অরোনী, তোমার জন্য~১২
লিখা- Sidratul Muntaz
অরোনী আবার ঘড়ির দিকে তাকালো৷ রাত দুইটা বাজতে চলেছে। রাফাত ক্রমাগত ম্যাসেজ দিয়ে যাচ্ছে। ফোন সাইলেন্ট করা তাই ম্যাসেজের শব্দ আসছে না। কিন্তু ম্যাসেজগুলো দেখে অরোনীর বুকে দ্রিম দ্রিম শব্দ হচ্ছে। বেচারার কি অনুরোধ, আকুতি, আহাজারি! অথচ অরোনী কিছুই করতে পারছে না। রাফাত অফিস থেকে আসার পর মাত্র পাঁচমিনিটের জন্য তার সাথে দেখা হয়েছিল। তারপর আর দেখা হয়নি। আজ মনে হচ্ছে অরোনী ঘরে না যাওয়া পর্যন্ত রাফাত ঘুমাবেও না। অরোনীর খুব খারাপ লাগছে। রাবেয়া বললেন,” দেখো বউমা, এখন মজার সিন হবে।”
অরোনী হতাশ দৃষ্টিতে টিভির দিকে তাকালো। তার চিৎকার করে বলতে মন চাইল,” আমি টিভি দেখবো না। আমি এখন একটু ঘরে যেতে চাই। আমাকে এই কারাগার থেকে মুক্তি দিন দয়া করে।”
কিন্তু বলা যাচ্ছে না। সামনের মানুষটি যখন অতিরিক্ত ভালো আচরণ করে তখন তার পিঠে অতিরিক্ত খারাপ আচরণ করা যায় না। রাবেয়ার হঠাৎ করেই ইচ্ছে হয়েছে অরোনীকে নিয়ে সিনেমা দেখবেন। রাত এগারোটা বাজে তিনি সিনেমা ছেড়েছেন। একটা সিনেমা শেষ। এখন আরেকটা চলছে। প্রথম সিনেমাটা অরোনীও খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছিল। শাশুড়ীর সাথে বসে সিনেমা দেখা তো মজার ব্যাপার। কিন্তু মজারও একটা সীমা আছে। রাত সাড়ে বারোটায় যখন তিনি নতুন সিনেমা ছাড়লেন তখন অরোনীর ইচ্ছে হলো শক্ত কণ্ঠে বলতে, ” মা, দয়া করে আপনি নিজে ঘুমান আর আমাকেও ঘুমাতে দিন।”
অরোনী শক্ত কণ্ঠে এই কথা বলতে পারেনি। কেবল বলেছে,” মা, আমার আর ভালো লাগছে না। আমি প্লিজ ঘুমাতে যাই?”
রাবেয়া তখন অনুরোধের দৃষ্টিতে বললেন,” আর মাত্র আধঘণ্টা মা। একটু সহ্য করো। এই সিনটা না দেখলে মনে হচ্ছে সারারাত আমার আর ঘুমও আসবে না। তুমি চলে গেলে আমার একা দেখতেও ইচ্ছে করবে না। প্লিজ একটু বসো অরোনী। আমার লক্ষী মেয়ে।”
অরোনী তখন মনে মনে বলল,” আমি আপনার লক্ষী মেয়ে না। আপনার লক্ষী মেয়ে ঘরে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। আর আপনি আমাকে এখানে বসিয়ে রেখেছেন। ওইদিকে আপনার ছেলে মরে যাচ্ছে।”
রাবেয়া আধঘণ্টা বলতে বলতে দেড়ঘণ্টা সময় লাগিয়ে দিয়েছেন। অরোনী কোনোভাবেই উঠতে পারছে না। নির্মল সাহেব বিছানার দেয়ালে হেলান দিয়ে বই একটা মুখের কাছে ধরে আছেন। তিনি কি ঘুমিয়ে গেছেন নাকি জেগে আছেন তাও বোঝা যাচ্ছে না। অরোনী নিজের অবস্থা বোঝানোর জন্য চোখ বন্ধ করে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে রাখল। যাতে রাবেয়া ভাবেন অরোনীর খুব ঘুম পেয়েছে। তখন যদি আল্লাহর ওয়াস্তে টিভিটা বন্ধ করে অরোনীকে যেতে দেন। রাফাত আবার ম্যাসেজ পাঠাল,
” তোমরা কোন রুমে আছো বলোতো? আমি এখনি আসছি।”
অরোনী দ্রুত লিখল,” প্লিজ এসো না। বাবা এখনও জেগে আছেন। তুমি কি ওদের দু’জনের সামনে থেকে আমাকে নিয়ে যাবে?”
” প্রয়োজনে তাই করবো। আমার আর ভাল্লাগছে না অরোনী!”
রাফাত চূড়ান্ত অধৈর্য্য হয়ে পড়েছে। অরোনী বিপদগ্রস্ত হয়ে লিখল,” এমন করলে আমার লজ্জা লাগবে। তুমি আমার জন্য এখনও জেগে আছো ব্যাপারটা কেমন দেখায়?”
” কেমন দেখায় মানে কি? আমার স্ত্রীর জন্য আমি জেগে থাকবো না তো কি অন্য ছেলে জেগে থাকবে? আশ্চর্য! ”
উফফ আল্লাহ, রাফাত এমন ঠোঁটকাটার মতো কথা বলছে কেন? অরোনীর অস্বস্তি লাগছে খুব। রাফাতকে নিচে আসতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই। অরোনী ম্যাসেজ লিখল,” আমি পাঁচমিনিটের মধ্যে উপরে আসছি। তাও তুমি নিচে এসো না প্লিজ!”
” ওকে। ঘড়ি ধরে মাত্র পাঁচমিনিট অপেক্ষা করবো। এরপরেও যদি না আসো তাহলে আমি সত্যি চলে আসবো।”
অরোনী রাবেয়ার দিকে চেয়ে দ্রুত বলল,” মা আমি বাথরুমে যাচ্ছি।”
রাবেয়া টিভির দিকে চেয়ে থেকেই বললেন,
” আচ্ছা, তাড়াতাড়ি এসো কিন্তু।”
অরোনী মনে মনে উত্তর দিল,” স্যরি মা, আপনি সকালের আগে আমার চেহারা আর দেখবেন না।”
অরোনী রুম থেকে বের হয়েই হাঁফ ছাড়ল। ইশ, এই বুদ্ধিটা তার মাথায় আগে কেন আসেনি? দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে লাগল অরোনী। কিন্তু মাঝপথেই দেখা হয়ে গেল রাফাতের সঙ্গে। একই সময় রাফাতও নিচে নামছিল। দু’জন দু’জনকে দেখেই হেসে ফেলল। তারপর একসঙ্গে হাত ধরে উপরে উঠে এলো। রাফাত ঘরে ঢুকেই দরজা আটকালো। তারপর অরোনীর দিকে ঘুরে কোমড়ে হাত রেখে প্রশ্ন করল,” সমস্যা কি বলোতো? এতোরাত পর্যন্ত কি করছিলে?”
অরোনী অপরাধী কণ্ঠে জানাল,” সিনেমা দেখছিলাম।”
” তোমার সিনেমা দেখা এতো ইম্পোর্ট্যান্ট হয়ে গেছে?”
” আরে আমি তো চলেই আসতে নিয়েছিলাম৷ কিন্তু মা আমাকে আটকে রেখেছিলেন। আসতেই দিচ্ছিলেন না।”
” মা কি তোমাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে আটকে রেখেছিলেন?”
অরোনী দুইপাশে মাথা নাড়ল। রাফাত রেগে বলল,” তাহলে তুমি কেন আসতে পারবে না?”
” বাবাও জেগে ছিলেন। আমি কি বলতাম তাদের? ঘুমের কথা অনেকবার বলেছি। মা বললেন এখানে তার সঙ্গেই শুয়ে পড়তে। বাবা অন্যরুমে চলে যাবেন। তখন আমি বললাম, থাক ঘুম আসছে না। তখন মা বললেন, তাহলে আরেকটু বসো। আমি তো তখন মুখ ফুটে এটা বলতে পারি না যে তুমি জেগে অপেক্ষা করছো।”
” এইটা বললে নিশ্চয়ই তোমার দাঁত পড়ে যেতো না।”
অরোনী চুপ করে রইল। রাফাত বিছানায় বসে অস্থির গলায় বলতে লাগল,” আমার এতোক্ষণ কি যে ইচ্ছে করছিল তোমাকে বোঝাতে পারবো না। বাড়িতে আমি থাকি মাত্র বারো ঘণ্টা। এর মধ্যে মিনিমাম ছয়ঘণ্টা ঘুমাতে হয়। তুমিও দুইঘণ্টা বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকো। অর্থাৎ চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আমার জন্য তোমার সময় মাত্র চারঘণ্টা। কত কম সময়! আর আজকে তো এক্সটেন্ড হয়ে গেল। তুমি ছয়ঘণ্টা ধরেই ঘরের বাহিরে! বেশি ইনজাস্টিস হয়ে গেল না? ”
অরোনী রাফাতের পাশে বসতে বসতে বলল,” আমি কি করবো বলো? ইচ্ছা করে তো কিছু করিনি। কাল থেকে আর হবে না। এখন তুমি শুয়ে পড়ো প্লিজ। নাহলে সকালে অফিসে যেতে পারবে না।”
রাফাত ভ্রু কুচকে বলল,” অফিসে কে যাবে? আমি ঠিক করেছি কাল অফিসেই যাবো না।”
” কেন?”
” সারারাত না ঘুমিয়ে অফিসে গেলে ঝিমাতে হবে। তার চেয়ে না যাই।”
” তুমি সারারাত ঘুমাবে না কেন?”
” তোমার কি মনে হচ্ছে? তোমাকে পাশে নিয়ে ঘুমানোর জন্য আমি দুইটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি?” অরোনী লজ্জিত গলায় বলল,” তাই বলে কাল অফিস মিস দেবে? এটা তো ঠিক না।”
” একটা দিন মিস দিলে এমন কোনো ক্ষতি হবে না।আমি তো ওয়েট করছি ভ্যাকেশনটার জন্য। আর মাত্র কয়টাদিন। তারপর আমরা হানিমুনে যাবো দুইমাসের জন্য।”
অরোনী চোখ বড় করে বলল,” দুইমাসের জন্য কেউ হানিমুনে যায় পাগল?”
” তাহলে কয়মাস? পাঁচ!”
অরোনী কপালে হাত দিয়ে বলল,” হায় গর্ধব!সর্বোচ্চ দশ-বারোদিনের জন্য যাওয়া যেতে পারে।”
রাফাত তাচ্ছিল্য কণ্ঠে বলল,” ধ্যাত! দশ-বারোদিনে কি হবে? চোখের পলকে কেটে যাবে।”
” এখন তোমার এটা মনে হচ্ছে। কিন্তু তখন দেখবে সময় যাচ্ছেই না। বোর লেগে যাবে।”
রাফাত অরোনীর দিকে চেয়ে নেশাবিষ্ট কণ্ঠে বলল,” তোমার বোর লাগতে পারে। কিন্তু আমার কখনোই লাগবে না৷ জানো সারাদিন অফিসে আমার কি ইচ্ছে করে? তোমাকেও যদি ব্যাগে ভরে আমার সাথে অফিসে নেওয়া যেতো! আমার ডেস্কের নিচে বড় একটা ড্রয়ার আছে। সেখানে তোমাকে লুকিয়ে রাখতাম। কেউ না থাকলে বের করে তোমাকে মন ভরে দেখতাম আর চুমু দিতাম।”
” ইশ!”
” সিরিয়াসলি! ইদানীং এই ইচ্ছেটা আমার এতো বেশি পরিমাণে হচ্ছে! মাঝে মাঝে অফিসে কাজের খুব প্রেশার থাকে। একটু রিল্যাক্স হওয়া যায় না। তখন মনে হয় অন্তত পাঁচমিনিটের জন্য যদি তুমি আমার অফিসে চলে আসতে! আমাকে জড়িয়ে ধরতে! তোমার বুকে মাথা রেখে আমার সব ক্লান্তি চলে যেতো!”
অরোনী মনখারাপের গলায় বলল,” আহারে, এইতো আমি সামনে আছি। এখন জড়িয়ে ধরলে চলবে?”
” উহুম। এখন শুধু জড়িয়ে ধরলে চলবে না। আরও.. ”
অরোনী সাথে সাথে রাফাতের মুখ চেপে বলল,” চুপ।”
রাফাত ঝট করে মুখ থেকে অরোনীর হাতটা সরিয়ে বলল,” কেন? আমার কথা শুনতে ভালো লাগছে না?”
কথা শুনতে শুনতেই তো অরোনীর চেহারা লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। সে মাথা নিচু করে বলল,” না। একদম জঘন্য লাগছে। ”
” জঘন্য লাগলেও শুনতে হবে। মাঝে মাঝে তো ইচ্ছে করে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাড়িতে চলে আসি। সারাদিন তোমাকে দেখি, তোমার ঠোঁটে, গলায়, গালে চুমু দিতে থাকি। তারপর..”
অরোনী কঠিন গলায় বলল,” তুমি যদি মুখ বন্ধ না করো তাহলে কিন্তু আমি আবার নিচে চলে যাবো। আর ফিরে আসবো না।”
রাফাত নিচের ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেলল। তারপর বলল,” বুঝেছি। তুমি চাইছো আমি যেন কথা বলা বন্ধ করে সরাসরি কাজ শুরু করি।”
অরোনী দুইহাতে মুখ ঢেকে বলল,” ছিঃ, কি খারাপ! আমি এটা একবারও বলিনি।”
রাফাত ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগল।
আজকের সকালটাই অরোনীর মনখারাপ দিয়ে শুরু হলো। গতকাল রাফাত অফিসে যায়নি। প্রায় সারাদিনই তাদের ঘরের দরজা বন্ধ ছিল। তখন ঘরভর্তি মানুষও ছিল। আর আজকে রাফাত সকাল সকাল অফিসে চলে গেছে। কিন্তু আজই বাড়িতে কোনো মানুষ নেই। কোনো মানুষ নেই বললে ভুল হবে। মানুষ আছে কিন্তু নিচতলায়। দুইতলাটা পুরো ফাঁকা। দীপ্তি ভাবী আজ তার বাপের বাড়ির মানুষদের নিয়ে ঘুরতে গেছেন। সে খুব শৌখিন মহিলা। কিছুদিন পর পর বেড়াতে যাওয়ার আয়োজন করা তার নেশা! রুমা, নীলিমা, তানজুও তার সাথে লাইন ধরেছে। আজ দীপ্তি রাবেয়াকেও সাথে নিয়ে গেছে। উর্মি তো এইসময় স্কুলেই থাকে। আর রিতুরও আজকে নিচে কাজ বেশি। সকাল থেকে সে একবারও উপরে আসেনি। কাজ না থাকলে নিশ্চয়ই আসতো। অতএব বলা যায় পুরো দুইতলায় অরোনী আজ একাই আছে। সবাই ফিরবে কখন বলা যায় না। এজন্যই ভালো লাগছে না অরোনীর। মন বিষণ্ণ লাগছে। একবার রাফাতকে ফোন করে কথা বলতে ইচ্ছে করল। কিন্তু রাফাত ইদানীং এতো ফাজিল হয়েছে যে তাকে ফোন দিতে গেলেও দশবার ভাবতে হয়। সে ফোন ধরেই এমন সব কথা বলতে থাকে যে লজ্জা পেয়ে অরোনীর ফোন কেটে দিতে হয়। দীপ্তিদের সাথে আজ চাইলেই অরোনী ঘুরতে যেতে পারতো। কিন্তু সে যায়নি রুবায়েতের ভয়ে। ওই ছেলের মুখোমুখি হতে তার একদম ইচ্ছে করে না। চাহনি দেখলেই মেজাজ খারাপ হয়। মন চায় কষিয়ে থাপ্পড় লাগাতে।
অরোনী রান্নাঘরে এসে চুলা জ্বালালো। কফি খেতে ইচ্ছে করছে। মগভর্তি কফি নিয়ে ছাদে বসে থাকবে। নাহলে নিচে শিলা চাচী আছেন। তার সঙ্গেও কফি খেয়ে গল্প করা যায়। মানুষটা সারাদিন এতো কাজ করতে থাকেন যে বসে দু’মিনিট গল্প করার সুযোগটুকুও হয় না। অথচ এই বাড়িতে যখন অরোনী প্রথম এসেছিল তখন শীলা চাচীই তাকে সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট দিয়েছেন। মানুষটার কাছে অরোনী কৃতজ্ঞ! তাছাড়া শিলা চাচীর ছেলে তাহসিনও আছে। এই বাড়ির সবচেয়ে নিশ্চুপ সদস্য। তার এখন এডমিশন পিরিয়ড চলছে। সারাক্ষণ পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকছে ছেলেটা। অরোনী তার কাছেও কফি নিয়ে যেতে পারে।
পেছন থেকে মনে হলো কারো পায়চারী শোনা যাচ্ছে। অরোনী তৎক্ষণাৎ পেছনে ঘুরল। কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। বুকে থুতু দিয়ে নিল। ভয় লাগছে তার। কফিটা দ্রুত বানাতে হবে। নিচে চলে গেলেই আর ভয়টা লাগবে না। দুইতলাটা এখন পুরোপুরি নিস্তব্ধ। এজন্যই বোধহয় এমন গা ছমছম করছে। অরোনী ভয় কাটানোর জন্য শব্দ করে গান গাইতে লাগল। তার গানের কণ্ঠ বেশ সুন্দর।
” তারে আমি চোখে দেখিনি..”
রুবায়েত পর্দার আড়াল থেকে অরোনীকে দেখছে। তার শরীর উত্তেজনায় ঘামছে। মাথার মধ্যে এলোমেলো সব চিন্তা। ভেবেছিল আজ সবার সাথে অরোনীও আসবে।সেদিন যখন অরোনী চায়ের কাপটা রুবায়েতের হাতে না দিয়ে দীপ্তির হাতে দিয়ে চলে যাচ্ছিল ঠিক তখনি অরোনীকে ছুঁয়ে দেওয়ার তীব্র আকাঙ্খাটা ভালোভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। যার ফলশ্রুতিতে আজ সে এতোবড় সাহস করে ফেলেছে। প্রায় ফাঁকা বাড়িতে অরোনী একা আছে জেনেই ছুটে এসেছে।
অরোনীর গানের কণ্ঠ আর চুলের গন্ধ কেমন কঠিন একটা মোহের জাল সৃষ্টি করছে। রুবায়েত নেশাগ্রস্তের মতো সেদিকে ঘনিষ্ট হচ্ছে। সে জানে অরোনী এখন তাকে দেখলে রেগে যাবে। চিৎকার করবে কিংবা আরও ভয়ংকর কাজ করবে। তাই রুবায়েত স্টোর-রুমের দরজাটা বন্ধ করে ঢুকেছে। তার মনে হচ্ছে, অরোনী যদি আজ রেগে তাকে চড় দেয় তাও কিছু হবে না। বরং ভালো লাগবে। মনে হবে অরোনীর হাতের ছোঁয়াতেও ফুলের সৌরভ মেশানো! অরোনী একমনে গান গেয়ে চলেছে। রুবায়েতের সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছিল। আলতো কণ্ঠে রুবায়েত ডাকল,” অরোনী।”
অরোনী পেছনে ঘুরে রুবায়েতকে দেখেই সহসা চিৎকার দিয়ে মুখে হাত চেপে ধরল। তার শরীর ধাক্কা খাওয়া দরজার মতো কাঁপতে লাগল।
রুবায়েত হালকা হাসল। অরোনীর মনে হলো এতো জঘন্য মুখের হাসি সে কোনোদিন দেখেনি! অরোনী কাঁপা কাঁপা গলায় আরেকটা চিৎকার দিয়ে বলল,” আপনি এখানে কেন এসেছেন? বের হোন। আল্লাহ, বের হোন।”
রুবায়েত নরম গলায় বলল,” বিশ্বাস করুন, আপনাকে আমি ভীষণ পছন্দ করি। আমার এই আবেগকে ঠুনকো মনে করবেন না। আপনাকে দেখার প্রথম দিন থেকেই আমার চোখের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। এরপর থেকে যতবার আপনার কথা মনে হয় ততবার আমার জ্বর আসে। এইযে দেখুন এখনও জ্বর আসছে। আমার গা কত গরম!”
অরোনীর হাতটা খপ করে ধরে নিজের গলায়, গালে স্পর্শ করাতে লাগল রুবায়েত। অরোনী চোখ বন্ধ করে গগনবিদারী চিৎকার করতে লাগল। রুবায়েত কোনো তোয়াক্কা করছে না। শক্ত করে অরোনীর কোমড় চেপে ধরল। অরোনী সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। লোকটাকে যে জোরে একটা ধাক্কা মারবে সেটুকু শক্তিও নেই৷ আতঙ্কে বুদ্ধি সাহস সব লোপ পেয়েছে। অরোনী চোখ দু’টো খুলে দেখার স্পর্ধাও পাচ্ছে না। তার সাথে এ কি সর্বনাশ হচ্ছে! প্রচন্ড ঘৃণা লাগছে। শরীর কাটা দিয়ে উঠেছে। অরোনী কিছু চিন্তা না করেই ফুটন্ত গরম কফির কেটলিটা হাতে নিয়ে রুবায়েতের মুখে ছুড়ে মারল। প্রথমে ভারী কেটলির আঘাতে রুবায়েতের কপাল ফুলে তারপর গরম কফিতে মুখ ঝলসে গেল। রুবায়েত হিংস্র জন্তুর মতো আর্তনাদ করে উঠল। অরোনী এই অবস্থায় রুবায়েতকে ল্যাং মেরে ফেলে দিল। রুবায়েত চিৎ হয়ে লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে। দুইহাত দিয়ে মুখ ঢেকে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল সে। অরোনী আক্রোশে তার গোপন জায়গায় একাধারে লাথি দিল। তারপর ছুটে বেরিয়ে এলো স্টোর-রুম থেকে। দরজা খুলতে একটু অসুবিধা হয়েছিল। কিন্তু অবশেষে খুলতে পেরেছে। এই সমস্ত কাজ সে করেছে এক নিঃশ্বাসে! বাহিরে বের হতেই রিতুকে দেখল অরোনী। রিতু বড় বড় চোখে বলল,” ভাবী কি হইছে? চিল্লানি শুনলাম তো। ভিতরে কেডা?”
অরোনী জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলল। কোনো কথা বলল না। রিতুকে ঠেলে নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিল। তার শুধু ভয় হচ্ছে। ভয়ংকর আতঙ্ক কাজ করছে মনে। এই বুঝি রুবায়েত ওখান থেকে উঠে চলে আসল। গর্জন করতে করতে দরজা ভেঙে ফেলল। অরোনী ঘরের কোথায় লুকাবে বুঝতে পারছে না। সে দৌড়ে বাথরুমে চলে গেল। বেসিনের উপর থেকে বডিওয়াশ নিয়ে শরীরে ঘষতে লাগল। এমনভাবে ঘষছে যেন তার পুরো শরীরে নোংরা। নোংরাটা ঘষে-মেজেও তোলা যাচ্ছে না। রিতু এতো অস্বাভাবিক অবস্থা দেখে ভয়ে স্তব্ধ। একটু পর অরোনীর কাছে গিয়ে মিনতি করে বলল,” ছোট ভাবী আফনের কি হইছে? আল্লাহর দোহাই লাগে কন আফনের কি হইছে?”
অরোনী শূন্যদৃষ্টিতে একবার তাকালো রিতুর দিকে। রিতুর চোখে পানি। তাই দেখে অরোনীও বাঁধ ভাঙা নদীর মতো কেঁদে উঠল। রিতুকে জড়িয়ে ধরে তার সে কি কান্না! রিতু অবাক হয়ে গেল। একটু পর অরোনী রিতুকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে শাওয়ার ছেড়ে দিল। সাদা ফেনামাখা শরীর ধুঁয়ে যাচ্ছে। অরোনী শাওয়ারের নিচে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল। তার ছিপছিপে শরীরটা মৃদু কাঁপছে। হঠাৎ করেই অরোনী বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দিল। রিতু জোরে জোরে দরজা ধাক্কাচ্ছে। কিন্তু অরোনীর সাড়া-শব্দ নেই। কূল-কিনারা না দেখে রিতু অরোনীর মোবাইল নিয়ে রাফাতকে ফোন দিল। ওই পাশ থেকে ফোন রিসিভ হওয়া মাত্রই রাফাতকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে এক নিঃশ্বাসে রিতু বলে গেল,” ছোটভাইয়া, আফনে বাড়িত আসেন জলদি। ছোটভাবীর অবস্থা খুব খারাপ। জলদি আসেন ছোটভাই।”
” কি হয়েছে অরোনীর?”
” আমি কইতে পারি না। আফনে আইসা দেইখা যান।”
রাফাত কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে তাড়াহুড়ো করে বলল,” আচ্ছা, আচ্ছা, আমি আসছি।”
রিতু ফোন কেটে দিয়ে আবার বাথরুমের দরজা ধাক্কাতে শুরু করল। তখনি বাহিরে থেকে রুবায়েতের চিৎকার শুনল। রিতু ভয়ে ভয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখল স্টোর-রুম থেকে বের হয়ে লিভিংরুমের সোফায় বসে আছে রুবায়েত। ফ্রীজ থেকে বরফ খন্ড বের করে নিজের মুখমন্ডলে ধরে আছে। রিতু মনে মনে বলল,” হারামজা* তোর লাইগা ছোটভাবীর এই অবস্থা!”
তার ইচ্ছে করল রান্নাঘর থেকে বটি এনে একটা কোপ দিতে। নয়তো গায়ের জ্বালা মিটবে না। রিতু দৌড়ে রান্নাঘরে যাচ্ছিল। রুবায়েত তাকে দেখেই বলল,” এই মেয়ে শোনো, আমার গায়ে গরম কফি পড়ে গেছে। খুব জ্বালাপোড়া করছে। তোমার কাছে এন্টিসেপটিক হবে?”
রিতু শান্ত গলায় বলল,” জ্বী হইবো।”
” তাহলে একটু দ্রত নিয়ে এসো।”
রিতু রান্নাঘরে গিয়ে মশলার পট নিল। একমুঠো মরিচের গুঁড়ো নিয়ে ফিরে এলো।
“এইযে নেন।”
রুবায়েত কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার সারামুখে মরিচ ডলে দিয়েছে রিতু। রুবায়েতের অকস্মাৎ চিৎকারে ভবন কেঁপে উঠল। রিতু দৌড়ে ঘরে চলে এসেছে। রুবায়েত চোখ খুলে তাকাতে পারছে না৷ তাকে কেবল দৌড়াতে হচ্ছে। রাফাত একঘণ্টার মধ্যেই বাড়ি ফিরে এলো। তখন দীপ্তিরাও ফিরে এসেছে। পুরো বাড়িতে ঘটনা জানাজানি হয়ে গেছে। রুবায়েতের চোখে মরিচ গুঁড়া মেখে দেওয়ার অপরাধে রিতুকে চড় মেরেছে দীপ্তি। রিতু গালে হাত দিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। এসব ঘটনাই এসে দেখতে পাচ্ছে রাফাত। সে এখনও বুঝতে পারেনি বাড়িতে আসলে হয়েছেটা কি! এদিকে অরোনী এখনও বাথরুমের দরজা খুলে বের হয়নি।
চলবে