অবশেষে বৃষ্টি পর্ব ১৯+২০

0
438

#অবশেষে_বৃষ্টি
পর্ব ১৯
#নীলাভ্র_নেহাল
.
সায়ান মেয়েটার ডাকে সাড়া না দিয়ে পৃথার দিকে ই চেয়ে রইলো। সায়ানের চেহারায় অদ্ভুত পরিবর্তন এসেছে। আগে ওকে দেখতে যেমন টিন এজ মনে হতো, এখন আর সেটা মনে হচ্ছে না। গড়নে একটা ভাড়িক্কি ভাব এসেছে। কাঁধ প্রশস্ত হয়েছে, চোয়াল শক্ত হয়েছে। পূর্ণ যৌবন প্রাপ্ত এক যুবক! পৃথা চোখ ফেরাতে পারলো না।
মেয়েটা সায়ানের পিছনে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলো, বাবা ফোন করেছিল। কথা বলতে চেয়েছে।
সায়ান পৃথার দিকে তাকিয়ে বিভ্রান্তিকর হাসি দিয়ে মেয়েটাকে বলল, বাহ এই ড্রেসে তোমাকে দারুণ দেখাচ্ছে তো!
– থ্যাংকস ডিয়ার।
– তুমি রুমে যাও, আমি একটু পরে আসছি।
মেয়েটা দুলতে দুলতে রুমের দিকে চলে গেলো। পৃথার কপালে ভাঁজ পড়ল। এতদিন পর দেখা হলো তাও এভাবে হবে এটা ভাবতে পারেনি ও। সায়ান বিয়ে করে ফেলেছে! সায়ানের জন্য কোনো স্মৃতি বুকে জমা নেই। কোনোদিনো সায়ানকে ভেবে রাতে কষ্টও হয়না। তবুও কেন জানি ওর স্ত্রীকে দেখে মেনে নিতে খারাপ লাগছে পৃথার। এটাকে জেলাস বলে কিনা পৃথার জানা নেই। ও দ্রুত রুমে চলে এলো। মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে। অবন্তি বলল আমরা বাইরে হাঁটতে যাবো। সূর্যাস্ত দেখবো।

বলামাত্রই #পৃথা ঘর থেকে বের হতে হতে বলল, এখনই যাবো। হঠাৎ পৃথার মেজাজ খারাপের কারণ বুঝতে পারলো না ওরা।

হ্যালিপ্যাডে সূর্যাস্ত দেখতে অনেকে জড়ো হয়েছে। সামনে বিশাল পাহাড়ের মেলা, পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে উড়ছে মেঘ। মেঘেদের দল একদিক থেকে আরেকদিকে ছুটে চলেছে। কোথাও আবার মেঘেরা দলবেঁধে আটকে রয়েছে। সূর্যের আলো লেগে কিছু মেঘ লালচে রঙের দেখাচ্ছে। অবন্তির মন খারাপ কিছুক্ষণের জন্য দূর হয়ে গেল এখানে এসে।
পৃথা দূরে একলা এক জায়গায় বসে আছে। মেঘের ভেলা দেখছে। বেশিরভাগ ট্যুরিস্ট ই কাপল। কেউ এসেছে প্রেমিকা নিয়ে আবার কেউ এসেছে স্ত্রী নিয়ে। সবার মনে কত আনন্দ। অথচ পৃথা এসেছে বান্ধবীর ডিপ্রেশন কাটাতে। অবন্তির সেই প্রেমিকও এখন নেই, আর নেই সেই প্রেমের দিনগুলোও। ও হয়তো এখানে এসে স্মৃতিচারণ করছে। সায়ানকে স্ত্রীর সাথে দেখার পর পৃথার মনে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। কোনো একটা জিনিস ভেতরে ভেতরে যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। সে মেয়ে নিয়ে সুখে দিন কাটাচ্ছে অথচ পৃথা এখনো সিঙ্গেল, হতে পারে সেই যন্ত্রণা।

মাথা ঘুরাতেই সায়ানকে দেখতে পেল পৃথা। সায়ান একলা দাঁড়িয়ে আছে। ওর বউকে খুঁজছে পৃথা। পেলো না। কিছুক্ষণ পরেই দেখল মেয়েটা ছবি তোলার বায়না নিয়ে সায়ানের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। পৃথা চোখ ফিরিয়ে নিলো।

রাতে হোটেলে খাবার খাওয়ার সময় পাশের টেবিলে সায়ান বসল। সাথে সেই মেয়েটা, টেবিলে আরো কয়েকজন ছেলে মেয়ে আছে। ওদেরকে পৃথা চেনেনা। হতে পারে সায়ানের বন্ধু। তার আবার বন্ধু বান্ধবীর অভাব নেই। পৃথা মাথা নিচু করে খাবার খেয়ে যেতে লাগল।

রাত্রিবেলা অবন্তির গলাফাটানো কান্নার শব্দে একটুও শান্তির উপায় ছিল না। এই রিসোর্টে এসে ও শান্তিপূর্ণ অনেক সময় কাটিয়েছে সে সবের কথা বলে আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছে। পৃথা অনেক্ক্ষণ ওকে স্বান্তনা দেয়ার পরও ওর কোনো ভাবান্তর হল না। ঘর থেকে বেরিয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পৃথা কটেজের ভেতরের দিকের দূরের বারান্দায় গিয়ে বসে রইল। ঝিঁঝিঁর ডাকে চারিদিক সরব হয়ে উঠেছে। মন খারাপের সময়টাকে উপভোগ করছে ও।
বারান্দা থেকে উঠে আসার সময় পাশের বারান্দায় সায়ানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হল। সায়ান এখান থেকে ওর দিকে চেয়ে ছিল না তো? পৃথা নিজের বসার জায়গাটার দিকে একবার তাকাল। তারপর সায়ানের পাশে এসে দাঁড়াল।

সায়ানের কোনো ভাবান্তর হল না। পৃথা জিজ্ঞেস করলো, হানিমুনে এসেছেন?
সায়ান প্রথমে ভ্রু কুঁচকে তাকালো পৃথার দিকে। তারপর শব্দ করে হেসে উঠলো। ওর হাসির শব্দ ধ্বনিত হতে লাগলো চারিদিকে।

হাসি থামিয়ে বললো, ফাজলামো করছো? হানিমুন? হা হা হা।
– আপনার কি মনে হচ্ছে আমি ফাজলামো করছি?
– তো?
– আপনার স্ত্রীকে দেখলাম।
– ও মাই গড! আমি এখনো আমার স্ত্রীকে দেখতে পারলাম না আর তুমি দেখে ফেললে? তাকে এনে দাও না প্লিজ। এত সুন্দর রাতটা একা কাটাতে ইচ্ছে করছে না।
– আপনি বিয়ে করেননি?
– না। বিয়ে করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে না?
– তাহলে কি উনি গার্লফ্রেন্ড? নাকি…
– বিকেলে যাকে দেখেছো? ও আমার বড়বোন। দুলাভাই ও বোনের সাথে বেড়াতে এসেছি ডিয়ার।
– ওহ সরি সরি। ভুল ভেবেছিলাম। মাফ করবেন।
– উহুম, মাফ তো করা যাবে না। এত দিন পর এমন একটা জায়গায় এসে দেখা হয়ে যাবে এটা ভাবতেও পারিনি।
– আমিও ভাবতে পারিনি। কি করছেন আজকাল?
– বাবার ব্যবসায়ে জয়েন করিনি। পাশ করে বেরোবার পর নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান খুলেছি। বাবার কাছে টাকাও নেইনি, জমানো টাকা আর লোন নিয়ে করছি। আমি একজন উদ্যোক্তা।
– বাহ! শুনে ভালো লাগলো। শুভ কামনা রইলো।
– তোমার জন্যও।
দুজনেই নিশ্চুপ হয়ে যাওয়ার পরও পৃথা গেলো না। দাঁড়িয়ে রইল পাশে। সায়ান জিজ্ঞেস করলো, কেমন লাগছে সাজেক?
– অদ্ভুত সুন্দর। এত কাছে থেকে মেঘ আমি কখনোই দেখিনি। আমরা কত উপরে চলে এসেছি ভাবতেই পারছি না।
– পড়াশোনা শেষ?
– মাত্র ফাইনাল ইয়ার পরীক্ষা দিলাম। প্রত্যেকটা সেমিস্টারে আমি ফার্স্ট গার্ল ছিলাম। স্কলারশিপে পড়াশোনা চালিয়ে এসেছি।
– খুব ভালো। এখন কি করার ইচ্ছে আছে?
– প্রস্তুতি নিচ্ছি জবের জন্য। দেখা যাক কি হয়।
– উদ্যোক্তা হতে চাও না?
– কি ব্যবসা করবো বুঝে উঠতে পারি না।
– ব্যবসা করা আর উদ্যোক্তা হওয়া কিন্তু এক কথা নয়।

পৃথা কিছু বলল না। সায়ান উদ্যোক্তা হওয়ার উপকারিতা বুঝিয়ে বলতে লাগলো পৃথাকে। উদ্যোক্তা হওয়া মানে নিজের স্বপ্ন নিজে পূরণ করা। আর চাকরি করা মানে অন্যের স্বপ্ন পূরণ করা। অন্য কেউ যেভাবে আদেশ করবে সেভাবেই কাজ করা। জীবনটা যখন তোমার, রিস্ক নিয়ে হলেও নিজের মত করে কাজ করা উচিৎ ।নিজস্ব স্বপ্ন থাকা উচিৎ। চাকরির থেকে নিজে কিছু করাটা যেমন সম্মানের তেমনি আনন্দের। ছোট ছোট সফলতায় খুশি হওয়া যায়।

পৃথা বলল, আমি কখনো ব্যবসা নিয়ে ভাবিনি। যদিও নিজেই কিছু করতে চেয়েছি সবসময়। কিন্তু পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করবো এটাই ভাবতাম।
– হয়ত বড় কোনো চাকরি পেয়ে যাবে। কিন্তু ওই যে বললাম চাকরি করলে অন্যের স্বপ্ন পূরণে কাজ করতে হয়। এখানে নিজের কোনো চাওয়া পাওয়ার মূল্য থাকে না। নিজের ইচ্ছে মত কাজও করা যায় না।
– তা ঠিক বলেছেন।

সায়ান পৃথাকে দাঁড়াতে বলে রুমের দিকে চলে গেলো। ফিরে এলো কিছুক্ষণ পর। হাতে করে এনেছে দুটো বই। পৃথার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এ দুটো তুমি নিয়ে যাও। একটু পড়াশোনা করে দেখো উদ্যোক্তা ও চাকরির মধ্যে পার্থক্য। আশা করি তোমার সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে।

পৃথা কৌতুহলী হয়ে চেয়ে রইলো। নেবে কিনা ভাবছে। সায়ান বললো, দ্যাখো পৃথা। আমাদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আমরা প্রেমের সম্পর্কে জড়াতে গিয়েও জড়াইনি। আমি বিয়ে করতে চাইলেও তুমি করোনি। তারমানে এই নয় যে আমাদের মাঝে কোনো খারাপ সম্পর্ক ছিল। শেষ দেখা হবার আগ পর্যন্তও আমরা বন্ধুর মতই ছিলাম। তুমি ভুল বুঝেছিলে, আমি তোমার ভুল ভাঙিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আমাদের মধ্যে কোনো খারাপ কিছু হয়নি। ঝগড়া হয়নি, তর্ক হয়নি, মনোমালিন্য হয়নি। এমন নয় যে একজন আরেকজনের শত্রু। এমন নয় যে ব্রেকাপ হয়ে গেছে। প্রেমই হয়নি, যতদিন পাশে ছিলে লাইক এ ফ্রেন্ড। কাজেই আমার মনে হয় অযথা নিজেদের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি না করাই ভালো। এইযে দীর্ঘ বছর পর দেখা হল, ভালো করে দুটো কথা বললাম। একজন আরেকজনের খোঁজ খবর নিলাম। এর জন্য তো আমাদের কোনো ক্ষতি হয়ে যায়নি। তাইনা? অযথা মুখ ফিরিয়ে রেখে, চিনেও না চেনার ভান করে কি লাভ? দু একটা স্বাভাবিক কথাবার্তা বললে মনের ভেতর যন্ত্রণা থাকবে না। আমরা স্বাভাবিক থাকবো।

পৃথা মৃদু হেসে বলল, থ্যাংকস এত সুন্দর করে বলার জন্য। আমি আপনাকে ভুল বুঝেছিলাম, কিন্তু সেটা মাত্র কয়েকদিনের জন্য। তাছাড়া সবসময় আপনাকে রেস্পেক্ট করেই এসেছি। আপনি মানুষটা কখনো খারাপ ছিলেন না।
– তুমি আমাকে খারাপ ই ভাবতে।
– না না। সত্যি আমি এমন কখনো ভাবতাম না। যেটুকু ভেবেছিলাম সেটা ভুল বুঝে। যাইহোক, কোনো কারণ ছাড়াই একটা অজানা দেয়াল আমাদের মাঝে শিকড় গেড়ে উঠেছিল। তাই মনের মাঝে ক্ষোভ ছিল। সেটা দূর করে দেয়ার জন্য আবারও থ্যাংকস।
– ওয়েলকাম। বই দুটো নেবে? তোমার সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হবে। বুঝতে পারবে আমাদের কেন নিজেদেরকেই কিছু করা উচিৎ ।
– হুম।

পৃথা হেসে সায়ানের কাছে বই দুটো চেয়ে নিলো। তারপর ধন্যবাদ দিয়ে রুমে চলে এলো। সায়ানের প্রতি রাগ ছিল না, তবুও মনটা কেমন যেন বিষিয়ে ছিল। কোনো কারণ নেই তবুও সায়ানকে সহ্য হত না। অথচ মানুষটা অনেক ভালো। পৃথাকে সবসময় ভালোবাসা ছাড়া খারাপ ব্যবহার কখনো করেনি৷ ওর কথাগুলো শোনার পর মন থেকে একটা পাহাড় সরে গেছে। উফফ!

পৃথা রুমে এসে দেখে অবন্তি ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই ওকে আর ডাকল না। ফোনের আলো জ্বেলে একটা বই খুলে বসল। কিছুদূর পড়ার পর আনমনে বইটা বন্ধ করে রেখে দিলো। জানালা দিয়ে শিরশির করে বাতাস আসছে। এত স্নিগ্ধ এখানকার বাতাস! শরীর মন ফুরফুরে করে দিচ্ছে। হঠাৎ ই নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে পৃথার। সায়ান শুধু ভালো বাসতেই চেয়েছিল। কোনোদিনো পৃথাকে কষ্ট দেয়নি ও। অথচ সায়ানের সাথে কত খারাপ ব্যবহার করেছে পৃথা। সায়ানের বাবা মাকেও ফিরিয়ে দিয়েছে। সব খারাপ আচরণের জন্য কখনো ওকে সরি বলা হয়নি। আর কখনো দেখা নাও হতে পারে। কাল দেখা হলে একবার সরি বলতে হবে। মনে মনে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে শান্তি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল পৃথা।

খুব ভোরেই উঠতে হল সূর্যোদয় দেখার জন্য। তিন বান্ধবী সূর্যোদয় দেখার জন্য হ্যালিপ্যাডে এলো। সবাই যাচ্ছে কংলাকের দিকে। ওখানে সূর্যোদয় দেখবে। পাহাড়ের বুক চিড়ে সাদা মেঘের মাঝ থেকে সূর্য উঠবে। পৃথা আশেপাশে তাকালো। মানুষজন খুব একটা নেই।
তিনজনে হাঁটা শুরু করলো কংলাক পাড়ার দিকে। যাওয়ার পথে সায়ানের সাথে দেখা। পৃথা চেঁচিয়ে বলল, সায়ান!
সায়ান পৃথার দিকে তাকিয়ে হাসি দিলো। পৃথা বলল, আমরা কংলাক পাড়ায় যাচ্ছি।
– আমরাও যাচ্ছি।
অনেক লোক হাঁটছে কংলাকের দিকে। সায়ান দৌড়ে পৃথার কাছাকাছি চলে এলো। হাফাতে হাফাতে বলল, এখানকার সকালটা অনেক স্নিগ্ধ তাইনা?
– হ্যাঁ। আমি ভোর চারটা থেকে জানালায় বসে মেঘ দেখছিলাম।
– আমি এবার দেখিনি। আগে একবার এসে সারা রাত বাইরেই শুয়ে ছিলাম। হা হা হা।
– বাইরে শোয়া যায়?
– অফ কোর্স যায়। কেউ কিচ্ছু বলবে না। কটেজের বারান্দায় শুয়ে থাকতে পারবা।
– তাহলে আজকে শোবো।
– বাইরে শুলে মনে হবে তারা গুলো অনেক কাছে চলে এসেছে।
– তাই!
– হ্যাঁ। অনেক বড় বড় নক্ষত্র। কালো কুচকুচে একটা আকাশ।
– আকাশ বুঝি কালো হয়?
– হা হা হা।

দুজনে হাসতে হাসতে দ্রুত গতিতে হাঁটতে লাগলো। সূর্য ওঠার আগেই কংলাকে যেতে হবে।

চলবে..

#অবশেষে_বৃষ্টি
পর্ব ২০
#নীলাভ্র_নেহাল
.
কংলাক পাড়ার দিকে যেতে যেতে হাফিয়ে উঠেছিল সবাই। বেশ দ্রুত ছুটতে হচ্ছে। সূর্য ওঠার আগেই পৌঁছাতে হবে। তাহলে মেঘের ছোঁয়া পাওয়া যাবে। দেরি হয়ে গেলে আর মেঘ ছোঁয়া যাবে না। পৃথা বলল, রাতে একটা বইয়ের কিছু অংশ পড়েছি। ভীষণ ভালো লেগেছে আমার। ইন্সপায়ারড হয়েছি। এরকম একটা বইয়ের জন্য থ্যাংকস দিতেই হয়।
– দুটোই ভালো করে পড়ে দেখো। যে অংশটুকু প্রয়োজনীয় মনে হবে নোট করে রেখো।
– কিন্তু আমি কি বিজনেস করবো? কুটির শিল্প টাইপের কিছু?
– হ্যাঁ করতে পারো। আরো ভালো কোনো আইডিয়া পাবা আশা করি।
– ওকে।
কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় উঠে সবাই যখন হাফাচ্ছিল, পৃথা এদিক থেকে ওদিকে সমানে ছুটোছুটি করছিল আনন্দে। চারিদিকে এত মেঘ, এত মেঘ ভেসে আসছে, উড়ে যাচ্ছে। খুশিতে কান্না আসতে চাইছে।

কিছু মেঘ উড়ে এসে শরীর ছুঁয়ে চলে গেলো । চোখ বন্ধ করে সে সুখটুকু অনুভব করলো পৃথা। সায়ান বললো, কাছাকাছি একটা ঝরণা আছে। জংগলের ভিতরে। খুব গভীর জংগলে। পথটা অনেক দূর্গম। আমি একবার গিয়েছিলাম ওখানে। সেই দূর্গম পথ শেষ করে যখন ঝরণার দেখা পেয়েছি, কি যে আনন্দ হয়েছে তোমাকে বোঝাতে পারবো না।
– খুব কষ্ট হবে যেত?
– হ্যাঁ।
– আসার পথে রিসাং ঝরণায় গিয়েছিলাম। জানেন আমি এর আগে কখনো ঝরণা দেখিনি। কি যে ভালো লেগেছে ঝরণা টা।
– আমারও ঝরনায় গোসল করতে ভালো লাগে।
– তাহলে চলুন এখানকার ঝরণাটায় যাই।
– ওটা বেশ ভিতরে। খুব কষ্ট হবে। ভয়ংকর দূর্গম পথ।
– হোক না, এডভেঞ্চার হবে। আমি আজীবন বইতেই পড়েছি এসব এডভেঞ্চারের কথা। কখনো যাই নি।
– আচ্ছা আমি দেখি আমার ফ্রেন্ড সার্কেল যেতে চায় কিনা।
পৃথা আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইলো। সায়ানের দলের ছেলেরা প্রথমে যেতে চায়নি, পরে ওরা রাজি হলো। পৃথার বন্ধুরা কেউ যাবে না। ওরা কটেজে ফিরে যেতে চায়। অবশেষে পৃথা একাই সায়ান ও ওর বন্ধুদের সাথে ঝরণায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।

পাহাড় থেকে নেমে এসে অন্য একটা পাহাড়ের ভিতর দিয়ে ঢুকতে হলো। ভিতরে ঢুকতেই ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে কান ঝালাপালা হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। পৃথার অবশ্য ভালোই লাগছে।
ঝিরিপথ দিয়ে হেঁটে যেতে হয় ঝরণার দিকে। ঝিরিপথের ভিতর ঘন অন্ধকার। গা ছমছম করা একটা ভাব। ও সায়ানের পিছু পিছু এগোচ্ছিল। এতগুলো ছেলের সাথে পৃথা একা। এখনো সায়ানের প্রতি ওর অগাধ বিশ্বাস। সায়ান ওর কোনো ক্ষতি করবে না এই বিশ্বাসটুকু শিরায় উপশিরায় উপস্থিত। সেই বিশ্বাসের জোরেই এতদিন পরও সায়ানের সাথে জংগলে ঢুকতে ভয় করছে না পৃথার।

যত ভিতরে যাচ্ছে পথের দুর্গমতা ততই বাড়ছে। পায়ের নিচে আটকে যাচ্ছে কাঁটা ও শ্যাওলা। কোথাও কোথাও আবার পিচ্ছল। একবার পা পিছলে পড়েই যাচ্ছিল পৃথা। চেঁচিয়ে উঠেছিল বলে সায়ান খপ করে ওর হাত ধরে ফেলেছে। এরপর আর হাত ছাড়েনি। সায়ানের হাত ধরে পৃথা ঝিরিপথের ভেতর দিয়ে এগোচ্ছে। পৃথার হাতের নরম স্পর্শ পেয়েও সায়ানের ভাবান্তর নেই। সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ ই নেই ওর। ও কেবল এডভেঞ্চার উপভোগ করছে। আর পৃথা সায়ানের উষ্ণ হাতের স্পর্শে আরো বেশি শিহরিত হয়ে উঠেছে। গাছের গন্ধ, পাহাড়ের গন্ধ, শ্যাওলা, ঝিঁঝিঁর ডাক, পথের দূর্গমতা সবকিছুকে ছাড়িয়ে সায়ানের উষ্ণতাকেই বেশি ভালো লাগছে। ইচ্ছে করেই আরো শক্ত করে হাত ধরলো।

সায়ানের সেদিকে মনোযোগ নেই। পথ হাঁটছে খুব দেখেশুনে। কাঁটা সরিয়ে ভেতরের দিকে নিজেও হাঁটছে আর পৃথাকেও নিয়ে যাচ্ছে। কখনো সরু পথে দুজনকে খুব কাছাকাছি চলে আসতে হয়। আবার কখনো পৃথার হাত টেনে ধরে সাবধানে নিয়ে যাওয়া। সায়ান বারবার একটা শব্দই উচ্চারণ করছে, এই সাবধানে এসো। পৃথা একটু সাবধানে পা ফেলো, এখানে কাটা আছে, এখানে পাথর। একটু দেখেশুনে..

এই সাবধানী বাণীগুলো পৃথার মন ছুঁয়ে যাচ্ছিল। সায়ানকে কতই না ভুল বুঝেছিল ও। অথচ কত সুন্দর একটা মানুষ!

অনেক এডভেঞ্চার পাড়ি দিয়ে অবশেষে ঝরণার দেখা মিললো। সায়ান ঝরণার নিচে দাঁড়িয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ভিজতে লাগলো। পৃথা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর দেখছে ওর পাগলামি। ঝরণা থেকে সরে এসে সায়ান বলল, তুমি ভিজছো না কেন? ভয় করছে?
– না।
– তাহলে? আসো আমার সাথে।

হাত বাড়িয়ে দিলো সায়ান। পৃথা সেই হাত ধরে সায়ানের সাথে ঝরণার নিচে গিয়ে দাঁড়াল। শীতল জলে স্নান করতে করতে মনের সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যাচ্ছিল। কি যে আনন্দ লাগছিল! পৃথা চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিলো। লাফাতে গিয়ে পরে যাচ্ছিল প্রায়। সায়ান এক টানে নিজের কাছে টেনে নিল। সায়ানের বুকের উপর এসে পড়ল পৃথা। ঝরণার জল মাথার উপর সজোরে আঘাত করছিল। জলের ভিতরেই একে অপরের দিকে তাকালো। কত দিন পর চোখাচোখি! ভাবতেই কেমন যেন লাগছে। জলের ধারা অনেক প্রবল। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা গেলো না। সরে এলো পৃথা।

ফেরার সময় সায়ান ওর গলার তোয়ালে পৃথার গায়ের উপর জড়িয়ে দিলো। তারপর বলল, সাবধানে পা ফেলবে পৃথা। খুব সতর্ক ওকে?
– ওকে বাবা।

এবার পৃথাকে ধরতে হল না। ও একা একাই হাঁটছে বেশ। সায়ান বারবার পিছনে ফিরে তাকায় আর পৃথাকে বলে এখানে গর্ত, একটু দেখে পা ফেলো। কখনো বলে এখানে পাথর, আবার পা কেটে যাবে। এত কেয়ার করা দেখে পৃথার সুখের মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। কেউ কেয়ার করলে বুঝি এত আনন্দ লাগে, এটা ওর জানা ছিল না। মনেমনে প্রবল খুশির জোয়াল উঠেছে যেন।

ফেরার পথটা তারাতারিই শেষ হয়ে গেলো। কটেজে ঢোকার সময় পৃথা সায়ানের তোয়ালে এগিয়ে দিচ্ছিল, সায়ান বাঁধা দিয়ে বলল, নিয়ে যাও।

ঘরে ঢুকতেই অবন্তি জিজ্ঞেস করলো, তুই চেনা নেই জানা নেই ওই ছেলের সাথে কিভাবে গেলি বলতো? তখন জিজ্ঞেস করলাম কাউকে চিনিস কিনা? বললি তোর পরিচিত। তুই কিভাবে চিনিস ওদেরকে?
– সব’চে হ্যান্ডসাম ছেলেটা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো।
– ওহ আচ্ছা।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে অবন্তি আবার জিজ্ঞেস করলো, সবচেয়ে হ্যান্ডসাম বলার কারণ?
পৃথা উত্তরে হাসল। কেন ও এটা বলেছে নিজেও বুঝতে পারছে না। হয়তো সায়ানকে সবার চেয়ে আলাদা বোঝাতে। তাতে ওর কি লাভ তাও বুঝতে পারছে না৷ তবে কথাটা বলতে পেরে ভালো লাগছে।

পৃথা শাওয়ার নিতে নিতে আপনমনেই হাসছিল। এই কাঠের ঘরেও এত আধুনিক বাথরুম যিনি বানিয়েছেন তাকে ধন্যবাদ জানানো উচিৎ।

পৃথা গোসল সেরে বেরিয়ে এলে অবন্তি বলল, আমরা কাল সকালেই চলে যাবো।
পৃথা চমকে উঠে বলল, না। আমরা আরো অনেকদিন থাকবো।
– অনেকদিন?
– হ্যাঁ। যতদিন আমার থেকে যেতে ইচ্ছে করবে ততদিন। হা হা হা।
অট্টহাসি হাসতে হাসতে পৃথা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অবন্তি কেবলই অবাক হচ্ছে। এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন পৃথা! কি হল মেয়েটার!

১৪
রাত্রিবেলা কটেজের খোলা বারান্দায় পা মেলে দিয়ে বসে রইলো পৃথা। আজ মনটা ভীষণ ফুরফুরে। বিগত অনেকগুলো দিন এতটা ফুরফুরে মন কখনো ছিলো না। গুণগুণ করে গান গাইছিল ও। বাকি দুই বান্ধবী ঘরেই আছে। ওরা বুঝতে চেষ্টা করছে পৃথার আচমকা পরিবর্তনের কারণ কি?

কটেজের খোলা বারান্দা। শিরশির করে হাওয়া আসছে। কি যে শান্তি লাগছে!
সায়ান চলে এলো কিছুক্ষণের মধ্যেই। পৃথা জানত সায়ান আসবে। না এসে থাকতে পারবে না। সায়ান এসে পাশে বসলে #পৃথা বলল, আজ আকাশে অনেক তারা।
– গুণছিলে নাকি?
– না। আপনি আসলে একসাথে গুণবো বলে অপেক্ষা করছিলাম।

সায়ান মুচকি হাসল। পাঁচ মিনিট সময় চেয়ে চলে গেলো কটেজের ভেতরে। ফিরে এলো দু কাপ কফি হাতে। একটা কাপ পৃথার দিকে এগিয়ে দিয়ে পাশে বসে পড়লো। রাতের নির্জনতা বেড়ে চলেছে। সায়ান খালি গলায় গান ধরলো। পৃথা হাত তালি দিচ্ছিল। গান গাইতে গাইতে অন্য এক জগতে বিচরণ করছিল দুজনে। বেশিরভাগ সময়েই দুজনে নিশ্চুপ থাকে৷ যখন কথা বলে তখন প্রকৃতি, পাহাড়, আকাশ এসব নিয়েই কথা হয়।

এক ফাঁকে সায়ান জিজ্ঞেস করলো, প্রেম করছো না?
– আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে?
– করছো। খুব রোমান্টিক লাগে তোমাকে আজকাল।
– আমাকে রোমান্টিক লাগে?
– তোমার মুডটাকে আরকি। রোমান্টিক মনে হয়।
– হা হা। নাহ, এতগুলো বছর একাই আছি। আমার প্রেমের সময় হয়নি।
– সময় কি আদৌ হবে? আমার মনেহয় কখনো হবে না। আজীবন কেউ কেউ সিঙ্গেল ই কাটিয়ে দেয়।
– হয়তো বা নয়। আমার জীবনের একটা অংশে গিয়ে আমিও প্রেমে পড়বো। কারো কেয়ারের, কারো আদরের, শাসনের।
– এসব দেখে কেউ প্রেমে পড়ে না। কারণ প্রেম করার আগে এসব পাওয়া যায় না। প্রেমে পড়ার পর এসব পায়।
– আমি যদি আমার বরের থেকে এসব পেতে চাই? তবে তো সম্ভব।
– হুম তা সম্ভব। কিন্তু বর হবার সুযোগ ও তো কাউকে দিতে চাও না। বললাম না কেউ কেউ আজীবন সিঙ্গেল থাকতে চায়।

পৃথা উত্তরে কিছু বলতে পারলো না। খানিকটা সময় চুপ করে থেকে বলল, আপনি প্রেম করছেন নিশ্চয়?
– সেটা করলে আর তোমার সাথে বসে গল্প করতাম না নিশ্চয়?
– কেন? প্রেম করলে কি অন্য কারো সাথে গল্প করা যায় না?
– আমি অন্তত করতাম না। আমার কাছে প্রেমিকাই সব হত। একমাত্র সে ছাড়া আর কাউকে পাত্তা দেয়ার মত সময় আমার নেই।
– সব সময় তাকেই দিতেন?
– অবশ্যই। তাকে নিয়েই এখানে আসতাম। পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে তাকে মেঘ ছোঁয়াতাম। দুজনে মেঘ গায়ে মাখতাম একসাথে।

পৃথা চোখ বন্ধ করে ফেলল। কল্পনায় দেখতে পাচ্ছে কেউ একজন ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে আছে। আর ও কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ মেঘ এসে ছুঁয়ে দিয়ে গেলো দুজনকে। একটা শীতল অনুভূতি। হালকা তুলোর মত মেঘ। কি অদ্ভুত সুন্দর! পৃথা পিছন দিকে পড়ে যাবেই হয়তো, পিছনে থাকা মানুষ টার বুকের উপর হেলান দিয়ে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখবে, মেঘ দেখবে। আর মানুষটা পৃথার চুলের গন্ধ শুকবে। কত সুন্দর ই না হতো!

সায়ান বললো, আমার একটা স্বপ্ন আছে। কি জানো? আমি আমার লাইফ পার্টনারকে নিয়ে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াতে চাই। পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য দেখে ফেলতে চাই। যেভাবে আমার বাবা মা এখন দেখছেন, ঘুরছেন। পৃথিবীটা কতই না সুন্দর। একসাথে পাহাড়ে যাবো, সমুদ্রে যাবো, মেঘের দেশে যাবো, কখনো বা হারিয়ে যাবো নদীর মোহনায়। ভিজবো ঝরণা ধারায়। হাতে হাত রেখে চাঁদনী রাতে সমুদ্র তীর ধরে হাঁটবো। কেমন হবে বলো তো?
পৃথা অবাক হয়ে বললো, আপনার স্বপ্নটা সুন্দর।
– এটা হয়তো খুব বড় পাওয়া নয়, আবার বড় পাওয়া। এছাড়া আমার আর জীবনে কিচ্ছু চাওয়ার নেই। বড় হওয়ার তীব্র ইচ্ছাও নেই, টাকা পয়সা দিয়ে পাহাড় বানাবার ইচ্ছাও নেই। আমি শুধু সময়কে উপভোগ করতে চাই। কারণ সময়কে আমরা ধরে রাখতে পারবো না।

পৃথা মুগ্ধ হয়ে সায়ানের কথা শুনছে। এত সুন্দর করে কাউকে কখনো বলতে শোনেনি ও। কারো স্বপ্ন এত সুন্দর ও হতে পারে!

সায়ান বলতেই থাকলো, জীবনটা অনেক ছোট। উপভোগ করার জন্য সময় খুব কম। তবে যতটুকু পেয়েছি ততটুকুই যদি উপভোগ করি তাতেও একটা সুন্দর লাইফ লিড করা সম্ভব। অবশ্য মানুষ টাকেও মনের মত হতে হবে। এমন একটা মানুষ সবসময় খুঁজে বেড়ালাম… হন্য হয়ে খুঁজলাম।

পৃথা মনেমনে বলল, এমন একটা মানুষ কে না চায়! আমিও তো মনেমনে এমন একটা মানুষ ই সবসময় চেয়েছি হয়তো। হয়তোবা স্বপ্ন দেখেছি, কখনো নিজের মনকেও বুঝতে দেইনি আমি কাউকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি।
– কি ভাবছো?
– না কিছু না।
– বলো?
– ভাবছি, এরকম একটা মানুষ হয়তো সবাই চায়।
– সবাই চায় না পৃথা। সবাই চায় না।

পৃথার বুকটা কেমন যেন করে উঠলো। মনে হলো সায়ান ওকে উদ্দেশ্য করেই কথাটা বললো। সবাই চায় না! সহস্র গাঁথা দুঃখ মিশে আছে এই কথায়।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here