#অবশেষে_বৃষ্টি
পর্ব ১১
#নীলাভ্র_নেহাল
.
সায়ান পৃথার খালার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ক্লান্ত চোখে চেয়ে আছে বেলকুনির দিকে। পৃথাকে সকাল থেকে কল দিয়ে ফোনে পায় নি ও। এমনকি নাম্বার টাও বন্ধ। সারাদিনের প্রচেষ্টা শেষে পৃথার খোঁজে সোজা ওর খালার বাসার সামনে চলে এসেছে। কিন্তু ভেতরে ঢোকার সাহস পাচ্ছে না। আবার পৃথার কোনো সমস্যা হয়ে না যায় এই ভয়ে। তার উপর ভীষণ দুশ্চিন্তা ও হচ্ছে পৃথার কিছু হয়েছে কিনা সেটা ভেবে। অনেক অপেক্ষা করেও যখন বেলকুনিতে পৃথার মুখ দেখা গেলো না, তখন আর থাকতে না পেরে বাসার গেটে চলে এলো সায়ান। দাড়োয়ানকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, ‘পৃথাকে চেনেন?’
– না চিনি না। এ বাসায় থাকে?
– হ্যাঁ।
– কয়তলায় থাকে?
– দোতলায়। ডানদিকের ফ্ল্যাটে।
দাড়োয়ান মনে করে বলল, ও। চিনতে পারছি। জিনাত আপার ভাগ্নী। লম্বা, ফর্সা, গোলগাল মুখ। চুলগুলো অনেক বড়।
– জ্বি জ্বি, আমি ওর কথাই বলছি। ও কি আজকে বাসা থেকে বেরিয়েছে?
– হ। বের হইছে তো। সকালের দিকে একটা ব্যাগ নিয়া বাহির হইয়া গ্যাছে। মনেহয় গ্রামে গ্যাছে।
বুকটা ধক করে উঠলো সায়ানের। ও কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইল, গ্রামে গেছে কেন? ওর গ্রামে কি কোনো সমস্যা হয়েছে? বা বিপদ?
– সেইটা তো জানিনা।
মাথায় হাত দিয়ে চিন্তা করতে লাগলো সায়ান। পৃথার নাম্বার বন্ধ, ব্যাগ নিয়ে গ্রামে গেছে৷ কি হতে পারে ব্যাপারটা? নিশ্চয়ই ও কোনো সমস্যায় আছে। সমস্যায় থাকলে ফোনটা অন্তত খোলা রাখত। একবার ফোনে ওকে বলে দিলেও পারতো সে সমস্যা হয়েছে। তাহলে সায়ানের দুশ্চিন্তাও হতো না, সায়ান ফোনও করতো না। উফফ! আর ভাবতে পারছে না সায়ান। বড্ড দুশ্চিন্তা হচ্ছে।
বাড়ির সামনে কয়েকবার পায়চারি করলো সায়ান। শঙ্কা হচ্ছে যে পৃথার বিয়ে ঠিক হল কিনা। এ কারণে ফোন বন্ধ করে চলে গেছে। এ কথাটা সায়ানকে বলার মত মন মানসিকতা ছিল না। আবার এটাও হতে পারে যে সায়ানের সাথে সম্পর্ক রাখতে চাইছে না। কিংবা এই ভার্সিটিতেই আর পড়তে চাইছে না। ওহ শিট! রাস্তায় পা দিয়ে জোরে আঘাত করল সায়ান।
তারপর গেটে এসে দাড়োয়ানকে বলল, মামা আমার একটা উপকার করতে পারবেন? পৃথা কবে আসবে? কিছু হয়েছে কিনা? ও আর ভার্সিটিতে পড়বে কিনা? যেকোনো একটা প্রশ্নের উত্তর আমাকে জানতে হবে। প্লিজ মামা, এই উপকার টুকু কইরেন।
দাড়োয়ানের হাতে একটা পাঁচশো টাকার নোট খুঁজে দিলো সায়ান। তারপর বলল, আইচ্ছা মামা আমি জাইনা লমু। আপনে কাইল আইসেন।
কিছুটা আশাজনক হলেও দুশ্চিন্তা আরো বেড়ে গেলো সায়ানের। সারা রাত ঘুমই হবে না। পৃথা যদি সেচ্ছায় এই কাজ করে থাকে আর আবারও সায়ানের সাথে ওর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়, তবে এর বদলা সায়ান নেবেই। ওকেও এভাবে একদিন টেনশনে ফেলে রাখবে। মনেমনে এই সিদ্ধান্ত নিলো সায়ান।
১০
পৃথা ডেল কার্নেগীর রচনা সমগ্র নিয়ে বসেছে। মোটিভেশনাল বই। এইমুহুর্তে ওর সবচেয়ে বেশি দরকার মোটিভেশন। নিজেকে বদলে নেয়ার জন্য জ্ঞানের দরকার, সিদ্ধান্ত দরকার আর প্রয়োগ দরকার। কিন্তু সবকিছুর উপায় হচ্ছে বই। এই মুহুর্তে ঠিক কোন কাজটা করলে নিজের সম্মান রক্ষা করে চলতে পারবে সেই সূত্র খুঁজছে পৃথা। পৃথিবীতে বাঁচতে হলে বাঁচার মত বাঁচতে হবে। বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে হবে। শহরে আবারও ফিরে যাবে ও। আর এবার সেই শহর একজন নতুন পৃথাকে দেখবে।
দুদিন পর
রাত বেড়েছে। রাতের খাবার খেয়ে সবাই বাসার আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছে। একটা টেবিল ল্যাম্পের আলো জ্বেলে বই পড়ছিল পৃথা। মনটা অনেকটাই শান্ত হয়েছে। এখন নিজেকে গড়ে তুলবার পালা। এমন সময় মা দরজায় শব্দ করলেন। পৃথা বলল, মা?
– হ্যাঁ। দরজা খোল তো।
পৃথা দরজা খুলে জিজ্ঞেস করলো, আসো। কিছু বলবে?
– সায়ান ফোন করেছে।
– কিহ!
রীতিমতো অবাক হয়ে মায়ের দিকে চেয়ে রইলো পৃথা। অবাক হয়ে জানতে চাইল, সায়ান তোমাকে ফোন করেছে?
– হ্যাঁ।
– নাম্বার কোথায় পেয়েছে?
– তুই দিস নি?
– না তো। আমি কেন ওকে তোমার ফোন নাম্বার দিতে যাবো?
– তাহলে কোথ থেকে পেলো?
– কি বলছে?
– তোর সাথে কথা বলতে চায়। আমি বলেছি পৃথা ঘুমাচ্ছে। ও বলল ভীষণ জরুরি দরকার। কথা বলতেই হবে।
– কি জানি কি বলবে আবার। কিন্তু ও তোমার ফোনে কল দেয়ার সাহস কি করে পেলো?
মা বললেন, আমি বারণ করেছি আর ফোন দিতে। তুই আগামীকাল চলে যাচ্ছিস৷ ছেলেটা নিশ্চয়ই আবারও যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে। খুব সাবধানে থাকবি। আর যোগাযোগ করার যতই চেষ্টা করুক, এভোয়েড করবি। আমি তোকে নিয়ে মাথা উঁচু করে চলতে চাই। বলতে চাই আমার মেয়ে একজন সত্যিকার মানুষ। আজেবাজে কাজে সময় নষ্ট না করলেই খুশি হবো আমরা।
মা চলে গেলে পৃথা বিছানায় এসে চিন্তিত মুখে বসে রইলো। সায়ান মায়ের নাম্বারে কেন ফোন দিলো? নিশ্চয়ই নাম্বারটা জোগাড় করতে অনেক কষ্ট হয়েছে। শুধুমাত্র বাজি ধরে প্রেম করলে কি এত কষ্ট করে কেউ দুঃসাহস করে বাড়িতে ফোন দেয়? মনের মধ্য প্রশ্নটা ঘুরপাক খেতে লাগলো পৃথার৷ পরক্ষণে আবার সায়ান ও অর্পার সেই ঘনিষ্ঠ ছবিটার কথা মনে পড়ে গেলো। সেটা মনে হতেই মন থেকে সায়ানের ভালো দিকটা মুছে ফেলার চেষ্টা করলো পৃথা। নাহ, ওকে নিয়ে আর একদমই ভাব্বে না।
পৃথা পরদিন শহরে এসে গোসল সেরে একটা লম্বা ঘুম দিয়েছিল। ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভেঙে এক কাপ চা নিয়ে বেলকুনিতে এসে দাঁড়ালো। চোখ ঘোরাতেই দেখলো রাস্তায় সায়ান দাঁড়িয়ে আছে। পৃথার দিকে পাগলের মত চোখে তাকিয়ে আছে ও। চোখাচোখি হতেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো পৃথা। সায়ান জোরে চিৎকার করে বলল, একবার নিচে আসো প্লিজ।
পৃথা রাগত চেহারা দেখিয়ে দ্রুত ভিতরে চলে গেলো। ফোনে বারবার নোটিফিকেশন আসছে। ব্লাকলিস্টে রাখা সায়ানের নাম্বার থেকে কল আসছে। মেসেজ আসছে। পৃথা বেলকুনিতে এসে ইশারায় বলল, চলে যান এখান থেকে। আর কখনো আসবেন না।
সায়ান হয়তো শুনতে পায় নি। ও ইশারায় বলল, প্লিজ একবার আসো৷ প্লিজ। কেন এমন করছো?
পৃথা বেলকুনির দরজা লাগিয়ে রুমের ভেতর চলে গেলো। মনকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে ও। কিন্তু বারবার একটা কথাই মনে ঘুরপাক খেতে লাগলো, সায়ান যদি বাজি ধরেই প্রেম করবে তবে এত কষ্ট করে এই গরমে বাসার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে কেন? আবার এও হতে পারে যে বাজিতে জেতার জন্যই এরকম করছে। পৃথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলো।
বই নিয়ে বসলো পড়ার জন্য। কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করলো। অনেকদিন ফেসবুকে ঢোকা হয়নি। ওয়াইফাই অন করামাত্রই মেসেঞ্জারে সায়ানের আইডি থেকে অসংখ্য মেসেজ চলে আসলো। ও রীতিমতো অবাক। একটা ছেলে বাজিতে জেতার জন্য আর কত কিছু যে করবে!
পরদিন ভার্সিটিতে এসেও বিপাকে পড়লো পৃথা। ওড়নায় মুখ ঢেকে লুকিয়ে ক্লাসে চলে এসেও নিস্তার পেলো না। ক্লাস শুরু হওয়ার ঠিক দুই মিনিট আগে সায়ান ক্লাসে ঢুকে পৃথার সামনে এসে দাঁড়ালো। পৃথা মাথা নিচু করেই বলল, কেন এসেছেন এখানে? এটা আমার ক্লাস। লাইফটাকে সিনেমা নাটক ভাব্বেন না।
– তোমার সমস্যাটা কোথায় জানতে পারি? কেন এরকম করছো? আমি কি অপরাধ করেছি যে আমাকে এভোয়েড করে যাচ্ছো? ভালোবেসেছি এটাই আমার অন্যায় হয়ে গেছে? খুব ভাব বেড়ে গেছে তাইনা?
– আপনি জানেন না আপনার অন্যায় কোথায়? বাজিতে জেতার জন্য আর কত নিচে নামবেন? লজ্জা করেনা বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে? কোন সাহসে আমার মাকে কল দিয়েছেন আপনি?
– ভালোবাসি তোমাকে। সেই দুঃসাহসে। আর বাজি মানে? কিসের বাজি? কার বাজি?
– জানেন না তাইনা? আপনার অভিনয় দেখতে দেখতে আমি ফেড আপ। প্লিজ আমার সামনে আর আসবেন না।
– পৃথা কিসের বাজি আমাকে ক্লিয়ার করে বলো?
এমন সময় ক্লাসে স্যার প্রবেশ করলেন। সায়ান পৃথাকে সরিয়ে দিয়ে ওর পাশের সিটে বসে পড়লো৷ পৃথা মৃদু স্বরে বলল, আমাকে জ্বালানোর জন্য এখানে বসে গেলেন আপনি?
– উত্তর না পেয়ে আমি যাবো না। বলো কিসের বাজি?
– বন্ধুদের সাথে বাজি ধরেছিলেন মনে নেই? আবার ন্যাকা সাজা হচ্ছে? শুনুন, আমার মত মেয়েকে সরল পেয়ে যাচ্ছেতাই ভাবে নাচাবেন না। আমরা কাউকে ঠকাই না, সত্যিকার ভাবে ভালোবাসতে চাই।
– আমিও তো তাই চাই। তুমি কি ভাবছো আমি বাজি ধরে তোমাকে চাইছি?
– অভিনয় বন্ধ করুন।
– আমার কথা শোনো।
– অভিনয় বন্ধ করুন।
– তোমাকে শুনতে হবে।
– আরেকবার কথা বললে স্যারকে বলে দিবো।
– আমার উত্তর চাই পৃথা। আমাকে বলো কেন তুমি এমন করছো? কেন?
পৃথা দাঁড়িয়ে পড়লো। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, কিছু বলবে?
পৃথা কিছু বলার আগেই সায়ান ওর হাত ধরে টান দিলো। যাতে কিছু না বলে৷ কিন্তু পৃথা জেদ করে বলল, স্যার আমার পাশের ছেলেটা আমাকে ডিস্টার্ব করছে।
ক্লাস শুদ্ধ সবাই সায়ানের দিকে তাকালো। কয়েকটা মেয়ে সায়ানকে সিনিয়র ভাইয়া হিসেবে জানে। ওরা বিরবির করে বলল, সায়ান ভাইয়া!
সায়ান লজ্জায় পড়ে বলল, কেন বলতে গেলে এটা?
মাথা নিচু করে ফেলল সায়ান। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ওকে ডিস্টার্ব কেন করছো?
সায়ানের কাছে কোনো উত্তর ছিলো না। ও চুপ করে ‘ইয়ে মানে, মানে’ করতে লাগল। পৃথাকে স্যার জিজ্ঞেস করলেন, কি করছে ও? খারাপ কিছু করছে?
পৃথা সবার সামনে ক্লাসে দাঁড়িয়ে বলল, ইয়েস স্যার। উনি বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে আমার সাথে রিলেশনশিপে যেতে চাইছেন। আমি বিষয়টা জেনে গিয়ে ওনাকে এভোয়েড করা শুরু করেছি। তাই উনি ক্লাসে এসে আমাকে ফোর্স করছেন। আমাকে সবসময় জ্বালাচ্ছেন। ওনার জন্য ক্লাসে আসতে ভয় পাই আমি। আর ওনার বন্ধুরা সবসময় আমাকে র্যাগ দেয়ার চেষ্টায় থাকে স্যার। আজেবাজে র্যাগিং দেয় আমাকে। সিনিয়র দেরকে আজেবাজে কথা বলতে বলে। আমি ভার্সিটি ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম এদের জন্য। আমার মা চায় আমি পড়াশোনা করি, বড় হই তাই আবার আমাকে পাঠিয়েছেন।
পুরো ক্লাস স্তব্ধ। স্যার পৃথার কথা শুনতে শুনতে মুখ কঠিন করে ফেলেছেন। উনি সায়ানকে দাঁড়াতে বলে জিজ্ঞেস করলেন, কোন ইয়ারে তুমি?
– ফাইনাল ইয়ারে স্যার।
– এক্ষুনি আমার সাথে দুজনে প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে যাবে।
ক্লাসে কেউ কোনো কথা বলছে না। পৃথা সায়ানকে বের হতে বলে নিজে আগে আগে হাঁটা শুরু করলো। সায়ান কি করবে বা কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। লজ্জায় মাথা নিচু করে রেখেছে ও। পৃথাকে বাজির এই মিথ্যে কথাটা কে বলেছে সায়ানের জানা নেই। কিন্তু স্যারদের সামনে এই প্রথমবার যাচ্ছে। কি যে বলবে বুঝতে পারছে না।
প্রিন্সিপাল স্যার সব কথা শুনে সায়ানের কাছে ওর বন্ধুদের নাম শুন সবাইকে ডেকে পাঠালেন। কয়েক মিনিটের মাথায় সবাই এসে হাজির হলো। সায়ানের সাথে পৃথাকে দেখে বেশ অবাক হয়েছে সবাই। এই প্রথমবার স্যারের রুমে ডাক পড়েছে। সবাই বিব্রত, একইসাথে কৌতুহল।
স্যার পৃথাকে জিজ্ঞেস করলেন, এরা তোমাকে র্যাগ দিয়েছে?
পৃথা দেখিয়ে দিলো মেয়েগুলোকে। মেয়েগুলো এমনভাবে পৃথার দিকে তাকালো যে, এখান থেকে কোনোমতে বের হতে পারলে এরপর পৃথাকে দেখে নেবে ওরা। ভয়াবহ শিক্ষা দেবে ওকে। পৃথা ভয় না পেয়ে বরং চোখ পাকিয়ে ওদের দিকে চেয়ে রইলো।
চলবে..
#অবশেষে_বৃষ্টি
পর্ব ১২
#নীলাভ্র_নেহাল
.
ভিসি স্যার প্রত্যেকের উপর নির্দেশ দিয়ে দিলেন যেন আর কোনোদিনও কোনো শিক্ষার্থীকে এভাবে র্যাগ না দেয়। পৃথাকে তো নয়ই। পৃথাকে বললেন আর কখনো ওরা বিরক্ত করলে সোজা স্যারকে জানাতে।
সায়ান সেই শুরু থেকেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। স্যার এসে ওকে বললেন, তোমাকে দেখলে ভদ্র ছেলে বলেই মনেহয়। এ বারের মত তোমাদেরকে ক্ষমা করা হলো। তবে ভবিষ্যতে আর কখনো মেয়েটাকে জ্বালাতন করবে না। বাজি ধরে প্রেম করা আবার কি হে? আমাদের সময়ে আমরা একজনকেই ভালোবাসতাম আর তার জন্য জীবন দিয়ে দিতেও দ্বিধা করতাম না। তোমরা এখনকার জেনারেশান একটা সুন্দর সম্পর্ক কে রীতিমতো খেলা ভাবছো। মজা করছো, বাজি ধরছো। শেম অন ইউ।
সায়ান এতক্ষণে মুখ খুললো, স্যার। বেয়াদবি না নিলে একটা কথা বলতে চাই।
– বলো।
– আমি পৃথার পিছনে লেগে আছি এটা স্বীকার করছি। কিন্তু বাজি ধরেছি এটা পুরোপুরি মিথ্যে। পৃথা বলেছে আমি আমার বন্ধুদের সাথে বাজি ধরেছি। এখানে সব বন্ধুরাই আছে। সবাইকে জিজ্ঞেস করে দেখুক, কারো সাথে আমার এখন যোগাযোগ ই নেই আর বাজি আসবে কেন স্যার?
পৃথা সায়ানের দিকে তাকালো। স্যার সায়ানকে জিজ্ঞেস করলেন, ওর পিছনে আর লাগার দরকার নেই।
– স্যার আমি ওকে ভালোবাসি। এটা সত্যি। এর জন্য লেগে থাকাটা নিশ্চয়ই অপরাধ নয়। আমি এই জেনারেশানের হতে পারি কিন্তু আর সব ছেলেদের মত অন্তত নই।
– হিরো সাজার চেষ্টা করছো?
স্যার হাসলেন। এরপর সায়ানের বন্ধুদের দিকে তাকালেন, তোমরাও দেখি ভালোই নাটক করতে পারো। তোমাদের বন্ধু তো হিরো আর তোমরা কি? বাজি ধরেছো কে কে?
ছেলেমেয়েরা বলল, স্যার আমরা কেউই বাজির ব্যাপারে জানি না।
স্যার হাসতে হাসতে বললেন, ছেলেমেয়ে রা যা নাটক জানে। গড! আমরা জীবনে এসব ভাবতেও পারতাম না। এসব সিনেমাতেই দেখে এসেছি সবসময়। হা হা হা। ঘটনা যাই হোক, পৃথা তোমাদের উপর বিরক্ত। কাজেই কেউই আর ওকে ডিস্টার্ব করবে না। ওয়েল ইউর ওউন মেশিন। যাও সবাই।
সায়ানের বন্ধুরা সবাই স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে এলো। সবার শেষে বেরিয়ে এলো পৃথা। সায়ান পৃথার কাছে এসে বললো, বাজি ধরার কথাটা তুমি কার কাছে জেনেছো বলবে কি?
– স্যার বলেছে আমাকে আর ডিস্টার্ব না করতে।
– এরকম কোরো না পৃথা। তুমি আমাকে ভালো করে চেনো।
– অভিনয় করলে কাউকেই চেনা যায় না।
– আমি অভিনয় করছি এটার কি প্রমাণ আছে তোমার কাছে?
পৃথা হেসে বললো, আপনি এতটাই দক্ষ অভিনয় করেছেন যে আমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই। তবে হ্যাঁ, আপনি অনেক ট্যালেন্ট এটা মানতেই হয়। কারণ যে মেয়েটা আমাকে আপনার আসল চরিত্র সম্পর্কে জানিয়েছে সেই মেয়েটা ছাড়া সবাইকে স্যারের রুমে হাজির করেছেন। গুড!
সায়ান অবাক হয়ে বললো, মানে! আমার এরা ছাড়া আর কোনো বন্ধু নেই। তুমি জানো না?
– ওই মেয়েটা আপনাদের সিক্রেট মেসেঞ্জার গ্রুপে আছে। সেখানে আপনারা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করেন। সবাই আমাকে অপমান করে আর আপনি তাল মিলান।
– থামো। আমাদের মেসেঞ্জার গ্রুপ কোথায় দেখলে? কে তোমাকে কি দেখিয়েছে? ক্লিয়ার করে বলো প্লিজ?
পৃথা কথার উত্তর না দিয়ে হনহন করে হাঁটা শুরু করলো। সায়ান এগিয়ে এসে পৃথার হাত টেনে ধরে বললো, আমার কথার উত্তর দিয়ে তারপর যাবে।
– আমার বিরক্ত করা বন্ধ করুন।
– স্যারকে ডাকবে? ডাকো। কিন্তু এর উত্তর আমার চাই ই। তুমি যা জেনেছো ভুল জেনেছো। আমি সবকিছু ক্লিয়ার করে দিতে চাই। প্লিজ আমাকে বলো।
পৃথা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, অনেক কিছুই তো করলেন। আমিও ভুল করেছিলাম আপনার সাথে চলাফেরা করে। এ বয়সে একটু ভুল নাকি সবাই করে। আর কোনো ভুল করতে চাই না। কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যে জানার ইচ্ছেও আমার নেই। যে কষ্টটা আমি পেয়েছি সেটা নিয়েই আমাকে থাকতে দিন। আমার একটা ভালো শিক্ষা হয়েছে।
সায়ানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত হেঁটে চলে গেলো পৃথা। সায়ান পিছুপিছু ছুটল। পৃথাকে ডাকতে ডাকতে রাস্তা পর্যন্ত চলে এলো। পৃথা রিকশায় উঠলে সায়ান এসে রিকশা টেন ধরে দাঁড়াল। বলল, দাঁড়াও। আমার কথা না শুনে তুমি যাবে না।
– আপনার কি লজ্জা নেই? বাজিতে জেতার জন্য আর কি করবেন আপনি?
– চুপপপ।
সায়ান খুব জোরে রাগ দেখালো পৃথাকে। চারিদিকে ধ্বনিত হতে লাগল ওর আওয়াজ। সবাই অবাক হয়ে তাকালো ওদের দিকে। সায়ান পৃথার হাত ধরে রিকশা থেকে নামালো। পৃথা থতমত খেয়ে গেছে ওর রাগ দেখে। সায়ান বললো, অনেক কাহিনি করেছো। এখন আমি যা বলবো সবকিছু শুনে তারপর যাবে তুমি। তার আগে এক পা তুলেছো তো পা ভেঙে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বাসায় পাঠাবো।
পৃথা ভয়ে ভয়ে মাথা নিচু করে রইলো। সায়ান বললো, বারবার এক কথা বলে যাচ্ছো, বাজি বাজি বাজি। আরে কে ভাই আমার কিসের ঠেকা পড়েছে বাজি ধরে প্রেম করবো? তাও তোমার সাথে। তোমার যা সরল মন, তাতে তো এমনিতেই তোমাকে গলানো সম্ভব। বাজি ধরতে হবে কেন? বাজি ধরলে তো ভার্সিটির সবচেয়ে ভয়ংকর সুন্দরী মেয়েটার জন্য বাজি ধরতাম। আমাকে দেখে তোমার এই বোধটুকুও জাগে নি?
পৃথা মৃদুস্বরে বললো, আমাকে অপমান করছেন আপনি।
– রাখো তোমার অপমান। আমি নাকি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি? কি কষ্ট দিয়েছি বলো? এভোয়েড করেছি? ছ্যাঁকা দিয়েছি? কে কি বলেছে সেটা নিয়ে নাচ্ছো। আমাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলে কোনটা সত্যি? আমার সাথে একবার কথা বলার প্রয়োজন মনে করেছিলে?
পৃথা চুপ করে রইলো। সায়ান বললো, দেখো আমি তোমার প্রেমে পড়ার পর থেকে বন্ধু বান্ধবদের সাথে মেশাই বন্ধ করে দিয়েছি। যোগাযোগ পর্যন্ত করিনা। আর ওদের সাথে মেসেঞ্জার গ্রুপ তো দূরের কথা। সিরিয়াসলি আমি কোনো গ্রুপে নেই। অনেক আগে ছিলাম ,তোমার সাথে কথা হওয়ার পর লিভ নিয়েছি। কে তোমাকে এসব বলেছে আমাকে খুলে বলো?
পৃথা এবারও কোনো কথা বললো না। সায়ান বললো, আমাদের সম্পর্ক হোক বা না হোক, সত্যিটা প্রকাশ হওয়া দরকার। আর কে আমার নামে এই মিথ্যে অপবাদ দিয়েছে সেটাও আমার জানা দরকার। চুপ করে থাকবে না। সত্যিটা জানা হয়ে গেলে আর তোমাকে বিরক্ত করবো না।
পৃথা বললো, আমি মেয়েটাকে চিনি না। তবে অর্পার সাথে ওর খুব কথা হয়। অর্পা ওকে বলেছে সায়ান অনেক হট, ইত্যাদি ইত্যাদি। কবে আপনার সাথে দেখা হয়েছে, কবে কি হয়েছে সবই ওকে বলেছে। এমনকি পারসোনাল ছবি পর্যন্ত শেয়ার করেছে। সেই মেয়েটিই আমাকে বলেছে যে আপনি বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে আমার সাথে প্রেম করতে চাইছেন।
সায়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমাকে বিশ্বাস করো আমি এসব কিছুই জানিনা।
– ও আমাকে আপনাদের মেসেজ দেখিয়েছে। আপনার বন্ধুরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। আপনি তাল মিলিয়ে যান।
– এটার রহস্য আমি উদ্ধার করবোই। প্রমাণ নিয়ে তারপর তোমার সামনে হাজির হবো।
– বেশ। তবে প্রমাণ জানার পরও আমার কোনো ভাবান্তর হবে না আশাকরি।
– পৃথা, আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি।
– আমাকে এটাও বলেছে যে আপনি অর্পাকে ভালোবাসেন। মানলাম আমাকে ভালোবাসেন। কিন্তু একসাথে কি দুজনকে ভালোবাসা যায়?
– অর্পা ইজ মাই বেস্ট ফ্রেন্ড।
– বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে শুতে হয়? খালি গায়ে?
সায়ান কি বলবে বুঝতে পারলো না। পৃথা হেসে বললো, বেস্ট ফ্রেন্ড মানে সবকিছু শেয়ার করতে হবে, আবার বাস্তবেও ওসব করতে হবে। তাইনা? আমাকে এতটাই বোকা পেয়েছেন?
– এটা আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলছি। আমাকে বিশ্বাস করো তুমি।
– কি বলবেন? ও জোর করে আপনার সাথে শুয়েছে তাই তো? আপনি ধোয়া তুলসি পাতা?
– আমি ধোয়া তুলসি পাতা নই। কিন্তু এতটাই খারাপ নই যে একজনকে ভালোবেসে আরেকজনের সাথে শোবো। ও সেদিন রীতিমতো জোর করেই আমার বিছানায় শুয়ে ছবিগুলো তুলেছে। এটা দিয়ে ব্লাকমেইল করবে আমি ভাবতেও পারিনি।
– ভালো। একটা মেয়ে চাইলেই একটা ছেলের পাশে শুতে পারে? নিশ্চয়ই আপনারও সম্মতি ছিল?
– আমাকে ভুল বুঝো না৷ আমাদের মধ্যে সে ধরণের কোনো সম্পর্ক নেই।
পৃথা হাসতে হাসতে বলল, সবই বিশ্বাস করলাম। কিন্তু একটা কথা, সেদিন অর্পা আপনার বাসায় গিয়েছিল বৃষ্টিতে ভিজে। অথচ আপনি আমাকে বলেছেন ছেলে বন্ধু। আবার অর্পাকে উইশ করার জন্য রাত বারোটায় ওর বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়েছেন। আর আমাকে বলেছেন মিথ্যে কথা। আমি কোনো মিথ্যুকের সাথে কথা বলতে চাই না। সে কোনটা সত্যিকে মিথ্যা বানাবে, কোনটা মিথ্যাকে সত্যি বানাবে আমার জানা নেই। এটা সময়ের অপচয় ছাড়া কিছুই না। আমাকে আমার মত থাকতে দিন। ভালো থাকবেন।
সায়ান এবার পৃথাকে আটকাতে পারলো না। কিছু বলার মত মুখ কিংবা সত্য মিথ্যার প্রমাণ ওর কাছে নেই। কেবলই নিরবতা। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পৃথার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো সায়ান।
পৃথা রিকশা নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলো। মনের মাঝে উথাল পাথাল ঝড় বয়ে যাচ্ছে। একবার মনে হচ্ছে সায়ান সত্যিই ভালোবাসে, একবার মনে হচ্ছে সায়ান অপরাধী। আবার কখনো নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে। সায়ান সত্যি বলে থাকলে ওকে এভাবে অপমান করাটা উচিৎ হয়নি। প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে নিয়ে যাওয়া, স্যারের কাছ থেকে কথা শোনানো, এসব বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। নিজের কাজটাও নিজের কাছে ভালো লাগছে না পৃথার। আজ থেকে সবকিছু ভুলে জীবনটাকে নতুন করে সাজাবে ও। সায়ান সত্যি মিথ্যা যাই হোক, ওকে নিয়ে আর ভাব্বে না। পৃথা শুধু নিজেকে ভালোবাসতে চায়। নিজেকে সমৃদ্ধ করতে চায়। কারণ বাবা মা অনেক স্বপ্ন নিয়ে এখানে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছেন। পড়াশোনা সবাই করে, সবাই তো মানুষ হতে পারে না। পৃথাকে মানুষ হতে হবে।
বারবার সায়ানকে মনে পড়ে যাচ্ছে পৃথার। একসাথে কাটানো সময়গুলো অনেক সুন্দর ছিল। প্রেম না হোক, দুজনের পথ চলাটা সুন্দর ছিল। বোঝাপড়া, কথা বলা, পাশে থাকার প্রত্যেকটা বিষয়ই মনের মতো ছিল। মনটা সায়ানের জন্যও টানে। কিন্তু এটাও সত্যি যে এখন মনকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখতে হবে। ক্যারিয়ার গড়ার সময়টাকে অন্যকিছুতে ব্যয় করলে ক্যারিয়ারটাও নষ্ট হয়ে যাবে। সায়ানকে ভুলতে পারাটা কষ্টকর হয়ে যাবে, কিন্তু সবকিছুর আগে নিজের স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ। মনকে শক্ত করতে হবে, আরো অনেক বেশি শক্ত। তবুও অজান্তেই চোখের কোণা ভিজে উঠতে শুরু করেছে পৃথার। ঠোঁট চেপে ধরে কান্না সংবরণ করলো ও।
চলবে..