অবশেষে বৃষ্টি পর্ব ১

0
1631

#অবশেষে_বৃষ্টি
সূচনা পর্ব
#নীলাভ্র_নেহাল

-“আপনার কাছে কি একটা সিগারেট ফ্লেভারের চুমু হবে?”
প্রশ্ন শুনে রীতিমতো আশ্চর্য হয়ে ফিরে তাকালো সায়ান। এ কেমন অদ্ভুত প্রশ্ন! লাজ নেই, লজ্জা নেই, কি করে বললো এমন কথা!

মেয়েটা মাথা নামিয়ে চোখ এদিক সেদিক ঘুরাচ্ছে। সমানে দু’হাত কচলাচ্ছে আর মুখটা কাচুমাচু করে রেখেছে। সায়ান চোখ থেকে সানগ্লাস খুলতে খুলতে বললো, ‘কি বললেন? রিপিট রিপিট?’

মেয়েটা এবার আরো বেশি হাত কচলাতে কচলাতে বললো, আপনার কাছে কি একটা সিগারেট ফ্লেভারের চুমু হবে?
– লাইক সিরিয়াসলি? চুমু? আমার কাছে? তাও আবার সিগারেট ফ্লেভারের?
– হুমমমম।
– আপনি চাইছেন?
– হুমম।
– কিভাবে দিবো? কাকে দিবো? আপনাকেই?
– না মানে প্লিজ মাফ করবেন।

মেয়েটার গলা কাঁদো কাঁদো শোনালো। প্রায় কেঁদেই দিচ্ছিল মেয়েটা। সায়ান থামিয়ে দিয়ে বলল, এই এই কাঁদছেন কেন আপনি? কি সমস্যা?

মেয়েটা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেলো। তারপর বললো, কেউ যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করে আমি আপনাকে এ কথা বলেছি কিনা তাহলে তাকে বলবেন হ্যাঁ বলেছি। কিন্তু কেন বলেছি সেটা আপনি বলবেন না।
– কেন বলেছেন তা তো আমিও জানিনা।
– কয়েকটা বড় আপু আমাকে বলতে বলেছে।
– তারমানে র‍্যাগিং? ভার্সিটিতে নতুন এসেছেন?
– জ্বি। নিউ ফাস্ট ইয়ার।
মেয়েটা এবার থাকতে না পেরে কেঁদেই ফেললো। বোধহয় গ্রাম থেকে এসেছে। আর এটাও নিশ্চিত যে এর আগে এ ধরণের কথা কখনো উচ্চারণ ও করে নি। আপাদমস্তক লজ্জার আবরণে নীল হয়ে উঠেছে। মেয়েটা দেখতে মিষ্টি, মায়াবতী। চোখে মুখে একটা অপার মায়া আছে। চোখ দুটো যেন স্থির, ও চোখে সমুদ্র আছে। চোখ মুছতে মুছতে দাঁড়িয়ে রইলো মেয়েটা।

সায়ান বলল, তুমি যাও। কেঁদো না। তুমি আমাকে কি বলেছো সেটা কেউ জানবেও না।
– সত্যি বলছেন তো? কেউ জানলে কিন্তু আমি এই ভার্সিটি ছেড়ে চলেই যাবো।
– আরে এ কেমন কথা? ভার্সিটিতে নতুন এলে বড় মেয়েরা কত রকমের র‍্যাগ দেবে সেটা কল্পনাই করতে পারবে না। এসব নিয়ে মন খারাপ কোরো না কেমন? আর বাসায়ও জানিও না। নয়তো বাবা মা কষ্ট পাবে।

মেয়েটা বাচ্চাদের মত হাতের পিঠ দিয়ে গাল মুছতে মুছতে বলল, ওরা আমাকে আবার বকবে না তো?
– না বকবে না। তুমি যাও।

মেয়েটা তবুও দাঁড়িয়ে রইল। এমন সময় পাঁচটা মেয়ে হাসতে হাসতে এসে সায়ানকে বলল, কি রে বন্ধু। কি বলে এই মেয়েটা? ও তো ফাস্ট ইয়ার।
– মেয়েটা কি বলছে তোদেরকে কেন বলবো?
– শুনি না কি বলল? প্রপোজ করল প্রপোজ? কি প্রপোজ করল রে শুনি?

বলেই হেসে উঠলো সবচেয়ে মোটা মেয়েটা। সায়ানের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে এরাই নতুন মেয়েটিকে র‍্যাগ দিয়েছে। ভীষণ রাগ হল ওর। যদিও এর আগে নিজেও অনেক ছেলে, মেয়েকে র‍্যাগ দিয়েছে। কিন্তু আজকে এই মেয়ের নিষ্পাপ চাহনি আর চোখের জল দেখার পর কেন যেন মনটা বিষন্ন হয়ে উঠলো। সায়ান মেয়েটাকে বলল, তুমি এখন যাও।

মেয়েটা সিনিয়র আপুদের দিকে ভয় ভয় চোখে তাকাচ্ছিল। সায়ান ভরসা দিয়ে বলল, ওরা কিছু বলবে না। তুমি যাও।

মেয়েটা দ্রুত ছুটে চলে গেলো। একবারও পিছন ফিরে তাকালো না। সায়ান ওর বান্ধবীদের উদ্দেশ্য করে বলল, তোরা এই মেয়েটার সাথে এমন কেন করলি?
– তোর কাছে একটা চুমু চেয়েছে। দিয়ে দিতিস। আমরা তো সেটাই দেখতে চাইছিলাম। আমাদেরকে তো আর দিবি না।

বলেই হেসে উঠলো রিদি নামের একটা মেয়ে। সায়ান বলল, তোরা কি জীবনে ভালো হবি না?
– কেন রে দোস্ত? তুই বোধহয় খুব ভালো হয়ে গেছিস?
– দ্যাখ, সবাইকে লাঞ্চিত করা ঠিক না। মেয়েটা ডিসিশন নিয়েছে ও ভার্সিটি ছেড়ে চলে যাবে।
– তাই নাকি? তাহলে তো আবার র‍্যাগ দিতে হয়।
– দ্যাখ রিদি, তোরা একদম ওর সাথে এসব করবি না।
– কেন রে দোস্ত? একবার চুমু দিতে চাইল বলে এত দরদ? এখনো তো দেয় নাই।

সায়ান নিজের রাগ সামলে নিলো। এই দলটা ভার্সিটির টপ ডেঞ্জারাস গ্যাং। এদেরকে বলে লাভ নেই। ওরা শোধরাবার মানুষ নয়। তাই কথা না বাড়ানোই ভালো।

সায়ান মাথাটা দুদিকে নেড়ে বলল, আমার কাজ আছে।

চলে এলো সেখান থেকে। করিডোরে এসে সায়ানের চোখ দুটো শুধু সেই মেয়েটাকেই খুঁজছিল। শত শত মেয়ের মাঝে ওকে আবার খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু মেয়েটাকে কেন যে আবারও খুঁজছে সায়ান নিজেই বুঝতে পারছে না। আজ আর ক্লাসে মন বসবে না।


রাতে ঘুমাতে গিয়ে দু চোখের পাতা এক হতে চাইছিল না সায়ানের। একটা তুচ্ছ ঘটনা, অথচ মনে দাগ কেটে বসে আছে। মেয়েটার শুকনো নিষ্পাপ মুখটাই বারবার ভেসে উঠছে চোখের সামনে। কি এক মায়ায় মেশানো দৃষ্টি, তলোয়ারের মত ভ্রু যুগল। সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে তবে?

বিছানার উপর উঠে বসে সায়ান। নাহ, অস্থিরতা কমছে না। মেয়েটাকে বান্ধবীদের হয়ে সরি বলতে হবে। কিন্তু ওই মেয়ে আবার ভার্সিটিতে আসবে তো? এই প্রথম অতীতে করে আসা ভুল গুলোর জন্য অনুতাপ হচ্ছে সায়ানের। অতীতে নিজেই কত ছেলেকে এভাবে বোকা বানিয়েছে, ইনসাল্ট করেছে। আজ ভালো লাগছে না। একটা সামান্য ঘটনার কারণে নিজেকে কেমন অপরাধী অপরাধী মনে হচ্ছে। আর কখনো কাউকে র‍্যাগ দেবে না সায়ান, মনে মনে এই প্রতিজ্ঞা করলো।

পরদিন ভার্সিটিতে এসেই মেয়েটার খোঁজে করিডোর, ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস রুম সব খুঁজে খুঁজে দেখতে লাগল সায়ান। কিন্তু দেখা মিলল না। অবশেষে হতাশ হয়ে ফিরে যাওয়ার সময় দেখলো বারান্দার এক কোণে পিলারে হেলান দিয়ে বসে শুকনো মুখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। সায়ানের মুখে অজান্তেই হাসি ফুটে উঠলো। ও ধীরপায়ে হেঁটে মেয়েটার পাশে বসতে বসতে বলল, হ্যালো ম্যাম।

মেয়েটা পাশ ফিরে তাকাতেই ভুত দেখার মত চমকে উঠলো। সায়ান হেসে বলল, কি দেখছো এভাবে?
– আপনি!
– ভয় পেও না। র‍্যাগ দিতে আসি নি। বন্ধুত্ব করতে এসেছি।
– ঠিক বিশ্বাস হলো না।
– তাই নাকি? বিশ্বাস না হলে নাই। ঝুলে থাকলাম।

মেয়েটা অবাক হয়ে বলল, আমার সাথে বন্ধুত্ব কি জন্য? আপনি তো আমাকে চেনেন না।
– চেনার জন্যই তো বন্ধুত্ব করতে চাইছি তাই নয় কি?
– কিন্তু আপনি তো সিনিয়র ভাইয়া। আর তাছাড়া মাত্র একবার দেখেই বন্ধুত্ব করতে চাইলে আমি তো আপনাকে সন্দেহ করতে পারি।
– সন্দেহ করো। আমি তো মানা করি নি।
– আচ্ছা।

মেয়েটা এরপর অনেক্ষণ চুপ করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। সায়ান হেসে বলল, কি গো সন্দেহ করছো নাকি?
– না মানে ভাবছি।
– এত ভাবতে হবে না। আমি এসেছি সরি বলতে। গত কালের ঘটনাটার জন্য আমি আমার ফ্রেন্ড সার্কেলের হয়ে তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি।
– সে কি! আমি তো লজ্জায় আপনাদের ওদিক দিয়ে আসাই বন্ধ করে দিয়েছি। আর আপনি কিনা তাদের হয়ে?
– হ্যাঁ। ওরা তো তোমাকে জীবনে সরি বলবে না। যাইহোক ভুলে যাও ব্যাপারটা।

মেয়েটা চুপ করে রইলো। কোনো কথাবার্তা ছাড়াই উঠতে উঠতে বলল, আমি যাই। আমার ক্লাস আছে।
– যাবে তো। সরি একসেপ্ট করে যাও।

মেয়েটা কিছু বললো না। সায়ান উঠে দাঁড়ালো। মেয়েটার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আমাকেও ওদের মত বাজে ভাবছো তো?
– ভাবার সময় পাই নি।
– বাব্বাহ!
– আমি আসি।

সায়ান পিছন দিক থেকে ডাক দিলো, কোন ডিপার্টমেন্ট?

কোনো উত্তর এলো না। উত্তর না পেয়ে আবারও হতাশ হলো সায়ান। মেয়েটাকে ফলো করে এসে ওর ক্লাসরুম দেখে গেলো।

সায়ানের ভার্সিটি জুরে একটা সুনাম আছে। ভালো গান গাইতে পারে। কনসার্ট হলেই তো হলরুম জুরে ‘সায়ান, সায়ান’ কলরব ওঠে। মেয়েরাও হুমড়ি খেয়ে ক্রাশ খায় এই ছেলেটার উপর। কাজেই সায়ান মোটামুটি ধরণের ভাব নিয়ে চলাফেরা করে সবার সামনে। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে সায়ানের ভাব উবে গেছে আজকে। নিজে থেকে যেচে ফ্রেন্ডশিপ করতে এসে ফিরে যেতে হচ্ছে। ব্যাপারটা যেমন পীড়াদায়ক, তেমনি যন্ত্রণাদায়কও বটে।

সায়ানের বন্ধু মহল বেশ বড়। তন্মধ্যে ওর বেস্ট ফ্রেন্ড হচ্ছে অর্পা, সায়েম, নিবিড়, সোহানী, দিলরুবা ও ফাহমিনা৷ অর্পা আবার সায়ানের উপর দূর্বল। ওদের মধ্যে মিলটাও সবার চেয়ে একটু বেশি। সারাক্ষণ চ্যাটিং, ফোনালাপ, দেখা সাক্ষাৎ, ট্রিট সবকিছু থাকবেই। মাঝেমাঝে বাইক নিয়ে লং ড্রাইভেও যাওয়া হয়। মেয়েটার দেয়া কষ্টটুকু ভুলতে সায়ান অর্পাকে ফোন দিয়ে আসতে বলল।

অর্পা সায়ানের ডাকে পাখির মত উড়ে চলে আসে। সবসময়ই এ কাজটায় ও এগিয়ে। যেখানেই থাকুক না কেন, সায়ান ডেকেছে মানে আর দেরি করা যাবে না। যদিও এখনো সায়ানকে প্রপোজ করা হয়ে ওঠে নি। তথাকথিত ‘জাস্ট ফ্রেন্ড’ এর মতই এগোচ্ছে ব্যাপারটা।

অর্পা এসে দেখে সায়ান একটা কালো শার্ট পরে আছে। ফর্সা গালে চাপ দাড়ি সায়ানের। তার উপর কালো শার্ট ও কালো ব্রেসলেট এ ছেলেটাকে কি অপূর্ব যে লাগে। আরেকবার ক্রাশ খেয়ে অর্পা সায়ানের সামনে এসে বসলো। চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, কখন এসেছিস?
– মাত্র। আজ ভালো লাগছে না। বেড়াতে যাবি?
– শিওর। আমাকে কখনো কোয়েশ্চেন করবি না। সোজা বলবি আজকে বেড়াতে যাচ্ছি।
– ওকে বাবা। বাইক নিয়ে আসিনাই, রিকসায় যাইতে হবে।

অর্পা সায়ানের হাতের কনুইতে ধরে হাঁটা শুরু করে দিয়ে বলল, চল। শুনলাম গতকাল রিদিদের দল একটা নিউ ইয়ারের মেয়েকে র‍্যাগ দিয়েছে? তাও আবার তোকে এসে কি বলেছে?
– হুম।
– কি বলেছে বল না?
– এসব ছোটখাটো ব্যাপার আমি আর মনে করতে চাইছি না।

দুজনে নির্দ্বিধায় ক্যাম্পাসে কাছাকাছি হয়ে হেঁটে যাচ্ছে। অর্পা সায়ানের হাতের কনুইতে ধরে রেখেছে। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা দেখে বিদ্রুপের হাসি হাসলো কলেজে নতুন আসা মেয়েটা। এতক্ষণ ধরে সায়ানকেই পর্যবেক্ষণ করছিল ও। যদিও সায়ানের সাথে আচরণ খারাপ করেছে। কিন্তু সায়ান চলে আসার পর কেবল ওকেই খুঁজছিল। অর্পার সাথে ওকে দেখার পর হাসি এলো এবার। ও জানত এসব ছেলেদের বিশ্বাস নেই। প্রেমিকা রেখে আবার বন্ধুত্ব করতে আসে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here