অবশেষে বৃষ্টি পর্ব ৯+১০

0
505

#অবশেষে_বৃষ্টি
পর্ব ৯
#নীলাভ্র_নেহাল
.
আকাশে তারার মেলা। দখিনা বাতাস বইছে। শিরশিরে হাওয়া শরীরে দোলা দিয়ে চলে যাচ্ছে। বেলকুনিতে বসে ইয়ারফোনে গান শুনছিলো পৃথা। আর আনমনে ভাবছিলো সায়ানের কথা। ছেলেটা অনেক হ্যান্ডসাম, বড়লোক, ছাত্র হিসেবেও ভালো। এ ধরণের ছেলেরা সাধারণত খুব সহজে কারো প্রেমে পড়ে না। মাঝেমাঝে নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হয় পৃথার। এক র‍্যাগিং এর সূত্রেই তার সাথে পরিচয়, অতঃপর সম্পর্ক গড়িয়ে চললো প্রণয়ের দিকে। আবার মাঝেমাঝে বুকের ভেতর অচেনা ভয় দানা বাঁধে। সবকিছুকে সাজানো নাটক মনে হয়, মিথ্যে মনে হয়। সেই ভয়ে কখনো কখনো ঘুম আসে না পৃথার।

গত দুদিন সায়ানের সাথে কথা খুব কম হয়েছে। তবে যা হয়েছে সেটা যথেষ্ট ছিল। দুজন দুজনের প্রতি এক ধরণের টান অনুভব করছে। গানের সুরের সাথে কোথাও হারিয়ে যাচ্ছিল পৃথা। এমন সময় সায়ানের নাম্বার থেকে কল।

পৃথা ফোন রিসিভ করে বলল, হ্যালো।
সায়ান সুরে সুরে গেয়ে উঠলো,
রংধনু ভালো লাগে, নীলাকাশ ভালো লাগে,
ভালো লাগে মেঘে ডাকা চাঁদ,
তারচেয়েও ভালো লাগে তারার মুখোমুখি জেগে থাকা সেই রাত..
বন্ধু তোমায় মনে পড়ে, বন্ধু তোমায় মনে পড়ে..

গান থামালে পৃথা বললো, ভালোই তো গাচ্ছিলেন। থামলেন কেন? আরেকটু শুনান না।
– নাহ, আর শুনাবো না। কি করছো?
– বেলকুনিতে বসে আছি। এই রাতের সাথে গানটা একদম মিলে গেছে।
– বেলকুনির পাশে রাস্তা আছে?
– হ্যাঁ।
– রাস্তার লোকজন দেখছো না তো?
– না।
– তোমাদের বাড়ির নাম্বার যেন কত? ১৩?
– হ্যাঁ। কেন?
– পাশেই তো মেইন রোড। নিশ্চয়ই রাস্তা দিয়ে যাওয়া ছেলেদের দেখছ।
– আমার ওসব দেখার অভ্যেস নেই বুঝেছেন?
– আচ্ছা। আমি তোমাকে একটু পরে কল দিই? মা ডাকছে তো।
– আচ্ছা।

ফোন রেখে দিলো সায়ান। পৃথা কিছুক্ষণ আগে সায়ানের গাওয়া গানটা শুনতে লাগলো। মিনিট দশেক পরে হঠাৎ চোখ ঘুরাতেই অবাক হয়ে দেখে রাস্তায় সায়ান দাঁড়িয়ে। চোখ বড়বড় হয়ে গেলো পৃথার। ও বিস্ময়ে কথা বলতে পারলো না।

সায়ান ইশারায় বলল, কি?
পৃথা কল দিয়ে বললো, আপনি এখানে কিভাবে এলেন?
– রাস্তা ফাঁকা ছিল। দ্রুত চলে এলাম।
– পাগল! আপনি না বললেন মা ডাকছে?
– তুমি যাতে বুঝতে না পারো তাই বলেছি।

পৃথা মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল। সায়ান বলল, মাথায় হাত দিও না কন্যা। চিন্তায় শুকিয়ে যাবে।
– আপনি চলে যান। খালা দেখে ফেললে সমস্যা হবে।
– নিচে নামতে পারবে না?
– অসম্ভব। আমি চাইনা খালা কোনোভাবে বুঝে ফেলুক আমি কারো সাথে কথা বলি।

সায়ান হাসতে হাসতে বাইকে উঠে বাইক স্টার্ট দিলো। পৃথার বুক ধুকপুক করছে। সায়ান বাইক চালাতে লাগল আর গান শোনাতে লাগল পৃথাকে। রাতটা আরো মধুর হয়ে উঠলো দুজনার।


ভার্সিটিতে এসে পৃথা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে সায়ানকে খুঁজছিল। ফোন দিতে ইচ্ছে করছে না।

এমন সময় পিছন থেকে কারো কন্ঠ শোনা গেল, সায়ানকে খুঁজছো নিশ্চয়ই?
পৃথা পিছনে ঘুরে দেখে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। এর আগে কখনো মেয়েটাকে দেখেনি ও। কোনো উত্তর না দিয়্র অবাক হয়ে চেয়ে রইলো ও। মেয়েটা বললো, আমাকে তুমি চিনবে না। তোমার ভালোর জন্য কয়েকটা কথা বলতে এসেছি।
– বলুন। কিন্তু আপনার পরিচয়টা কি দেয়া যাবে না?
– সেটা জানতে পারবে। তুমি কি সায়ানকে ভালোবাসো?
– আপনাকে কেন বলবো সেটা?
– কারণ আমি তোমার ভালোর জন্যই কথাগুলো বলতে এসেছি। আমার সাথে এসো।

মেয়েটা পৃথাকে দূরে একটা নির্জন জায়গায় নিয়ে গেলো। তারপর বললো, শোনো। আমি জানিনা সায়ানের সাথে তোমার সম্পর্ক কতদূর গড়িয়েছে। তবে যতদূর গড়াক, এখনই সেটা শেষ করে দাও। সায়ান বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে তোমার সাথে প্রেম করছে।

পৃথা অবাক হয়ে বলল, কিহ!
– হ্যাঁ। ওর বন্ধুরা সবাই গোপন রেখেছে কথাগুলো। ওদের একটা মেসেঞ্জার গ্রুপ আছে যেটাতে আমি এড আছি। সেখানে কথা হয় তোমাকে নিয়ে। আমি যতদুর জানি তুমি অনেক ইনোসেন্ট একটা মেয়ে। তোমাকে ঠকতে দিতে চাই না।
পৃথার চোখ গরম হতে শুরু করেছে। কথাগুলো বিশ্বাস হতেই চাইছে না। সায়ান এমন হতে পারে না। কিন্তু এই মেয়েটাকে দেখেও মনে হচ্ছে না সে মিথ্যে বলছে। ও স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারলো না।

মেয়েটা বলল, সায়ানের সাথে অর্পার খুব ক্লোজ রিলেশন। যদিও ওরা স্বীকার করে না ওরা একে অপরের সাথে এত ইন্টিমেট। কিন্তু ঠিকই একসাথে শোয়া শুয়ি, ফোন সেক্স সবই করে।

পৃথার মাথায় আগুন ধরে যাচ্ছে। ও মেয়েটার চোখে চোখ রেখে বললো, আপনি সত্যি বলছেন তার প্রমাণ কি?
– এই দেখো।
মেয়েটা গ্যালারিতে কিছু ছবি বের করে দেখালো। ছবিতে সায়ান খালি গায়ে শুয়ে আছে, সাথে শুয়ে আছে অর্পা। অর্পার চোখেমুখে আবেদন। অর্পা জড়িয়ে রেখেছে সায়ানকে। সায়ানের মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে খুব আনন্দিত। এত ক্লোজ হয়ে দুজনে একই চাদরে শুয়ে আছে যা দেখে নিজের চোখকেই অবিশ্বাস্য লাগছিল পৃথার। হতে পারে মেয়েটা মিথ্যে বলছে কিন্তু সায়ান এভাবে অর্পার সাথে শুয়ে আছে এটা তো মিথ্যে হতে পারে না।

মেয়েটা ফোনের মেসেঞ্জারে ঢুকে অর্পার সাথে হওয়া চ্যাট পৃথাকে দেখাতে লাগল৷ সেখানে অর্পা বলছে, জানিস সায়ান ইদানিং ওই গাইয়া মেয়েটার সাথে বেশি মেলামেশা করছে। আমার সহ্য হচ্ছে না। যদিও বাজি করে করছে, তবুও ওর ভাগ কাউকে দিতে পারি না আমি।
মেয়েটার রিপ্লাই ছিল, ভাবিস না। ও তো তোকেই লাভ করে।

অর্পা রিপ্লাই দিয়েছে, হুম। ১১ তারিখ রাত বারোটায় আমার বাসায় ছুটে এসেছে উইশ করতে। পাগল একটা।

পৃথা চিন্তায় পড়ে গেলো। ১১ তারিখ রাতে ও সায়ানের ফোনের জন্য অপেক্ষা করছিল। সায়ান অনেক দেরি করে ফোন দিয়ে বলেছিল বন্ধুদের সাথে বাইরে ছিলাম। এত বড় মিথ্যে!

মেয়েটা আরো উপরে গিয়ে মেসেজগুলো দেখাতে লাগলো। দুদিন আগে অর্পা মেসেজ দিয়েছে, আজ আমি আর সায়ান খুব মাস্তি করলাম। বৃষ্টিতে ভিজে ওর বাসায় গিয়েছিলাম। আমাকে ছাড়তেই চাইছিলো না।

এই মেসেজ দেখার পর নিজেকে ধরে রাখা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিল পৃথার জন্য। সায়ান বৃষ্টির দিন বলেছিলো ওর ছেলে ফ্রেন্ড এসেছিল। তাই পুরোটা বিকেল ওকে অনলাইনে পাওয়া যায় নি। কিন্তু সেদিন আসলে অর্পার সাথে.. ছিঃছিঃ

পৃথার বুক ফেটে কান্না আসতে চাইছে। কাকে বিশ্বাস করেছিল ও! ওইদিন রাতে নিশ্চয়ই সায়ান বুদ্ধি করে জিয়ানের বাসায় যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। রাতে বারবার ফোন দিয়ে হয়তো কোনো সুযোগ চাইছিল। ভাগ্যিস পৃথা রিসিভ করেনি। যে ছেলেটা বাইকে বারাবার ব্রেক কষে যাতে শরীরের সাথে শরীর ধাক্কা লাগে, সে ছেলেটা কিভাবে মুহুর্তেই ভালো হয়ে যায়! এটাই ছিল সায়ানের আসল রূপ! খুব কষ্ট হচ্ছে। অচেনা এক মায়া জন্মেছিল ওর প্রতি। খুব আপন ভাবতে শুরু করেছিল পৃথা। ভালোবাসতেও শুরু করেছিল। এভাবে সবকিছু মিথ্যে হয়ে যাবে এটা ভাবতেও পারছে না ও।

মেয়েটা ফোন ঘেঁটে আরেকটা চ্যাট বক্সে ঢুকে দেখাতে লাগলো মেসেজ গুলো। পৃথার দেখতে একদমই ইচ্ছে করছিল না। মেয়েটা জোরে জোরে পড়ে শোনাতে লাগল, সায়েমের মেসেজ ছিল এরকম, বাজি ধরে অবশেষে প্রেমটা করেই ফেললি? তাও একটা গাইয়া মেয়ের সাথে?
সোহানী রিপ্লাই দিয়েছে, ওর ভার্জিন লাগবে তাই। মেয়েটা ওর কাছে সিগারেট ফ্লেভারের চুমু চাইছে। কিউট না?
দিলরুবা লিখেছে, ড্যাম কিউট। গ্রামের হলেও টাটকা সবজি।

পৃথা চেঁচিয়ে বলল, চুপ করুন আপনি। আর একটাও না। যথেষ্ট হয়েছে। আপনাদের শহরটাই খারাপ, এখানে কোনো মানুষ বাস করে না। সবাই একেকটা কীট, জানোয়ার।

কাঁদতে কাঁদতে ছুটে চলে গেলো পৃথা। সায়ানের অভিনয়টার জন্য যতটা খারাপ লাগছে, তারচেয়ে বেশি খারাপ লেগেছে ওর বন্ধুদের করা অপমানগুলো। ওরা এভাবে ওকে নিয়ে হাসাহাসি করে! ছিঃ

ভীষণ কষ্ট হচ্ছে পৃথার। ক্লাসে যেতে পারলো না ও। সোজা বাইরে বেরিয়ে এলো। উবার ডাকার জন্য ফোন বের করে দেখে সায়ানের নাম্বার থেকে কল এসেছিল। ওর ইচ্ছে করছিল ফোনটা আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলতে। উবার চলে এলে গাড়িতে উঠে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
গাড়ির ড্রাইভার অবাক চোখে মিররের দিকে তাকাচ্ছে। বুঝতে পেরে পৃথা চোখ মুছে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। আবারও সায়ানের নাম্বার থেকে কল আসলে ফোন বন্ধ করে রেখে দিলো ব্যাগে।
বাসায় ফিরে অনেক্ষণ শাওয়ারের নিচে বসে রইলো। পানি ছেড়ে দিয়ে কাঁদছে হাউমাউ করে। বাইরে বেরিয়ে এসে মাকে ফোন দিয়ে বলল, মা, আমি বাসায় আসবো। আমার এখানে ভালো লাগছে না।
– তোর বাবা গিয়ে নিয়ে আসবে? কবে আসতে চাস?
– আজই। বাবাকে লাগবে না। খালাকে বলো আমাকে বাসে তুলে দিতে। বাবাকে বলে দিও আমাকে স্টেশন থেকে নিয়ে যেতে।
বেশি কথা বলতে পারলো না পৃথা। অপমানজনক কথাগুলো বারবার কানে ভাসছে ওর। আর একমুহূর্ত এই শহরে থাকতে চায় না ও।
যেই পৃথা কখনো একা কোথাও যাওয়ার সাহস করেনি, কষ্ট সহ্য করতে না পেরে সে একাই শহর থেকে গ্রামে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। এই শহর অনেক নিষ্ঠুরতা করেছে ওর সাথে। আর কখনো এ শহরে পা দিতে চায় না ও।

চলবে..

#অবশেষে_বৃষ্টি
পর্ব ১০
#নীলাভ্র_নেহাল
.
পৃথা অনেক আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মেয়ে। কখনো কোনো অন্যায় ওর উপর চাপিয়ে দেয়া হলে মুখ বুজে সহ্য করবার মত মেয়ে সে নয়। আত্মমর্যাদাশীল হলেও অনেক আবেগী ও সরল মনের। মানুষকে দ্রুত বিশ্বাস করে ফেলে। আর ভালোবাসা কিংবা প্রেমের স্পর্শ ওর জীবনে আসার জন্য হাত বাড়ালেও পৃথা কাউকে গ্রহণ করার কথা ভাবে নি। ওর একটাই টার্গেট ছিল, ভার্সিটি জীবন শুরু করার আগে কখনো প্রেমের সম্পর্কে জড়াবে না। ভার্সিটিতে পা দেবার আগে থেকেই মন উড়ুউড়ু করে উঠত, মনে হত আর কদিন পরেই স্বপ্নের জায়গায় পা রাখতে যাচ্ছে। মনকে মুক্ত পাখির মত খাঁচা ছাড়া করে দিবে, মন তার আপন গতিতে চলুক তাতে ওর দ্বিধা থাকবে না। অন্তত এই বয়সে এসে ভুল গুলো করবে না, এই আত্মবিশ্বাস ওর ছিল। তবুও একটা ভুল করে আরো ভুলের পথে পা বাড়াচ্ছিল সেটা ভেবেই কষ্ট হচ্ছে পৃথার।

মেয়েদের আঠারো বছর বয়সটা বড়ই বিপদজনক। এ বয়সে ধুপ করে এরা যে কারো প্রেমে পড়ে যেতে পারে। সারাজীবন মনকে শক্ত করে খাঁচায় বন্দি করে রাখা মেয়েটাও হুট করে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। মন হয়ে যায় চির অচেনা। নিজের মনকে নিজেও চেনে না, মন আপন কথা শোনে না। হয়তো পৃথারও একই দশা হয়েছিল। ভালোবাসবে না, বাসবে না করেও সায়ানের সাথে যে গভীরতার সূত্র ঘটেছিল, তাতে মনের অর্ধেকটাই হয়তো ওর কাছে পড়ে আছে। আর নিজের অজান্তেই ওর প্রতি কতটা দূর্বলতা জন্মে গেছে পৃথা নিজেও তা টের পায় নি।

বাড়িতে পৌঁছে ‘মা, মা’ বলে ডাকতে লাগল পৃথা। মা কাজে ব্যস্ত ছিলেন। চিন্তিত ছিলেন পৃথার কি হয়েছে সেটা নিয়ে। উনি ভেবেই পাচ্ছেন না এত দ্রুত সময়ের মধ্যে পৃথার কি হতে পারে। মাত্র কদিন তো হলো শহরে যাওয়ার। তাছাড়া দুদিন আগেও তো বান্ধবীর বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলো। তবে কি এমন হলো হঠাৎ! মেয়েটাও বড় আবেগী। এখনো অবুঝ, হয়তো কারো বকা খেয়ে আর থাকবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পৃথার ডাক শুনে কাজ ফেলে ছুটে এলেন। পৃথা মায়ের মুখ দেখামাত্রই নস্টালজিক হয়ে পড়লো। এই পৃথিবীতে একমাত্র মা – ই সবচেয়ে আপন, মাকে দেখলে বুকের ভেতর মুচড়ে ওঠে। মা, মা বলে দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ফেললো।
মা পৃথার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, কি হইছে তোর মা? কেউ কিছু বলেছে?
– মা গো, ও মা। তোমরা আমাকে এ কোথায় পাঠিয়েছিলে গো? আমি আর কখনো ওখানে যাবো না।
– আরে পাগলী আমাকে না বললে তো বুঝবো না কি হয়েছে?
– মা, জানো আমি ভয়ানক এক ফাঁদে পা দিয়েছিলাম। আমাকে মাফ করো আম্মু, আমাকে মাফ করো তুমি।

মা অবাক হয়ে মেয়ের দিকে চেয়ে রইলেন। কি বলে শান্তনা দেবেন তাও বুঝতে পারছেন না। উনি তো জানেনই না মেয়ের কি হয়েছে।

পৃথা চোখ মুছতে মুছতে বললো, তোমাকে পরে সব বলবো। আগে আব্বুকে দেখবো আম্মু। আব্বু কোথায়? আব্বু কি আমার উপর রেগে আছে?
– রেগে থাকবে কেন?
– আজ আমাকে একটু আদর করে গোসল করিয়ে দিবে আম্মু? মনেহচ্ছে আমি যেন তোমার ছোট্ট সেই খুকি হয়ে গেছি। আমাকে আগের মত একটু আদর করো না গো।

পৃথার দুই চোখের উপর চুমু খেয়ে মা ওকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। তারপর হাতের ব্যাগটা নিয়ে পৃথাকে বাসার ভিতরে চলে গেলেন। মেয়ে যে খুব বড়সড় আঘাত পেয়েছে এটা বুঝতে পেরেছেন উনি।

পৃথাকে চুলে শ্যাম্পু করিয়ে দিয়ে, গা ঘষে দিয়ে গোসল করিয়ে দিলেন। পৃথা শিশুসুলভ আচরণ করছে। প্রতিটা মানুষের মাঝেই একজন শিশু লুকিয়ে আছে সেটা এখন মায়ের মনে হচ্ছে। কি সরল মেয়েটা, মায়ের বুকে গুটিশুটি মেরে লুকিয়ে থাকতে চাইছে। চোখ বন্ধ করলেই পৃথার মনে হচ্ছে সায়ান হাসছে, সায়ানের সেই কালো শার্ট পরে ওর সামনে বাইক থামিয়ে পিছন ফিরে তাকাচ্ছে। কত স্মৃতি যে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে ভেতরে।

স্মৃতি এমন একটা বিষয়, চাইলেও যেটাকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। স্মৃতির দরজা বন্ধ করার ও উপায় নেই। মনের ভেতর ঘুরপাক খেতেই থাকে। আর বিষিয়ে দেয় পুরো হৃদয় আর শরীর টাকে।

মা আজকে ভাত তুলে খাওয়ালেন পৃথাকে। খাওয়া দাওয়ার পর মায়ের কোলে মাথা রেখে বিছানায় শুয়ে রইলো ও। মা আস্তে আস্তে ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি মা?
– হুম।
– তুই কি কাউকে ভালোবাসিস?

পৃথা অনেক্ষণ চুপ করে রইলো। মা ধীরেসুস্থে ঠান্ডা মাথায় বললেন, দ্যাখ আমিও প্রেম করে বিয়ে করেছি৷ আমি তোর বন্ধুর মত, কখনো তো কোনোকিছু আমার কাছে লুকাস নি। কিছু হয়ে থাকলে আমাকে বল। মা তোকে সব’চে বেশি ভালোবাসে।
– আম্মু, আমার জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল কি জানো? আমি এই বিষয়টা তোমাকে লুকিয়ে গেছি। কেন লুকিয়েছি জানিনা। হয়তো প্রতিটা মেয়েরই এমন হয়।
– হুম। প্রেম ব্যাপারটা এমনই। বাবা মায়ের সাথে যতই ফ্রি হোক না কেন, প্রেমে পড়লে বা প্রেম হয়ে গেলে কোনো মেয়েই এটা কারো কাছে প্রকাশ করতে চায় না। এটা স্বাভাবিক।
– আম্মু, আমার উপর রাগ করবে না তো?
– করবো না। মাকে তুই চিনিস না?
– সেদিন আমি তোমাকে মিথ্যে বলেছিলাম। ঠিক বলিনি, তুমি যা বুঝেছিলে আসলে সেটা ভুল ছিল।
– মানে!
– সেদিন আমি বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে যাইনি।
– বন্ধুর সাথে গিয়েছিলি তাই তো?

পৃথা চুপ করে রইলো। অনেক্ষণ নিরব রইল ও। মায়ের মুখ নীল হয়ে উঠতে শুরু করেছে। মনেমনে ভয় পাচ্ছেন উনি। ভাবছেন নিশ্চয় ছেলে বন্ধুটা পৃথার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে পৃথাকে ছেড়ে দিয়েছেন। উনি শঙ্কায় নীল হয়ে বললেন, সবকিছু আমাকে খুলে বলবি? ছেলেটার সাথে তোর কি কি হয়েছে?
– মানে?
– গায়ে টায়ে হাত দিয়েছে? নাকি আরো বেশি কিছু?
– কি বলছো মা, সেরকম কিছুই নয়। তুমি যা ভাবছো তা একেবারেই নয় আম্মু।
– তাহলে কোনটা সত্যি? আমাকে খুলে বল? তুই এত ভেঙে পড়েছিস কেন?

পৃথা মায়ের হাত চেপে ধরে বললো, একটা ছেলে আমার পিছনে খুব ঘুরছিল। আমাকে নাকি খুব পছন্দ হয়েছে। পাগলের মত করছিল। ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়েছে মাত্র। কিন্তু কালকে শুনলাম, ও বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে আমার সাথে প্রেম করতে চেয়েছে।
– তাতে কি হয়েছে? তুই কাঁদছিস কেন?
– কারণ আমিও মনেহয় ওকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম।
– হুম বুঝলাম এতক্ষণে। এর জন্য বেশি ভেঙে পড়তে হবে? সবকিছু তো স্বাভাবিক হয়ে যাবে। মনকে শক্ত কর, দেখবি খুব সহজে ও মন থেকে দূরে সরে গেছে। এই সময়টা কাটিয়ে ওঠাটাই একটু কষ্টকর। এটা কাটিয়ে উঠলে, দেখবি কিছুদিন পর আর ওকে মনেই পরবে না।

পৃথা মায়ের হাত আরো শক্ত করে চেপে ধরলো। বলল, আমি জানি ওকে ভুলতে পারবো। কিন্তু মা আমাকে নিয়ে ওরা খুব হাসাহাসি করেছে, আমাকে অপমান করেছে। বলেছে আমি নাকি গাইয়া মেয়ে। ক্ষ্যাত মেয়ে। আমি আর ওখানে ফিরে যাবো না আম্মু।
– তোকে গাইয়া বলেছে? সেই ছেলেটা বলেছে?
– না। ওর বন্ধুরা বলেছে। ও চুপচাপ শুনেছে কোনো প্রতিবাদ করেনি।
– হুম।
– আরেকটা সত্য জেনেছি। ওকে একটা মেয়ের সাথে খুব ঘনিষ্ঠ হতে দেখেছি। ওদের শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে বোধহয়। ও হয়তো আমাকে ফাঁসিয়েও এসব করতে চেয়েছিল।
– তোর ভাগ্য ভালো আগেই এসব জেনে গেছিস। এ জন্য শুকরিয়া আদায় কর। এত ভেঙে পড়িস না। তুই তো ভালো আছিস সোনা মা আমার।

পৃথা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি সায়ানকে খুব বিশ্বাস করেছিলাম মা।
– মানুষকে এত সহজে বিশ্বাস করতে নেই।
– শহরের কাউকেই বিশ্বাস করতে নেই।
– এটা ভুল কথা। আমি কি শহরের নই? শুধুমাত্র তোর বাবাকে ভালোবেসে সবকিছু ছেড়ে এই গ্রামে চলে এসেছি। এখন গ্রামেই থাকছি। আমার বাবা, ভাই কেউই খারাপ নয়। শহরের সবাই খারাপ হয় না মা। জীবনে চলার পথে ভালো, খারাপ দুটোরই দেখা পাবি। আমাদেরকে বুঝতে হবে কোনটা আমাদের জন্য ভালো আর কোনটা খারাপ।
পৃথা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো আনমনে।

মা বললেন, তুই আর একদমই কাঁদবি না। আর যেন তোকে কাঁদতে না দেখি। তুই বসে বসে ভাব তোর এখন কি করা উচিৎ। ঠিক কোন কাজটা করলে তোর অপমানের জবাব দিতে পারবি, কি করলে সবার সামনে মাথা উঁচু করে চলতে পারবি। এর সমাধান তুই ই জানবি। ডিপার্টমেন্টে সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট তোকে করতে হবে। নিজেকে বদলে ফেলতে হবে। তুই কিভাবে নিজেকে বদলাবি এটা তুই নিজেই ঠিক কর। পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেয়া, নিজেকে খাপ খাইয়ে চলাটাই জীবন। আমি শহর থেকে এসে নিজেকে মানিয়ে নেইনি? ভার্সিটি থেকে এমবিএ শেষ করে কোনো জব না করে সংসার করছি। এটাকে বলে নিজেকে মানিয়ে নেয়া। তুই কেন পারবি না?

মা আরো বললেন, মেয়েদেরকে হতে হয় সাহসী, শক্তিশালী। এত সহজে ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়লে কিভাবে হবে? শক্ত হ। নিজেকে গড়ে তোল৷ তোকে যেভাবে কাঁদতে কাঁদতে শহর ছাড়া হতে হয়েছে, তার বদলা নে। নিজেকে আপন যোগ্যতায় দাঁড় করাতে হবে।

পৃথা অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো। মায়ের কথাগুলো ওর মনকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। নতুন করে অঙ্কুরিত হওয়ার মতন। এই মুহুর্তে এই কথাগুলোই ওর ভীষণ প্রয়োজন ছিলো। ওর হেরে যাওয়া বা জিতে যাওয়াতে কারোরই কিচ্ছু যাবে আসবে না। বিশেষ করে সায়ানের তো নয় ই। কিন্তু এতে করে নিজের কাছে নিজেকে ছোট হতে হচ্ছে, এ জিনিসটাই ভয়ঙ্কর। মানুষের মস্তিষ্ক বড়ই আজব জিনিস, এটা কুড়ে কুড়ে যন্ত্রণা দিতে থাকে।

মা বললেন, তুই ভার্সিটিতে যাবি। আমরা পয়সা খরচ করে তোকে সেখানে পড়তে পাঠিয়েছি। তুই পড়াশোনা শিখবি, আমাদের স্বপ্ন পূরণ করবি। তোকে মানুষ করতে পাঠিয়েছি, প্রেম করতে পাঠাই নি।

হঠাৎ করেই মায়ের কথাগুলো খুব কঠিন মনে হচ্ছে পৃথার কাছে। ও অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকালো।

মা বললেন, সবাই শহরে গেলে প্রেম করে বেড়ায়। নতুন স্বাধীনতা পেলে যাচ্ছেতাই করে বেড়ায়। বাবা মাকে না জানিয়ে এখানে সেখানে যায়, প্রেমিকের সাথে ঘুরতে যায়। রাত কাটায়। পরে আঘাত পেলে বলে জীবন শেষ, ডিপ্রেশন, হতাশা হেন তেন। কেন রে? তোমাদেরকে কেউ কি বলেছিল এসব আজেবাজে কাজ করে বেড়াতে? বাবা মা কি এজন্যই সন্তানকে শিক্ষালয়ে পাঠায়? উচ্চশিক্ষার জন্য? উচ্চশিক্ষার নামে তোমরা প্রেম শিক্ষা করে বেড়াও? কিভাবে মিথ্যে বলা যাবে, কিভাবে টাকা হাতানো যাবে, কিভাবে অন্যের জীবন নষ্ট করা যাবে। এসব কি বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখানো হয়?

পৃথা অবাক হয়ে মাথা নিচু করে রইল। মা কাছে এসে বললেন, মন খারাপ হচ্ছে? হোক। মন খারাপ না হলে তো নিজেকে শোধরাতে পারবে না। একই ভুল আবারও করে বসবে। স্বপ্নকে মূল্যায়ন করতে শিখো। আমি তোমাকে হার্ট করার জন্য কিছু বলছি না। একজন মায়ের মত কথা বলছি। যা বলছি, মাথায় থাকে যেন।

মা চলে গেলেন ঘর থেকে। পৃথা স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। চোখের পলক ফেলছে আর প্রতি পলকে পলকে জোরে জোরে হৃদস্পন্দন হচ্ছে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here