অশান্ত বসন্ত পর্ব-২৭

0
713

#অশান্ত বসন্ত।
(২৭ পর্ব)
জয়া চক্রবর্তী
***********************
গভীর জ্যোৎস্না মাখা রাতের রাস্তায় উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে গাড়ি চালাতে দারুণ লাগে সৃঞ্জয়ের। তাই ইচ্ছে করেই অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা বাড়ির দিকে আসেনা।
বরং বাড়ির রাস্তার উল্টো দিকে গাড়ি ঘুরিয়ে লঙ ড্রাইভে যাওয়াটা তার দারুণ পছন্দের।

এই সময়টা রাস্তার ধারের ছোটো বড়ো বাড়ি,দোকান,গাছগুলোকেও ভীষন রহস্যময় লাগে।তার ওপর ঈষৎ খোলা জানলা দিয়ে হুহু করে আসা ঠান্ডা হাওয়া সাথে মিউজিক সিস্টেমে চলা একটার পর একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত মনটাকে আরো অন্য জগতে নিয়ে যায়।

সম্মন্ধ করে বিয়ে করবার ছেলে নয় সৃঞ্জয়। কিন্তু কারো সাথে নিজেকে ঠিক রিলেট করতে পারেনি এতোদিন।তবে সেদিন মায়ের ইচ্ছেতে যেতেই হলো পিউকে দেখতে।

হাজার বাতির ঝারবাতির মতো ঝা চকচকে রূপ নয় মেয়েটার বরং প্রদীপের আলোর মতোই স্নিগ্ধ সুন্দর রূপ ওর। তাকিয়েই ভালো লাগা ছুঁয়ে গেছে মনটায়।প্রথম দেখাতেই মন কেড়েছে মেয়েটি।আলাদা করে কথা বলবে ভেবেছিলো।কিন্তু পরিস্থিতি সঙ্গ দেয়নি।

আজ সকালেই সৃঞ্জয়কে পিউয়ের নাম্বারটা দিয়েছে অঞ্জনা।সারাদিন অফিসের কাজের চাপে মাথা তুলতে পারেনি ছেলেটা।’আচ্ছা এখন কি ফোন করাটা ঠিক হবে!কিন্তু ইচ্ছে করছে যে!’,ভাবতে ভাবতে ফোনটা করেই ফেললো সৃঞ্জয়।

অপর প্রান্ত থেকে একটু পরেই ভীষণ মিষ্টি একটা গলা ‘হেলো’ বলে উঠলো।’আমি সৃঞ্জয় বলছি।আসলে সারাদিন সময় পাইনি।আমি কি ঘুমের ব্যাঘাত ঘটালাম তোমার?’

পিউ বললো,’না ঘুমোইনি,আজ সেমিস্টার শেষ হলো।তাই ব্যলকনিতে বসে মোবাইলে একটা সিরিজ দেখছিলাম’,সৃঞ্জয় বললো,’খুব ভালো,আচ্ছা পল্লব কি ঘুমিয়ে পরেছে?’পিউ হেসে বললো,’না এখনো ঘুমোয়নি,অফিসের কাজ করছে দাদা।তবে শিখাদি ঘুমিয়ে পরেছে।’

‘শিখাদি কে?’,সৃঞ্জয়ের প্রশ্নে পিউ বলে,’শিখাদি দাদার গার্লফ্রেন্ড বহ্নিদির দিদি।বহ্নিদি ছয় মাসের ট্রেনিং এ মুম্বাইতে গেছে,তাই শিখাদি এখন আমাদের কাছেই আছে’।

সৃঞ্জয় বললো,’আসলে ভাবছিলাম দেখা করতে আসতে বলবো তোমাকে।সেই কারনেই পল্লবের সাথে কথা ছিলো,তবে তার আগে তুমি বলো আমার সাথে দেখা করতে কোনো আপত্তি নেই তো তোমার ?’।

পিউ বললো,’না নেই।দেখা আমিও করতে চাইছিলাম। নিজেকে নিয়ে কিছু জানাবার ছিলো।কিন্তু আমি তো কলেজ ছাড়া সেভাবে কিছুই চিনে উঠতে পারিনি এখানের। সৃঞ্জয় বললো,তোমার আপত্তি না থাকলে তোমাদের ফ্ল্যাটের সামনে থেকেই পিক আপ করতে পারি আমি’।

পিউ চুপ করে আছে দেখে সৃঞ্জয় বললো,’আগামীকাল বিকেলের দিকে কি সম্ভব হবে?আমার ছুটি ছিলো’।পিউ বললো,’না আমার অসুবিধা নেই।তবে দাদাকে বলতে হবেনা এখন। আমি সকালে জানিয়ে দেবো ওকে’।

“দূরে কোথায়,দূরে দূরে…..আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে” গানটা হয়ে চলেছে তখনো সৃঞ্জয়ের গাড়ির মিউজিক সিস্টেমে।পিউয়ের কানেও ভেসে আসছিলো গান।পিউ জানতে চাইলো,’শ্রাবণী সেনের?’,সৃঞ্জয় বললো,’হুম।আচ্ছা তুমি তো খুব ভালো গান জানো শুনেছিলাম। কাল তোমার গলায় এই গানটা শোনবার আগাম আব্দার রইলো।কাল দেখা হচ্ছে।রাখছি এখন’,পিউ বললো,’ওকে বাই’।

সৃঞ্জয় ফোন রাখবার পরে গানের রেশটা ধরে পিউ ও গুন গুন করে গেয়ে উঠলো,
“যে পথ সকল দেশ পারায়ে/উদাস হয়ে যায় হারায়ে/
সে পথ বেয়ে কাঙাল পরাণ/যেতে চায় কোন অচীন পুরে..দূরে কোথায়, দূরে দূরে”…..

বহ্নিকে পল্লব ফোন করে জানিয়েছিলো,বরুন সাহা ওর দিদিয়াকে নিয়ে লালবাগ বোটানিক্যাল গার্ডেনে ঘুরিয়ে এনেছে।আর তারপর থেকে দিদিয়া নাকি আগ্রহ নিয়ে যেমন থেরাপি নিচ্ছে, তেমনই মন দিয়ে দীপক স্যারের কাছে আঁকাটাও শিখছে।

দীপক স্যার নাকি বলেছে,এতো কম সময়ে এতোটা শিখে নিতে খুব কম শিক্ষার্থীই পারে। দিদিয়ার নাকি শিল্পী চোখ।দিদিয়া একা একা বসে নিজে নিজেই খাতায় পেন্সিল স্কেচ করে। আর তা নাকি দেখবার মতো হয়।

বহ্নি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে,’দূর এই সময়টাই দিদিয়ার কাছে নেই আমি’ ।সন্তান যেমন নতুন কিছু শিখলে মায়ের আনন্দের শেষ থাকেনা,বহ্নির মনের অবস্থা ও এখন ঠিক তেমন। এতো খুশি লাগছে মনটা।

মা থাকলে যে কি খুশি হতো!ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললো বহ্নি।মায়ের উদ্দেশ্যে বললো ”মা তুমি আকাশ থেকে দেখছো তো তোমার শিখাকে?তোমার শিখা কথা বলতে পারছে,তোমার শিখা আঁকতে পারছে’।

তখনই ফোনটা বেজে উঠলো। তাকিয়ে দেখলো স্ক্রিনে পল্লবের হাসি মুখটা ভেসে উঠেছে।বহ্নি,’ হেলো’ বলতেই পল্লব বললো,’কাঁদছিলে তুমি?’,বহ্নি আর পারলোনা সামলাতে নিজেকে। এবার জোরে জোরে কেঁদে ফেললো।

পল্লব অস্থির হয়ে বহ্নিকে বলতে থাকলো,’লক্ষ্মী সোনা কি হয়েছে বলো আমায়?এভাবে কেঁদোনা।কিছু সমস্যায় পরেছো ট্রেনিংয়ের ব্যাপারে?’

বহ্নি চোখ মুছে নিয়ে পল্লবকে বললো,’আমি যে কিভাবে তোমায় ধন্যবাদ জানাবো!তোমাকে পাশে না পেলে আমাদের স্বপ্ন গুলো যে এতো তাড়াতাড়ি পূরণ হতোনা।তুমি যেভাবে আমার পাশে ছিলে বা আছো..’আর কথা বলতে পারলোনা বহ্নি কান্নার দমকে।

পল্লব বললো, ‘তোমার স্বপ্ন পূরণ করার জন্য ভগবান ডাক্তার এ.কে.গুপ্তা,থেরাপিস্ট বরুন সাহা,আঁকা শেখাবার দীপক স্যার সবাইকে একত্রে জুটিয়ে দিয়েছেন বুঝলে।শুধু শুধু তুমি আমাকে ক্রেডিট দিওনা’।

বহ্নি বললো,’তুমি খুব ভালো জানো।আসলে তুমি শুধু ভালো নও,তুমি সবচেয়ে ভালো।তাইতো আমি এতো নিশ্চিন্তে দিদিয়াকে তোমার হেফাজতে রেখে ট্রেনিং নিতে পারছি।জানো শুনছি গিয়েই প্রমোশন।আর এই সব কিছু শুধু তোমার জন্যই সম্ভব হয়েছে’।

পল্লব বললো,’উরিব্বাস! তাহলে তো এসেই পার্টি,আমি কিন্তু ওয়াইন খাবো’,বহ্নি হেসে ফেলে বললো,’একদম,যা বলবে’।

পল্লব বললো,’খুব চাপ যাচ্ছে জানো অফিসে।বাড়িতেও কাজ নিয়ে আসতে হচ্ছে।ঘুমের সময়টাই কমে গেছে। তোমার সাথে ও তো সেভাবে প্রতিদিন কথা বলতে পারছিনা’।
বহ্নি বললো,’আমাদের সম্পর্কটা এখন এতোটাই মজবুত যে আমরা কথা বলি আর না বলি,সম্পর্কটা টিকবে তার নিজের মাধুর্য নিয়ে।আর রাত কোরো না,ঘুমিয়ে পরো’।

পল্লব বললো,’তাহলে আমাদের বিয়েটা?’,বহ্নি হেসে বললো, শুভ রাত্রি। এই বিষয় নিয়ে আমি ফিরে গিয়ে কথা বলবো’।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here