অপ্রিয় আশালতা পর্ব ১

0
1802

প্রবাসী স্বামীর রুমমেটের পাঠানো কয়েক সংখ্যক স্ক্রিনশট দেখে কিয়ৎক্ষণ ধরে স্তব্দ হয়ে আছে আশালতা। স্ক্রিনশটগুলো মূলত আশালতার স্বামী এবং তার প্রাক্তনের সাম্প্রতিক কালের কিছু কথোপকথনের। এতক্ষণে আশালতা তার স্বামীর এই একমাস ধরে নানা অজুহাত দেখিয়ে তাকে এড়িয়ে চলার কারণটি খুজে পেয়েছে। তার স্বামী যে পুনরায় তার অতি সুন্দরী প্রাক্তনের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। স্ক্রিনশটে বিদ্যমান কথোপকথনগুলো দেখে গা গুলিয়ে ওঠে আশালতার। একটা মানুষ এত নিকৃষ্টও হতে পারে তাহলে?
ধপ করে মাথায় হাত দিয়ে মেঝেতে বসে পড়ে আশালতা। তবে কি তার কপাল পুড়ল বলে? এই জীবনে কি আর তার কপালে সুখ জুটবেনা? কেন সে আড়ালে সবার এত অপ্রিয়?
কাঁদেনা আশালতা। কাঁদলে যে একূলও যাবে আর ওকূল তো গেছেই। এই কথা তার শশুড়বাড়ির বাড়ির সকলে জানলে যে এখানে তার আর ঠাই মেলবেনা। কত লাঞ্চনা-বঞ্চনার স্বীকার হয়ে সে এই বাড়িতে পড়ে আছে। শুধুমাত্র তার একটাই আশার আলো ছিল স্বামীর ভালোবাসা। তার স্বামী যে তাকে ভালোবাসতো। কিন্তু আজ সে কি জানতে পারলো এটা? মন চায় চিৎকার করে কাদতে। কিন্তু পারেনা আশালতা। কারণ সব আশালতারাই যে পরিস্থিতির নিকটে বাধা পড়ে যায়।

রাতে বারান্দায় গিয়ে আশা কল দেয় তার স্বামী সাদকে। চার-পাচবার রিং হওয়ার পরে রিসিভ হতেই অপরপাশ থেকে ধমকের সুর ভেসে আসে।
-হয়েছি কি তোমার? শান্তিতে কি একটু কাজও করতে পারবনা তোমার জন্য? বলেছিনা আমাকে তুমি অসময়ে কল দেবেনা। আমি যখন ফ্রি হব তখন নিজেই কল দেব। (সাদ)
ডুকরে কেঁদে ওঠে আশা। অস্পষ্ট কন্ঠে বলে ওঠে,
-কেন করলে আমার সাথে এমন? যদি সত্যিই নিজের প্রাক্তনকে ভুলতে না পারো তবে কেন আমার সাথে ভালোবাসার নাটক করলে? কেন এই তিনটা বছর সংসার করলে সাদ? আমিতো কখনোই তোমাকে জোর করিনি যে আমাকে বিয়ে করতেই হবে। নিজেই তো বলেছিলে আমাকে নাকি তুমি ভালোবাসো বিয়ে করতে চাও। কেন করলে এটা? কেন তোমার একটু বুক কাঁপলনা সাদ?
অপরপাশ হতে কল কেটে দেয় সাদ। ক্ষানিকবাদেই বড়সড় একটা ম্যাসেজ লিখে পাঠিয়ে দেয় আশার নাম্বারে।

“কিভাবে সব জেনেছো আমি জানিনা আশা। আর জানতেও চাইনা আমি।আমাকে ক্ষমা করে দিও তুমি। আমি ইচ্ছা করে তোমাকে ঠকাইনি। তিনটা বছর তোমার সাথে সংসার করেছি। ভেবেছিলাম ভালোবেসেছি হয়তো তোমাকে। কিন্তু না ভালোবাসতে পারিনি আমি তোমাকে। কিন্তু হ্যা একটা গভীর মায়া জন্মেছে তোমার প্রতি। বিশ্বাস করো আমি লিনাকে অনেক ভালোবাসি। ওকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না। গত সপ্তাহে আমার জন্মদিনে ও আমাকে ম্যাসেঞ্জারে নক দিয়ে উইস করে। ওর স্বামীর সাথে ডিভোর্স হয়ে গেছে দেড় বছর আগেই। বিশ্বাস করো আশা আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি। স্বার্থপর হয়ে গেছি আমি। ও যদি সতীনের সংসার করতে রাজি থাকতো তবে আমি তোমাকে ছাড়তে চাইতাম না আশা। কিন্তু ও রাজিনা। ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেব। তুমি যাওয়ার আগে তোমার সব স্বর্ণ নিয়ে যেয়ো আশা। ভালো থেকো।“

আশার নাম্বার ব্লক করে দেয় সাদ। শত চেষ্টা করেও আর সাদের নাম্বারে কল ঢোকাতে পারেনি আশা। দৌড়ে নিজের রুমের চলে গিয়ে বালিশে মুখ গুজে কাঁদতে শুরু করে। নিজেকে তাও যেন সে ধন্য মনে করছে। এই কুশ্রী চেহারার ও সকলের অপ্রিয় আশালতার প্রতি তাহলে কারো একটু মায়াও জন্মেছিল? ভাবনার জগতে ডুব দেয় আশা।
নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান আশালতা। বাবা ছিল একজন অটো চালক। অবশ্য সে গত হয়েছেন দেড় বছর হতে চলল। বড় ভাই ছিল তখনও বেকার। আশালতা আঠার পেরোতেই চারপাশের মানুষের হৈ-হুল্লোড় শুরু হয়ে যায়। “মাইয়া ডাঙ্গর হইছে সারাজীবন কি মাইয়ারে গোলা বাইন্ধা রাখবা?” কন্যা ভারগ্র্যস্থ আশালতার বাবা-মা দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। কিভাবে মেয়ের বিয়ে দেবেন? মেয়ের শশুড়বাড়ির লোকদের খুশি করতে যে বিরাট অংকের টাকা-পয়সা লাগবে। তা তারা কোথায় পাবে। এর মাঝেই ফেসবুকে আশালতার পরিচয় হয় সাদের সাথে। কয়েকমাস টানা কথা বলার পরে বেশ বন্ধুত্বও হয়ে যায় তাদের মাঝে। একদিন কথায় কথায় সাদ তার প্রাক্তনের কথা খুলে বলে। আশালতারও বেশ মায়া হয় তার জন্য।
সাদ যখন জানতে পারে আশালতার বিয়ের জন্য পাত্র খুজছে তার বাবা-মা। তখনই সে জানায় আশালতাকে সে ভালোবাসে। আশালতা যদি রাজি থাকে তবে সে আশালতার বাবা-মায়ের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেবে। আশালতা সাদকে খুব করে বোঝাতে থাকে সাদের পরিবার কখনোই তাকে মেনে নেবেনা। তার রূপ দেখে যে কেউই তাকে পছন্দ করেনা। মুখে না বললেও আড়ালে যে সে সকলের অপ্রিয়। নাছড়বান্দা সাদের কাছে পরিশেষে হার মেনে আশালতা রাজি হয়ে যায়। কিন্তু বাধা সাজে সাদের পরিবার। আশালতাকে যে তারা কিছুতেই বাড়ির বউ করতে রাজি নয়। সাদের বড় ভাবির অনুপ্রেরণায় সাদ বেশ জোর করেই আশালতাকে বিয়ে করে নেয়। শুরু থেকেই শশুড়বাড়ির কেউই আশাকে মেনে নেয়নি। সারাক্ষণ চেষ্টা করে গেছে কি করে সাদের চোখে তাকে অপ্রিয় করে তুলবে।

বর্তমানে,
সকালে আশালতার ঘুম ভাঙতেই ঝাপসা চোখে দেখতে পায় তার শাশুড়ি তার মুখের দিকে রাগান্বিত হয়ে চেয়ে আছে। হুড়মুড় করে উঠে বসতেই দেখে রুমে পুরো বাড়ির সকলেই উপস্থিত আছে। আচমকা আশার শাশুড়ি তার চুল খা/ম/চে ধরে তাকে খাট থেকে টেনে নামায়।
-এতগুলো বছর অনেক কষ্টে তোরে সহ্য করছি। এইবার আমার ছেলেই অনুমতি দিছে তোরে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার। পাড়া-পড়শির কত ঠেস মা/রা কথা শুনেও তোরে এই বাড়িতে জায়গা দিছি। আমার ছেলেও তো তোরে ভালোবাসেনা। ঘরে নতুন বউ আসবে। তোর মতো ময়লার স্তূপ এই বাড়ি থাকলে বাড়ির অশান্তি কোনোদিন দূর হবেনা। আজকেই তুই বের হয়ে যাবি এই বাড়ি থেকে। (সাজেদা বেগম)
-আম্মা আমারে বের করে দিয়েন না। আমি কই যাব বলেন? আমি এই বাড়িতে কাজের লোক হয়ে থেকে যাব আম্মা। তবুও আমাকে বের করে দিয়েন না আম্মা। (আশালতা)
-এহ কথা শোনো? এত বছর ধরে চেষ্টা করছি তোরে বের করার এই বাড়ি দিয়ে। তোরে দয়া দেখায়ে নিজেদের পায়ে কু/ড়া/ল মা/র/ব? (ছবি,আশালতার ননদ)
-আম্মা আশার দিক একটু দেখেন। মেয়েটা কই যাবে? বাপেরবাড়ির অবস্থাও তো ভালোনা যে সেখানে থাকবে ও। আপনি দয়া করে একটু সাদকে বুঝান আম্মা। তিন বছর সংসার করে কিভাবে এটা করতে পারে সে? (রেশমা,সাদের বড় ভাবি)

আশালতার শাশুড়ি ধমকে বলে ওঠেন,
-তুমি চুপ করো বড় বউ। তোমারে এই বিষয়ে নাক গলাতে বলছে কেউ? তুমি তোমার রুমে চলে যাও। ছবি আলমারি দিয়ে ওর ব্যাগ বের করে সব জামা-কাপড় তাতে রাখ। আর সোনাদানা সব নিয়ে আমার রুমের আলমারীতে রাখ। তোর ভাইরে বলবি এই ছেমরি সব সাথে করেই নিয়ে গেছে।
-আচ্ছা আম্মা। (ছবি)
হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে আশালতা। এবার যে তার একূলও গেল আর ওকূলও গেল।
-ও আম্মা এত নিষ্ঠুর হবেন না আম্মা। আমাকে একটু জায়গা দেন আম্মা। আমি আপনার ছেলেরে বুঝাবো আম্মা। আমাকে একটু থাকতে দেন। (আশালতা)

ব্যাগপত্রসহ আশালতাকে বাড়ি থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় তার শশুড়বাড়ির লোকজন। শুধু অপরাধীর মতো এক কোণে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলে রেশমা। সে যে পারল না তার এই ছোট বোনটার জন্য কিছু করতে।

দুঃখিনী আশালতা ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের কাছে হার মেনে যায়। প্রতিনিয়ত এমন শত শত আশালতারা হার মেনে যাচ্ছে নিজেদের জীবনের কাছে।
ব্যাগপত্র হাতে নিয়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে রওনা হয় আশালতা।

আশালতাকে ব্যাগপত্র নিয়ে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করতে দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে তার বড় ভাবি মারজানা।
-আইসা পড়ছস দেখি? তা এইবার কি সারাজীবনের জন্যই চইলে আইছস আশা?
ভাবির ভারী কথা কর্ণগোচর হতেই বুকটা পুড়ে ওঠে আশালতার।

চলবে…

#অপ্রিয়_আশালতা
#সূচনা_পর্ব
আফিয়া অন্ত্রীশা

[বিশেষ কথাঃ গল্পের প্রথমটুকু একজন আপুর জীবন কাহিনী থেকে নেওয়া]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here