অবশেষে বৃষ্টি পর্ব ১৭+১৮

0
446

#অবশেষে_বৃষ্টি
পর্ব ১৭
#নীলাভ্র_নেহাল
.
সকালবেলা আবির কানের কাছে এসে চায়ের কাপে পিরিচ বাজিয়ে টিং টিং শব্দ করছে। ঘুম ভেঙে চোখ মেলে পৃথা তারাহুরো করে উঠে বসে। আবির বলল, গুড মর্নিং। বেড টি এসে গেছে।
পৃথা দেখলো ট্রে তে করে অনেকগুলো চায়ের কাপ নিয়ে যাচ্ছে আবির। ও হেসে বলল, চা বিলি করা দায়িত্ব কি আপনাকে দেয়া হয়েছে?
– আমি ই নিয়েছি। আমার আম্মুদের হেল্প করতে ভালো লাগে।
– আম্মুদের বলতে? কতগুলো আম্মু আপনার?
– হা হা হা। মায়ের বয়সী চাচী খালাদের মিন করছি আরকি। চা টাও কিন্তু আমি বানিয়েছি।
– তাই নাকি? তাহলে তো খেয়ে দেখতেই হয়।
পৃথা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, উমম অসাধারণ। লোভ লাগিয়ে দিলেন ভাই। এখন থেকে তো আপনার কাছে চা খাওয়ার বায়না ধরবো।
– তা ধরতে পারেন। আমি আজীবন বানিয়ে খাওয়াতে প্রস্তুত হা হা হা।
– যে কয়দিন এখানে আছি আরকি।
– আপনি চাইলেও পরেও খাওয়াতে পারি। মাঝেমাঝে চা খাওয়ার দাওয়াত দিবো বাসায়। আমি আবার কাউকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়াতে বড্ড ভালোবাসি।
– কাউ মানে তো গরু। আমি ফিমেল ওকে?
– হা হা হা।
শব্দ করে হাসতে লাগল আবির। অবন্তি ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে বলল, ভালোই তো হাসির মেলা বসেছে দেখছি। এত হাসি কোথায় পেলে?
পৃথা বলল, চায়ের কাপে রে ভাই। তোর ভাই যা চা বানিয়েছে না! এনিওয়ে, থ্যাংকস ফর দ্যা ম্যাজিক্যাল টি।
– ওয়াও, ম্যাজিক্যাল! তা ম্যাজিকে কি কাজ হয়েছে শুনি?
– উমমম, আপনার জন্য পাত্রী দেখে দিতে পারি।
– পাত্রী! ওটা আমি নিজেই জোগাড় করে নিবো ম্যাডাম।

পৃথা আর কিছু বললো না। চায়ের কাপে চুমুক দিলো। আবির বলল, চুমুতেই শান্তি। আহ!

পৃথা চোখ বড়বড় করে তাকাল। আবির বলল, মানে চায়ের কাপে চুমুতে শান্তি। হা হা হা।

পৃথা প্রথমে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেও পরে হেসে ফেলল। আবির ট্রে হাতে বেরিয়ে গেলো এই ঘর থেকে অন্য ঘরে। অবন্তি বলল, আবির ভাইয়া খুব ভালো মানুষ জানিস? অসহায় মানুষ দেরকে ভীষণ হেল্প করে।
– তাই”
– হ্যাঁ। কেউ যদি এসে ওর কাছে সাহায্য চায়, প্রয়োজনে অফিসে না গিয়ে তার কাজ করে দেবে। পকেটে যা থাকবে বের করে দেবে।
– বাহ! এরকম মানুষ আছে সত্যি!
– হ্যাঁ। ভাইয়ার আরেকটা ভালো গুণ হচ্ছে ও সব কাজে মাকে হেল্প করে। এই যে চা বানিয়েছে না? দেখবি এখানে বেড়াতে এসেও রুম ঝাড়ু দেবে, মাকে জিজ্ঞেস করবে কোন কাজে হেল্প লাগবে কি না।

পৃথা কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে থেকে চায়ের কাপে চুমুক দিলো। মনেমনে ভাবল, এরকম একটা মানুষকে ভালো না লেগে উপায় নেই। হুট করে প্রেমে পড়ে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমার তো এখন প্রেমে পড়া বারণ। আগে নিজের স্বপ্ন পূরণ। অতদিন নিজের লক্ষ্যে স্থির থাকবে নাকি দূরে সরে যাবে সেটা নিয়ে ভয় হয় পৃথার। তবুও নিজেকে শক্ত রাখার প্রচেষ্টা। পাগলামি করলে হবে না।

অবন্তির বড় বোনের সাথেও বেশ ভাব হয়ে গেলো পৃথার। আপু অনেক ভালো মনের আর মিশুক। অবন্তির মত অত বেশি কথা বলে না, তবে গল্প করতে জানে। পৃথার সময় খুব ভালোই যাচ্ছে এখন।

বিকেলে নাচের রিহার্সাল হচ্ছিল। পৃথাকেও নাচের পার্ট দেয়া হয়েছে। প্রথমে সে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। অবন্তি আর ওর বোনের জোরাজুরিতে রাজি হয়েছে। অবন্তি ও পৃথা একসাথে নাচবে। ওদের নাচের প্রাকটিসের মাঝখানে অবন্তি আবির ভাইয়াকে টেনে নিয়ে আসল। বলল ভাইয়াকেও পারফর্ম করতে হবে। ভাইয়া বলছে সে নিজের মত করে নাচবে। পৃথা বলছে, আমাদের কারো সাথে ডুয়েট ডান্স দিতে হবে। চাপে পরে আবির ভাইয়া রাজি হয়ে গেল। আবির ভাইয়া ও অবন্তি একসাথে প্রাকটিস করলো নাচের। নাচ শেষ করে এসে পৃথাকে জিজ্ঞেস করলো ,কেমন নাচলাম?
– নট ব্যাড। ভালোই লাগল।
– ভালো নাচতে পারবো মনে হচ্ছে?
– হুম। তবে চায়ের মত ভালো হবে না। হা হা।
– চা খাওয়ার ধান্ধা নাকি?
– যদি কষ্ট না হয়, তবে এখন না। সন্ধ্যায়।
– ওকে। যদি চুলা ফাঁকা পাই আরকি। হা হা।

আবির ভাইয়া রসিক মানুষ। কথায় কথায় হাসিয়ে ছাড়েন আবার নিজেও হাসেন। ওনার মুখটাই হাসি হাসি। পৃথা বলল, আপনি কোথায় থাকেন?
– চিটাগাং।
– একা?
– হুম। মা চেষ্টা করছে খুব শীঘ্রই আমাকে দোকলা বানানোর।
– আমিও করতে পারি। আরেক কাপ চা খাওয়ালে। ওহ সরি, আপনি তো আবার নিজের পাত্রী নিজেই খুঁজে নেবেন।
– সেটাই ইচ্ছে। এতদিন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, তারপর প্রাকটিস নিয়ে, তারপর জব নিয়ে। এখন সবকিছু সেটেলড, এবার মন দিয়ে শুধু পাত্রী ই খুঁজবো।
– বেস্ট অফ লাক। কেমন পাত্রী পছন্দ?
– হলেই হল একটা।
– হা হা। হলেই হল?
– হুম। আবার শুধু বউ দরকার। তবে একটা কথা, আমার বউ যেন আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। আর আমি তাকে সবচেয়ে বেশি ভালো রাখবো।
– বাহ! দেখি খোঁজ করে। আমার পরিচিত ভালো পাত্রী আছে।
– থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ।

আবির হাসছে। #পৃথাও হাসছে। সন্ধ্যাবেলা আবির চা বানিয়ে আনল পৃথার জন্য। এবার বানিয়েছে মালাই চা। চায়ের রংটা দারুণ, আর খেতেও ভীষণ টেস্ট হয়েছে। পৃথা হেসে বলল, আপনি কি চিটাগং ও রান্না করে খান?
– জ্বি।
– তাহলে তো আপনার বউ সোনায় সোহাগা।
– তা তো অবশ্যই। মেয়েরা একজন ভালো ছেলের সাথে একটা ভালো ক্যারিয়ার, ভালো বেতন, ভালো ফ্যামিলি সবই খোঁজে। অথচ মুখে বলে ছেলে ভালো হলেই হল।
– আপনার তো সবই আছে। ভালো চেহারাও। হা হা।
– চেহারা?
– অবশ্যই। আপনি যথেষ্ট হ্যান্ডসাম। একটা বোন থাকলে দিয়ে দিতাম।
– ওহ মাই গড! মিস করলাম।

পৃথা চা খেতে খেতে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। কি অদ্ভুত সুন্দর চা! এমন একটা মানুষ হলে রোজ চা বানিয়ে খাওয়াত, সব কাজে হেল্প করত। কতই না ভালো হত! কিন্তু…

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল পৃথা। আবির চায়ের কাপ নিয়ে চলে গেলো। অন্যান্য ছেলের মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এক্সট্রা কথা বলার স্বভাব ওর নেই। পৃথা বারবার মুগ্ধ হচ্ছে ওর প্রতি।

রাত্রিবেলা অবন্তি ফোনে কথা বলতে বলতে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখ নিয়ে বসে রইল। পৃথা জানতে চাইল কি সমস্যা? অবন্তি বলল নির্ঝর বাসায় আসতে চাইছে। ওর নাকি ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে। এত লোকজনের মধ্যে ওকে কিভাবে নিয়ে আসবো?
– লোকজনের মধ্যে আসলেই তো কেউ বুঝতে পারবে না। বাইরে দেখা করবি। আর আংকেল আন্টিও এখন ব্যস্ত।
– ও আমার রুমে আসতে চায়।
– কেন?
– বুঝিস না? একটু হাগ করবে না? একটা ছোট্ট কিসি দেবে না?
– তোদের যা প্রেম রে। আমাকে জ্বালাচ্ছিস না?
– কি আর করবো বল। ও যখন আমাকে দেখতে চায় আমারও ওকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করে।

পৃথা কিছুক্ষণ ভেবে বলল ওকে আসতে বল। আমি পাহারা দেবো। তবে বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না, বড়জোর দশ মিনিট।
– ওকে ওকে। থ্যাংক ইউ রে। ওকে এক্ষুনি বলছি।

অবন্তি আনন্দে উচ্ছল। পৃথার দেখতে ভালো লাগছে। একটা মানুষ প্রিয়জনকে দেখার জন্য, একবার জড়িয়ে ধরার জন্য কত ব্যকুল হতে পারে। হায়রে প্রেম!

নির্ঝরের সাথে পরিচিত হল পৃথা। তারপর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইল ওদেরকে রুমে রেখে। বন্ধু হয়ে এইটুকু দায়িত্ব তো পালন করতেই হবে। দশ মিনিটের জায়গায় বিশ মিনিট পেরিয়ে গেলো, এখনও দরজা খোলার নাম নেই। কেউ রুমের দিকে আসলে পৃথা বলে, অবন্তি চেঞ্জ করছে। ভেতরে যাওয়া যাবে না। এভাবেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করছে ও।

নির্ঝর চলে গেলে পৃথা রুমে দেখে অবন্তি কে কেমন যেন দেখাচ্ছে। ও অবাক হয়ে বলল, ইউ লুক ডিফারেন্ট।
– ও আমাকে অনেক আদর করেছে।
– কিরকম?
– অ… নে…ক।

অবন্তি বালিশ জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইলো। পৃথার কেমন যেন লাগছে। ও ছাদে চলে গেলো। কিছুক্ষণ মশার কামড়ে দাঁড়িয়ে রইল। খানিক হাঁটাহাঁটি করল। মন খারাপ লাগছে। কেন যে লাগছে নিজেও বুঝতে পারছে না। কি হল হঠাৎ করে!

আবির ভাইয়া হঠাৎ এসে জিজ্ঞেস করলো, কিছু হয়েছে?
– না তো।
– একা দাঁড়িয়ে?
– এমনি।
– অবন্তি বলল আপনি ছাদে তাই এলাম। এই নিন চা।
– আবারো বানিয়েছেন? আপনি তো মশাই নেশা ধরিয়ে দেবেন।
– হা হা।

চা খাওয়ার পর আবির কিছুক্ষণ গল্প করে চলে গেলো। পৃথা অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চেয়ে রইলো। এতক্ষণ ভালো লাগলেও এখন আর ভালো লাগছে না। আবারও মন খারাপটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কেন এমন হচ্ছে কে জানে!

রুমে এসে চুপচাপ শুয়ে পরল বিছানায়। অবন্তি জিজ্ঞেস করলো, কি রে এতক্ষণ ছাদে ছিলি যে?
– এমনি।

অবন্তি নানান কথা বলার চেষ্টা করল। শুনতে ভালো লাগছে না পৃথার। ও নিশ্চুপ হয়ে রইলো। অবন্তি অনেক্ষণ পর বুঝতে পেরে বলল, তোর কি মন খারাপ?
– না রে।
– এমন লাগছে কেন? এত চুপচাপ? কি হয়েছে বলতো?
– কিছু না।

অবন্তি পৃথার হাত ধরলে পৃথা ওকে জড়িয়ে ধরলো। পৃথাকে দেখে মনে হচ্ছে ও খুব কষ্ট পাচ্ছে। অবন্তি আবার জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে তোর?
– তোকে একটা কথা বলবো মন খারাপ করবি না তো?
– না। বল?
– তোরা কি আজকে সেক্স করেছিস?
অবন্তি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, হ্যাঁ। অল্প কিছু সময়। নির্ঝর থাকতে পারছিল না তাই ছুটে এসেছে।
– কিন্তু..
– কি?

পৃথা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। এতক্ষণ মনের ভেতর যা চলছিল বলেই ফেললো, অবন্তি। বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্ক করা কি ঠিক? নির্ঝর ভালো ছেলে বুঝলাম ।কিন্তু তোদে যে কখনো ব্রেক আপ হবেনা এমন নিশ্চয়তা আছে? কিংবা ও যে তোকেই বিয়ে করবে এমন গ্যারান্টি কে দেবে? এভাবে নিজেকে ধীরেধীরে শেষ করে দিচ্ছিস না? যদি কখনো তোরা আলাদা হয়ে যাস, পারবি অন্য কাউকে বিয়ে করতে? পারবি কাউকে তোর শরীরের সাথে মিশতে দিতে? পারবি না। সবসময় নির্ঝরের শরীরেও গন্ধ, স্বাদ তোকে তাড়া করে বেড়াবে। ধুকে ধুকে মরবি। এসব আর করিস না প্লিজ। আমার ভালো লাগছে না ব্যাপারটা।

অবন্তি কথা বলছে না। শান্ত হয়ে আছে। অন্ধকার রুমে পৃথা দেখতে পারছে না। দেখতে পারছে না সেই অদ্ভুত দৃশ্য, অবন্তির টলমলে চোখ।

চলবে..
#অবশেষে_বৃষ্টি
পর্ব ১৮
#নীলাভ্র_নেহাল
.
পৃথা অবন্তিকে জড়িয়ে ধরে বললো, ভালোবাসা মানে পাশে থাকা, একজন আরেকজনের আত্মার সাথে মিশে যাওয়া। যে ছেলে থাকতে পারেনা বলে প্রেমিকার বাসায় এসে শারীরিক চাহিদা মেটায় সেটাকে কেমন ভালোবাসা বলে? আমি জানি তোর শুনতে খারাপ লাগছে। কিন্তু এটাই কঠিন বাস্তবতা অবন্তি। প্লিজ একবার বিবেক দিয়ে ভেবে দ্যাখ। নির্ঝর তোকে আসলেই কতটা ফিল করে? কতটা চায় ও তোকে? বিয়ের প্রেশার আসলে কি পালিয়ে যাবে নাকি বিয়ে করবে?

অবন্তি বলল, ও বিয়ে করবে আমাকে। ও অনেক ভালো রে।
– আমি জানিনা কেমন ভালো। যদি বিয়ে করতে অসম্মতি জানায়। বা মনটা কখনো চেঞ্জ হয়ে যায়। তখন তুই কি করবি? এভাবে লাইফ টাকে শেষ করে দিস না।

অবন্তি কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলল, আমি চেষ্টা করবো। আর যেন এরকম না হয়।
– থ্যাংক ইউ অবন্তি। আমি তোকে খুব ভালোবাসি তাই তোর ভালোর জন্যই বললাম। যেটা ভালো লাগেনা সেটাকে জোর করে ভালো লাগাতে পারিনা আমি। তোর কাছে এসব শুনে আমার খুব খারাপ লাগছিল।
– বুঝতে পারছি । এজন্যই তোর মন খারাপ সেই তখন থেকে। আর এমন করবো না লক্ষিটি। আর মন খারাপ করিস না।

অবন্তিকে জাপটে ধরে পৃথা। তারপর সুখের গল্প করতে লাগল। রাত যত গভীর হতে লাগল, দুজনের গল্পও তত মধুর হয়ে জমতে লাগল৷ ঘড়ির কাটায় দুটো বাজলে ঘুমিয়ে পড়ল দুজনে।

পরেরদিন যথারীতি চায়ের কাপে টুংটাং আওয়াজ করে পৃথার ঘুম ভাঙিয়ে দিলো আবির। পৃথা চোখ মেলতে মেলতে ধড়মড় করে উঠে বসল। আবির হেসে বলক, সুপ্রভাত।
– আজকেও হাজির হয়েছেন?
– হ্যাঁ। এই নিন আপনার বেড টি। গরম গরম পান করে নিন। আমি আসছি।

বাড়ির মেহমান বেড়ে গেছে। লোকে গিজগিজ করছে আজ। আজকে নাচের ফাইনাল প্রাকটিস করা হবে। নাচের সময় আবির পৃথাকে জিজ্ঞেস করলো, আমার সাথে নাচতে আপত্তি আছে আপনার?

পৃথা কোনো উত্তর দিলো না। আবির আর কিছু বলল না ওকে।
রাত্রিবেলা ছাদে দাঁড়িয়ে আছে পৃথা। আবির এসে চায়ের কাপ হাতে দিয়ে বলল, নিন খান। পৃথা চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, আজকের রাতটা অনেক সুন্দর তাইনা?
– হ্যাঁ। রাত আমার অনেক ভালোলাগে। উপভোগ করুন, রাতের একটা মোহময়ী সৌন্দর্য আছে।
– আপনি বই পড়তে পছন্দ করেন?
– আমার প্যাশন। স্টাডি লাইফ তো বই নিয়েই কেটেছে।
– তাই নাকি?
– হ্যাঁ।
– আজকের চায়ে চিনি বেশি কেন?
– হয়তো আজকে মায়াটা বেশি পরে গেছে।
– মানে?

আবির মুচকি হাসলো। পৃথা চা শেষ করে চায়ের কাপ এগিয়ে দিলো, আবির চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে কাছে এসে বলল, আপনার ঘুমন্ত চেহারাটা খুব বেশি মায়াবী। ঘুম ভাঙাতেই ইচ্ছে করছিল না। মনে হচ্ছিল এ ঘুম ভাঙালে পাপ হবে আমার। এই মায়াবী মুখের দিকে চেয়ে একটা জীবন পার করে দেয়া যায়।

পৃথা অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। আবির কাপ হাতে চলে গেলো ছাদ থেকে। ছেলেটা প্রেমে পড়ে যাচ্ছে না তো? এই ভয়টাই তো পাচ্ছিল পৃথা। আবার যদি প্রপোজ করে বসে! এরকম একজন মানুষ কে এড়িয়ে যাওয়াটা দুঃসাধ্য ব্যাপার। যে কেউ রাজি হয়ে যাবে। কিন্তু না, পৃথাকে এত সহজে ভাংলে চলবে না। মজবুত হতে হবে, অনেক মজবুত।

১৩
আজ গায়ে হলুদ। মেয়েরা সবাই হলুদ রঙের শাড়ি পরেছে। শাড়ি আর গাদা ফুলের রঙে সকলেই রাঙা। নাচে ,গানে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে বিয়ে বাড়ি। পৃথা আবিরের চোখের দিকে ভুল করেও তাকাচ্ছে না। কয়েকবার আবির সামনে এসে ঘুরঘুর করছিল। সেদিকে পাত্তা দিচ্ছিল না পৃথা।
গায়ে হলুদের রাতে সবাই যখন ক্লান্ত। যে যার মত বিশ্রাম নিচ্ছে। পৃথা বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে নিচে তাকিয়ে দেখে একটা মেয়ে একটা ছেলের সাথে প্রচুর হাসছে আর হাত ধরে রেখেছে। আহা কি প্রেম! চারিদিকে শুধু প্রেম আর প্রেম।
বেলকুনি থেকে পিছন ফিরেছে এমন সময় মুখোমুখি আবির এসে দাঁড়াল। না চাইতেও চোখাচোখি হয়ে গেলো আবিরের সাথে। এত কাছ থেকে কারো চোখের দিকে তাকায়নি পৃথা। এমনকি সায়ানের দিকেও না। পৃথার বুক ঢিপঢিপ করতে শুরু করলো। আবির বলল, আপনাকে আজকে ভীষণ সুন্দর লাগছিল। মায়াপরির মত।
– এটা বলার জন্য এখানে এসেছেন?
– না। মানে খুঁজছিলাম, পাচ্ছিলাম না আরকি।
– ওহ আচ্ছা। কেন খুঁজছিলেন?
– এমনি।

পৃথা হেসে বলল, এবার তাহলে যান।
– যেতেই হবে?
– থাকার কোনো অপশন নেই।
– অপশন তৈরি করতে চাইলে কি আমার পাপ হবে?
– হতেও পারে।
– পার্মানেন্ট অপশন যদি তৈরি করতে চাই?
– চেষ্টা করে দেখতে পারেন। আগেভাগে কিছু বলা যাচ্ছে না।

পরেরদিন সকাল থেকে সকলে বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলো। পৃথাও জামাকাপড় সবকিছু গুছিয়ে রাখছিল। এমন সময় এক মেয়ে এসে বলল তার মা ডাকছে। পৃথা বাইরে এসে দেখে একজন মায়ের বয়সী মহিলা। ও সালাম দিয়ে হাসিমুখে জানতে চাইলো, বলুন?
– আমার পাশে বসো মা।

পৃথা মহিলার পাশে বসে পড়লো। উনি পৃথার হাত ধরে বললেন ,তোমার নাম কি মা?
– পৃথা।
– আমি আবিরের মা। আবিরকে চেনো?
– জ্বি আন্টি। আবির ভাইয়া।
– হ্যাঁ। আমার ছেলেটা ভীষণ ভালো ছেলে রে মা। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত। সব ক্লাসে বৃত্তি পেয়েছে। কখনো কোনো মেয়ে সংক্রান্ত ঝামেলা ওর নেই। আমাকে সবসময় হেল্প করে। সব কাজে।
– শুনেছি আন্টি।
– তাহলে তো হলোই। স্যালারি পাচ্ছে আশি হাজার টাকা। নতুন জয়েন করেছে তো। তো মা, আমার ছেলেটা তোমাকে পছন্দ করেছে মাশাল্লাহ। কখনো মুখ ফুটে বলেনি কাউকে এসব কথা। তোমাকে প্রথম ভালো লেগেছে। তোমার যদি ওকে ভালোলাগে তাহলে বিয়ের ব্যাপারে আমি কথা বলতে চাই। তুমি কি এটা নিয়ে ভাব্বে?

পৃথা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। আন্টি বললেন, তোমার সমস্যা থাকলে বলতে পারো৷ তবে সবকিছুর আগে আমার ছেলেটার সাথে কথা বলো, মিশে দেখো।
– আন্টি আমি এখন কোনোভাবেই বিয়ে করবো না। আমার স্বপ্ন আছে, লক্ষ্য আছে। আগে স্বপ্ন পূরণ করবো তারপর সবকিছু আন্টি।
– ভেবে দেখো মা।
– আচ্ছা ভাব্বো। আসি আন্টি।

পৃথা অবন্তির রুমে এসে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে রইলো। মানব মন এত বিচিত্র কেন! অকারণে মন খারাপ লাগছে। এ মন খারাপের কি কোনো মানে হয়!

বিয়ের প্রোগ্রাম থেকে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেলো। বিছানায় গা এলিয়ে দেয়ামাত্র ঘুমে ঢলে পড়েছে পৃথা। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে দেখে অবন্তি গভীর ঘুমে মগ্ন। ও উঠে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। তারপর অবন্তিকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে ডেকে তুললো। চোখ কচলে অবন্তি জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে?
– সকালে যদি আবির ভাইয়া চা নিয়ে আসে রুমে ঢুকতে দিবি না৷ দরজা খুলে বলে দিবি পৃথা চা খাবে না।
– এটা বলার জন্য ঘুম ভাঙালি?
– মনে অশান্তি নিয়ে আমি ঘুমাতে পারি না।
– আজব!

পৃথা উল্টা পাশ হয়ে শুয়ে গেলো। ঘুমিয়েও পড়ল কিছুক্ষণের মধ্যেই। পরদিন সকালের নাস্তা করেই পৃথা বাসায় ফিরে এলো। বৌভাতে যাওয়ার আর কোনো প্রশ্নই আসে না।

১৪
ফাইনাল পরীক্ষা শেষ। পৃথা গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাবে। প্রস্তুতি নিচ্ছে বাড়িতে যাওয়ার জন্য। দু একদিনের মধ্যেই হয়তো চলে যাবে। হঠাৎ অবন্তির নাম্বার থেকে কল। পৃথা রিসিভ করে বলল, ফুচকা না খেলে তোর চলে না সে আমার জানা আছে। নিশ্চয় বলবি বাইরে যেতে? আমি ব্যাগ গুছাচ্ছি। যেতে পারবো না বাবু।
– পৃথা..
কেঁদে ফেলল অবন্তি। অবাক হয়ে পৃথা জানতে চাইলো, কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন তুই?
– নির্ঝর আমার সাথে ব্রেকাপ করে দিয়েছে।

হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো অবন্তি। পৃথা ওর কান্নার শব্দ সহ্য করতে পারছে না। ফোন রেখে দ্রুত অবন্তিদের বাসায় চলে এলো ও। অবন্তি পৃথাকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মত কাঁদতে লাগল।
পৃথা জানতে চাইছে কিভাবে এটা হল? অবন্তি কান্নার জন্য কিছু বলতেও পারছে না। তবে এতটুকু বলল যে নির্ঝরের অন্য একটা মেয়ের সাথে রিলেশন ছিল। সেই মেয়েটাকেই বিয়ে করেছে ও। গত দুদিন আগে বিয়ে হয়েছে। অবন্তির সাথে দুদিন ধরে যোগাযোগ নেই। অনেক চেষ্টার পর এ জানতে পারে নির্ঝর বিয়ে করেছে। হাত পা ছুঁড়ে কাঁদছে অবন্তি। পৃথা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, তোকে আগেই বলেছিলাম। এই ভয়টা অনেক আগে থেকে পাচ্ছিলাম আমি।
– আমার এখন কি হবে? কি করে বাঁচবো আমি? আমি মরে যাবো। মরে যাবো।
– একটা ঠকবাজের জন্য কেন মরে যাবি?
– ও ঠকবাজ হতে পারে। কিন্তু আমি তো সবকিছু উজার করে ওকে ভালোবেসেছি। নিজের জন্য যা করিনি ওর জন্য তাও করেছি। কি না করেছি আমি? ও আমাকে এভাবে ঠকালো। এটা হতে পারে না। হতে পারে না।
– হয়ে গেছে অবন্তি৷ হতে পারে না বলে আর লাভ নেই৷ কিছুই আর আগের মত স্বাভাবিক হবে না। ওর দোষে তুইও কিন্তু দোষী। তুই ওকে ভুলে যা।
– ভুলে যাওয়া কি এতই সহজ?

মেঝেতে শুয়ে ছটফট করতে লাগল অবন্তি। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। অবন্তির মা মেয়ের এই অবস্থা দেখে ভয় পাচ্ছেন। কিছু বলারও সাহস পাচ্ছেন না, সহ্য করতেও পারছেন না। এটুকু বুঝতে পারছেন মেয়েটা অনেক বড় কষ্ট পেয়েছে।
অবন্তির কান্না দেখে পৃথারও ভীষণ কান্না আসছে। অবন্তি বলল, আমি ওরে আমার নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসছি রে। কখন আরেকটা মেয়ের সাথে জড়াইছে বুঝতেও পারিনাই।
– প্লিজ শান্ত হ।
– আমি মরে যাবো। শেষ হয়ে যাবো রে। আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। নির্ঝর আর আমার লাইফে নাই এটা আমি মানতেই পারছি না।

অবন্তিকে বুকে চেপে ধরে রইলো পৃথা। অবন্তি বাচ্চাদের মত পৃথার বুকে গুটিশুটি মেরে কান্না করতে লাগলো।

পৃথার আর বাড়ি ফেরা হল না। অবন্তির সাথেই থাকতে হল ওকে। এইমুহুর্তে অবন্তিকে একা ছেড়ে দিলে অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে ও। খাওয়া, ঘুম সবকিছু ছেড়ে দিয়েছে মেয়েটা। গোসল করেনা, সারাদিন মেঝেতে পরে থাকে। পৃথা এসে অবন্তিকে গোসল করিয়ে দেয়, চুল আঁচড়ে দেয়, খাইয়ে দেয়। এভাবে চলছে দেখে অবন্তি নিজে থেকেই বলল, আমার এখানে থেকে দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি কিছুদিন পাহাড়ে ঘুরতে যেতে চাই।

অবন্তির মা রাজি হলেন। পৃথা অবন্তি ও আরেকটা মেয়ে সহ সাজেকে চলে এলো ঘুরতে। অন্তত প্রকৃতির সাথে থাকলে ট্রাজেডি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে অবন্তি। সাজেকে একটা কাঠের কটেজে উঠেছে ওরা। অবন্তি ভীষণ মনমরা। কটেজের ভিতরের দিকে পাহাড়ের উপর একটা দোলনা আছে। সেখানে গিয়ে পা দুলিয়ে দোলনায় বসে দোল খেতে লাগল ও। দূরে দাঁড়িয়ে মেঘের ভেসে যাওয়া দেখছে পৃথা। মাঝেমাঝে অবন্তির দিকে তাকাচ্ছে। পাগলপ্রায় হয়ে গেছে ও। কবে যে স্বাভাবিক হবে! কেন যে মানুষ প্রেমের মত পাগলামি করতে যায় কে জানে। আচমকা মুখ ঘোরাতেই পাশের কটেজের বারান্দায় একটা চেনা মুখ দেখে চমকে উঠল পৃথা। মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেলো। হৃদপিন্ড লাফিয়ে উঠলো। ওপাশের মানুষ টাও একইভাবে চমকে তাকিয়ে আছে। পিছন থেকে একটা মেয়ে ডাকতে ডাকতে এলো, সায়ান এই সায়ান…

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here