(( পঞ্চদশ /ষোড়শ পর্ব ))
**********************************************
#অশান্ত বসন্ত
(পঞ্চদশ পর্ব)
জয়া চক্রবর্তী
********************
‘ স্বপ্ন গুলো বাস্তবায়িত করবার আগেই জীবন প্রদীপ নিভে গেলো মায়ের’,এই ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না বহ্নি।
একটুখানি সুখের মুখ দেখতে পেলো না মা। ধারাবাহিক বঞ্চনাই যেন ছিলো মায়ের জীবনযাপনের স্বরলিপি।
ট্যাক্সি কাঁথির রাস্তা ধরে নেওয়ার পর থেকেই,পল্লব কিছুটা রাস্তা গাইড করেছে ড্রাইভারকে।
কিন্তু বহ্নির বাড়ির গলি তো চেনেনা পল্লব। তাই বাধ্য হয়েই বহ্নিকে ডাকলো।তবে পল্লবের ডাক বহ্নির কানে আদৌ পৌঁছোচ্ছিলো না।বাধ্য হয়েই বহ্নিকে ঝাঁকিয়ে দিয়ে ডাকলো পল্লব।
বহ্নি তাকিয়ে দেখলো আর দুটো মোড় ঘুরেই ওর বাড়ি।সেই হিসেবে ড্রাইভার কে ইন্সট্রাকশন দিয়ে আবার চোখ বুজলো।
সাতসকালে বহ্নিদের বাড়ির সামনে ট্যাক্সির হর্ন শুনে আশেপাশের বাড়ি থেকে উৎসাহী চোখ গুলো উঁকি দিলো।’ওমা সাথে আবার ছেলেটা কে!,নিজের মনেই আওড়াল রনির মা।
ওই দিকে শিবানীর বর শিবানীকে বলছে,’দেখেছো কান্ড!বাপ এখানে রাসলীলা সেরে কানাডায় নতুন খেলা খেলতে গেছে,আর মেয়ে পড়াশোনার নাম করে….হে হে হে হে সিঙ্কিং সিঙ্কিং ড্রিঙ্কিং ওয়াটার,বুঝলে না?’,শিবানী বিরক্ত মুখে বললো,’থামো তো তুমি,মেয়েটার এই শোকের সময়টাতেও বিষ উগড়াচ্ছ’,কথাটা বলেই এগিয়ে গেলো।
ততোক্ষনে বহ্নি ঘরে ঢুকে বিছানায় আছড়ে পরে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে।শিউলি মাসি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলছে,’কি আর করবি মা,তোকে তো শক্ত হতেই হবে।ওই দ্যাখ শিখাটা কেমন করছে,মেয়েটার তো মুখে ভাষাও নেই,কতো কষ্ট পাচ্ছে দ্যাখ একবার’,শিউলি মাসির কথায় ধীরে ধীরে বহ্নি উঠে বসে।
সত্যিই তো তার দিদিয়া তো স্বাভাবিক নয়।দিদিয়ার তো মাকে ছাড়া এক মুহুর্ত ও চলতোনা।খাটের কোনায় দিদিয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো বহ্নি।শিখা ও আঁকড়ে ধরলো বহ্নিকে।
দুই বোনের চোখের জল মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে থাকে।ওদের দেখে কেউ কেউ নিজেদের চোখের জল মুছছে আবার কেউ কেউ আঁড়চোখে পল্লবকেই দেখে যাচ্ছে।
ব্যাপারটা ভালোই খেয়াল করে পল্লব।
কিন্তু বুঝতে পারেনা এই মুহূর্তে ঠিক কি করা উচিত ওর।তবে একেই তো এরা পাড়াগাঁয়ের লোকজন।তার ওপর ওদের দুজনকে একসাথে নামতে দেখেছে ট্যাক্সি থেকে।নিজেদের মধ্যে ওদের নিয়ে একটা রসালো গল্প তো ফাঁদবেই।
অবশ্য শুধু পাড়া-গাঁ বলে নয় শহরের কিছু লোকজনের মানসিকতা ও এখনো প্রায় এদের মতোই।মুখে যতই শিক্ষার বড়াই করুক না কেন মনে মনে এখনো সেই একই অশিক্ষিত মনোভাব।
পল্লব ঠিক করে ফুলমানির বাড়িতে চলে যাবে।সেই মতো বহ্নির ফোনে একটা মেসেজ ছেড়ে যায়।লেখে, যে কোনো প্রয়োজনে ওকে ডেকে নিতে,ও ফুলমানির বাড়িতেই থাকবে।বহ্নি চাইলে ওরা একসাথেই ফেরত যাবে।
ভ্রুক্ষেপহীন খাপছাড়া চেহারা নিয়ে চুপচাপ মেঝেতে বসে আছে অর্নব।গোটা বাড়িটা যেন গিলে খেতে চাইছে ওকে।গতকালই বহ্নি শিখাকে সাথে নিয়ে চলে গেছে।
একটা ছেলে এসেছিলো ট্যাক্সি নিয়ে।ছেলেটাকে অর্নব চেনেনা।আর বহ্নিকে জিজ্ঞেস করবার সাহস ও হয়নি।
তবু বলেছিলো,অন্তত করুনার কাজ অবধি থেকে যেতে।উত্তরে বহ্নি বলেছে,’মানুষ বেঁচে থাকতেই দায়িত্ব কর্তব্য ভালোবাসা দেখাতে হয়,মৃত্যুর পর এসবের কোন মূল্যই নেই’।
এছাড়াও বলেছে’,আপনার যদি লোক দেখানো কাজ করতে হয় সেটা আপনি করতেই পারেন,তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই।কিন্তু ডিভোর্স হওয়ার পর আপনার আর পারলৌকিক কাজ করবার অধিকার আছে কিনা সেটা একটু জেনে নেবেন।আর আপনার বাড়িটা আপনারই রইলো,আমরা চললাম’।
কতো বড়ো হয়ে গেছে মেয়েটা।কতো সহজেই বাপের কাটা গায়ে নুনের ছিটে দেয়।অর্নবের চোখে জল চলে এসেছিলো।ভগবানকে প্রার্থনা করে অর্নব, যাতে কারোর ওর মতো করুন অবস্থা না হয়।
এখন অর্নবের নেই কোনো সামাজিক দায়বদ্ধতা, নেই কোনো উদ্দেশ্য, নেই ভালোবাসার মানুষগুলোর সাথে হাসি কথার জলতরঙ্গ।তবুও রক্তক্ষরন চলছে ছিঁড়ে যাওয়া ধমনীর ভিতর।
এখন নিজেই যেন সে ছায়াহীন প্রেতাত্মা।
না আর কানাডায় ফিরে যাবেনা অর্নব।এখানেই কাটিয়ে দেবে বাকি জীবনটা।কি হবে টাকার পিছনে ছুটে!কাদের জন্য রোজগার করবে!ব্যাঙ্কে যা আছে তা দিয়ে তার একার জীবনটা ভালো মতোই কেটে যাবে।দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে অর্নব।
মাত্র একটা ভূলের মাশুল গুনে চলেছে সে এতোকাল।ভেবেছিলো করুনা আর বাচ্চাদের ঝেড়ে ফেলে অদ্রিজার সাথে সুখে জীবন কাটাবে।
এখন সেই নিজেকে উজাড় করে দিয়ে ভালোবাসার মতো করুনাও নেই আর ভালোবাসার অভিনয় করা অদ্রিজাও নেই।
মনে মনে করুনাকে বলে,আমি আমাদের ঘর ভেঙে অদ্রিজার বুকে প্রেম খুঁজছিলাম,আর তুমি জ্বলছিলে আমারই প্রনয় পিলসুজে।
সে কারনে সন্তান থাকবার পরেও আজ আমি সন্তানহীন।
অর্নব ধীর পায়ে ছাদে উঠে আসলো।গতকাল ও এসেছিলো।নক্ষত্র সজ্জায় শুয়ে থাকা আকাশ কন্যা করুনার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে পল্লব। আসতে আসতে চোখ ঝাপসা হয়ে যায়,গলা শুকিয়ে যায়,নিশ্বাস দ্রুত হয়।আর পারেনা নিজেকে ধরে রাখতে। বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পরতে পরতে বলে,’এতোটা শাস্তি জরুরি ছিলো কি!’
(চলবে)
#অশান্ত বসন্ত।
(ষোড়শ পর্ব)
জয়া চক্রবর্তী।
********************
অফিস থেকে বেরিয়েই বহ্নিকে একটা ফোন করে পল্লব। জানায় আধ ঘন্টার মধ্যেই ডক্টর এ.কে.গুপ্তার চেম্বারে পৌঁছে যাবে।বহ্নি হেসে জানায়, অলরেডি ও দিদিয়াকে নিয়ে চেম্বারেই বসে আছে।পল্লবের তাড়াহুড়ো করে গাড়ি চালিয়ে আসবার দরকার নেই।ধীরে সুস্থে আসলেই হবে।
পল্লব তাও চটপট গাড়ি বের করলো।ফোনের ভিতরেও বহ্নির গলায় খুশির আমেজ স্পষ্ট। এই প্রথম বহ্নিকে এতো খুশি মনে হলো পল্লবের। মনটা ভালো হয়ে গেলো।জানলার কাঁচ নামিয়ে এক ভাঁড় চা কিনলো,তারপর আয়েশ করে চুমুক দিয়ে ভাঁড়টা ছুঁড়ে ফেলে গন্তব্যের দিকে এগোলো।
আজ আর অফিস যায়নি বহ্নি।কারন অফিস থেকে বের হওয়ার আগের মুহুর্তে যদি আবার কোনো কাজের দায়িত্ব চাপিয়ে দেয় বস।সাধারণত বহ্নির ক্ষেত্রে এটাই ঘটে।তাই রিক্স না নিয়ে সকালেই মেইল পাঠিয়ে দিয়েছে,’আই কান্ট গো টু অফিস টুডে. ফিলিং সিক’।
ডক্টর এ.কে,গুপ্তার কথা পল্লবের কাছে শোনবার পর থেকে অনেকের কাছেই খোঁজ নিয়েছে বহ্নি।জেনেছে ওনার হাতে নাকি ম্যাজিক হয়।বেছে বেছে কঠিন থেকে কঠিন কেস গুলোই উনি চ্যালেঞ্জের সাথে গ্রহন করেন।এবং আজ পর্যন্ত ওনার সব অপারেশনই সাকসেসফুল।
ওনার এপোয়েনমেন্ট পাওয়াও সহজ ব্যাপার নয়।পল্লবের বন্ধুর মাস্ততো দিদির বর উনি।পল্লবের চেষ্টায় সেই বন্ধুর রেফারেন্স দিয়েই আজকের এপোয়েনমেন্টটা।
চুপচাপ বসে থাকতে গিয়ে আজ অনেক কথাই মনে পরছে বহ্নির।দেখতে দেখতে পাঁচ বছর হয়ে গেলো ও দিদিয়াকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোরে।প্রথম ছয় মাস অবশ্য হোস্টেল ছেড়ে পল্লবের ফ্ল্যাটেই থাকতে হয়েছিলো বহ্নিদের।এছাড়া আর কোন উপায় ও তো ছিলোনা।পল্লব নিজের একটা ঘর বহ্নিদের ছেড়ে দিয়েছিলো।প্রথম দিকে অস্বস্তি লাগলেও অল্প দিনেই সেটা কেটে গিয়েছিলো পল্লবের অমায়িক ব্যবহারে।
ছয়মাস পর কলেজ ক্যাম্পাসিং এ চাকরিটা পাওয়ার পর দিদিয়াকে নিয়ে আলাদা জগৎ গড়ে তোলে বহ্নি।অবশ্য সেখানেও পল্লবের ভূমিকা অস্বীকার করবার উপায় নেই।বহ্নির অনুরোধে পল্লবই অল্প ভাড়ায় ঘর ঠিক করে দিয়েছিলো।মাঝেমধ্যে ছুটির দিনে বাজারটাও করে দিয়ে যেতো।পল্লবের কাছে বহ্নির ঋণের শেষ নেই।কিছু মানুষের কাছে বোধহয় ঋণী থাকতেই বেশি ভালো লাগে।
তবে এই পাঁচ বছর ধরে বহ্নি খুব হিসেব করে খরচ করেছে।বেশিরভাগটাই জমিয়ে রেখেছে দিদিয়ার জন্য। অপারেশনের খরচ যে অনেক হবে সেটা তো আন্দাজেই বোঝা যায়।তবে যা জমিয়েছে তাতে হয়তো হবেনা।বহ্নি ঠিক করেছে তেমন হলে বাকিটা না হয় লোন নিয়ে নেবে অফিস থেকে।
পল্লব হন্তদন্ত হয়ে চেম্বারে এসে ঢুকলো।আধ ঘন্টার জায়গায় এক ঘন্টা লেগে গেছে আসতে।রাস্তায় প্রচন্ড যানজট। বহ্নি হাত নাড়িয়ে ইশারায় পল্লবকে ডাকে।পল্লব কাছে আসতেই নিজের সীটটা ছেড়ে পল্লবকে বসতে বলে।পল্লব না চাইতেও বসে পরে।কারণ পল্লব জানে বহ্নি ওর কথা শুনিয়েই ছাড়বে।
পল্লব বসার পরেই বহ্নি এগিয়ে যায় রিসেপশনিস্ট মেয়েটার দিকে।শিখার নাম্বার কতোজনের পরে জেনে নিয়ে বেরিয়ে যায় চেম্বার থেকে।একটু পরেই ফিরে আসে হাতে পেপসির বোতল নিয়ে।ফিরে এসে পল্লবের হাতে বোতলটি ধরিয়ে দিয়ে বলে, ‘কয়েক চুমুক দিয়ে নাও, দিদিয়ার নাম্বার আরো পাঁচজনের পরে’।
বহ্নির এই ছোট্ট ছোট্ট ব্যাপার গুলো পল্লবের মন ছুঁয়ে যায় সবসময়।পল্লব জানে বহ্নিও ওকে চোখে হারায়,কিন্তু নিজের কাছে সেটা স্বীকার করতে ভয় পায়।অথচ পল্লব বহ্নির চোখে নিজের জন্য ভালোবাসাই দেখেছে।
পল্লব উঠে বহ্নিকে বসতে দিয়ে ঠান্ডা পেপসির বোতল খুলে ঢকঢক করে কিছুটা গলায় ঢালে।তারপর তৃপ্ত মুখে বহ্নির দিকে বোতলটা এগিয়ে দেয়।শিখাকে ইশারায় জিজ্ঞেস করে কেমন আছে ও?শিখার চোখ খুশিতে চিকমিক করে ওঠে।শিখা ও ওর নিজস্ব ইশারার বুঝিয়ে দেয় ভালো আছে।
শিখা সম্ভবত পল্লবেরই বয়েসী হবে।শিখার লালা ঝড়া দেখে প্রথম দিকে বেশ গা ঘিনঘিন করতো পল্লবের।সারা ঘরে কেমন চিটচিটে ভাব।মেয়েটার হাতে সবসময় রুমাল থাকলেও ঝড়ে যাওয়া লালা সারাক্ষণ মোছা তো আর সম্ভব নয়।পল্লব সেটা বুঝতে পারে।
তাছাড়া লালা শুকিয়ে যাওয়ার কারনে একটা বিশ্রী স্মেল আসতো শিখার গা থেকে।যেটাতে মনে হতো ওর অন্নপ্রাশনের ভাত ও বেরিয়ে আসবে।
প্রথম দিকে এক টেবিলে খেতে বেশ সমস্যা হতো পল্লবের।চেষ্টা করতো শুধু নিজের খাওয়ারের দিকেই মন দিতে,কিন্তু চোখটা চলেই যেতো ওদের দিকে।
বহ্নির কাছে শুনেছে,ওর দিদয়া কখনো বাবার ভালোবাসা পায়নি লালা ঝড়ার কারনে।ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুতই লেগেছে পল্লবের।যদি ওর নিজের সন্তানের এমন হতো তাহলেও কি তাকে উপেক্ষা করে দুরে সরিয়ে রাখতে পারতো পল্লব!কি জানি!
তবে ধীরে ধীরে শিখাকে ওর খামতি সহই মেনে নিয়েছে পল্লব।আজকাল শিখার লালা ঝড়াতে ওর আর গা ঘিনঘিন করেনা।বরং চেয়েছিলো শিখার অপারেশনটা অনেক আগেই করিয়ে দিয়ে, এই লালা ঝড়ার অভিশাপ থেকে শিখাকে মুক্তি দিতে।কিন্তু বহ্নি রাজি হয়নি।ওর মায়ের স্বপ্ন নাকি ওকেই পূরণ করতে হবে।
শিখার নাম ধরে ডাকতেই বহ্নি শিখাকে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।কিন্তু বুকটা ধড়ফড় করতে থাকে।কুলে এসে তরী ডুববে নাতো!বহ্নির অস্থির ভাবটা চোখে পরে পল্লবের।বহ্নির কাঁধে আলতো চাপ দিয়ে বলে,’সব ঠিকঠাক মতোই হবে,ঘাবড়ানোর কিছু নেই,ভিতরে চলো’।ভরসা পেয়ে এগিয়ে যায় বহ্নি।
(চলবে)