#অবশেষে_সন্ধি_হলো
#পর্ব:৮
#লেখিকা : ইনায়া আমরিন
ম’ধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ছিলো রাবেয়া বেগম।বাবা ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক।আর মা সাধারণ একজন গৃহিণী।দুই বোনের মধ্যে রাবেয়া ছোট জন।ছোট হিসেবে বাবার আদরের মেয়ে ছিলো।স্কুল পড়ুয়া রাবেয়া তখন বাবার হাত ধরে স্কুলে যেতো।বাবাকে যখন দেখতো ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে খুব সুন্দর ভঙিমায় পড়ায়,তখন বাবার মাঝে একজন আদর্শ শিক্ষককে দেখতে পেতো।সেই থেকে শিক্ষক পেশাটা স্বপ্নতে রূপ নিলো রাবেয়ার কাছে।সেও হতে চায় বাবার মতো। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কে পড়াবে, শিক্ষা দান করবে। কিন্তু তা হতে হলে তো আগে নিজেকে পরিপূর্ণ শিক্ষা অর্জন করতে হবে। তাই পড়ালেখায় মনোযোগী হয় রাবেয়া। শিক্ষিকা হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু তখন কী আর মেয়েদের এতো স্বপ্ন দেখা মানায়?বয়স চৌদ্দ পনেরোর কোঠায় এলেই বিয়ের ঘন্টা বে’জে যেতো।
ঠিক তা-ই হয়েছে রাবেয়ার বেলায়ও।তবে তার বাবা ছিলেন শিক্ষক মানুষ। তিনি চেয়েছিলেন মেয়েগুলোকেও শিক্ষিত করতে।সেটা চাকরি বাকরি করার উদ্দেশ্যে নয়।তিনি বিশ্বাস করতেন এই ক’ঠিন দুনিয়ায় টিকে থাকতে হলে শিক্ষা অর্জন বাধ্যতামূলক।যেনো উনার অবর্তমানে উনার মেয়েরা অর্জিত শিক্ষা,বুদ্ধি দিয়ে দুনিয়ার যাবতীয় বে’ড়াজাল থেকে নিজেদেরকে মু’ক্ত করতে পারে।
কিন্তু সমাজ বলে একটা কথা আছে।সেই সময় মেয়ের বিয়ে না দিলে আত্মীয় স্বজন,পাড়া প্রতিবেশী নানা রকম আ’জেবা’জে মন্তব্য করে বসতো। “আপনার মেয়ের বিয়ে হয় না?” “কোনো সমন্ধ আসে না ওর জন্য?” “মেয়ের কী কোনো সম’স্যা আছে নাকি,তা না হলে বিয়ে হবে না কেনো?” “এতো বড়ো মেয়েকে এখনো ঘরে বসিয়ে বুড়ি বানাচ্ছেন?পরে তো বর খুঁজেই পাবেন না।”
আরো নানা কথা শুনতে হয়।তাও ক’ষ্ট করে মেয়েকে টেন পাশ করিয়েছেন রাবেয়ার বাবা নিজাম উদ্দিন। কিন্তু বড়ো মেয়ের বেলায় তো টেন অবধিও আনতে পারেন নি।বিয়ে দিয়ে দিতে হয়েছে। তবে ছোট মেয়েকে শিক্ষিত করতে চেয়েছিলেন,সেই আগ্রহ রাবেয়ার মাঝে ছিলো তাও তিনি লক্ষ্য করেছেন। কিন্তু ঐ যে সমাজ।
রাবেয়া টেন পাশ করার পর বাড়িতে ঘ’টকের ঘটকা’লির তো’পে স্থি’র থাকতে পারতেন না তিনি,সাথে পাড়া প্রতিবেশীর ক’টু’ক্তি তো আছেই।এতো সব স’হ্য করতে না পেরে শে’ষে হা’র মেনে নিলেন নিজাম উদ্দিন।রাজি হয়ে গেলেন বিয়েতে।জিতিয়ে দিলেন সমাজকে,ভে’ঙে দিলেন নিজের ইচ্ছা আর মেয়ের স্বপ্নকে।
নিজের বিয়ে নিয়ে বাবা মাকে এতো হে’ন’স্থা হতে দেখে খুব ক’ষ্ট পেতো যুবতি মেয়ে রাবেয়া। মনে হতো তার জন্যই এতো কথা শুনতে হচ্ছে বাবা মাকে।যখন দেখলো আর কোনো দিশা খুঁজে না পেয়ে বিয়েতে বাবা মত দিলো তখন একবারের জন্যও “না” বলেনা রাবেয়া।সে বাবা মায়ের ক’ষ্টের কারণ হয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে চায় নি। ভাগ্যকে মেনে নিয়ে বিয়ে করে সংসার জীবনে পা রাখে।
একটা স্বপ্ন পূরণ না হলে সেটা নিয়ে বসে থাকা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না।স্বপ্ন ভা’ঙলে আবার স্বপ্ন দেখুন,তা পূরণ করার চেষ্টা করুন,চেষ্টা চালিয়ে যান। চেষ্টাই মানুষকে সফলতার দুয়ারে এনে ঠেকাবে।হাল ছেড়ে দিলেন তো হে’রে গেলেন।
রাবেয়া সবসময় তাই ভাবতো।সে পড়াশোনা শে’ষ করতে পারে নি, শিক্ষিকা হতে পারে নি।সেটা হয়তো তার ভাগ্যের লিখনে ছিলো না,ভাগ্যে যা লিখা ছিলো সেটাই হয়েছে। আর সে ভাগ্যে বিশ্বাসী এবং তার মেনে নেয়ার মতো মন মানসিকতাও তার আছে। ভাগ্য তাকে সংসার নামক এক জীবন দিয়েছে। আদর্শ শিক্ষিকা হয় নি,তবে সে আদর্শ গৃহিণী হবে,আদর্শ স্ত্রী হবে।ভবিষ্যতে সন্তানের আদর্শ একজন মা হবে।এটাই তার লক্ষ্য ছিলো।
সব ভুলে মন দিয়ে সংসার করে সে। সুন্দর স্বপ্ন দেখা সুন্দর চিন্তা ভাবনা করা যতোটা সহজ, সেই অনুযায়ী কাজ করা বা শ্রম দেওয়া ঠিক ততোটাই ক’ঠিন।শশুড় বাড়ীতে এসে তা উপলব্ধি করতে পারে রাবেয়া।
প্রথমে শাশুড়ি ভালো ব্যবহারই করে। কিন্তু সময়ের সাথে যেনো রুপ বদলাতে লাগলো। অ’ভাবের সংসার ছিলো শশুড়ের,তবে তা নিয়ে একটুও আফসোস ছিলো না রাবেয়ার,স্বামীর কাছে কোনো অ’ভিযোগও করে নি কখনো।মন প্রাণ দিয়ে সংসারের কাজ করতো।পুরো সংসারের সব কাজ একা হাতে করতো তারওপর কোনো কাজে একটু উনিশ বিশ হলেই শাশুড়ি কথা শোনাতে ছাড় দিতো না।
সংসারের কাজের পরিমাণ বেশি দেখে অনেক সময় রাতেও কাজ করে পরের দিনের কাজ এগিয়ে রাখতো রাবেয়া। কিন্তু কীসের কী?তার শাশুড়ি যেনো তাকে কাজের মধ্যে ডুবিয়ে রাখলেই বাঁচে। সারাক্ষন শুধু “এটা করো” “ওটা করো” বলে ব্যস্ত রাখতো। এতো পরিশ্রম খা’টাখা’টুনি করে রাতে একটু বিশ্রাম নিতে চায় শরীর। কিন্তু আশফাক সাহেবও সারাদিন ব্যবসা সামলে রাতে বাড়ি ফিরতেন। স্বভাবতই তিনি চাইবেন স্ত্রীর সেবা যত্ন।স্ত্রী নিজের হাতে বেড়ে খাওয়াবে,তাকে একটু সময় দিবে। কিন্তু তিনি তো জানতেন না তার মা তার স্ত্রীকে সারাদিন কী পরিমাণ পরিশ্রম করায়।জানলে হয়তো নিজেই স্ত্রীর সেবা করতেন।
একটা সময় রাবেয়ার কোল আলো করে জন্ম নেয় আহনাফ।সে যে কী এক সুখ বলে বোঝানো মুশকিল।
এমন না’দুসনু’দুস রু’ষ্টপু’ষ্ট নাতি পেয়ে সেলিনা বেগমের গর্ভে বুকের ছাতি ফে’টে যেতো যেনো।বার বার রাবেয়াকে শুনিয়ে শুনিয়ে আওড়াতো ‘আমাদের বংশের ছেলে’। উনি ভুলেই যান রাবেয়া আহনাফের জন্মদাত্রী মা।ভাব এমন মনে হয় আহনাফ আকাশ থেকে পড়েছে,এতে রাবেয়ার কোনো অবদানই নেই।ক’ষ্ট পেতো রাবেয়া, শাশুড়ির কাজকর্মে আড়ালে গিয়ে কাঁদতো।কিন্তু অ’শান্তির ভ’য়ে কিছুই বলতো না।
সেলিনা বেগম আহনাফকে নিজের কাছেই রাখতেন বেশি,শুধু খাওয়ার সময় রাবেয়ার কাছে দিতেন। আহনাফ যদি রাবেয়ার কাছে থাকে তাহলে সে তো ছেলে নিয়েই ব্যস্ত থাকবে,বাড়ির কাজ করবে কে?
এভাবেই রাবেয়া শাশুড়ির অ’ত্যাচার স’হ্য করতে করতে পার করে দেয় সংসার জীবনের অনেকটা সময়।এদিকে স্বামী মানুষটার করা ত্যা’গ,পরিবারের জন্য করা পরিশ্রম দেখে নিজেরও ক’ষ্ট লাগতো মায়া হতো,স্বামীকে খুব ভালবাসতো কী না।সবসময় ভাবতো যদি স্বামীর জন্য কিছু করতে পারতো।
যখন দেখলো আশফাক সাহেব বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছে তাদের সুখের কথা ভেবে।তখন রাবেয়া ভাবলো এখনই সুযোগ স্বামীর জন্য কিছু করার। মানুষ খা’রাপ সময় যাদেরকে পাশে পায়, তাদেরকেই সারাজীবন মনে রাখে। রাবেয়াও ভাবে একটা সময় হয়তো আশফাক সাহেবের অনেক টাকা হবে, কিন্তু খা’রাপ সময়টার কথা ঠিকই মনে থাকবে।আর সে চায় তার স্বামীর এই সময়টাতে পাশে থাকতে। নিজের গয়না দিয়ে দেয় স্বামীকে, বান্ধুবীর সাহায্য নেয়। অনেক অপেক্ষার পরে অবশেষে বিদেশে গেলেন আশফাক সাহেব।তখন আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া আদায় করে রাবেয়া।কিন্তু সেলিনা বেগম যেনো তাকে অপ’দস্থ করতে উঠে পড়ে লাগে।উঠতে বসতে আজে বা’জে কথা শোনাতো।যখন এর মাত্রা ছাড়িয়ে গেলো তখন আর স’হ্য করতে পারে নি রাবেয়া, প্রতিবাদ করে।আর এই প্রতিবাদই তার কা’ল হয়ে দাঁড়ায়।স’হ্য করতে হয় চরম অপ’মান।
তার শাশুড়ি তার বান্ধবীর স্বামী কবিরের সাথে মিলিয়ে তাকে বা’জে ভাবে অ’পমান করে।যা তার আত্মসম্মানে আঘা’ত হানে।স’হ্য করতে না পেরে প্রথম বারের মতো শাশুড়ির কথার পিঠে উচিত জবাব দেয় রাবেয়া।তাতে যেনো অপ’মানের পরিমাণ আরো বেড়ে যায়। সেলিনা বেগম র’টিয়ে দেয় তার নামে মি’থ্যে অপ’বাদ।
সেইদিন সেলিনা বেগমের সাথে ঝগ’ড়া করে আহনাফকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে আসে রাবেয়া। হ’ঠাৎ বাবার বাড়ি যাওয়ার ফলে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলো, কোনো ভাবে উত্তর দিয়ে পরিস্থিতি সামলায়। সেখানে গিয়ে এক দ’ন্ড শান্তি পায় নি।পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজনের ইঙ্গিতপূর্ণ খোঁ’চা মা’রা কথার স’হ্য করতে হয়েছে।
তার কিছুদিন পর জানতে পারে সে দ্বিতীয় বারের মতো মা হতে চলেছে। মনে মনে খুশি হয়েছিলো খুব।এই খবর পেয়ে আহনাফের খুশি দেখে রাবেয়ার খুশি যেনো দিগুন বেড়ে গেলো।
আহনাফকে বাবার বাড়ি রেখে রাবেয়া শশুড়বাড়ী যায়।সুখবর দিতে সাথে শাশুড়ির সাথে সব ঝা’মেলা মিটমাট করতে। কিন্তু সেখানে গিয়েই জীবনের সবচেয়ে বড়ো ধা’ক্কাটা খায়।
তার স্বামী তাকে অবি’শ্বাস করেছে?তাকে আর নিজের জীবনে চায় না?তা’লাক দিতে চায়?ছোট একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে এতো বড়ো সিদ্ধান্ত?
যখন সেলিনা বেগম জানে রাবেয়া অ’ন্তঃস’ত্ত্বা। তখন সেই বাচ্চাকে অবৈ’ধ বলতেও জিভে আ’টকায় না।এই কথা শুনে জ্ব’লে উঠে রাবেয়া।আর যা-ই হোক কোনো মা সন্তান সম্পর্কে বা’জে কথা স’হ্য করতে পারে না।সে ছাড় দেয় না, শাশুড়ির মুখের ওপর কথা শুনিয়ে দিয়ে রা’গে শশুড় বাড়ী ত্যা’গ করে। সেইদিনের পর জন্ম নেয় অন্য এক রাবেয়া,তার সাথে সাথে মনে মনে স্বামীর ওপর রা’গ অভিমা’নও জন্মায়।
সাহস করে প্রেগন্যান্ট অবস্থায় আহনাফকে নিয়ে বাবার বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায়,কাউকে কিছু জানায় না।সবার সাথে যোগাযোগ বি’চ্ছিন্ন করে ফেলে।বাবার দেওয়া কানে একজোড়া স্বর্ণের দুল ছাড়া কিছুই ছিলো না তার কাছে। বি’ক্রি করে ফেলে, সারাদিন ছোট আহনাফের হাত ধরে বাসা খুঁজে। সন্ধ্যের পর দুই রুমের একটা বাসা পায়। শুরু হয় তার আরেক যুদ্ধ।
সারাদিন ধরে কাজ খুঁজতো।তা না হলে পেট চলবে কী করে।কিন্ত বললেই তো আর কাজ পাওয়া যায় না। বাড়িওয়ালার কাছে সাহায্য চায় যদি কোনো সন্ধান দিতে পারেন।প্রথমে বাড়িওয়ালা না না করে তারপর রাবেয়ার এমন করুন অবস্থা দেখে তিনি খোঁজ নিয়ে একটা কাজ যোগাড় করে দেন। কয়েকটা ব্যাচেলার ছেলে ভাড়া থাকতো তাদের বাসায়। তাদের রান্নাবান্না করার দায়িত্ব দিয়েছে রাবেয়াকে,মাস শে’ষে দেড় হাজার করে দিবে।রাজি না হয়ে উপায় নেই। কিন্তু এই টাকায় হবে না।আরো দরকার।কি করবে বুঝে উঠতে পারে না রাবেয়া।তার মধ্যে অ’ন্তঃস’ত্ত্বা।এক করুন অবস্থা তার।
একদিন রুমি ফোন দেয় তাকে।বাধ্য হয় সব কথা রুমিকে খুলে বলতে।সব শুনে রুমি আর তার স্বামী কবির রাবেয়া আর আহনাফকে দেখতে আসে।রুমি তার সাথে নিয়ে যেতে চায় আহনাফ আর রাবেয়াকে,কবির বলে সে খরচ চালাবে। কিন্তু রাবেয়া মোটেও রাজি হয় না।বলে পারলে তাকে যেনো একটা কাজ জোগাড় করে দেয়। সামান্য দেড় হাজারে সংসার চলে না।
রাবেয়ার কথায় হা’র মানে কবির আর রুমি।কবির তার পরিচিত মানুষজনের সাথে যোগাযোগ করে রাবেয়াকে একটা এনজিওতে চাকরি পাইয়ে দেয়।মাসে চারহাজার।তবে রাবেয়া কাজ ভালো ভাবে করলে তারা পরবর্তীতে বেতন বাড়িয়ে দেবে বলে কথা দিয়েছে। কৃতজ্ঞতায় চোখে জল আসে রাবেয়ার।তার বি’পদে আপনজনের মতো পাশে ছিলো কবির আর রুমি।
প্রেগন্যান্ট অবস্থায় ছেলেগুলোর রান্নাবান্না করা, এনজিও সামলে আবার আহনাফের দেখাশোনা।ছোট সংসার ছিলো মা ছেলের,সেই সংসারের কাজও তো সেই রাবেয়াকেই করতে হতো। ক’ষ্টে দুঃ’খে নামাজের বিছানায় কেঁদে ফেলতো। আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতো। আবার নিজেকে শ’ক্ত করতো,সে এভাবে ভে’ঙে পড়লে তো তার ভেতরে যে বেড়ে উঠছে তারও ক্ষ’তি হবে।আর আহনাফ,সেও তো ভে’ঙে পড়বে মাকে দেখে।নিজেকে বোঝায় রাবেয়া।তার সন্তানদের জন্য হলেও তাকে শ’ক্ত হতে হবে। তাদেরকে মানুষের মতো মানুষ করতে হবে, তাদের আদর্শ মা হতে হবে।তার জন্য আগে নিজেকে ঠিক রাখতে হবে,ভে’ঙে পড়লে চলবে না। সন্তানের ভালোর জন্য সব করবে।
অবশেষে নয় মাস গর্ভে থাকার পর জন্ম হয় উর্মির।তার দুঃ’খের জীবনে সৃষ্টিকর্তার পাঠানো একটুকরো সুখ যেনো।সদ্য জন্মানো উর্মির মুখের দিকে তাকিয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলে রাবেয়া। ছেলের পর আল্লাহ তাকে মেয়ের সুখও দিয়েছে,কজন পায় এটা?ভেবেই শুকরিয়া আদায় করে আল্লাহর কাছে।
রাবেয়া যখন সংসার,স্বামী সন্তান নিয়ে স্বপ্ন দেখতো।তখন আহনাফের পর একটা মেয়ের আশা করতো।সেই চিন্তা থেকে মেয়ের নামও ঠিক করে ফেলে।
“উর্মি”,এই নামটা রাবেয়ার খুব পছন্দের ছিলো।ভেবেছিলো মেয়ে হলে এই নামটাই রাখবে। আল্লাহ তার ইচ্ছা পূরণ করেছে,কন্যা সন্তানের মাও বানিয়েছে তাকে।মেয়েটা তার দুঃ’খের সঙ্গীর হয়ে এসেছে।তার মেয়ে উর্মি।ভাবলেই মুখে হাসি ফোটে।তাই নিজের নামের সাথে মিলিয়ে উর্মির নাম রাখে রাবেয়া।
আশফাকুর রহমান এবং রাবেয়া বেগমের মেয়ে রাদিয়া রহমান উর্মি।
উর্মি যেদিন জন্ম নেয় সেদিন বিকেলে হাসপাতালে তাদেরকে দেখতে আসে রুমি আর কবির। হাসপাতালের বিলও তারাই দিয়ে দেয়। রাবেয়া না করে কিন্তু কানে নেয় না কবির।এরপর থেকে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখতো রাবেয়ার সাথে। রাবেয়া ভাবে এমন বোনের মতো বান্ধুবী কয়জনের কপালে জোটে?এ দিক দিয়ে সে বড়ো ভাগ্যবতী।
এনজিও,আহনাফ আর ছোট উর্মিকে নিয়ে চলতে থাকে তার জীবন।ব্যাচেলার ছেলেগুলো বাসা ছেড়ে দেয় তাই সেই কাজ আর করতে হয় নি।তবে এনজিওর ওনার তার কাজে খুশি হয়ে বেতন বাড়িয়ে দেয়। সেই বেতনের টাকা দিয়ে চলে তাদের টানপো’ড়নের সংসার।
একদিন আশফাক সাহেব আসেন তার কাছে। হ’ঠাৎ ওনাকে দেখে চম’কায় রাবেয়া। পুরোনো রা’গ ফিরে আসে। অ’ভিমানে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু যখন আশফাক সাহেব সব খুলে বলেন তখন রাবেয়া অবাকের শে’ষ সীমানায়। দুজনে দুজনকে এতোবছর ভুল বুঝে ছিলো?
বুঝতে পেরে ক্ষ’মা চায় দুজনেই,হয়ে যায় একসাথ।
কিন্তু ছেলে কী আর এতো সহজে সব ভুলবে।তার তো বাবার মতোই রা’গ। সব বোঝার মতো সেই বয়সও তো হয় নি। তাই রাবেয়া সিদ্ধান্ত নেয় আপাতত যেভাবে চলছে চলুক।সময় হোক, আহনাফ বুঝদার হোক তখন সব খুলে বলবে।
ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের ম্যাচিউরিটি আসে তাড়াতাড়ি। মেয়েরা অনেক গুন বেশি ধৈ’র্যশীল হয়, বুঝদার হয়। চূড়ান্ত রা’গের সময়ও নিজেদের রা’গ নিয়ন্ত্রণ করার মতো ক্ষমতা মেয়েদের থাকে যেটা অনেকসময় ছেলেদের থাকে না।
উর্মিকে ছোট থেকেই লক্ষ্য করেছে রাবেয়া। উর্মির মধ্যে নিজের স্বভাব খুঁজে পেয়েছে অনেকবার।যেমন অল্প কথা বলা,শান্ত নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করা,ঝা’মেলা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করা,ছোট ছেলেমেয়েদেরকে পড়ানোর ইচ্ছা। তাছাড়াও উর্মি যথেষ্ট বুঝদার বুদ্ধিমতী বলেই রাবেয়ার ধারণা।একটা মা-ই সন্তানকে ভালোভাবে চিনতে পারে,বুঝতে পারে।রাবেয়াও পেরেছে।
তাই নিজের জীবনে এই উ’ত্থান পত’নের গল্প মেয়েকে আগেই জানিয়েছে।যেনো মেয়ে তার জীবন থেকে শিক্ষা নিতে পারে। উর্মি সবটাই বুঝেছে।ক’ষ্টে চোখের পানি পড়েছে বাবা, ভাই,মায়ের অতীতের গল্প শুনে।
নিজের জীবনের সব ঘটে যাওয়া ঘটনা মনে পড়ে গেলো আজ রাবেয়া বেগমের।সেই সহজ সরল রাবেয়া বেগমকে পরিস্থিতি একজন সাহসী নারীতে রূপান্তর করেছে। সেই সহজ সরল রাবেয়া আজ ব্যক্তিত্ববান বুদ্ধিমতী একজন স্ত্রী, একজন মা।
দরজা লাগানোর আওয়াজে নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে রাবেয়া। আশফাক সাহেব এসেছে।মুখে এক চিলতে শান্তির হাসি। বিছানায় বসে আশফাক সাহেব রাবেয়াকে বলে_
“আজ মনে হচ্ছে, বুক থেকে অনেক বড়ো পাথর সরে গেলো।”
স্বামীর কথা হাসে রাবেয়া, হাসিমুখেই আশফাক সাহেবের পাশে বসে। নিঃশব্দে স্বামীর বুকে মাথা রাখে।স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আশফাক সাহেব বলেন_
“অনেক বছর পর শান্তির ঘুম হবে আজ। এবার শুধু তোমাকে আর আমাদের ছেলেমেয়ে দুটোকে নিয়ে সুখে শান্তিতে বাকি জীবনটা কা’টিয়ে দিতে চাই।আর কিছু চাওয়ার নেই।”
চলবে…
(আজকের পর্ব শুধুই রাবেয়াময়।)