#অশান্ত বসন্ত
(দ্বাদশ পর্ব)
জয়া চক্রবর্তী
********************
কফি-শপের বাইরে একরাশ উৎকন্ঠা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো পল্লব। অবশেষে বহ্নিকে আসতে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো।
একটু এগিয়ে গিয়ে এক গাল হেসে বললো,’ভেবেছিলাম ভুলে গেছেন।তাই মনে করিয়ে দিতে ফোন করেছিলাম,ফোনটা ধরেননি দেখে ভয় পাচ্ছিলাম আসবেন না ভেবে’।
বহ্নি বললো,’ডিউটি আওয়ার্সে ফোন ধরার পার্মিশন নেই।তাই কেটে দিয়েছিলাম’।
কফি-শপের ভিতরে ঢুকেই পল্লব, ‘প্লিজ আসুন’,বলে একটা খালি টেবিলের দিকে এগিয়ে যায় ।তারপর চেয়ার টেনে আগে বহ্নিকে বসিয়ে, নিজেও উল্টো দিকের চেয়ার টেনে বসে।
এরমধ্যেই কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে পল্লবের ।রুমাল বের করে ঘামটা মুছে নিলো।
তারপর বললো,’আমার মনে হয় পরিচিতি পর্বটা নাম দিয়েই শুরু হওয়া উচিত, আমার নাম পল্লব চ্যাটার্জি, আপনি?’,বহ্নি বলে, ‘আমি বহ্নি চৌধুরী, এবার বলুন তো কি কারনে ডাকলেন?আমার কিন্তু হাতে অনেক সময় নেই’।
পল্লব হেসে বলে,’সরাসরি বিষয়েই যেতে বলছেন।একটু কফি খেলে হতোনা?এখানের চিকেন স্যান্ডউইচটা কিন্তু ব্যাপক’।
বহ্নি বললো,’আমি এক কাপ কফিই নেবো।আর আমার কফির পেমেন্টটা কিন্তু আমিই করবো’।
পল্লব বললো,’ ঠিক আছে দুকাপ কফি নিয়ে আসছি’।
কাউন্টারের দিকে যেতে গিয়ে পল্লব মনে মনে ভাবলো,অফিসে কতো স্বাচ্ছন্দ্যে বড়ো বড়ো মিটিং এটেন্ড করি অথচ ওর সাথে কথা বলতে গিয়ে কালঘাম ছুটে যাচ্ছে,আবার চড় না মারার ইচ্ছে হয় মেয়েটার!
গতকাল রাতে কতো কিছু ভেবে রেখেছিলো,অথচ মেয়েটার সামনে কেমন যেন সব গুলিয়ে যাচ্ছে।
দুকাপ কফির কাপ ট্রেতে নিয়ে নিজেদের টেবিলের দিকে এগিয়ে আসলো পল্লব।বহ্নি বললো,’এবার বলুন কি বলতে চেয়েছিলেন কাঁথিতে? আর আজকেও কি বলতে ডাকলেন?’
পল্লব কফির কাপটা বহ্নির দিকে এগিয়ে দিয়ে,নিজের কাপে একটা বড় চুমুক দিয়ে নিলো।
তারপর বললো,’ মন্দারমনি আমার ভীষণ পছন্দের জায়গা।আর ওখানে গেলেই ফেরার পথে কাঁথিতে ফুলমানির বাড়িতে দেখা করে আসি’।
বহ্নি বললো, ‘ফুলমানি মানে বোস কাকিমা?’
পল্লব মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললো,’একবার ফুলমানির দোতলার ব্যলকনিতে দাঁড়িয়ে চা খাওয়ার সময় আপনাকে দেখি।কমলা পাড় সাদা শাড়ি পরে,কাঁধে ব্যাগ নিয়ে,দুবেনী ঝুলিয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছেন’।
বহ্নি বললো, ‘আর আপনার সেটা দেখেই প্রতিদিন পিছু নেওয়ার ইচ্ছে হলো তাইতো?’
পল্লব বহ্নির কথার উওর না দিয়েই বললো,’ঠিক তা নয়,আসলে ভালো লেগে গিয়েছিল আপনাকে, ফিরবার আগের দিন কথা বলতে চেয়েছিলাম,আর তাতেই বিপত্তি’।
বহ্নি বললো,’আপনার ধারণা নেই কি পরিমাণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি’।
পল্লব বললো,’সে তো আপনার প্রানপন ছোটা দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম।কিন্তু বিশ্বাস করুন শুধুমাত্র কথা বলতেই চেয়েছিলাম সেদিন’।
বহ্নি বললো,’বুঝলাম।এবার বলুন পরেরবার কি এমন জরুরি কথা ছিলো,যে আমার সাথেই দেখা করবার জন্য কাঁথি গিয়েছিলেন!”
পল্লব একটু সময় চুপ করে থেকে বললো,’এখানকার চিকেন স্যান্ডউইচটা সত্যিই ব্যাপক বানায়।এতোক্ষণ কাজের জায়গায় ছিলেন,ক্ষিদে পায়নি?’
বহ্নি বিরক্ত মুখে বললো, ‘আপনার ক্ষিদে পেলে অর্ডার দিন না।আমি খাবোনা’।
পল্লব বললো,’আপনি কি রেগেই থাকেন সবসময়?’, বহ্নি এই কথাটার কোনো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলোনা।বললো,’কথা শেষ করুন,আমার তাড়া আছে’।
পল্লব এবার ঢকঢক করে এক গ্লাস জল খেয়ে নিলো।
মনে মনে কথা হাতড়াচ্ছে,অথচ কোনো কথাই খুঁজে পাচ্ছেনা।
বুঝতে পারছে সত্যি কথাটা বলে দিলে মেয়েটা শুধু যে ওকে অপমান করে দেবে এমনটা নয়,ওর সাথে আর কথাই বাড়াবেনা।
তবু সত্যি কথাই বললো।’বাড়িতে বিয়ের কথা চলছিলো,তাই ভাবছিলাম…’,কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বহ্নি বলে উঠলো,’ বিয়ে! আমার অভিধানে কিন্তু ওই শব্দটা একেবারেই নেই’।
পল্লব অতি কষ্টে ও হেসে ফেলে বললো, ‘সে আমাকে না হয় যোগ্য মনে হয়নি ।কিন্তু শব্দটা অভিধানেই নেই এমন বলবেন না’।
বহ্নি বলে,’যা কথা বলার ছিলো নিশ্চয়ই বলে নিয়েছেন।আর আমার উত্তর টাও আশা করি পরিস্কার ভাবে জানিয়ে দিতে পেরেছি,তাহলে আমি এবার আসি?’।
ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিলো পল্লব।এইভাবে বলতেও চায়নি কিছু,তবু মেয়েটার জেরার মুখে পরে না বলেও পারলোনা।
অনেক কষ্টে হাসি এনে পল্লব বললো,’ আমরা তো বন্ধু হোতেই পারি তাইনা?’,বহ্নি বললো,’না পারিনা ”।
একটু থেমে বলে,’তাছাড়া আমাকে নিয়ে কি জানেন ,যে বন্ধু হতে এগিয়ে এলেন?’,পল্লব বুঝতে পারছে ওর নিজের মুখটা লাল হয়ে গেছে, নিশ্বাস দ্রুত পরছে।পারলে কেঁদেই ফেলবে এখন ‘।
বহ্নি পল্লবের মুখের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলো,এইভাবে বলাটা ওর ঠিক হয়নি।
নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,’দেখুন এখানে আপনি আমায় ডাকলেও আমি আসলে নিজেই এসেছিলাম ক্ষমা চাইতে। রাস্তায় অতো লোকের মাঝে চড় মারাটা আমার অন্যায় ছিলো।আমি সত্যিই লজ্জিত’।
পল্লব বললো,’ইটস ওকে বহ্নি।আপনার অনিচ্ছাসত্ত্বেও দাঁড় করিয়ে কথা বলতে চাওয়াটা ঠিক হয়নি’।
বহ্নি বলে চলে,’আসলে জীবনে কিছু পরিস্থিতি আসে যখন নিজের ব্যবহারের ওপর নিজেরই কন্ট্রোল থাকেনা।সেদিনটা আমার জীবনের তেমনই একটা দিন ছিলো।মাঝখান দিয়ে আপনি চড়টা খেয়ে গেলেন।এনিওয়ে ক্ষমা চাইছি সেই দিনের সেই ব্যবহারের জন্য’।
তারপর নিজের বিলের টাকাটা রেখে ‘আসছি’,বলে বেরিয়ে গেলো।
বহ্নির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে মনে মনে বহ্নির উদ্দেশ্যে বললো,’আমার মন বলছে এতো সহজে তুমি ছেড়ে যেতে পারোনা আমায়।আমি যে তোমায় ছেড়ে আমার ভবিষ্যৎ জীবনের কথা ভাবতেই পারিনা’।
কাল রাতের আর আজ সারাদিনের অস্বস্তিটা এখন আর নেই।অনেকটা নিশ্চিন্ত লাগছে বহ্নির।কফি-শপ থেকে বেরিয়ে, কিছুটা রাস্তা হেঁটে খাতার দোকানে আসলো ।দুদিন আগেই খাতা শেষ হয়ে গেছে।
খাতার সাথে দুটো পেন,একটা পেনসিল ও নিয়ে নিলো।
কলেজে প্লেসমেন্ট চলছে এখন।বেশ কয়েকটা জায়গা থেকে ইন্টারভিউ ও নিয়েছে।মনে হচ্ছে হয়ে যেতে পারে চাকরিটা।টাকা মিটিয়ে দোকান থেকে বের হোতেই ফোনটা বেজে উঠলো।
(চলবে)