অন্তর দহন পর্ব ২৩

0
444

#অন্তর_দহন
#লেখনিতে_আরুহি_অহি

পর্ব___২৩

চন্দ্র স্পন্দনের পাশে বসে আছে।স্পন্দন তাকিয়ে আছে চন্দ্রের দিকে। এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে চন্দ্র বললো,

__এখন কেমন লাগছে স্পন্দন?

দূর্বল শরীর নিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে স্পন্দন বললো,

__এই যে চোখের সামনে তুমি আছো চন্দ্র। এখন বেশ ভালো লাগছে।

__সেদিন কি হয়েছিল স্পন্দন?

__আমি গাড়ি নিয়ে ডাক্তারের এপোয়েন্ট নিতে যাচ্ছিলাম। তোমার কথা মনে মনে ভাবছিলাম।বা পাশে একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি ওভারটেক করতে একটু অন্যমনষ্ক ভাবে রাস্তার মাঝে চলে এসেছিলাম। হঠাৎ মনে হলো সামনে থেকে একটা ট্রাক আমার দিকে ছুটে আসছে তীব্র গতিতে। আমি ব্রেক ঘুরিয়ে পাশে যাওয়ার আগেই পাশে থাকা ট্রাকটা আমার গাড়িকে পাশে যাওয়ার থেকে আটকে দেয়। এরপর একটা বিকট শব্দ হয়। আমার আর কিছুই মনে নেই চন্দ্র।

__আপনার গাড়িটা জায়গায় পিষে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল স্পন্দন।তবে আপনার ভাগ্য ভালো যে সিটবেল্ট বাঁধা ছিলো। না হলে অনেক বড় বিপদ হয়ে যেতো।এখনো অবশ্য কম বিপদ যায়নি আপনার উপর দিয়ে। তবুও বেঁচে আছেন। আমার কাছে এর থেকে বড় খুশির খবর আর দ্বিতীয়টি নেই স্পন্দন।

__মিশালকে আসতে বলো চন্দ্র।

__আসছে। আমি ফোন করেছি আপনার ফোন থেকে।একটা কথা জানতে চাই স্পন্দন।

__বলো চন্দ্র।

__হৃদি আপুর কোনো ছবি আছে আপনার কাছে?

__না।সব পুড়িয়ে ফেলেছি। কিন্তু কেনো?

__তাকে দেখতে কেমন বলতে পারবেন?

স্পন্দনের কাছে বর্ণনা শুনে কিছুটা বিস্মিত হয়ে গেছে চন্দ্র।ওর জানা মতে হৃদি সু’ইসাইড করেছে।তাহলে তার ফিরে আসার কথা নয়।এমনকি এই জন্য স্পন্দন জেলেও ছিলো।সে যদি বেঁচে থাকতো তাহলে তো স্পন্দনকে মিথ্যা মামলা থেকে বাঁচাতে এগিয়ে আসতো।হয়তো আমিই ভুল ভাবছি। এমন কিছু তো সম্ভব নয় কখনো।

স্পন্দন চন্দ্রকে এতো গভীর চিন্তা করতে দেখে চন্দ্রের হাতের উপর হাতটা রেখে বললো,

__কি হয়েছে চন্দ্র?

__ক্ কিছু না স্পন্দন। আপনি একটু ঘুমান। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।

স্পন্দনের শরীর তেমন ভালো না।তাই আর কথা না বাড়িয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলো। কিন্তু চন্দ্রের ভেতরে উথাল পাতাল ঝড় চলছে। অনেক গুলো প্রশ্ন ওর সামনে অথচ একটার ও উত্তর নেই ওর কাছে। এমন সময় নার্স এসে বললো,

__ম্যাম আপনাকে ডাক্তার বাবু ডাকছেন।

চন্দ্র উঠে দাঁড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে ওর আব্বু আর বড় আম্মু বসে আছে। ওনাদের দিকে তাকিয়ে চন্দ্র বললো,

__বড় আম্মু? তুমি ভেতরে গিয়ে বসো।স্পন্দন ঘুমাচ্ছে। আমি না আসা পর্যন্ত তুমি কাউকে ভেতরে আসতে দিবে না।আর না তুমি কোথাও যাবে।

__আচ্ছা চন্দ্র আমি বসে থাকবো ওর পাশে। তুই চিন্তা করিস না মা।

__আব্বু তুমি এখানে থাকবে।চোখ কান খোলা রাখবে।কে আসছে কে যাচ্ছে খেয়াল রাখবে।

__কিছু কি বুঝতে পারছিস চন্দ্র মা?

__অনেক কিছুই বুঝতে পারছি আব্বু।তবে সবকিছু এখনো ধোঁয়া ধোঁয়া আবছা। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস স্পন্দনের বেঁচে থাকা নিয়ে অনেক জনের ঘুম হারাম হয়ে গেছে।তাই বারবার ওদের আঘাত আসতে থাকবে আব্বু। আমাদের সব সময় সতর্ক থাকতে হবে।

__আমি তোর সাথে আছি চন্দ্র।ভয় পাস না মা।

__বড় আম্মুকে কিছু বলো না। টেনশন করবেন উনি। আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে আসছি।

চন্দ্র করিডোর থেকে বেরিয়ে ডাক্তারের কেবিনে গিয়ে নক করলো।ডাক্তার ভেতরে ডেকে বসতে বললেন। এরপর স্পন্দনের রিপোর্ট গুলো বের করে টেবিলে রেখে শুকনো মুখে বললেন,

__দেখুন মিসেস্ স্পন্দন আমরা স্পন্দন মির্জার যে রিপোর্ট গুলো হাতে পেয়েছি তাতে কিছু ভয়ংকর কথা লেখা আছে। আমি চাইনা আপনার কাছে কোনোকিছু লুকিয়ে রাখতে। আমি চাই আপনি ও আপনার স্বামী সম্পর্কে সমস্ত বিষয়ে অবগত থাকুন।

__জ্বী বলুন আপনি কি পেয়েছেন রিপোর্টে?

__স্পন্দনের শরীরের আঘাত গুলোর মধ্যে সব থেকে বড় আঘাত ও মাথায় পেয়েছে।এতে ওর মাথার নার্ভ গুলো ক্ষতিগ্রস্ত।আর ওর যে নার্ভ গুলো এখনো আছে সেখানে ব্লাড জমে গেছে।

চন্দ্র এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ডাক্তারের দিকে। চন্দ্র জানতো স্পন্দনের এই এক্সিডেন্টে ওর অনেক বড় আঘাত লেগেছে। কিন্তু এতটা আঘাত লেগেছে এটা বুঝতে পারে নি।তাই নিজেকে সামলাতে পারছে না চন্দ্র।

__আমি বলছি না যে এতে ওর বেঁচে থাকা বা সুস্থ থাকা সম্ভব নয়। আমি বলছি ওর জীবন সংশয় আছে এতে। আপনার এ বিষয়ে অবগত থাকতে হবে।ওর যে নার্ভ গুলোতে ব্লাড জমেছে সেখান থেকে ওর শারীরিক অবস্থার মাঝে মাঝেই অবনতি হবে। এগুলো আপনার খেয়াল রাখতে হবে।অন্তত ছয় মাস ওনাকে কোনো মেন্টাল প্রেসার দেওয়া যাবেনা।বড় আঘাত পেলে কিন্তু ভীষণ বড় বিপদ আসতে পারে মিসেস্ স্পন্দন।

ডাক্তারের বলা প্রতিটা কথাই চন্দ্রের মস্তিষ্কের ভেতরে মি’শাইলের মতো আঘাত করছে।ওর একটাই কাজ স্পন্দনকে বাঁচাতে হবে সেটা যেভাবেই হোক।বড় আম্মুকে এসব বললে উনি ভেঙে পড়বেন।বড় আব্বু জেলে।তাকেও খবর দেওয়া যাবেনা। চন্দ্রের এসব ভাবনার মধ্যে ডাক্তার বললেন,

__আমি জানি কথাগুলো শুনে আপনার উপর কতটা প্রভাব পড়ছে। কিন্তু ডাক্তার হিসেবে আমার দায়িত্ব আমার রুগির সমস্ত ডিটেইলস তার বাড়ির লোককে দেওয়া। আমি বুঝতে পারছি আপনার বয়স কম।স্বামীর এতো গুলো সমস্যা সম্পর্কে জানতে পেরে নিজেকে সামলে নিতে আপনার কষ্ট হচ্ছে মিসেস্ স্পন্দন। তবুও আমি বলতে বাধ্য। আমি ও নিরুপায়।তবে আমি আপনাকে এটুকু আশ্বাস দিতে পারি স্পন্দন মির্জার যেকোনো বিষয়ে আপনি আপনি আমাকে এসে বলবেন। আমি ওর ডাক্তার হিসেবে ওকে বাঁচিয়ে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।বাকিটা আল্লাহ পাক জানেন। আমার চিকিৎসার যতটুকু সাহায্য আপনাকে করা সম্ভব আমি তা করবো।

__আমি আপনার কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকবো ডাক্তার বাবু। আমার স্বামীর জীবন সংশয় আছে এটা আপনি আর কাউকে বলবেন না।ওর মা বাবা বয়স্ক মানুষ।তারা সামলাতে পারবে না।

__আপনি যেমন বলবেন মিসেস্ স্পন্দন।আমি ঠিক তেমনি করবো।

__আর একটা কথা ডাক্তার বাবু।

__জ্বী বলেন।

__স্পন্দন যেনো নিজের এই সমস্যা গুলো সম্পর্কে জানতে না পারে। আপনি আমাকে কথা দেন যে ওকে কিছু বলবেন না।

__কিন্তু মিসেস্ স্পন্দন আমাকে তো এটা তাকে বলতেই হবে।

__প্লিজ ডাক্তার বাবু আমার দিকটা একটু ভাবুন। আমার স্বামীর এক্সিডেন্টটা ইচ্ছে করে করানো হয়েছে। আমার স্বামীকে মেরে ফেলতে এই হাসপাতাল পর্যন্ত লোক পৌঁছে গেছে। আমি কিভাবে এখনো তাকে দেখে রেখেছি তা আমি জানি। আপনার সহযোগিতা ছাড়া বাকিটা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।প্লিজ আমাকে সহায়তা করুন ডাক্তার বাবু।

__আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন মিসেস্ স্পন্দন। আমি পূর্ণ সহযোগিতা করবো আপনার স্বামীকে বাঁচিয়ে রাখতে।

__ধন্যবাদ দিয়ে আপনাকে ছোট করবো না ডাক্তার বাবু। আল্লাহর কাছে আপনার জন্য লাখ লাখ শুকরিয়া আদায় করি তিনি যেনো আপনার নেক হায়াত দান করেন। আমার স্বামীর জন্য দোয়া করবেন ডাক্তার বাবু।

__অবশ্যই করবো মিসেস্ স্পন্দন। আমি যতটুকু পারি আপনাকে সহায়তা করবো।

__এই খবরটা দয়া করে বাইরে না যায় ডাক্তার বাবু।

__আমি সেদিকে খেয়াল রাখবো মিসেস্ স্পন্দন।

__আমি এখন আসি ডাক্তার বাবু।

__জ্বী আসুন।

ডাক্তারের কেবিন থেকে এলোমেলো বিধ্বস্ত পায়ে বেরিয়ে এলো চন্দ্র। নিজের শরীর ও আগে থেকেই ভালো ছিলো না।তার উপর কয়েকদিন ধরে যেভাবে খাওয়া ঘুম নেই চন্দ্রের তাতে আরো ভেঙে পড়েছে ভেতরে ভেতরে। কিন্তু কাউকে বুঝতে দেওয়া যাবেনা এই সময়ে।তাই যতটা সম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে চলেছে চন্দ্র। বাইরে এসে দেখে ওর মা আর মেঝো আব্বু আম্মু আসছে। চন্দ্রকে দেখেই ওনারা এগিয়ে এলেন। চন্দ্রের কাছে জানতে চাইলেন ডাক্তার কি বলেছে। চন্দ্র বললো,

__স্পন্দন ঠিক আছে। সমস্যা নেই।আমরা কয়েকদিন পরেই ওকে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবো।

সবাই একসাথে বলে উঠল,

__আলহামদুলিল্লাহ।

চন্দ্রের মাথায় ওর মা হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

__কয়েকদিন ধরে সমানে দৌড় ঝাঁপ করছিস চন্দ্র।তোর শরীরের দিকেও তো তাকানো যাচ্ছেনা মা।

__আমি ঠিক আছি আম্মু। আমার স্পন্দন সুস্থ হয়ে গেলে আমিও সুস্থ হয়ে যাবো।তোমরা আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না আম্মু।

ওর মা চোখটা মুছে নিয়ে বললো,

__আমার সেই দিনের এতোটুকু চন্দ্র। আজকে কতটা বড় হয়ে গেছে। নিজেকে সামলে স্বামী সংসার সামলাতে শিখে গেছে রে মেঝো আপা।

__আমাদের চন্দ্র লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে।ও পারে না এমন কোনো কাজ নেই ছোট। তুই চিন্তা করিস না ছোট।

__হুম মেঝো আপা।

__আমি বড় আম্মুকে পাঠিয়ে দিচ্ছি আম্মু। কিছু খাইয়ে দিও। আম্মুর প্রেসার আপ ডাউন করছে এতো টেনশনে।

__তুই একটু খাবি না চন্দ্র?

__আমি পরে খাবো মেঝো আম্মু।আসছি আমি।

চন্দ্র যাওয়ার সময় মিশালকে একটা টেক্সট করে দিলো। এরপর স্পন্দনর কেবিনে চলে গেলো।

#চলবে,,,,,,,,

ভুল ত্রুটি মার্জনীয়। গল্প পড়ে ভালো লাগলে লাইক কমেন্ট করে লেখিকাকে উৎসাহিত করুন।হ্যাপি রিডিং।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here