#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা
৮.
রাস্তায় চলতে চলতেই ইশার আজান পড়ে গেল। মেঘালয়ার মনে অদ্ভুত কিছু চলছে। যা সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। চারদিকের এই চলমান আধো-অন্ধকার রাতের পরিবেশ মনে দোলা দেয় ওর।
বাজারের মাঝ দিয়ে অতিক্রম করার সময়, আকস্মিক মেঘালয়া চিৎকার করে ওঠে, “থামুন, থামুন ইরাজ ভাই। থামুন!ʼʼ
ইরাজ বিরক্ত হয়ে তড়িঘড়ি বাইকের ব্রেক কষে ধরল। মেঘালয়া নেমে দাঁড়ায়। ইরাজ কপাল কুঞ্চিত করে তাকাল, “কি সমস্যা তোর?ʼʼ
এবার সংকোচে পড়ে যায় মেঘালয়া। উত্তেজনায় ইরাজকে থামিয়েছে তো। এবার? দ্বিধা-সংকোচ কাটিয়ে হাতের বামদিকে আঙুল দ্বারা ইশারা করল। ইরাজ তাকায় সেদিকে। মুখ-চোখ জড়িয়ে চেয়ে রইল। সামনে ফুসকার স্টল। ফিরে তাকাল মেঘালয়ার দিকে। মেঘালয়া মাথাটা নত করে নিলো। আবার চোখ উঠিয়ে ইরাজের দিকে তাকিয়ে দ্রুত বলল, “ফুসকা খাব।ʼʼ
“তো খা গিয়ে। নিষেধ কে করেছে?ʼʼ
“আর আপনি?ʼʼ
“তোর আর আমার রুচিবোধ গুলিয়ে ফেলছিস নাকি? ওসব থার্ডক্লাস, ফালতু জিনিস আমার পোষায় না।ʼʼ
মেঘালয়া এবার ক্ষেপে ওঠে, “ফুসকাকে নিয়ে আর একটাও বাজে কথা বলবেন না। আপনার রুচিতে সমস্যা আছে। নয়ত ফুসকা অপছন্দ হতো না। আপনার মতো লোকের ভালো কিছু ভালো নাই লাগতে পারে। তাই বলে, সে জিনিস খারাপ না। আর এসব আপনার পোষাবে কেন, আপনার তো পোষায়— ঢকঢক করে যা গিললে টাল হয়ে পড়ে থাকা যায়।ʼʼ
ইরাজ ভ্রু উঁচিয়ে তাকাল। বলল, “আমার হাতে লাস্ট থাপ্পড় কবে খেয়েছিস!ʼʼ
মেঘালয়ার মনে পড়ে, ছোটবেলায় বহুত থাপ্পড় খেয়েছে নিজের উল্টো-পাল্টা কাজ কর্মের জন্য। মুখ শক্ত করে বলল, “টাকা দিন। আমি নিজেই গিয়ে খেয়ে আসছি।ʼʼ
ইরাজ বলল, “খাবি তুই, টাকা আমি কেন দেব, আজব! আর খেয়ে কোথায় আসছিস? তোর মনে হয়, আমি তোর খাওয়া শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করব?ʼʼ
এবার মেঘালয়া খানিকটা দমে যায়, ভেতরে অদ্ভুত এক অভিমান চেপে গেল। সেই অভিমান নিয়েই বলল, “তো নিতে এসেছেন কেন?ʼʼ
“দায়িত্ববোধ।ʼʼ
মেঘালয়া প্রশ্ন করে, “শুধুই দায়িতববোধ?ʼʼ
‘হু, তোর বাপের তুলে দেওয়া আমার ঘাঁড়ে শুধুই এক দায়িত্ব আজ তুই।ʼʼ
মেঘালয়া হুট করে প্রশ্ন করে ওঠে, “আজ! আর আগে কি ছিলাম, ইরাজ ভাই।ʼʼ
ইরাজ সামনের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে। সে ভুলেও মেঘালয়ার দিকে তাকায় না সচরাচর। এখনও ওই সামনের দিকে তাকিয়েই, গম্ভীর ভারী আওয়াজে বলল,
“দু সেকেন্ডের মধ্যে বাইকে উঠবি, নয়ত তোকে ফেলে রেখে চলে যাওয়া অসম্ভব না আমার জন্য, তুই জানিস।ʼʼ
মেঘালয়া দীর্ঘ এক প্রলম্বিত শ্বাস টেনে নিলো। ইরাজ ওর কাছে দিন-দিন আরও দুর্বোধ্য আর জটিল হয়ে উঠছে। যাকে ধরা যায় না, বোঝা যায় না, না ছোঁয়া যায়, আর না যায় বিশ্লেষণ করা।
—
বাড়িতে প্রবেশ করেই মেঘালয়া আগে আগে ভেতরে যায়। থমথমে মুখে সম্মুখে এসে দাঁড়াল আনতারা খানম। ভারী মুখটা দেখে মেঘালয়ার বুকটা কিঞ্চিত কেঁপে ওঠে। তখন পেছনে এসে দাঁড়াল ইরাজ। মেঘালয়াকে উদ্দেশ্য করে আনতারা খানম বেজায় অসন্তুষ্ট চিত্তে কঠিন স্বরে জিজ্ঞেস করল, “তা কোথায় গিয়েছিলে আবার কার সাথে? আমার ছেলেকে তোমার বাবা রক্ষাকর্তা নিযুক্ত করেছে নাকি? তুমি যা অকাম-কুকাম করবে, যখন ইচ্ছে, যার সাথে ইচ্ছে চলে যাবে, রাজ গিয়ে বাঁচিয়ে ফিরিয়ে আনবে!ʼʼ
মেঘালয়া মাথাটা সামান্য নত করে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আনতারা খানম এবার চিৎকার উঠে উঠলেন,
“কি হলো কথা বলছ না কেন? তুমি কোথায় কি করে আসবে, তার দায় আমার ছেলে এবং আমরা নেব? লজ্জা করল না তোমার বাবা আর তোমার? এরকম একটা বিষয় লুকিয়ে মেয়েকে আমার ছেলের ঘরে তুলে দিলো?ʼʼ
মেঘালয়া মৃদূ প্রতিবাদের স্বরে বলল, “বাবাই আর ইরাজ ভাই জানত।ʼʼ
“বাহ। উত্তরও আছে দেখছি তোমার কাছে? আমার থেকে কেন লুকিয়েছে তোমার বাবা? বিয়ে হতে দিতাম না বলে? মেয়েকে বিদায় করতে এমন নিঁচু আয়োজন যার বাবার, তার মেয়ে এমন কিছু করবে, এটা অসম্ভব কিছুনা।ʼʼ
এবার আর মেঘালয়ার সইল না। ভেতর পুড়ে উঠল এমন কথায়। তবুও শক্ত হয়ে, কঠিন চিত্তে দাঁড়িয়ে রইল। ইরাজও গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে পাশেই। আনতারা খানম আকস্মিক দরজার দিকে আঙ্গুল ইশারা করে মেঘালয়ার উদ্দেশ্যে বললেন,
“বেরিয়ে যাও। তুমি অন্তত ততদিন আমার সম্মুখে আসবে না, যতদিন না এর কোন বিহিত হয়। বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে।ʼʼ শেষের কথাটুকু জোর দিয়ে বললেন।
মেঘালয়া ধীর পায়ে দরজার দিকে পা বাড়ায়। আচমকা খপ করে ওর হাত চেপে ধরল ইরাজ। আজ প্রথমবার ইরাজ ইচ্ছাকৃত মেঘালয়াকে স্পর্শ করল। মেঘালয়া ফিরে চায়না। হাত মোচড়া-মুচড়ি করে ছাড়া পেতে। ইরাজ আরও শক্ত করে চেপে ধরে একটানে সামনে এনে দাঁড় করালো। মেঘালয়া চোখ লাল হয়ে উঠেছে। চোখে পানি টলমল। তবে গড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে না মেয়েটা। ইরাজ হুংকার ছেড়ে আদেশ করে, “ওপরে যা।ʼʼ
মেঘালয়া আগের মতোই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ইরাজ অপর হাত দ্বারা এবার ওর মুখটা উঁচিয়ে ধরল। চোখাচোখি হতেই এক ফোঁটা পানি চোখ ছাপিয়ে বেয়ে গড়িয়ে পড়ল, উত্তেজনায় লাল হয়ে উঠা মেঘালয়ার গাল বেঁয়ে। ইরাজ শীতল স্বরে ভারী আওয়াজে আবারও বলে ওঠে, “ওপরে যেতে বলেছি, মেঘ। আমি আমার স্টাইলে কিছু করলে তা খারাপ হবে তুই জানিস। যা বলছি কর।ʼʼ
মেঘালয়া এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে সিড়ির দিকে চলে গেল। আর পেছনে ফিরে চায় না।
ইরাজ ঠোঁট গোল করে গাঢ় শ্বাস ফেলল। অতঃপর ভাবলেশহীন ভঙ্গিমায় বসার রুম অবধি হেঁটে যায়। আনতারা খানম চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছেন। ইরাজ হেঁটে গিয়ে ফ্রিজ খুলে একটা পানির পট বের করল। এসে সোফায় বসল। আনতারা খানম গম্ভীর পায়ে হেঁটে এসে দাঁড়ালেন ছেলের সম্মুখে। ইরাজ ঢক-ঢক করে পানি গিলছে। আনতারা খানম যথাসম্ভব শান্ত করে নিলেন নিজেকে। ইরাজের সঙ্গে বাঁকা কথা বলে লাভ নেই। ধপ করে বসলেন ইরাজের সামনের সোফাটির ওপর। ইরাজ পানি খাওয়া শেষ করে ওয়াটার পট টি-টেবিলের ওপর রাখে।
“বড়ো মায়া জেগেছে ওই অন্য ছেলের সাথে ভেগে যাওয়া বউয়ের জন্য!ʼʼ মায়ের কণ্ঠে অভিমান স্পষ্ট।
ইরাজ তা দেখেও দেখল না। অবাক হওয়ার ভান করে বলল, “আম্মা! আমার সাথে বিয়ে হওয়ার আগে ভেগেছিল, মেঘ। অর্থাৎ তখন ও আমার বউ ছিল না।ʼʼ
আনতারা ছেলের দিকে তাকালেন, “তোর সবকিছু মজা লাগছে, রাজ?ʼʼ
“না।ʼʼ
“লজ্জা করেনি? ওই চরিত্রহীন মেয়েকে বিয়ে করতে, জেনে শুনে? তোর বাপ তো বন্ধুত্বে অন্ধ। আমি জানতাম আমার ছেলের আত্মমর্যাদাবোধ প্রবল।ʼʼ
ইরাজ মায়ের দিকে তাকাল। শান্ত স্বরে বলল, “হেলাল আঙ্কেল খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছিল।ʼʼ
“মেয়ের কুকর্ম ঢাকতে এরকম বহু নাটকে করে মানুষ।ʼʼ
“হুম, বুঝলাম।ʼʼ— ইরাজের স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর। যেন কিছুই হয়নি।
“ওই মেয়ে এ বাড়িতে থাকবেনা।ʼʼ
নির্বিকার জবাব দেয় ইরাজ, “ও আচ্ছা! কোথায় রাখতে চাইছ ওকে?ʼʼ
“জাহান্নামে।ʼʼ চিৎকার করে ওঠেন আনতারা খানম।
ইরাজ মুখ চেপে ধরল হাত দ্বারা, “আম্মা! তুমি মেঘাকে খু ন করার পরিকল্পনা করছ নাকি? না মরলে তো কেউ জাহান্নামে যায় বলে জানা নেই আমার।ʼʼ
ইরাজের এমন নির্লিপ্ত জবাব শুনে আনতারা খানম ক্রোধে ফেটে পড়েন যেন।
“পারলে আমি তুই আর তোর বাপকে খু ন করে ফেলতাম। লোকে আমাকে রাস্তায় ধরে অপমান করে? এই সুযোগটা তোরা দুজনে করে দিয়েছিস। এ বাড়িতে তোদের সামনে থাকতেও ঘৃণা হচ্ছে আমার।’ʼʼ
ইরাজ মাথা দুলায়, “হুমমম, বুঝলাম। তারপর?ʼʼ
আনতারা খানম ইরাজের কাছে এর চেয়ে বেশি আশাও রাখেন না। তার ছেলে যে কত বড়ো ছন্নছাড়া তা তার অজানা নয়। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ চেয়ে রইলেন ইরাজের মুখের দিকে। ইরাজ ফোনে ব্যস্ত। খানিকটা শান্ত স্বরে ডাকলেন, “রাজ!ʼʼ
ইরাজ একটু পর চোখ তুলে মায়ের দিকে চাইল। মাথাটা একবার উপর-নিচ দুলিয়ে বলল, “জি!ʼʼ
“তুই মেঘাকে ছেড়ে দে। ওই মেয়ে যতদিন এ বাড়িতে তোর পরিচয়ে থাকবে, শুদুই বদনামী আর সম্মানহানীর কারন হবে, এ বাড়ি, তোর বাবা, তোর। ওকে বিদায় কর।ʼʼ
“হেলাল আঙ্কেলের স্ট্রোক হয়ে যাবে।ʼʼ
“হেলাল ভাইজানের চিন্তা করছিস নাকি নিজের? কারন তুই যে নিজের বাপের চিন্তাও করিস না, তাও সকলের জানা।ʼʼ
ইরাজ এড়িয়ে গেল কথাখানা। বুঝানোর মতো করে বলল, “আম্মা! তুমি এত রাগ করছ কেন, জানো? কারন তোমাকে আগে জানানো হয় নি। নয়ত আমার আম্মা এত নিষ্ঠুর না। আর কোন আক্রোশ নেই তোমার মেঘ এর প্রতি।ʼʼ
ইরাজের কথাটা খোশামদের মতো লাগে। নতুন লাগল ইরাজকে। এ ইরাজকে অপরিচিত লাগে কেমন জানি। কারণ ইরাজ মাত্রাতিরিক্ত বেপরোয়া। অথচ আজ কেমন অদ্ভুত লাগছে ওর আচরণ। আনতারা খানম সন্দিগ্ধ দৃষ্টি মেলে তাকালেন ছেলের দিকে। বললেন,
“রাজ! তুই মেঘালয়ার প্রতি দুর্বল! তুই রাখতে চাইছিস ওকে? লজ্জা করছে না তোর?ʼʼ
“অন্তত লজ্জা আমার নেই।ʼʼ
বলেই উঠে দাঁড়াল। আনতারা খানম বলে ওঠেন, “প্রশ্ন এটা ছাড়াও আরও দুটো করেছি।ʼʼ
ইরাজ হেঁটে দরজার দিকে অগ্রসর হতে হতে পেছন না ফিরেই জবাব দিলো, “হুম, শুনেছি।ʼʼ
বলেই দরজা দিয়ে বের হয়ে বাইরে চলে গেল। আনতারা খানম চোখ-মুখ কুঞ্চিত করে, অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে বসে রইলেন সোফায়।
_
মেঘালয়া ঘন্টাখানেক বালিশে মুখ গুঁজে পাগলের মতো কেঁদেছে। চিৎকার করে কেঁদেছে, তবে মুখ চেপে। যা গোঙানির মতো শুনতে লাগে। ঘন্টাখানেক পর উঠে বসল। কিছুক্ষণ উদ্ভ্রান্তের মতো বসে থেকে, ওয়াশরুমে চলে যায়।চোখ-মুখ ফুলে উঠেছে। মুখ লাল, চোখের ভেতরের শিরা-উপশিরা রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে। চোখে-মুখে পানি দিলো। অতঃপর আস্তে করে হেঁটে গিয়ে বেলকনিতে দাঁড়াল। এই ছোট্ট জীবনে কয়েকদিনের বিক্ষিপ্ততা ওকে অনেক অভিজ্ঞ করে তুলেছে। আকাশের দিকে চেয়ে রইল উদাস চোখে।
রাত এগারোটার দিকে ইরাজ বাড়ি ফেরে আবার। ওকে দেখেও আনতারা খানম আর কোন কথা বললেন না। ইরাজও নীরব পায়ে নিজের রুমে এলো। হাতে থলের মতো কিছু একটা। সেটা রাখল সোফার পাশে। মেঘালয়াকে রুমে না দেখে গম্ভীর সুরে ডাকে, “মেঘ! মেঘ! রুমে আয়, দ্রুত!ʼʼ
মেঘালয়ার আসতে ইচ্ছে করে না। কিছুই ভালো লাগছে না। ইরাজ আবার ডেকে ওঠে, এবার স্বরটা আরও ভারী শোনায়। না চাইতেও রুমে এসে দাড়ায় মেঘালয়া।
ইরাজ শার্টের বাটন খুলতে খুলতে বলল, “চোখে কি মৌমাছির চাক বসেছিল নাকি?ʼʼ
মেঘালয়া উত্তর দেয় না। ইরাজ তাকাল ওর দিকে।
“বোবায় ধরেছে নাকি তোকে?ʼʼ ধমকে উঠল ইরাজ।
মেঘালয়া কণ্ঠ বসে গেছে অতিরিক্ত কাঁদার ফলে। ওভাবেই বলল, “বিশেষ কোন কাজ আছে? কেন ডাকছেন?ʼʼ
কঠিন কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল ইরাজ। সোফার পাশে টেবিলে রাখা প্যাকেটের দিকে ইশারা করে বলল, “ওটা খোল।ʼʼ
বলেই তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়, হাত-মুখ ধোঁয়ার উদ্দেশ্যে।
মেঘালয়ার কিছুক্ষণ চুপচাপ দাড়িয়ে, তাকিয়ে রইল প্যাকেটটির দিকে। কৌতুহল জাগে, কি আছে ওটাতে?
সোফায় গিয়ে বসে প্যাকেটটি হাতে নিলো। খুলে ফেলল। অবাক হয়ে বাথরুমের দরজার দিকে তাকায়। প্যাকেটে অনেকটা ফুসকা। যা মেঘালয়ার একার পক্ষে খেয়ে শেষ করা হয়ত সম্ভব না আপাতত। প্যাকেটটি হাতে নিয়ে বাথরুমের বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রইল কেবল অদ্ভুত চোখে!
চলবে।
#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা
৯.
ইরাজ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সোজা হেঁটে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। মেঘালয়া চুপচাপ চেয়ে দেখল কেবল। বেশ অনেকটা সময় কেঁটে যাওয়ার পরও ইরাজ রুমে এলো না। মেঘালয়া ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে, ফুসকার প্যাকেটটি টি-টেবিলের ওপর রেখে সোফার কুশন মাথার তলে রেখে আড়াআড়ি ভাবে— গুটিশুটি মেরে শুয়ে রয়।
প্রায় ঘন্টা-দুয়েক কেঁটে যাওয়ার পর ইরাজ রুমে এলো। একবার আড়চোখে দেখল। অতঃপর বিছানার দিকে অগ্রসর হয়। সেই মুহূর্তেই মেঘালয়া তড়াক করে উঠে বসল। তড়িঘড়ি ডেকে উঠল, “ইরাজ ভাই!ʼʼ
ইরাজ তাৎক্ষনিক ফিরে তাকায় না। একটু রয়েসয়ে বিরক্ত চোখে তাকাল। মেঘালয়া খানিক ইতস্ততঃ করে বলে, “একটু সময় হবে?ʼʼ
ইরাজ কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করল, “কোন মহাকাজে সময় লাগবে তোর?ʼʼ
মেঘালয়ার অনুযোগের স্বর, “আমায় যেকোন কিছুতে আপনার টেমপারেচার হাই হয়ে যায়? একটু ভালো করে কথা বললেও তো পারেন।ʼʼ
ইরাজ ভাবলেশহীন জবাব দিল, “কখনও বলেছি?ʼʼ
“বদলাবেন না আপনি?ʼʼ
“আজীবনেও না।ʼʼ
মেঘালয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আস্তে করে বলল, “বসুন। কিছু পরামর্শ নেওয়ার আছে।ʼʼ
ইরাজ কঠিন কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে গেল। বিরক্তিতে বুদ হয়ে অতিষ্ট ভঙ্গিতে মেঘালয়ার সামনের সোফায় এসে বসল। মেঘালয়া মাথা নত করে হাতের নখ খুঁটছে। ইরাজ কপাল জড়িয়ে দেখতে লাগল। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে মেঘালয়া বলে ওঠে, “কিছু জটিলতায় ভুগছি।ʼʼ
ভ্রু উঁচিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলে ইরাজ, “কাব্যিক হয়ে উঠছিস নাকি?ʼʼ
মেঘালয়া ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়, “কাব্যিক? নাহ.. মানে! আমি নিজের ভেতরে অবস্থা বুঝতে পারছি না। মিশ্র অনুভূতি আর চিন্তারা জ্বালাতন করছে। অনেক কৌতৃহল আর প্রশ্ন জমেছে।ʼʼ
ইরাজ নির্লিপ্ত নজরে নিচের দিকে চেয়ে, সামনের চুলগুলো মুচরে ধরে পেছনে ঠেলে আড়মোড়া ভাঙার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, “বয়স কত তোর?ʼʼ
মেঘালয়া নাক কুঁচকাল। তবে জবাব দিল, “হুম? আঠারো পার হয়েছে। বোধহয় ঊনিশ! না, হ্যাঁ! মানে আব্বু জানে। আসলে আমিও জানি, ঊনিশ।ʼʼ
ইরাজ শীতল দৃষ্টিতে সামান্য সময়ের জন্য মেঘালয়ার অতি চঞ্চল চোখে দৃষটিপাত করল। নজর নামিয়ে বলল, “এ বয়সে এমন অস্থিরতা কাজ করা অস্বাভাবিক নয়। এমন হয়।ʼʼ
“কী হয়?ʼʼ সরল প্রশ্ন মেঘালয়ার।
ইরাজ এবার শান্ত দৃষ্টি ঠিক মেঘালয়ার দৃষ্টিতে ফেলল। তাতেই যেন আরও অশান্ত হয়ে ওঠে মেঘালয়া। শীতল স্বরে বলল ইরাজ, “তোর কী হচ্ছে?ʼʼ
মেঘালয়া মাথা দুদিকে দুলায়, “উহু। আমার সকল জটিল কৌতূহল আপনাকে ঘিরে। সবারই তো বয়স ঊনিশ হয়। তাদের কাছে তো আর আপনি থাকেন না! তো সবার কি হয় তাহলে? মানে— কি নিয়ে এমন অসস্তিতে ভোগে তারা?ʼʼ
ইরাজ সে-সবের জবাব না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কৌতূহল গুলো বল।ʼʼ
মেঘালয়া থমকে যায় এবার। কিছুটা সময় নিলো। অতঃপর ধীর-স্থির কম্পমান কণ্ঠে প্রশ্ন করে, “তাবির, তাবিরের সঙ্গে আপনার যে ঝামেলা হয়েছিল, তা আপনি আমাদের কলেজে যাওয়ার কারনেই হয়েছিল! আপনি কেন যেতেন আমাদের কলেজে?ʼʼ
বলেই ইরাজের দিকে তাকায়। ইরাজ ঠাণ্ডা নজরে তাকিয়ে আছে। মেঘালয়া ব্যস্ত হয়ে ওঠে, বুঝানোর মতো করে বলে ওঠে, “না মানে, আমি জানি, ওটা আপনারও কলেজ। আপনি সেখানকার প্রাক্তন ছাত্র। কিন্ত শুধু কি এ কারনেই যেতেন রোজ আমাদের কলেজে?ʼʼ
ইরাজ কিছুক্ষন চুপচাপ চেয়ে রইল মেঘালয়ার চোখের দিকে। মেঘালয়া চেয়েও দৃষ্টি সরাতে পারে না ইরাজের দৃষ্টি থেকে। আচমকা উঠে দাঁড়াল ইরাজ। অদ্ভুত স্বরে বলল,
“দামী জিনিস চোখে চোখে রাখতে হয়, জানিস তো! ওই কলেজে আমার এক মূল্যবান সম্পদ ছিল। তাতে নজর রাখতে যেতাম। এখন ঘুমা।ʼʼ
মেঘালয়া ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকাল ইরাজের দিকে। কি বুঝল কে জানে! কিঞ্চিত হাসির ফুটে উঠল যেন ঠোঁটের কোনে। ইরাজ হাঁটতে অগ্রসর হলে পেছন থেকে চঞ্চল কণ্ঠে বলল, “আমার প্রশ্ন শেষ হয় নি।ʼʼ
ইরাজের কণ্ঠস্বর যেন গম্ভীর শোনায় এবার, “আমার উত্তর শেষ।ʼʼ
“আচ্ছা, আর প্রশ্ন করছি না। বসুন এবার।ʼʼ
ইরাজ কপাল জড়িয়ে পেছন ফিরে তাকাল।
“তোর সঙ্গে এই প্যানপ্যানানি প্যাঁচাল পারব রাতভর?ʼʼ
“উহু!ʼʼ মনঃক্ষুন্ন হয়ে ধীরে জবাব দেয় মেঘালয়া। মাথাটা নত করে বসে রইল। চমকে উঠল সেকেন্ড কয়েক পর— ইরাজ ধপ করে বসে পড়ে আবার সোফাটির ওপর। তবে মেঘালয়া তাকিয়ে দেখল না। ইরাজ ধমকে ওঠে, “ন্যাকামি চরম অপছন্দের আমার। কেন বসতে বললি?ʼʼ
মেঘালয়া কণ্ঠ কেঁপে ওঠে, “এ বাড়িতে এমনিতেও তো স্থায়ী নই আমি, তাই-না! খুব বেশি সময় জায়গা হবে না এখানে আমার।ʼʼ
আরও কিছু বলবে, তার পূর্বেই ইরাজ রসিকতা করে বলে ওঠে, “এত মোটা হয়ে যাবি তুই? আমার বাপের এত বড়ো বাড়িতে আঁটবে না তোর শরীর?ʼʼ
মেঘালয়া ধাক্কা খেল, এমন এক সময় এরকম একটা কথা শুনে। হাঁ হয়ে গেল মুখটা। ভেতরে নিঃশব্দে প্রশ্ন করে ওঠে, ‘অ্যাঁহ!’
কথাটা বুঝতেই কেন জানি অদ্ভুত ভঙ্গিতে মুচকি হেসে ওঠে। মাথাটা নামিয়ে নিলো হাসিমুখে। ইরাজ কেমন করে যেন চেয়ে রয় মেঘালয়ার বাঁকা চাঁদের ন্যায় হাস্যজ্জল ঠোঁটের দিকে। চোখ সরল না। ঠোঁটের দুকোন বেঁকে আছে মেঘালয়ার। মাথা নিঁচু করে থাকায়, সামান্য দেখতে পাওয়া যায় আকস্মিক হেসে ওঠা ঠোঁট। কোন এক আবেশে চেয়ে রইল ইরাজ। বুকে অদ্ভুত জ্বালা অনুভব করে। কোথাও তিরতির করে উঠছে, নিভু-নিভু আগুন যেন দমকা বাতাস পেয়েছে। আবার খড়ের গাদায় দাউ-দাউ করে জ্বলে উঠতে চাইছে।
মেঘালয়া হাসিমুখেই তাকাল ইরাজের দিকে। ইরাজের এই অদ্ভুত দৃষ্টিপাত সম্পূর্ন নতুন। মেঘালয়ার ভেতর থমকে যায়। হাসিটুকু মিশে যায়, বাঁকানো ঠোঁট জায়গায় ফিরে মিলিত হলো। ইরাজ তাৎক্ষণিক দৃষ্টি সরিয়ে দেয়ালের দিকে তাকাল। চোখ বুঁজে শ্বাস নিলো। অর্ধভেজা এক ঢোক গিলল। তাতে তার গলায় দৃশ্যমান স্বরযন্ত্রের উঁচুস্থানটি নড়ে উঠে ব্যাপক আন্দোলনে। নজর এড়ায় না মেঘালয়ার বিষয়টি। খোঁচা খোঁচা দাড়ি গলা অবধি নেমেছে হালকা করে। তার ওপর সেই পুরুষের বিশেষত্ব— উঁচু হয়ে থাকা দৃশ্যমান স্বরযন্ত্রের কম্পন দৃশ্যে মেঘালয়া কি বিমোহিত হলো!
মেঘালয়া দৃষ্টি সরে আসে ইরাজের কঠিন স্বরের বলা নিষেধাজ্ঞায়, “হাসবি না তুই, মেঘ!ʼʼ
মেঘালয়া কি বুঝল কে জানে! আবার লাজুক হেসে ওঠে। ইরাজ এবার কোনভাবেই তাকাল না। মাঝে কিছুক্ষণ নিরবতায় কেঁটে যায়। দুজনের দৃষ্টি নিবদ্ধ মেঝেতে। নিরবতা ভঙ্গ করে মেঘালয়া।
“আপনি জটিল।ʼʼ
“কতটা?ʼʼ
“না পড়া বইয়ের মতো।ʼʼ
“তাতে কী?ʼʼ
“পড়ে দেখতে ইচ্ছুক আমি। শুরু করেছি পড়তে।ʼʼ
সামান্য চমকেই যেন তাকাল ইরাজ। হাসল সামান্য। মেঘালয়া আবার থেমে যায়। দ্রুত চোখ নামিয়ে নেয়। সাহস হয় না ওই পোড়া ঠোঁটের রহস্য হাসিতে দৃষ্টি ধরে রাখার। ইরাজ হাসিটা গিলে নিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে, মেঘালয়াকে যেন তুচ্ছজ্ঞান করে বসল। ভাব নিয়ে বলল,
“জটিল কেন আমি?ʼʼ
মেঘালয়া সে প্রশ্নের উত্তর দেয় না। বরঞ্চ নিজে প্রশ্ন করল,
“তখন ফুসকা খেতে চেয়েছিলাম, যে খিস্তি ঝাড়লেন— পরে আবার তা কিনে এনেছেন কেন?ʼʼ
ইরাজ চুপচাপ নিচের দিকে চেয়ে রয়। খানিক সময় পর মুখ তুলে, দুষ্টু হাসল। সেই বদ-হাসি ঠোঁটে রেখেই জবাব দেয়,
“মানুষের হউত-মউতের কথা বলা যায় না। অত করে চাইলি, না খেয়ে যদি এর মাঝেইʼ— বলেই হাতের তর্জনী আঙুল দিয়ে ওপরের ইশারা করে বলল, “টপকে যাস, তারপর পেত্নী হয়ে ভয় দেখাবি, আল্লাহর কাছে দায়ী থাকব এমনকি সবচেয়ে বড়ো ভয়, যদি দ্বিতীয় বউ নিয়ে সুখে সংসার করতে না দিস? ভয়ে এনেছি।ʼʼ বলেই মাথা দুলায়।
মেঘালয়া চোয়াল শক্ত করে চেয়ে রইল। ইরাজ মেঘালয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে এবার শব্দ করে হেসে উঠল। তা দেখে কি হলো কে জানে— মেঘালয়া নিজেও ফিক করে হেসে ওঠে।
অতঃপর বলল, “যতবার ফুসকা খেয়েছি— আব্বু আর নয়ত বান্ধবীরা সাথে থেকেছে। এ রুমে তো আর তাদের কেউ উপস্থিত নেই।ʼʼ
ইরাজ কথা কেড়ে নেয়, “তুই যদি মনে করে থাকিস, তাদের জায়গায় প্রতিস্থাপন বিক্রিয়ার মাধ্যমে আমায় বসাবি, তাহলে খুব শীঘ্রই তোর কানটা গরম হতে যাচ্ছে।ʼʼ
মেঘালয়া ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, “একবার টেস্ট করে তো দেখুন। যত্ন করে নিজ হাতে বানিয়ে দেব।ʼʼ
ইরাজ তড়িঘড়ি উঠে দাড়ায়, “চটাং করে মারব এক চড়! তুই খা বেশি করে, আমার পোষাবে না ওসব আজুবাজু জিনিস।ʼʼ
মেঘালয়া ঠোঁট গোল করে শ্বাস ফেলল। নির্বিকার চিত্তে ভাবলেশহীন জবাব দিল, “আমারও।ʼʼ
ইরাজ ঘুরে তাকাল। বসল সোফায় আরাম করে। মেঘালয়া খুশি হয়। দ্রুত প্যাকেট ছিঁড়ে ফুসকা বের করতে উদ্যেত হয়। ইরাজ আস্তে করে প্যাকেটটি মেঘালয়ার হাত থেকে নিলো। দারুন খোশ-মেজাজে বলল, “তুই তো আর আমায় ছাড়া খাবি না। এতে ডাস্টবিনের হক আছে, বুঝলাম। দে।ʼʼ
বলেই প্যাকেট নিয়ে হাঁটা ধরে। মেঘালয়া কয়েক সেকেন্ড অবুঝের মতো বসে থেকে, যখন বুঝল ব্যাপারটা— ইরাজের পেছনে দৌড় লাগায়, “দিন, বলছি। খেতে হবে না আপনার। ইরাজ ভাই, আমার ফুসকা।ʼʼ
বলতে বলতেই রুম ছেড়ে বেরিয়ে সিঁড়ির প্রায় অর্ধেক পেরিয়ে এলো দুজনে। পেছন থেকে মেঘালয়া তাড়া করতে করতে ডেকে ওঠে, “ইরাজ ভাই! আমার ফুসকা!ʼʼ
ইরাজও ওই একই সুরে বলল, “হ বইন, তোর ফুসকা। তা খুব শীঘ্রই ডাসটবিনে যাবে।ʼʼ
নিঁচে নেমে আসে দুজনে ধরাধরি করতে করতে। এক পর্যায়ে, ইরাজ নির্লিপ্ত আর মেঘালয়া থমকে দাঁড়িয়ে যায়। সম্মুখে থমথমে মুখে দাড়িয়ে আছেন আনতারা খানম। ইরাজ ফুসকার প্যাকেটটি মেঘালয়ার হাতে ধরিয়ে দেয় আস্তে করে। ভাবলেশহীন হেলেদুলে হেঁটে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসল। মেঘালয়া মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল কেবল।
রাত প্রায় দু’টোর কাছাকাছি!
চলবে..