#অভিমান
পর্বঃ২৩
………………..
.
.
একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছি নিলয়ের মুখোমুখি,জায়গাটা অনেক নির্জন,লোকজন ও তেমনটা নেই, ও আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যেটা মোটেও স্বস্তি দিচ্ছে না আমাকে ,ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে ও আমাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে এলে কেন,কিছুই বুঝতে পারলাম না,হয়তো এটা ওর পছন্দের জায়গা,
আমি অপ্রস্তুত ভাবে চারিপাশে তাকাচ্ছি ভীষন আনইজি লাগছে,
উনার সাথে ও তো কতবার বাইরে ঘুরতে এসেছি কখনও এতো অস্বস্তি লাগে নি,
নাহ এভাবে আর বসে থাকা যায় না আমি ওর দিকে তাকিয়ে জোর করে একটা হাসি দিয়ে বলে উঠলাম,
-এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন কিছু বলবি ?
তখনই ও ঘোর লাগা কন্ঠে বলে উঠলো,
-শাড়ীতে তোকে দারুন লাগে ,সব কিছুতেই তোকে হেব্বি সুন্দর লাগে বাট শাড়ী মারাত্মক লাগে ,ভীষন এট্রাকটিভ তাকালেই কেমন নেশা লেগে যায় উফ!!বলেই ও চোঁখ বন্ধ করে একটা শ্বাস নিল,
ওর কথা বলার ধরন দেখে আমি অবাক হলাম,ও এভাবে কথা বলছে কেন,অনেক দিন থেকে আমি ওকে চিনি কোনো দিন আমার সাথে এভাবে কথা বলেনি,
ওর রিকোয়েস্টেই শাড়ী পরে বের হতে বাধ্য হয়েছি,
যখন রেডি হতে যাচ্ছিলাম তখন ও গিয়ে আমার পথ আগলে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করে ,
-প্লিজ সুহা শাড়ী পরিস ,আমি জানি তুই বাইরে বের হলে শাড়ী পরিস না ব্রোয়ের নিষেধ আছে কিন্তু ও তো জানতে পারবে না তার আগেই আমরা চলে আসবো ,
ওর কথা শুনে আমি সাফ মানা করে দিলাম শাড়ী পরতে পরবো না কিন্তু তখন ও ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল শুরু করলো,
ও বলতে লাগল,
-ফ্রেন্ডের এই সামন্য রিকোয়েস্ট টুকু রাখতে পারবি না ,এত দিনের বন্ধুত্ব তোর সাথে কখনও কিছুর জন্য রিকোয়েস্ট করেছি,
ঠিক আছে তুই যদি না পরিস তাহলে তো আমার কিছু করার নেই আমি তো আর তোর উপর জোর করতে পারবো না সেই অধিকার তো আমার নেই বলেই মন খারাপ করে আমার সামন থেকে চলে গেল,
ওর কথা শুনে আর ওকে এভাবে দেখে আমার ভীষন খারাপ লাগল তাই শেষে শাড়ী পরেই বের হলাম ওর সাথে।
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভুল করেছি ,ওর করা প্রশংসা শুনে মোটেও ভালো লাগলো না আমার,বরং আমার অস্বস্তি আরো বেড়ে গেল,
আমি বিব্রত ভাবে বলে উঠলাম,
-এসব কি ধরনের কথা নিলয়,তুই এভাবে কথা বলছিস কেন আমার সাথে,
আমার কথা শুনে নিলয় বিশ্রী ভাবে একটা হাসি দিয়ে বলে উঠল,
-আরে ইয়ার প্রশংসাই তো করছি খুশি হস নি ,
-আমার এখানে একদম ভালো লাগছে না আমি এক্ষুনি বাসায় যেতে চাই ,তোর বাসায় যেতে ইচ্ছা না হলে তুই বসে থাক,
আমার কথা শুনে নিলয় সাথে সাথে টেবিলের উপরে থাকা আমার দুহাত চেপে ধরল,
ওর এমন কান্ডে আমি হতবাক হয়ে গেলাম,বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে
হাত ছাড়তে চাইলাম কিন্তু ও আরো চেপে ধরে ধরে বলে উঠল,
-তোর সাথে আমার কথা আছে,আমার কথা না শুনে তুই কোথাও যেতে পারবি না,অনেক আগেই কথা গুলো বলা উচিত ছিল ,আমার ভুলের জন্য আজ আমাকে এই দিন দেখতে হচ্ছে,আমি আর পারছি না এসব কিছু মেনে নিতে,
আমি ওর দিকে ব্রু কুচকে তাকিয়ে বলে উঠলাম ,- কি কথা বল!!ওয়েট ওয়ান সেকেন্ড আগে আমার হাতটা তো ছাড়,এভাবে হাত ধরে রয়েছিস কেন??
সাথে সাথে ও আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলে উঠল,
-আই লাভ ইউ সুহা।আমি তোকে সেই কলেজ লাইফ থেকে ভালবাসি,
ওর বলা কথাটা শুনে আমি কয়েক সেকেন্ড স্তব্দ হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বসে রইলাম,কয়েক মুহূর্ত শব্দহীন ভাবে কাটলো ,
তারপর এক ঝটকায় ওর হাত থেকে আমার হাত সরিয়ে নিয়ে অবাক গলায় বলে উঠলাম,
-হোওয়াট!!!!এসব কি আবেল তাবোল কথা বলছিস তুই নিলয়,আমার চোঁখ ভরা প্রশ্ন আর কৌতুহল,
-আমি যা বলছি সব সত্যি এগুলো আবোল তাবোল কথা নয় সুহা ,তোকে যে দিন আমি প্রথম দেখেছিলাম সেই প্রথম দেখায় আমি তোকে ভালবেসে ফেলি,যাকে বলে লাভ এট ফার্স্ট সাইট ,এক মুহূর্তের জন্য তোকে মন থেকে সরাতে পারছিলাম না ,তারপর তোকে ফলো করা শুরু করি তোর সম্পর্কে খুঁজ খবর নিতে থাকি,তোর কোনো বয় ফ্রেন্ড আছে কিনা সেই সব,কিন্তু তোর সম্পর্কে সবার কাছ থেকে যা শুনলাম তাতে আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম,জানলাম তোকে কলেজের অনেক ছেলে প্রপোজ করেছে আর তুই নাকি সবাইকেই রিজেক্ট করে দিয়েছিস এবং সেই সাথে যারা যারা প্রপোজ করেছিল সবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিস,জীবনের প্রথম কাউকে ভালবাসলাম আর থাকে কিনা এভাবেই হারিয়ে ফেলবো,এটা আমি কিছুতেই মানতে পারলাম না তাই ভালবাসাটা মনে চাপা দিয়ে তোর বন্ধু হতে উঠে পরে লেগে গেলাম বন্ধু হলে এট লিস্ট তোর পাশে থাকতে পারবো এই আশায় ,এবং অনেক চেষ্টার পর আমি সফল হলাম অবশেষে তুই আমাকে বন্ধু হিসেবে মেনে নিলি
আমি অবাক হয়ে নির্বাক স্রোতার মতো নিলয়ে কথা গুলো শুনতে লাগলাম,
ও থেমে আবার বলতে শুরু করলো,
-তুই কখনও প্রেম করবি না প্রেম ভালবাসা থেকে তুই অনেক দূরে তাই তোকে হারানোর ভয় ও রইলো না তাই ভাবলাম বিদেশ থেকে লেখা পড়া শেষ করে দেশে ফিরে তোর বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো এরজন্য আমার দুই বন্ধুকে তোর উপর খেয়াল রাখার দায়িত্ব দিয়ে আমি ইংল্যান্ড চলে যাই,কিন্তু যখন
নিলয়ের বলা কথার মাঝে আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলাম,
-এসব কি বলছিস তুই নিলয়,আমি কখনও তোকে বন্ধু ছাড়া এর বেশি কিছু ভাবি নি,তোর জন্য আমার মনে অন্য কোনো ফিলিংস কখনই ছিল না ,আমি এটা ও ভেবেছি তুই ও শুধু আমাকে একজন ভাল বন্ধুই ভাবিস,কিন্তু এত বছর পর তুই এসব কি বলছিস,
-আমি সত্যি বলছি সুহা তোকে আমি কখনই বন্ধু ভাবিনি তোর জন্য আমার মনে অন্য ফিলিংস ছিল এবং সেটা প্রথম দিন থেকে,
-কিন্তু আমি তো এটাই বুঝতে পারছি না এসব কথা তুই এখন কেন বলছিস আমাকে ,
-আমি জানি তুই বিবাহিত কিন্তু এই বিয়ের কোনো মূল্য তো তোর কাছে নেই আমি সব জানি সুহা ওই কাব্য তোকে জোর করে বিয়ে করছে,এই বিয়েতে তোর কোনো মত ছিল না,
আমি ওর কথা শুনে আরো একবার অবাক হলাম ,আমি চোঁখ মুখ শক্ত করে বলে উঠলাম,
-কে বলছে তোকে এই বিয়ের কোনো মূল্য নেই আমার কাছে,আর আমার বিয়ের কথা তুই জানলি কি করে,
-সেদিন তোর মায়ের সাথে বলা সব কথা আমি শুনেছি,তুই কাব্যকে ভালবাসিস না ও তোকে এই বিয়েটা করতে বাধ্য করেছে ,আমি জানতাম তুই কখনও কাব্যের মতো বদ রাগী বদ মেজাজি যার হাজারো মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল থাকে কখনই ভালবাসতে পারিস না ,ওর মতো একজনের সাথে তুই কখনই সুখে হবি না ,প্লিজ সুহা তুই আমার সাথে চল।
আমি ওর কথা শুনে বিস্ময় নিয়ে বলে উঠলাম ,
-মানে,কি বলতে চাইছিস তুই,
-মানে খুব সহজ সুহা,কাব্য কখনই তোকে ভালো রাখতে পারবে না,যে তোর সব স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে তোকে নিজের মত চালাতে চায় ,একটু ভুল করলে যে তোকে কঠিন কঠিন শাস্তি দেয়,তার সাথে তুই কিভাবে থাকবি,ও তোকে ভালবাসে না ও শুধু নিজের জেদের বসে তোকে বিয়ে করেছে ,নিজের জেদ ফুফিয়ে গেলে ও তোকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করে নিবে,ও এরকমই ও কাউকে ভালবাসতেই জানে না শুধু অধিকার ফলাতে জানে ,ও অনেক মেয়ের জীবন নষ্ট করছ,ওর ওই সুন্দর চেহারার আড়ালে এক পৈচাশিক শয়তান লুকিয়ে আছে ,আমি আমার ভালবাসকে কখনই এভাবে অন্য কারো হাতের পুতুল হয়ে তাকতে দিব না,আমি তোকে আমার জীবনের থেকেও বেশী ভালবাসি সুহা,আমি তোকে কাব্যের থেকে অনেক অনেক বেশি ভালো রাখবো,তুই ওকে ছেড়ে আমার সাথে চল আমি তোকে ওর থেকে অনেক দূরে নিয়ে চলে যাবো,ও কখনই আমাদের খুঁজে পাবেনা,আমি তোকে বিয়ে করতে চাই সুহা,কাব্যের সাথে আমি তোকে আর মেনে নিতে পারছিনা,প্লিজ তুই আমাকে ফিরিয়ে দিস না,
নিলয়ে কথা শুনে আমি আশ্চার্য্য হয়ে গেলাম এসব কি পাগলের প্রলাব বকছে ও ,
উনার সম্পর্কে বাজে কথা বলায় আর আমাকে এরকম একটা কুপ্রস্তাব দেওয়ায় আমার ভীষন রাগ হলো আমার সামনে বসে আমার স্বামীকে আজে বাজে কথা বলছে,ওর সাহস কি করে হয় এসব বলার ,আমি রাগে অন্ধ হয়ে বলে উঠলাম,
-তুই ভাবলি কি করে এরকম একটা প্রস্তাবে আমি রাজি হবো,আমি তোর মতো এত নিচু মন মানসিকতার নই,কে বলেছে তোকে এ বিয়ের কোনো মূল্য আমার কাছে নেই আমার জীবনের সব থেকে বড় আর গুরুত্বপূর্ন সত্যি হচ্ছে আমার বিয়ে ,এটির মূল্য আমার কাছে অন্য যে কিছুর থেকে বেশী,তোর একটুও লজ্জা করছে না নিজের ভাইয়ের সম্পর্কে এত বাজে কথা বলতে,আমি তো শুধু তোর বন্ধু না তোর বড় ভাইয়ের স্ত্রী ,নিজের ভাইয়ের স্ত্রীকে এ কথা বলতে তোর বিবেকে বাঁধলো না,ছি: নিলয় !
আর উনার কথা কি বললি জেদের বসে আমাকে বিয়ে করেছেন ,আমি ও প্রথমে সেটাই ভেবেছিলাম,কিন্তু উনার সাথে থেকে আমি বুঝতে পেরেছি উনি জেদের বসে নয় ভালবাসার বসে আমাকে বিয়ে করেছে,
আর উনি আমার সাথে যাই করেন না কেন সব কিছুই উনার এই ভালবাসার বহিপ্রকাশ ,আর কি বললি উনার জেদ শেষ হয়ে গেলে আমাকে ছেড়ে দিবেন আরে আমার জন্য আমি বললে উনি দুনিয়া ছেড়ে দিতে পারেন কিন্তু আমাকে কখনই ছাড়বেন না ,
উনার যতই রাগ তাকোক না কেন উনি কিন্তু তোর মতো নিচু মানসিকতার নয় ,উনি রাগী হন বা বদ মেজেজী যাই হোন কেন আমার শুধু উনাকেই চাই,উনার সম্পর্কে আর কখন বাজে কথা বললে তোকে আমি ছেড়ে দিবো না
আমি ভুলে যাবো তুই আমার বন্ধু,আর ফারদার আমাকে এ ধরনের কু প্রস্তাব দিলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না বলেই সুহা নিলয়ে আর একটা কথা বলার ও সুযোগ না দিয়ে রেগেমেগে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে রিক্সায় উঠে পরলো বাসার উদ্দেশ্যে রাগে ওর সমস্ত শরীর কাঁপছে,
অন্যদিকে সুহা বেরিয়ে যাওয়ার পরেই নিলয় আয়েশি ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে একটা শয়তানি হাসি দিয়ে বলে উঠল,
-আমার কথা না মেনে অনেক বড় ভুল করলি সুহা,তোকে তো আমি নিজের করেই ছাড়বো!!
.
সুহা বাসায় এসে হাফ ছেড়ে বাঁচলো কাব্য বাসায় আসার আগেই ও চলে এসেছে ,কাব্য যদি জানতে পারে তাহলে কি অঘটনটাই না ঘটবে ,ও বারবার নিষেধ করেছে নিলয়ের সাথে কথা না বলতে,সুহা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নিল আর কখনও কাব্যের কথার অবাধ্য হবে না,ও শূন্য মস্তিস্ক নিয়ে নিজের রুমের দিকে হাঁটা দিল ওর মাথা এখন ও ভন ভন করছে নিলয়ের বলা কথাগুলো ভেবে ,মানুষের চিন্তা ভাবনা এত নোংরা হতে পারে কি ভাবে সেটাই ভেবে পাচ্ছেনা ও,সেদিনের কাব্যের বলা কথা গুলো মনে পরছে বার বার ,ও
ঠিকিই বলেছিল,নিলয় ওকে বন্ধু ভাবে না বাজে নজরে ওকে দেখে ,এ কথা ভেবেও ওর আফসোস হলো শুধু শুধু ওর জন্য কাব্যের সাথে সেদিন জগড়া করল,
রুমের দরজা খুলে অবাক হয়ে গেল ও সমস্ত রুম ঘুটঘুটে অন্ধকার ও হাতড়ে হাতড়ে লাইট অন করল,
লাইট অন করেই ও সোফার দিকে তাকিয়ে আতংকে উঠলো ,গম্ভীর মুখ নিয়ে মাথা নিচু করে সোফায় কাব্য বসে রয়েছে,
ওকে দেখেই সুহার মন আর্তনাদ করে বলে উঠল,
‘হায় আল্লাহ আজ কি শুধু বাজে কিছুই ঘটবে আমার সাথে,উনি কখন বাসায় এলেন এখন উনাকে কি বলবো নিলয়ের কথা সব কি উনাকে বলে দিবো,
নিজের মনে ও ভেবেই চলছে ভয়ে ওর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে ,হঠাৎ কাব্যের কথায় ওর ধ্যান ভাংলো,
ভয়ানক গম্ভীর কন্ঠে কাব্য বলে উঠলো,
-চলে এলে যে ,রেস্টুরেন্টে বসে হাতে হাত ধরে করা প্রেম আলাপ এতো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল!!!(চলবে)???