#অবেলায়_তুমি (অন্তিম-পর্ব)
#লেখক_আকাশ_মাহমুদ
সোহান আবারো তেড়ে যায় আকাশকে মা’রার জন্য। খালেক সাহেব আকাশকে ছেড়ে সোহানকে আটকানোর চেষ্টা করে। এই সুযোগে পিছন থেকে আকাশ সামনে এগিয়ে গিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সোহানকে কোষে একটা লাগিয়ে দেয়। যার ফলে সোহান সাথে সাথে ঢুলে ধ্রামম করে মাটিতে পড়ে যায়। আকাশের এক ঘু’ষিতে সোহানের দুনিয়াদারী উলট-পালট হয়ে গিয়েছে। নাক ফেটে অনবরত রক্ত পড়ছে। রক্তের কারণে চেহারার নকশা বদলে গিয়েছে সোহানের। সারা মুখ রক্তে লাল হয়ে গিয়েছে। মাটির মধ্যে শুয়ে নাক চেপে ধরে আছে সোহান। তনু সোহানের অবস্থা দেখে সোহানের কাছে দৌড়ে আসে। আকাশ সোহানের অবস্থা সত্যিই বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। এতো সময়ের প্রতিশোধ আকাশ একবারেই উঠিয়ে নিয়েছে। হিসেব বরাবর। তবে আকাশের ভিতরটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে তনুর আচরণে। রক্ত দু’জনের শরীর থেকেই পড়ছে। কিন্তু তনু তাঁকে নয় সোহানকে সামলাচ্ছে। রক্তের সাথে চোখের জল ঝর্ণার পানির ন্যায় টলমল করে পড়ছে আকাশের চোখ থেকে৷ হতভাগার মতন তাকিয়ে আছে তনুর দিকে আকাশ। আর তনু সোহানকে সামলে মাটি থেকে ধরে উঠে বসায়। আকাশের উপরে প্রচন্ড রাগ উঠছে তনুর। ইচ্ছে করছে আকাশকে এখুনি খু’ন করে ফেলতে৷ তবে এমনটা করা সম্ভব নয়। কারণ অনেক মানুষজন রয়েছে উপস্থিত। তার উপরে একটা মানুষকে খু’ন করা দু’চারটে কথা নয়। সোহানকে কোনো মতে সামলে রাগান্বিত কন্ঠে আকাশকে বলে,
–‘আকাশ এই মুহূর্তে তুই আমার অফিস থেকে বের হ। না হয় কিন্তু আমার হাতে তোর কোনো অঘটন ঘটবে। তোর কতো বড় সাহস তুই আমার সোহানের শরীরে আ’ঘাত করিস? তুই তো এর জন্য কখনোই ক্ষমা পাবি না আকাশ। একদম জানে মে’রে ফেলবো তোকে। আমার সোহানের গায়ে হাত উঠানোর ফল তোকে অবশ্যই ভোগ করতে হবে। অবশ্য আমার সমস্ত প্রতিশোধ নেওয়া শেষ তোর উপরে। কিন্তু একটু আগে যেটা করলি সেটার কারণে আমি নয় সোহান তোর উপরে নিজেই প্রতিশোধ নিবে। আর সেই সময় আমি সোহানকে সঙ্গ দিব। তুই নিজের জীবনে আরো একটা মুসিবত ডেকে এনেছিস সোহানের উপরে হাত তুলে। আমার প্রতিশোধের পালা শেষ। কিন্তু সোহানের নতুন করে পালা শুরু হয়েছে। তুই পাতালে গিয়ে লুকিয়ে থাকলেও সোহান তোকে খুঁজে বের করবে। এবার আমার চোখের সামনে থেকে দূর হ। আগামীতে যেনো আর কখনো তোর সাথে আমার দেখা না হয়। আর যদি হয়েও থাকে, তাহলেও যেনো তোর লাশের সাথে আমার দেখা হয়। এখন বের হ তুই আমার অফিস থেকে। তোর মতন ছোট লোক আমার অফিসে থাকার কোনো যোগ্যতাই রাখে না।’
তনুর কথা শুনে আকাশের প্রচন্ড হাসি পায়। তনুর কথার কোনো প্রত্যুত্তর না করে সজোড়ে হাসতে হাসতে তনুর অফিস থেকে বেরিয়ে চলে যায়। আপদ বিদায় হয়েছে অফিস থেকে। আকাশ চলে যাওয়ার পর তনু কয়েক জনের সাহায্যে নিয়ে সোহানকে হসপিটালে নিয়ে যায়। ডক্টর জানায় সোহানের নাকের ভিতরে হালকা করে চোট লেগেছে। তেমন বড় ধরনের কোনো ক্ষতি হয় নি। তনুর শান্তিতে নিশ্বাস ফেলে ডক্টরের কথা শুনে। ভিতরে ভিতরে বেশ আনন্দ লাগছে তনুর। একে তো সোহানের তেমন বড় ধরনের কোনো ক্ষতি হয়নি। দ্বিতীয়ত আকাশের উপরে আজ সে সমস্ত কিছুর প্রতিশোধ নিয়েছে। সোহানকে ডক্টর দেখিয়ে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসে তনু। আনন্দের কোনো সীমা নাই তনুর। এর আগে কখনো তার কোনো কিছু নিয়ে এতোটা আনন্দ হয়নি। আজ যেই আনন্দটা হচ্ছে আকাশের উপরে প্ল্যান মোতাবেক সমস্ত প্র’তিশোধ নিতে পেরে। খুশি মনে বাসায় এসে নিজের মা’কে বলে,
–‘মা আজ আমি বেশ খুশি। জানো আজ আমি ঐ আকাশের উপরে সমস্ত প্রতিশোধ নিয়ে নিয়েছি। আমার বাবার প্রতিশোধ এবং আমাকে করা অপমানের শোধ আজ আমি আকাশের উপরে তুলেছি। অফিসের সকল কর্মচারীর সামনে তাঁকে অপমান করে অফিস থেকে বের করে দিয়েছি। আর সেই সঙ্গে তাঁকে সোহানের হাতেও মা’ইর খাইয়েছি। আমার কি যে আনন্দ হচ্ছে মা জানো? আমার এই জীবনের সব চাইতে বড় পূর্ণতাটা যেনো আজ আমি পেয়েছি আকাশের উপরে প্রতিশোধ নিতে পেরে। একেবারে নাক-মুখ ফা’টিয়ে দিয়েছে সোহান আকাশের। আমায় অপমান করার সমস্ত ফল আজ আকাশ পেয়েছে। কত্তো বড় সাহস তার সে আমায় অপমান করেছিল প্রেমের প্রপোজাল দেওয়ায়। আজ তার স্টাটাস তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছি৷ রাস্তার টোকাই হয়ে আমার সাথে বাহাদুরি দেখায়। আজ একদম পরিপূর্ণ ক্ষোভ মিটিয়েছি আকাশের উপর।’
তনুর সমস্ত কথাবার্তা শুনে রাগে তনুর মা’য়ের চোখে পানি চলে আসে। মেয়ের কথাবার্তা শুনে নিজেকে দমানো মুশকিল হয়ে উঠেছে তনুর মা’য়ের। কোষে তনুর দুই গালে দু’টো থা’প্পড় লাগিয়ে দেয় তনুর মা। তনু আশ্চর্য হয় তার মা’য়ের এমন আচরণে। গালে হাত দিয়ে আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করে,
–‘মা তুমি আমায় মা’রলে কেন? তোমার তো আমার খুশিতে খুশি হওয়া উচিত মা। সেই জায়গায় তুমি আমায় থা’প্পড় মা’রলে?’
–‘হ্যাঁ মে’রেছি। কারণ তুই যেই বড় অন্যায় টা করেছিস আকাশের উপরে, সেটা এর আগে দুনিয়ার বুকে কেউ কারোর সাথে করেনি।’
–‘মা আমি কিসের অন্যায় করেছি আকাশের উপরে? অন্যায় তো সে আমার সাথে করেছে৷ তাঁকে প্রেমের প্রপোজাল দেওয়ায় আমাকে অপমান করেছে। আমার বাবার দুঃসময়ে তারা সাহায্য না করে আমার বাবাকে ম’রার জন্য ছেড়ে দিয়েছিল। আজ তাঁদের কারণে আমার বাবা বেঁচে নেই। তার উপরে সে আমায় পার্টিতেও অপমান করেছে। আর তুমি বলছো আমি তার উপরে সমস্ত কিছুর প্রতিশোধ নিয়ে অন্যায় করেছি?’
–‘হ্যাঁ তুই অন্যায় করেছিস। আর তোর অন্যায়টা এতো বড় যার কারণে হয়তো সৃষ্টিকর্তার আরশ সহ কেঁপে উঠেছে। তনু তুই একটা নির্দোষ ছেলের উপরে প্রতিশোধ নিয়েছিস। যেটার কারণে তুই এই জীবনে হয়তো কোনোদিন ও ক্ষমা পাবি না।’
–‘মা আকাশকে তোমার কোন দিকে নির্দোষ মনে হচ্ছে? সে যে আমার সাথে এতো কিছু করেছে সেসব কি তোমার কাছে কিছুই মনে হচ্ছে না?’
–‘না মনে হচ্ছে না। কারণ তুই এখনো সত্যিটা জানিস না।’
–‘কিসের সত্যি আমি জানি না মা?’
–‘শুনতে চাস কোন কি তুই জানিস না?’
–‘হ্যাঁ শুনতে চাই।’
–‘ঠিক আছে বলছি। তবে আমি কখনোই চাইনি তোকে এই সত্যি গুলো বলতে। কিন্তু শেষমেশ বাধ্য হচ্ছি বলতে। শুরুতে তোর বাবার কথা দিয়েই শুরু করি। তোর বাবা আর সেলিম সাহেব এক সাথে বিজনেস করতো। কিন্তু মাঝ পথে তোর বাবাই সেলিম সাহেব থেকে আলাদা হয়ে অন্য একটা কোম্পানির সাথে হাত মিলিয়ে অধিক অর্থের লোভে বিজনেস করেছে। আর সেটাই তোর বাবার কাল হয়েছে। তোর বাবা সেলিম সাহেবকে রেখে যেই কোম্পানির সাথে শেয়ারে বিজনের করেছে সেই কোম্পানি তো ডুবেছেই, সাথে তোর বাবাকেও ডুবিয়েছে। তোর বাবার সমস্ত টাকা-পয়সা নিজের কারণে হারিয়েছে। সেলিম সাহেব অনেক বার তোর বাবাকে বুঝিয়েছিল এমনটা না করতে, কিন্তু তোর বাবা সেলিম সাহেবর একটা কথাও শোনে নি। উল্টো আরো ব্যাংক থেকেও অনেক লোন নিয়েছিল তোর বাবা নতুন করে বিজনেস করার জন্য। সেলিম সাহেব তোর বাবার কারণে প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু তার পরেও তোর বাবার বিপদে সেলিম সাহেব এগিয়ে এসেছিল। কিন্তু তোর বাবা নিজেই সাহায্য নেয়নি। কারণ এমনিতেই সেলিম সাহেবের কথা না শোনায় তোর বাবার প্রচন্ড লজ্জাবোধ কাজ করছিল। তাই তোর বাবা সেলিম সাহেবের সাহায্য নেয়নি।
আর এই বিষয়টা থেকে তুই নিজেও বেখবর। অবশ্য তোকে ইচ্ছা করেই জানানো হয়নি। কারণ তোর বাবা অতিরিক্ত অর্থের লোভ করতে গিয়ে সব হারিয়েছি সেটা তুই জানতে পেলে তোর নজরে তোর বাবা নিচে নেমে যাবে। তাই তোর বাবা সেটা তোকে জানাতে বারণ করেছে। এরপর যখন তোর বাবা মা’রা যায়, তখন তোর বাবার লোনের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় ব্যাংকের লোকজন আমাদের বাড়িটা নিয়ে নেয়। কিন্তু তার পরেও লোন পুরোপুরি পরিশোধ হয় না। তখন আকাশের বাবা নিজে বাকি টাকা পরিশোধ করেছে। এবার আসি আকাশের কথায়। তুই আকাশকে কখন থেকে ভালোবাসিস সেটা আমি জানি না! তবে তুই যখন ক্লাস সেভেন-এইটে পড়িস তখন থেকেই আকাশ তোকে পছন্দ করে৷ তোর আর সোহানের বিষয়টা সে সহ্য করতে না পাড়ায় পার্টিতে সে তোকে অপমান করেছে। আর গত পাঁচ বছর আগে সে তোকে যেই অপমানটা করেছে সেটা ইচ্ছা করেই করেছে। কারণ যাতে করে আমাদের যেই নাম-ডাকটা খারাপ হয়েছে সেটা তুই আবার ফিরিয়ে আনতে পারিস। তখন সে তোর আচরণে সাড়া দিলে তুই আজ কখনোই এই জায়গায় পৌঁছাতে পারতি না। তোকে অপমান করে সে তোর মধ্যে একটা জেদ ঢুকিয়ে দিয়েছে। যাতে করে তুই তোর বাবার চাইতেও অনেক বেশি নাম-ডাক অর্জন করতে পারিস। আকাশ তোকে এবং আমাদের পরিবারকে অনেক বেশি ভালোবাসতো। তাই আমাদের ভালোর জন্য সে এমনটা করেছে। এমনকি তুই যেই টাকা দিয়ে বিজনেস করছিস সেটা আকাশের এই দেওয়া টাকা। কিন্তু আকাশ তোকে এসব বিষয়ে কখনো না বলতে বলেছে। কারণ সে চায় না তুই তার কাছে কখনো ছোট হয়ে থাক। এমনকি সে তোর বিপদে উপকার করেছে সেই কারণে তুই তাঁকে ভালোবাস। সে সবসময় চাইতো তোদের ভালোবাসাটা যেনো পিওর হয়। কখনো যেনো তোদের ভালোবাসার মধ্যে তার উপকারের প্রসঙ্গটা না আসে। তার জন্যই সে সব সময় ওইসব কথা লুকিয়ে গেছে। এমনকি আমাকেও বারণ করেছে কখনো তোকে এসব বিষয় না বলতে। তাই আমি তার দেওয়া টাকা তোকে দিয়ে বলেছিলাম এসব আমার নিজের জায়গা বিক্রির টাকা। কিন্তু সত্যিকারত্বে টাকাটা আমায় আকাশ দিয়েছিল তোকে দেওয়ার জন্য। আমার কোনো জায়গা জমিন ছিল না।
কিন্তু তুই কি করলি? তার দেওয়া টাকায় রাজপ্রাসাদ বানিয়ে সেই রাজপ্রাসাদে দাঁড়িয়ে তাকেই অপমান করলি? হায়রে তনু তোর কিছুই থাকবে না রে। সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি তোর মা হয়ে বলছি৷ তুই কোনো কুল-কিনারা খুঁজে পাবি না। সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে যাবে তোর। অন্যায় ভাবে কখনো মানুষের উপরে প্রতিশোধ নিলে সৃষ্টিকর্তার আরশ সহ কেঁপে উঠে। তার মনের আঘাতে তুই যেই রাজপ্রাসাদ বানিয়েছিস, সেই রাজপ্রাসাদের একটা ইঁটের টুকরো ও খুঁজে পাবি না। আমার কথাটা মিলিয়ে নিস তুই।’
তনুর মা’য়ের চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে। আর তনু তার মা’য়ের মুখ থেকে সমস্ত সত্যি কথা শুনার পর যেনো তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়েছে। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে তনুর। মনের ভিতরে বিশাল এক ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়েছে। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। নিজের মা’য়ের মুখ থেকে অপ্রিয় সত্যি গুলো শুনার পর নিজের অনিচ্ছাতেই চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করেছে। কলিজাটা বেধড়ক ভাবে মোচড় দিচ্ছে তনুর। মনে হচ্ছে যেনো কেউ নিজের হাতে ধরে কলিজা টাকে কচলাচ্ছে। ধাপাস করে মাটিতে বসে ফুফিয়ে কাঁদতে শুরু করে তনু। নিজের হাতে দিয়েই সে সব কিছু শেষ করে ফেলেছে। কতো বড় ভুল করেছে সেটা সে এখন উপলব্ধি করতে পারছে৷ কিন্তু এখন উপলব্ধি করে আর কি হবে। যা হওয়ার তা তো হয়েই গিয়েছে।
মেয়ের কান্নাতে মা’য়ের কলিজায় একফোঁটাও ফারাক পড়ছে না। যেখানে সন্তানের কান্নায় মা’য়ের ভিতরে ভূমিকম্প শুরু হয়, সেখানে তনুর কান্না তনুর মা’য়ের ভিতর পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না এতো বড় পাপ করেছে তনু। উল্টো আরো রাগান্বিত কন্ঠে মেয়েকে বলে,
–‘এখন কাঁদছিস কেন? তোর তো আনন্দে থাকার কথা প্রতিশোধ নিতে পেরে। আমি বারবার বলেছিলাম এমনটা করিস না। যা হয়েছে গত পাঁচ বছর আগে চলে গিয়েছে। কিন্তু না আমার কথার অমান্য করে তুই ঠিকই প্রতিশোধ নিয়েছিস। আসলে তোর মতন মেয়ে আমি গর্ভে ধরে নিজের গর্ভকে কলঙ্কিত করেছি এছাড়া আর কিছুই নয়। একদম কাঁদবি না। কাঁদলে গলা টি’পে মে’রে ফেলবো। মায়া কান্না থামা।’
–‘ও মা প্লিজ এই ভাবে বলো না। সত্যিই আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি না বুঝে! মা প্লিজ আমাকে একটা বার শোধরানোর সুযোগ দাও।’
–‘আমার কাছে সুযোগ চেয়ে কোনো লাভ নেই। সুযোগ যার কাছে চাইলে কাজ হবে তার কাছে গিয়ে চা।’
তনু মাটি থেকে উঠে দাঁড়ায়। তার মা ঠিক কথাই বলেছে। ক্ষমা তার আকাশের কাছে চাওয়া উচিত। এক সেকেন্ড ও আর দেরি না করে গাড়ি নিয়ে আকাশের বাসায় চলে যায়। কিন্তু আকাশের বাসায় গিয়ে জানতে পারে আকাশ বাসায় যায়নি। বাসায় না পেয়ে গাড়ি নিয়ে এদিক-সেদিক পাগলের মতন খুঁজতে থাকে আকাশকে। কিন্তু কোথাও আকাশের দেখা মিলে না। অসংখ্য বার ফোন করে। কিন্তু ফোন প্রতিবারই বন্ধ আসে৷ তনু না খেয়ে না দেয়ে সেই বিকাল চারটা থেকে আকাশকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। রাতের বাজে এগারোটা। এখনো আকাশের দেখা মিলেনি। রাস্তার এক পাশে গাড়ি থামিয়ে আকাশের মা’য়ের কাছে ফোন করে জিজ্ঞাস করে আকাশ বাড়ি গিয়েছে কিনা। কিন্তু আকাশের মা ভয়ার্ত কন্ঠে জানায় আকাশ এখনো বাড়ি ফিরেনি। আকাশের মা’য়ের ও প্রচন্ড ভয় হচ্ছে আকাশকে নিয়ে৷ এতো রাত হয়ে গেছে কিন্তু এখনো আকাশ বাড়ি ফিরেনি। হতাশাগ্রস্ত হয়ে ছেলে বাড়ি ফিরে আসার প্রত্যাশায় বসে আছে রহিমা বেগম। ঐ দিকে তনুর ভিতরে প্রচন্ড ভয় হচ্ছে আকাশকে নিয়ে। আবারো গাড়ি করে খুঁজতে শুরু করে আকাশকে। রাত বাজে বারোটা। এখনো অব্দি আকাশের খোঁজ মিলেনি। এতো খোঁজার পরেও না পেয়ে হতাশ হয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বাড়ি ফিরে আসে তনু। শরীর প্রচন্ড ক্লান্ত। চোখের পানি গাল বেয়ে এখনো পড়ছে সেই বিকাল থেকে। বাড়ি ফিরে ক্লান্ত শরীর নিয়ে নিজের রুমে প্রবেশ করে। এমন সময় হুট করে তনু দেখে আকাশ তার রুমের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। তনু আকাশকে দেখতে পেয়ে কোনো কথাবার্তা ছাড়া এক দৌড়ে আকাশের কাছে গিয়ে আকাশকে জড়িয়ে ধরে। আকাশ কোনো কথাবার্তা বলছে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। তনু উপলব্ধি করতে পারে আকাশের মনে প্রচন্ড অভিমান জন্মেছে। অভিমান ভাঙ্গাতে আকাশের চোখে-মুখে অসংখ্য চুমু এঁকে দেয় তনু। কিন্তু তাও আকাশ কোনো কথাবার্তা বলে না। তনু বুঝতে পারে আকাশের রাগ এভাবে কমবে নিয়ে। আকাশের রাগ ভাঙ্গাতে হলে অন্য কিছু করতে হবে। হাত চে’পে ধরে আকাশকে নিয়ে সোজা ছাদে চলে যায়। এরপর ছাদের এক জায়গায় নিয়ে গিয়ে পাশাপাশি বসে একেক বার একেকটা করে আকাশের রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করে। কখনো আকাশের গালে চুমু খাচ্ছে। কখনো আকাশকে এটা সেটা বলে হাসানোর চেষ্টা করছে। এভাবে দুই ঘন্টা কেটে যায়। অবশেষে দুই ঘন্টার প্রচেষ্টার পর আকাশের রাগ ভাঙ্গে৷ তনুর কাছে পারস্য বিজয় করার মতন লেগেছে আকাশের রাগ ভাঙ্গানোটা। তনুর পাগলামি দেখে মুচকি হেঁসে দেয় আকাশ। তনুর মুখেও হাসি ফুটে উঠে আকাশের রাগ ভাঙ্গাতে পেরে। এমন সময় তনুর কাছে একটা ফোন আসে। কাঁধের মধ্যে ঝুলে থাকা ছোট সাইড ব্যাগ থেকে ফোন বের করে রিসিভ করে তনু। তখনি অপরপাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠে,
–‘দুই ঘন্টা আগে রোড এক্সিডেন্টে একজন লোক মা’রা গিয়েছেন। যিনার শরীর এক্সিডেন্টে একদম ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছে। আমরা কোনো ভাবেই সনাক্ত করতে পারছি না উনি কে। লাশের কাটা আলাদা একটা হাত আর থেঁতলে যাও দেহটা শুধু পড়ে রেয়েছে। মাথার কোনো অস্তিত্ব আমরা খুঁজে পাইনি। তাই লাশের বিষয়ে কাউকে ইনফর্ম করতে পারছিলাম না। তবে আমরা উনাকে সার্চ করে শুরুত উনার একটা মানিব্যাগ পেয়েছি। যেখানে স্বর্ণকারের দোকানের একটা রিসিট ছিল। এছাড়া আর কোনো আইডেন্টিটি ছিল না। তাই আমরা রিসিটের দেওয়া নাম্বারে ফোন করেছিলাম। তখন উনি বললো উনাকে চিনে না। তবে কয়েকদিন আগে উনি কানের এক জোড়া দুল বন্ধক দিয়ে হাজার দশেক টাকা নিয়েছিল। এছাড়া উনার বিষয়ে আর কিছুই জানে না। কিন্তু একটু আগে ঘটনাস্থলে আমরা একটা ফোন খুঁজে পেয়েছি যেটা বন্ধ ছিল। তবে আমরা ফোনটা চালু করার পর দেখি আপনার নাম পার্টনার দিয়ে সেভ করা এবং আপনার নাম্বার অনেক গুলো মিসডকল। তাই আমরা আপনাকে ফোন করেছি। আপনি কি উনার কিছু হন?’
তনু লোকটার কথা শুনে পাশে তাকাতেই দেখে আকাশ নাই। তনু বুঝে ফেলে এতো সময় তার সাথে কেউ ছিল না। আকাশ দুই ঘন্টা আগেই রোড এক্সিডেন্টে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেছে। আর সে নিজে নিজেই এতো সময় একা একা বকবক করেছে। তনুর হাত থেকে ফোনটা নিচে পড়ে যায়। সেই সঙ্গে তনু বিকট আওয়াজে এক চিৎকার মা’রে। মনে হচ্ছে যেনো কেউ তনুর বুকে ছু’রি ঢু’কিয়ে দিয়ে তার কলিজাটা জোরজবরদস্তি বের করে নিচ্ছে। পাগলের মতন জোরে জোরে চিৎকার করে কান্না করতে শুরু করে। আর সেই সঙ্গে চিৎকার করে বলতে থাকে,
–‘আকাশ প্লিজ ফিরে এসো। আমি তোমার সত্যিকারত্বে ভালোবাসাটা বুঝতে পারিনি। তুমি আমায় উচ্চ আসনে বসিয়েছো। আর আমি তোমায় মৃত্যু উপহার দিয়েছি। আজ আমি জেনে গেছি তুমি সেদিন টাকা গুলো কোথা থেকে পেয়েছিল। আমায় অনেক বড় সারপ্রাইজ দিয়েছিলে তুমি সেদিন। আর পরিশেষে আমিও তোমায় সারপ্রাইজ দিলাম অপমান আর লাঞ্ছনা করে। আকাশ প্লিজ ফিরে এসো। আমি তোমার পা ধরে নিজের ভুলের জন্য ক্ষমা চেতে চাই। আমি তোমার সাথে সারাজীবন কাটাতে চাই। প্লিজ ফিরে এসো আকাশ..
তনু চিৎকার করে কান্না করছে আর পাগলের মতন প্রলাপ করছে। তনু হয়তো ভুলে গেছে যে একবার সৃষ্টি কর্তার ডাকে সাড়া দেয় সে আর কখনোই ফিরে আসে না। সঠিক বেলা ফুরিয়ে গেছে। অবেলায় হাজারবার চাইলেও সেটা আর কাজে দিবে না। আর একটা প্রবাদ আছে। সব কিছুর সাথে আপোষ চললেও নিজের আত্মসম্মানের সাথে কখনো আপোষ চলে না। কিন্তু তনু আকাশের সেই আত্নসম্মান টাকেই সকলের সামনে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। সেজন্য আকাশ অভিমান করে মৃত্যুর সাথে আপোষ করেছে। আর কখনো সে ফিরবে না। হারিয়ে গেছে সে। আর অবেলায় মাথা ঠেকিয়ে কাঁদছে তনু।
সমাপ্তি।
“আমি আগেই বলেছিলাম গল্পটা একদম ভিন্ন রকমের হবে। আর সেটাই হলো। জানি না গল্পটা কার কাছে কেমন লেগেছে! তবে আমি গল্পটাকে একটা শিক্ষনীয় পর্যায়ে নিয়ে যেতে চেয়েছি। কিছু সময় মানুষ প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। সঠিক ভাবে ভেবে দেখে না মানুষটার দোষ আছে কি নাই। তাই কেউ কারোর উপরে আক্রোশ মেটানোর আগে একশ বার ভেবে নিবেন। না হয় পরবর্তীতে আপনাকেই কষ্ট পেতে হবে।”
(গল্পের সমস্ত ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো। আর গল্পের মাঝে (‘) চিহ্নটা ব্যবহার করা হয় যাতে গল্পে ভায়োলেন্স না আসে। সবাই বিষয়টা বুঝবেন আশা করি। এবার বিদায় নিচ্ছি। সবাই ভালো থাকবেন। খোদা হাফেজ।)