বোনু সত্যিই কতো বড়ো হয়ে গেছে। নিজেই নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারছে।ভালোবাসা ওকে কতোটা পরিনত করে দিয়েছে।তবে ভালো লাগলো একটা বিষয় ভেবে,পিউ বিয়ের পাশাপাশি নিজের পায়ে দাঁড়াবার স্বপ্নটাও বজায় রেখেছে। পল্লব হেসে বললো,’ ঠিক আছে আমি কথা বলবো কাল সকালেই।
(চলবে)