“আব্বু, আমি বিয়ে করতে চাইনা আপাতত। পড়ালেখা শেষ করতে চাই।ʼʼ
মেয়ের ভেজা চোখে, আকুতি করে বলা কথায় মনে হলো না, সামান্যও টলেছে হেলাল আকবর সাহেবের হৃদয়। তাচ্ছিল্য করে বলে উঠলেন তিনি, “এজন্যই তো প্রেমিক নিয়ে চট্রগ্রাম পাড়ি দিয়েছিলে? তার সঙ্গে পড়ালেখা শেষ করতেই তো বাবাকে ধোঁকা দিয়ে পালিয়েছিলে। তাই-না?ʼʼ
মেঘালয়া মুখ চেপে ডুকরে কেঁদে উঠল বাবার কথায়। কলিজা ছিদ্র করে ঢুকেছে আব্বুর বলা কথাখানি। তবুও আবার নতজানু হয়ে অনুরোধ জানায়, “আব্বু, ভুল করে ফেলেছি। ক্ষমা করে দাও। তবুও আমায় আমার ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগটুকু দাও।ʼʼ
হেলাল সাহেব হুংকার ছেড়ে বললেন, “উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা তো দিয়েছ। কী করে দিয়েছ বলতো! পড়ালেখার সময়ে তো প্রেম করেছ। তাহলে পরীক্ষার খাতায় কি লিখে এসেছ? আবার সেই ফলাফলের আশায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নও দেখছ?ʼʼ
আব্বুর এত এত তিরস্কারের ভিড়েও কেবল বুক চিড়ে ঠোঁটে ভেঙে মলিন হাসিই ফুটে উঠল মেঘালয়ার মুখে। মাথাটা নত করে নিলো। হেলাল সাহেব নিজেই আবার জানানোর উদ্দেশ্যে বললেন, “আগামী শুক্রবার তোমার বিয়ে হবে। এবং তা রাজের সঙ্গেই। আর তোমার মতো বাপের সম্মান নিয়ে খেলা করা মেয়ের, মত-অমতের পরোয়া আমি করব না। তৈরী থাকবে।ʼʼ
এবার যেন মেঘালয়া ছটফটিয়ে উঠল। তড়াক করে মাথা তুলে উঠে দাঁড়াল। ব্যস্ত কণ্ঠে বলে উঠল, “কার সঙ্গে বিয়ের কথা বললে আব্বু? ইরাজ ভাই?ʼʼ
হেলাল সাহেব গম্ভীর স্বরে সংক্ষিপ্ত জবাব দিলেন, “হু।ʼʼ
মেঘালয়া তাচ্ছিল্য হেসে ওঠে। ব্যাপক অস্থিরতা ঘিরে ধরেছে ওকে। ব্যাকুল কণ্ঠে বলে উঠল, “আব্বু তুমি আমাকে শূলে চড়িয়ে খন্ড-বিখন্ড করে ফেলো। তবুও এত বড়ো শাস্তি দিও না। আমি মৃত্যুকে তো সাদরে গ্রহন করব, তবুও ইরাজের মতো বদমেজাজি, রগচটা, ক্ষ্যাপাটে অমানুষকে বিয়ে করে নিজেকে প্রতি মুহূর্তে এক-বার করে মেরে ফেলতে পারব না।ʼʼ
এবার হেলাল সাহেব নিজের ওপরই ভৎসনা করে উঠলেন,
“বুঝলে মেঘ! আমি আসলেই তোমার মতো নির্বোধ, মূর্খ আর অকৃতজ্ঞ মেয়েকে নিয়ে এতদিন অযথা গর্ব করে এসেছি। রাজ তোমার মতো, প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়া সম্মান ডোবানো মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হবে কিনা, সে চিন্তা করছি আমি। আর তুমি কিনা আজও ভ্রান্তিতে পড়ে আছো? স্বয়ং রাজই উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে তোমায় চট্রগ্রাম থেকে। পড়ালেখা শেষ করে বাপের ব্যবসা সামাল দিচ্ছে। নিজের কোম্পানি গড়ে তুলতে সচেষ্ট সে। দেখতে, শুনতে কি নেই তার? তো অহংকারবোধ তার থাকবে না? তোমার মতো মূর্খ মেয়ের থাকবে?ʼʼ
কত আদরের মেয়ে মেঘালয়া, আজ বাবার মুখে এমন সব কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে কেবল শুনছে বাবার কথাগুলো। কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলে উঠল, “আব্বু, ইরাজ ভাই আর আমার বয়সের তফাৎ প্রায় নয়-দশ বছরের। তাছাড়া সে আমাকে অতিরিক্ত অপছন্দ করে। তার বদমেজাজ আর বাজে স্বভাবের ব্যপারে সবটা জেনেও তুমি আমাকে তার হাতে সারাজীবনের জন্য তুলে দিতে এত আগ্রহী?ʼʼ
হেলাল সাহেব মেয়ের দিকে পূর্ণদৃষ্টি মেলে তাকালেন এবার। মেঘালয়া দ্রুত চোখ নামিয়ে নেয়। আজ আব্বুর চোখে চোখ রাখার সাহসটুকু সে জঘন্য ভাবে হারিয়ে ফেলেছে। হেলাল সাহেব আক্রোশের সঙ্গে বললেন,
“যে মেয়েকে সর্বোচ্চ আদর-যত্নে বড়ো করে তুলেছি, কত কত বড়ো কথা বলেছি মেয়েকে নিয়ে সমাজে, তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি। সে যদি আমার মান-সম্মানকে পা দিয়ে পিষে নিজের ইচ্ছেমতো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বসতে পারে— আমিই বা এত ভালো কবে ছিলাম, যে এবার আর তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার পরোয়া করব! আর নিশ্চিন্ত থেকো, বাবা আমি তোমার। তোমার মতো ছোটোলোকি কাজ করব না। রাজের নেই কি! সুখে থাকবে। সে আমারই বিজনেস পার্টনারের ছেলে। আর আমি, তোমার মতো, বাবার ভালোবাসার প্রতিদান, মন ভেঙে দেব না।ʼʼ
শেষের কথাগুলোতে ক্ষোভ আর মনের কষ্ট ঝরে পড়ল যেন হেলাল সাহেবের কথায়। কথাগুলো বলেই তিনি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে, মেঘালয়ার রুম থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন।
মেঘালয়া কেঁদে ওঠে এবার শব্দ করে। আব্বুকে সে কষ্ট দিয়েছে, সমাজে আব্বুর সম্মান নষ্ট করেছে— সব মানছে সে। তার বদলে আব্বু ওকে এত জঘন্যতম শাস্তি দেবে, এটা আশাতীত ছিল ওর কাছে। মেঝেতে পড়ে বুক ফাঁটা আত্মচিৎকারে ফেটে পড়ল মেঘালয়া। ইরাজ তার জীবনে অভিশাপ হয়ে আসতে চলেছে। সে প্রয়োজন পড়লে আবার নাহয় একবার পালিয়ে যাবে, তবুও ইরাজকে বিয়ে করার মতো বিদঘুটে কাজ করবে না।
—
ইরাজ বাড়িতে প্রবেশ করে সোজা সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হয়। সেখানে সোফাতে বসে কফিতে চুমুক দিচ্ছিলেন, ইমতিয়াজ খান। ছেলেকে প্রবেশ করতে দেখেই, কথা বলতে উদ্যত হলেন। ইরাজ ঢুকেই সোজা সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়েছে। মনঃক্ষুন্ন হয়ে পেছন থেকে ডাক দিলেন,
“মেঘাকে পাওয়া গিয়েছে, রাজ?ʼʼ
পা থামিয়ে দাঁড়াল ইরাজ, তবে ঘাঁড় না ঘুরিয়েই জবাব দিলো, “ড্যাড, আ’ম সো টায়ার্ড, ডোন্ট আস্ক এনি কোয়েশ্চেন ফর নাও।ʼʼ
ইমতিয়াজ সাহেব বুঝলেন, ছেলের মন-মেজাজ ভালো নেই, তবুও জানা দরকার মেয়েটার কি খবর এখন। তাই আবারও স্বরটা আরও আদুরে করে জিজ্ঞেস করলেন,
“টেনশন হচ্ছে বাপ, সংক্ষেপেই বল নাহয়।ʼʼ
ইরাজ নেমে এলো সিঁড়ি থেকে। ডাইনিং টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে, ওয়াটার পট থেকে হাফ-গ্লাস পানি ঢালল। অতঃপর রেফ্রিজারেটর থেকে কয়েকটি আইস কিউব এনে পানিতে মিশিয়ে নিলো। গ্লাসটি নিয়ে এসে সোফাতে বাবার পাশে গা এলিয়ে বসে পড়ল। ওভাবেই কিছুক্ষণ চোখ বুঁজে বসে রইল। ইমতিয়াজ সাহেব ইরাজের গায়ের শার্টের উপরের বোতামগুলো আলগা করে দিলেন। মাথায় দুয়েকবার একটু আদুরে হাতও বুলিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণ ছেলের ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আলতো হাসলেন। এই বেপরোয়া বাঁদরটা একমাত্র তার কাছে আজও আহ্লাদের।
আরও কিছুক্ষণ ওভাবেই নিরব থেকে জিজ্ঞেস করল ইরাজ, “আম্মু ফেরেনি এখনও?ʼʼ
“চলে আসবে। কিছু লাগবে তোর? খাবি না?ʼʼ
মৃদূ মাথা নেড়ে ‘না’ বোঝাল ইরাজ। এতক্ষণে শান্ত স্বরে ইমতিয়াজ সাহেব প্রশ্ন করলেন, “হাত কেটেছে কি-করে? কোথাও মারপিট করে এসেছিস?ʼʼ
বাবার এমন শীতল কণ্ঠস্বরে, চোখ খুলে তাকাল ইরাজ বাবার দিকে, মুহূর্তে চোখ-মুখ শক্ত হয়ে উঠল। ইমতিয়াজ সাহেব কেবল চেয়ে রইলেন ছেলের দিকে।
বরফ মেশানো পানিটুকু ঢক-ঢক করে গিলে নিয়ে, গ্লাসটা শব্দ করে টেবিলের ওপর রাখল ইরাজ। অতঃপর দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠল, “কি জানো তুমি, ড্যাড? তোমার আদরের বন্ধুকন্যা বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছিল চট্রগ্রাম, আর তাকে উদ্ধার করে আনতে গিয়েছিলাম?ʼʼ
ইমতিয়াজ সাহেব নিরব শ্রোতার মতো চেয়ে আছেন ইরাজের ক্ষুব্ধ মুখপানে। ইরাজ আচমকা শান্ত হয়ে গেল। দুষ্টু হাসি ছেয়ে গেল চোখে-মুখে। সেই হাসি যেন ভেতরের কিছু লুকোতেই ঠোঁটে হানা দিয়েছে! বদমাশি একটা হাসি দিয়ে বলে উঠল, “মেঘা বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে পালিয়েছিল, ড্যাড। এবার আবার অবিশ্বাস কোরো না যেন! এটা আধুনিক যুগ, ড্যাড। মুখ দেখে নয়, কাজ দেখে দৃঢ় বিশ্বাস করতে হয়— কে কী করতে পারে!ʼʼ
বলেই ব্লেজারটা কাঁধে চড়িয়ে, হেলে-দুলে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল।
পেছনে ইমতিয়াজ সাহেব, বিষ্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে প্রাণহীনের মতো পড়ে রইলেন। আসলেই, মেঘালয়া কে নিয়ে এমন ভাবনা কেউ ভাবলেও তাকে মারতে উদ্যত হতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না তিনি। অথচ তিনি জানেন, ইরাজ যাই হোক, মিথ্যা কথা বলে না।
তার ধ্যান ভাঙল হলরুমে কারো পদার্পনের আওয়াজে। সেদিকে না দেখেও তিনি বুঝলেন, তার মিসেস এর আগমন ঘটল। আনতারা খানম এসে তিনিও স্বামীর পাশে বসে পড়লেন। তার বোনের মেয়ে অদ্বিতার পাত্র বাছাই পর্ব চলছে। সেখানেই গিয়েছিলেন গতকাল। অবশ্য তার বোনের সুপ্ত ইচ্ছে ছিল অদ্বিতাকে ইরাজের ঘাঁড়ে ঝোলানোর। তবে ইরাজ; সে তো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। সাহস হয়নি কারোই, ওর কাছে এমন প্রস্তাব করে যা-তা খিস্তি শোনার।
আনতারা খানম বসেই সর্বপ্রথম মেঘালয়ার খোঁজ লাগালেন, “পেয়েছে নাকি মেঘাকে? ওমন আদুরে মেয়েকে ওতদূর বন্ধুদের সঙ্গে পাঠাবারই কি দরকার হেলাল ভাইজানের। নাজুক মেয়ে, পথঘাট হারানোরই কথা। রাজ ফিরেছে?ʼʼ
ইমতিয়াজ সাহেব দ্বিধায় পড়ে গেলেন। যে মেয়ে পরিচিতদের কাছে লক্ষী হিসেবে নামকরা। সে মেয়ের ব্যাপারে এমন একটা কথা স্ত্রীর কাছে ব্যাক্ত করতে একটু বাঁধল যেন জিহ্বায়। কথাটা কাটিয়ে, বরং স্ত্রী যা জানে, সে-ভাবেই জানিয়ে দিলেন,
“না পাওয়ার কি আছে? তোমার ছেলে গিয়েছিল কিনা খুঁজতে! ওকে বাড়িতে দিয়ে সবে বাড়ি ফিরল রাজ।ʼʼ
আনতারা খানম স্বস্তি পেলেন যেন, “আলহামদুলিল্লাহ, বাড়ির মেয়ে বাড়ি ফিরেছে। চলো তোমাদের খাবার দেই। রাজকে ডাকো তো। সারাদিনে না জানি কত ধকল পেরিয়ে এসেছে।ʼʼ
ইমতিয়াজ সাহেব সন্তর্পণে এড়িয়ে গেলেন ব্যাপারটি। মহিলাদের কাছে স্পর্শকাতর ব্যাপারগুলো এড়িয়ে যাওয়াকে উত্তম মনে করেন তিনি। আর যেখানে মেয়ের সম্মান জড়িয়ে আছে, সেখানে না জানি আনতারা বেগম কত বিরূপ মন্তব্যে ভরে ফেলবেন মেয়েটির চরিত্রকে। আনতারা খানম নিজেই উঠে গেলেন ইরাজকে ডাকতে। তখনই ফোন বেজে উঠল হলরুম কাঁপিয়ে।
ইমতিয়াজ সাহেব স্ক্রিনে দেখলেন, হেলাল আকবর শাহ এর নম্বর। কেমন অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো। আল্লাহ তায়ালা জানেন, কি ব্যপারে কল করেছে, হেলাল! এ আশঙ্কা বুকে চেপে ফোন কানে তুলে নিলেন।
চলবে..
#সূচনা_পর্ব
#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মুর্তজা