#অশান্ত বসন্ত।
(দশম পর্ব)
জয়া চক্রবর্তী
(প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য)
********************
দিনের পর দিন কেটে যায়,রাতের পর রাত।ক্যালেন্ডার জানান দেয় পাঁচ বছর আট মাস তেইশ দিন অতিক্রান্ত।আজ প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর ধরে পল্লব ব্যাঙ্গালোরে।নিজেকে আরো অনেক ব্যস্ত করে নিয়েছে সে।
তবু ক্লান্ত শরীরেও ঘুম আসতে চায়না।আসে তন্দ্রা,তন্দ্রা এলেই স্বপ্নরা আসে,স্বপ্ন গুলো ও ভেঙে লক্ষচির হয়।
সেই বৃত্তাকার স্বপ্ন গুলো নেড়েচেড়ে ছানাছানি করে পল্লব।
আসলে সময় সব কিছু বদলে ফেললেও,কিছু কিছু মানুষকে একেবারেই বদলে ফেলতে পারেনা।পল্লবের মনে তাই আজও বহ্নি।
পল্লব ওর দামী মোবাইলটা বের করে ঋতমকে ফোন করে।অফিসের কাজে দু-দিনের জন্য ঋতম ব্যাঙ্গালোরে এসেছে।পল্লবকে বলেছে তিনটের দিকে একটা সময় বের করতে,দেখা করবে।
পল্লব অফিসের কাছের কফি-শপে ফোন করে টেবিল বুক করলো।ঋতমকে লোকেশন সেন্ড করে দিয়ে,মিস্টার পোড়েলকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পরলো।অনেকদিন পর প্রিয় বন্ধুর সাথে দেখা হবে,একটু আগেই বেরিয়ে আসলো।
পল্লব কফি-শপের পাশের মলে ঢুকলো।
সাধারণত মলটা দুপুরের দিকে একটু ফাঁকাই থাকে।কিন্তু আজ ভিড়টা তুলনামূলক ভাবে বেশিই।পল্লব টি-শার্ট এর সেকশনে ঢুকে beige colour এর একটা টি-শার্ট নিলো ঋতমের জন্য।কাউন্টারে টাকা দেওয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে চমকে উঠলো পল্লব।’কাকে দেখছে!এ তো কাঁথির মেয়েটা!’
লাইন ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে ভালো করে খেয়াল করে দেখলো,’একেবারে সেই চোখ,সেই মুখ,সেই গলার আওয়াজ’।
কাউন্টার ফাঁকা হতে এগিয়ে যায় পল্লব। কেনা টি-শার্ট টা এগিয়ে দেয়।
মেয়েটা মোবাইল নাম্বার নিয়ে বিল করে,প্যাকেটের সাথে বিল এগিয়ে দিতেই,পল্লব বলে, ‘কাঁথির থেকে কি?’,মেয়েটা মনে হলো পল্লবকে চিনতে পেরেছে,কেঁপে উঠলো যেন চোখের পাতা।মুখে বললো,’one thousands nine hundred ninety please’।
পল্লব টাকা মিটিয়ে ফিডব্যাক বাটন প্রেস করে বেরিয়ে আসলো।বুঝলো,মেয়েটা কথা বলতে ইন্টারেস্টেড নয়,বা হতে পারে কাজের জায়গা বলে কথা বলতে চায় না।পল্লবের কেমন হতাশ লাগছিলো।মেয়েটা এখনো পল্লবের শ্বাসে প্রশ্বাসে।
কফি-শপে ঢুকতেই ওর বুকিং করা টেবিলে ঋতমকে দেখে হাত নাড়লো।ঋতম ওকে দেখে উঠে এসে জড়িয়ে ধরলো।অজান্তেই পল্লবের চোখ ভিজে আসলো।আজ দুজন প্রিয় মানুষের সাথে দেখা হলো ওর।একজন শার্টের কাউন্টারে আর অন্যজন এখন ওর বুকে।
চেয়ারে বসেই পল্লব বললো,’খিদে পেয়ে গেছে নিশ্চয়ই। আমিও লাঞ্চ করিনি।দাঁড়া আগে অর্ডারটা দিই।কি খাবি বল?চাইনিজ না কন্টিনেন্টাল? ঋতম বললো,’এনিথিং, যেটা তুই প্রেফার করিস’।পল্লব ওয়েটারকে বেল বাজিয়ে ডেকে খাওয়ারের অর্ডার দিয়ে দিলো।
‘তুই এখন দিল্লিতেই আছিস তাই না?’,পল্লবের প্রশ্নে হেসে ঋতম বললো,’প্রিসাইজলি নয়ডাতে।আমার খোঁজ রাখিস তাহলে।সেই যে কলকাতা ছাড়লি তারপর তো পাত্তাই নেই কোনো’,একটু থেমে বললো,’রক্ষিতের সাথে কথায় কথায় জানতে পারলাম তুই এখানে,নাম্বারটাও ওর থেকেই পেলাম’।
‘কোন রক্ষিত বলতো!ও আচ্ছা পরেশ রক্ষিত। হ্যাঁ উনি তো আমাদের কোম্পানি ছেড়ে দিল্লিতে জয়েন করেছেন।লোকটা ভালো কিন্তু অলস প্রকৃতির। কাজের চাইতে কথা বলে বেশি।এখন কি তোদের কোম্পানিতে নাকি?’পল্লবের কথায় ঋতম বলে,’সেসব পরে শুনিস।আগে বল কি খবর তোর?’।
‘কেমন দেখছিস?’,হেসে বলে পল্লব।ঋতম ও হেসে ফেললো কথা বলার ভঙ্গিমাতে।তারপর বলে,’ফেসবুক ডিএক্টিভেট করেছিস,নাম্বারটাও বদলে ফেলেছিস।তুই জানিস পাগলের মতো খুঁজেছি তোকে’।
‘আচ্ছা তোর মনে আছে তোকে একটা মেয়ের কথা বলেছিলাম’,পল্লবের কথা শেষ হতেই ঋতম বলে,’ওই যে কাঁথি না মন্দারমনি কোথায় যেন থাকতো!নাম না জেনেও যাকে ভালোবেসে ফেলেছিলিস!’
পল্লব ম্লান হেসে বলে,’মনে রেখেছিস দেখছি।জানিস আবার গিয়ে মেয়েটির সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম।কিছু না শুনেই বিশ্রী ভাবে রিজেক্ট করে।তারপরেই অফিসের অফারটা নিয়ে ব্যাঙ্গালোরে আসলাম’।
টি -শার্টটা এগিয়ে দিয়ে বলে,’দ্যাখ তো পছন্দ হয় কিনা?তোর প্রিয় রঙের’,ঋতম বললো,’শালা তুই মার্কেটিং করা শিখে গেছিস?আগে তো একটা সিগারেট কিনতেও আমায় ঠেলতিস’,দারুন দারুন হয়েছে।আমি তো ভাবতেই পারছিনা’।
‘জানিস কাউন্টারে সেই কাঁথির মেয়েটাকে দেখলাম’,পল্লবের কথায় হো হো করে হেসে উঠলো ঋতম।বললো,’বলিস কিরে!শয়নে-স্বপনে-জাগরনে এখনো সেই মেয়েটাই আছে?এখনো সব জায়গায় ওকেই দেখছিস?’
পল্লব গম্ভীর মুখে বললো,’তোর কি মনে হচ্ছে আমি মজা করছি?’,ঋতম সোজা হয়ে বসলো।বললো,’তুই সিরিয়াস?সেই মেয়েটিই?এতো বছর বাদে দেখলি,চিনতে পেরেছিস।মানে কোনো গণ্ডোগোল হয়নি তো?’।
পল্লব বললো,’নারে কোনো গন্ডোগোল নেই।সেই মেয়েটিই।আরে ওই চোখ দুটো যে একেবারেই ভোলবার নয়।ভয়েজটাও সেম।আমি ১০০% শিওর,কাউন্টারের মেয়েটা কাঁথির মেয়েটাই’,ওয়েটার প্লেট গুলো দিয়ে যাওয়ার পর,আরো অনেক গল্প করলো ওরা,কিন্তু তেমন জমলো না।
শেষে ঋতম বললো,’এবার কি করবি ভেবেছিস?’,পল্লব হেসে বললো,’আবারো চেষ্টা, আরে চেষ্টা ছাড়া আর কিইবা করতে পারি বলতো!’।
মল থেকে আজ হোস্টেলে আসতে অনেক সময় লাগলো বহ্নির।পা দুটো যেন চলছেই না।অন্য দিন গুলোতেও ক্লান্ত থাকে বহ্নি।কিন্তু আজকের ক্লান্তিটা শরীরের চাইতে বেশি মনের।
সকালে কলেজ করে সোজা মলে চলে যায়।১২ টা থেকে ৬ টা অবধি ডিউটি,তারপর হোস্টেলে ফিরে ফ্রেস হয়ে পড়তে বসা,আপাতত এটাই বহ্নির ডেইলি রুটিন।
ওর মা, দিদিয়াকে এখনো আনতে পারেনি এখানে।তবে ওর দৃঢ় বিশ্বাস পরীক্ষার পরেই চাকরি পেয়ে যাবে।তবে ব্যাঙ্গালোরে এসে পড়তে পারার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ও মনে মনে প্রফেসর কাকুকে আবারো ধন্যবাদ দিলো।উনি স্কলারশিপের ব্যবস্থা না করে দিলে ওর আর পড়া হোতোনা।
অবশ্য এখানে এসে মলের চাকরিটা ও নিজেই জুটিয়েছে।ডায়রেক্ট গিয়ে কথা বলেছিলো, আর মলের মালিক বাঙালি হওয়াতে ওর কাজ পেতে অসুবিধা হয়নি।লোকটার মন বেশ ভালো। বেশিই টাকা দেয় পড়াশোনা করছে জেনে।
তবে এতো বেশি পরিশ্রমে শরীরটাও বিদ্রোহ করতে চায়,কিন্তু উপায় নেই কোনো।অনেকটা পথ চলা বাকি যে।এরপর চাকরি পেয়ে এখানে থাকার একটা বন্দোবস্ত করে মা দিদিয়াকে নিয়ে আসতে হবে, তারপর দিদিয়ার অপারেশনটাও তো করাতে হবে।কেমন দমবন্ধ লাগে বহ্নির।এতো দায়িত্ব ওর কাঁধে,পারবে তো ঠিকঠাক পালন করতে!
হোস্টেলে এসে ফ্রেস হয়ে পড়তে বসে।কিন্তু অন্যদিনের মতো আজ আর মন বসেনা পড়াতে।বহ্নি বুঝতে পারে ওর কিছু একটা হয়েছে।যদিও সেটা দেখা যাচ্ছেনা,শোনা যাচ্ছেনা,বোঝাও যাচ্ছেনা।কিন্তু ভিতরে একটা তাগিদ,একটা উৎকন্ঠা, একটা তাড়াহুড়ো ভাব।
বহ্নি উঠে ফোনটাকে নিয়ে,’সেই মানুষটা’বলে সেভ করা নাম্বারটা দেখে।ডায়াল করতে চেয়েও করতে পারেনা।কিসের একটা অস্বস্তিবোধ ছেয়ে আছে মনে।
রুমমেট আঁচলের সাথে নিজে নিজেই হাবিজাবি কথা বলতে থাকে।আঁচল বোধহয় নিজেও অবাক হয়ে যায় বহ্নির আচরণে।সাধারণত বহ্নি চুপচাপ থাকে।নিজে থেকে কোনো কথাই বলেনা।আসলে যদি কোনো ভাবে দুপুরের ব্যাপারটা মাথা থেকে বেরিয়ে যায়।
খাওয়াদাওয়া সেরে শুয়ে পরে তাড়াতাড়ি।দেখতে দেখতে পাশের বেডে আঁচল ঘুমিয়ে পরে।কিন্তু বহ্নির ঘুমটা আসছে না।সেই তাড়াহুড়োর ভাবটাও কিছুতেই কাটছে না বহ্নির।যেন কোথাও যেতে হবে এক্ষুনি,কি যেন হয়েছে একটা,একটা তাগিদ আসছে ভিতর থেকে।জরুরি,ভীষণ জরুরি একটা ব্যাপার।
না আর পারলোনা বহ্নি শুয়ে থাকতে।দরজাটা বাইরে থেকে টেনে দিয়ে সোজা ছাদে গিয়ে,’সেই মানুষটা’নাম্বারটায় ডায়াল করলো।অপরপ্রান্তে ‘হেলো’বলার সাথে সাথেই কেটে দিলো ফোনটা।
বেশ খানিকটা সময় পায়চারি করবার পর আবার ডায়াল করলো,অপর প্রান্ত থেকে বলে উঠলো,প্লিজ কাটবেন না ফোনটা।আমার মন বলছে আপনি কাঁথির সেই মেয়েটা,যাকে কাউন্টারে দেখলাম’।
বহ্নি কোনো রকমে বললো,’হুম’।
কেন যে সেবার ছেলেটির কথা না শুনে ভয়ে দৌঁড়েছিলো!আর কেন যে পরের বার ও কথা বলতে চাওয়ায় চড় মারতে গেলো!সেই অপরাধ বোধ আজও ওকে কুড়ে কুড়ে খায়।আর সেই অপরাধবোধ থেকেই নাম্বারটা আজ সেভ করেছিলো কাউন্টার থেকে।ভেবেছিলো,ক্ষমা চাইবে।কিন্তু ক্ষমা চাওয়াটা যে এতো কঠিন হয় সেটাই বোঝেনি।
গলা দিয়ে একটা আওয়াজ বের হচ্ছেনা বহ্নির।পল্লব বললো,’আমার না বলা কথা গুলো বলতে চাই আবারো।কাল কি সময় হবে?আমি সন্ধ্যে ছয়টার পর মলের পাশের কফি-শপটায় ওয়েট করবো,প্লিজ একবার আসুন’,বহ্নি কোনোরকমে, ‘আচ্ছা’বলে ফোন কেটে দিলো।এতো অস্থিরতা আগে কখনো হয়নি বহ্নির,দরদর করে শুধু ঘামছে।
(চলবে)