অন্তর দহন পর্ব ১৭

0
441

#অন্তর_দহন
#লেখনিতে_আরুহি_অহি

পর্ব___১৭

শহরের শেষ মাথায় একটা নিরিবিলি পরিবেশে অনেক সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ‘সেতারা’ নামের একটি রিসোর্ট। চারপাশে খোলা মাঠ। লোকজনের হৈচৈ তেমন নেই বললেই চলে। হাইওয়ে রোডের একদমই পাশে রিসোর্টটি।বেশ শান্ত আর মনোরম পরিবেশ চারিদিকে।গাড়িটা তার সামনে গিয়ে হর্ন দিতেই দারোয়ান এসে গেইট খুলে দিলো।স্পন্দন গাড়ি ভেতরে নিয়ে থামিয়ে নেমে পড়লো। এরপর চন্দ্রের পাশের দরজা খুলে নামতে বললো। চন্দ্র নেমে দাঁড়াতেই স্পন্দন চন্দ্রের হাতটা ধরে ভেতরে একটা গার্ডেনের মতো জায়গায় নিয়ে এলো। ওরা আসতেই চারপাশে আলো গুলো জ্বলে উঠলো। চন্দ্র এদিকে ওদিকে ঘুরে ঘুরে দেখছে পুরোটা। এরপর বললো,

__ইশ্ কত্তো সুন্দর এটা স্পন্দন।

__পছন্দ হয়েছে চন্দ্র?

__ভীষণ পছন্দ হয়েছে স্পন্দন।

স্পন্দন চন্দ্রের হাত ধরে আরেক পাশে নিয়ে গেলো।করিডোরের পাশেই একটা কৃত্রিম ফুয়ারা।তার চারপাশে অনেক সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। চন্দ্র মুগ্ধ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে।স্পন্দন কখন যে ওর হাত ছেড়ে দিয়ে সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে তা চন্দ্র খেয়াল করে নি। খেয়াল হতেই চন্দ্র তাকিয়ে দেখে স্পন্দন একতোড়া গোলাপ ফুল আর একটা আংটি নিয়ে চন্দ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এরপর স্পন্দন বললো,

__আমাকে তোমার মতো করে ভালোবাসবে চন্দ্র? আমার হাতটা ধরে সারাজীবন আমার পাশে পায়ে পা ফেলে হাঁটবে চন্দ্র?এই অগোছালো ছন্নছাড়া স্পন্দনকে সারাজীবন গুছিয়ে রাখবে চন্দ্র?

চন্দ্র মুগ্ধতা নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে। চোখের কোণে জল চিকচিক করছে চন্দ্রের। এমন ভাবে স্পন্দন যে কখনো চন্দ্রকে ভালোবাসার কথা বলবে সেটা যেনো ও ভাবতেই পারেনি।স্পন্দনের চোখ দুটো ও ছলছল করছে।খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে চোখের চাহনি। চন্দ্র মাথা নেড়ে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে স্পন্দনের হাতের সামনে এগিয়ে দিয়ে বললো,

__আপনাকে চন্দ্র চন্দ্রের মতো করেই সারাজীবন ভালোবাসবে স্পন্দন। আপনার হাতে হাত রেখে পায়ে পা মিলিয়ে সারাজীবন আপনার পাশে থাকবে চন্দ্র। আপনার জীবনের সবটুকু দুঃখ কষ্ট ভুলিয়ে দিয়ে আপনাকে চন্দ্র আগলে রাখবে সারাজীবন।

স্পন্দন খুশিতে কেঁদে ফেললো। চন্দ্র ও তাই।স্পন্দন চন্দ্রের হাতে আংটি পরিয়ে দিয়ে ফুলটা চন্দ্রের হাতে দিলো। চন্দ্রের হাত ধরে উঠে দাঁড়িয়েই চন্দ্রকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো স্পন্দন। চন্দ্র স্পন্দনের বুকে মাথা রেখে বললো,

__ভালোবাসি স্পন্দন।

__ভালোবাসি চন্দ্র। তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি। আমাকে ছেড়ে কখনো দূরে যেওনা চন্দ্র।

এরপর কিছু সময় নীরব সবকিছু। দুজন দুজনের বুকের শব্দ গুলো মন দিয়ে শুনতে লাগলো।এক অদ্ভুত শিহরণ খেলে যাচ্ছে দুজনের মধ্যে। এরপর লেকের পাশে চন্দ্র স্পন্দনের কাঁধে মাথা রেখে আঙ্গুলের ভাঁজে আঙ্গুল দিয়ে বসলো।স্পন্দন বললো,

__কি থেকে কি হয়ে গেলো। তাইনা চন্দ্র

__হুম।

__আমি কখনো ভাবিনি আমার চন্দ্রকে এতটা ভালোবাসবো।এতোটা পাগলামি করবো চন্দ্রের জন্য।

__আমিও ভাবিনি এই রাগী গোমরামুখো স্পন্দনকে এতোটা ভালোবাসবো স্পন্দন।

__আমি কখনো মনের কথা মুখে বলতে পারি না চন্দ্র।এই যে তোমাকে এটুকু বলতে আমার শরীরের ঘাম ছুটে যাচ্ছিলো চন্দ্র।

স্পন্দনের কথা শুনে চন্দ্র খিলখিল করে হেসে উঠলো। সেদিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে স্পন্দন বললো,

__তোমার চোখের দিকে তাকালে কেমন মায়াবী লাগে সবকিছু। শরীর থেকে একটা হীম শিতল ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায় হৃদয় জুড়ে। চারপাশের সৌন্দর্যের সাথে পাল্লা দিয়ে তোমার সৌন্দর্যে ভেসে যাই আমি। তুমি আসেপাশে থাকলে মনে হয় আমার ভেতরে মাত্রাতিরিক্ত মাদকতা কাজ করে। আমি যেনো একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাই। তোমার নেশায় আসক্ত হয়ে যাই।এই আসক্তিতে ক্লান্তি নেই।আছে শুধু হারানোর ভয়।মনে হয় এতো সুখ এতো ভালোবাসা সইবে তো আমার? আমি শুধু তোমার ভালোবাসার অন্তর দহনে জ্বলে পুড়ে যাই চন্দ্র। তোমার মধ্যেই আমার হকল সুখের পরিব্যাপ্তি শুরু হয়, আবার শেষ ও হয়। আমি শুধু তোমাকে আর তোমাকেই ভালোবাসতে চাই চন্দ্র।

চন্দ্র মুগ্ধ হয়ে স্পন্দনের কথাগুলো শুনছে।কি এক অনাবিল শান্তি অনুভব হচ্ছে ভেতরে ভেতরে তা বলে বোঝাতে পারছেনা চন্দ্র। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নেমে এসেছে ধরায়। জোছনার আলোয় ঝলমল করছে চারপাশ। সাথে বাড়তি সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিচ্ছে চন্দ্রের হাস্যোজ্বল মুখটা।রাতে ডিনার করে বাসায় ফিরেছে চন্দ্র আর স্পন্দন। চন্দ্র বেলকনিতে গিয়ে স্পন্দধনের পাশে গুটিসুটি দিয়ে বসে আছে স্পন্দন।স্পন্দন বললো,

__যতো তোমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি।ততোই হারিয়ে ফেলার ভয়ে গুটিয়ে যাচ্ছি চন্দ্র।

__এতো হারিয়ে ফেলার ভয় কেনো?

__আমি যে তোমাকে ছাড়া নিঃশ্বাস নিতে পারিনা চন্দ্র। আমার সবকিছু ফাঁকা ফাঁকা লাগে চন্দ্র। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে তখন।

__আপনি এসব বলবেন না স্পন্দন। চন্দ্র আছে তো আপনার পাশে সব সময়। তবুও এতো ভয় পান কেনো স্পন্দন?

__জানিনা চন্দ্র।ভয় হয়। ভীষণ ভয়।

চন্দ্র এবার পেছনে ফিরে স্পন্দনের চোখে চোখ রেখে বললো,

__আপনি যদি কোনো অপরাধ না করে থাকেন তাহলে চন্দ্রকে হারিয়ে ফেলার ভয় কখনো পাবেন না স্পন্দন। চন্দ্র আপনার সাথে থাকার কথা দিয়েছে।আর তার কথা সে রাখবে স্পন্দন।ভয় পাবেন না আপনি।

স্পন্দনের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। চন্দ্র তাড়াতাড়ি করে বিষয়টা সামলে নিতে বললো,

__ঘুমাতে চলেন স্পন্দন। অনেক রাত হয়ে গেছে।

চন্দ্রকে বুকে নিয়ে শুয়ে আছে স্পন্দন। চন্দ্রর বলা কথাটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। চন্দ্র কিছু আঁচ করতে পারেনি তো। আবরার চৌধুরীর লোক সৈয়দ মির্জার লোক সেজে যে কথা গুলো চন্দ্রকে বলেছে তাতে কি চন্দ্র আমাকেও সন্দেহ করছে?এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেছে স্পন্দন। চন্দ্র সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে স্পন্দন পাশে নেই।ওয়াশরুম ফাঁকা।এতো সকালে কোথায় গেছে তা ভেবে বেলকনিতে পা দিতেই দেখলো নিচে বড় আব্বুর সাথে কথা বলছে স্পন্দন। দূর থেকে কিছু কানে না আসলেও দুজনের মধ্যে কথা শুনে মনে হচ্ছে রেগে আছে দুজনেই। চন্দ্র তাড়াতাড়ি করে নিচে নেমে এলো।ওর চোখ বাগানের দিকে।বড় আম্মু বললো,

__কিরে চন্দ্র কলেজ নেই আজকে?

__আছে বড় আম্মু।

__এখানে কি।গোসল করে আয়। আমার নাস্তা রেডি হয়ে গেছে প্রায়।স্পন্দন উঠেছে?

__হু।

__কি হয়েছে তোর?চোখ মুখ এমন লাগছে কেনো দেখতে?

__কিছু না বড় আম্মু।

চন্দ্র তাড়াতাড়ি করে উঠে এলো।প্রায় সাথে সাথেই স্পন্দন ও এসেছে। চন্দ্র ভুত দেখার মতো চমকে উঠে বললো,

__আরে আপনি এখানে?আমি আরও ভাবলাম সকাল সকাল কোথায় গেছেন আবার।

স্পন্দনের মুখ থমথমে। গম্ভীর মুখে বললো,

__আমি রেডি হয়ে নিচে আসছি। তুমি রেডি হয়ে নাও চন্দ্র।

চন্দ্র এতো সময় কেমন যেনো নিঃশ্বাস আটকে ছিলো।কি এমন হলো যে স্পন্দন আজকে আবার এতো রেগে আছে?নাহ্ আজকে আর স্পন্দনকে বেশি খেপানো ঠিক হবেনা। পাশের রুমে গিয়ে গোসল সেরে রেডি হয়ে নিলো চন্দ্র। গাড়িতে কোনো কথাই বলেনি আজকে স্পন্দন। নামিয়ে দেওয়ার সময় শুধু বলে গেছে,

__আমি না আসা পর্যন্ত কলেজ থেকে বের হবে না।

__জ্বী আচ্ছা।

চন্দ্রকে ক্লাসে অন্যমনষ্ক হতে দেখে রাত বললো,

__কি হয়েছে তোর? জামাইয়ের প্রেমের ডোজ কি বেশি পরেছে নাকি?তাই এমন মুখ ফুলিয়ে আছিস মনে হয়।

__কিছু হয়নি। আমি আজকে ক্লাস করবো না রাত। আমি আব্বুর অফিসে যাবো দেখা করতে। তুই একটু সামলে নিস এদিকে।স্পন্দন আসার আগেই আমি ফিরে আসবো।

__কিন্তু হঠাৎ?

__পরে বলবো।আসছি আমি।

চন্দ্র কলেজ থেকে রিকশা নিয়ে বেরিয়ে গেছে।ও জানেই না স্পন্দনের লোক ওর পেছনে সব সময়ই আছে।সেও গাড়ি নিয়ে ওর পেছনে যেতে যেতে স্পন্দনকে ফোন করে বললো,

__স্যার?ম্যাম রিকশায় করে সৈয়দ আশরাফ সাহেবের অফিসে এসেছে। মাত্র ভেতরে গেছে।

__তুমি পেছনে থাকো।বিপদ দেখলে সাথে সাথে আমাকে জানাবে আর ব্যবস্থা নিবে।

__জ্বী স্যার।

স্পন্দন তীব্র দৃষ্টিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে।কি এমন হলো যে চন্দ্র আমাকে না জানিয়ে কলেজ থেকে মেজো আব্বুর সাথে দেখা করতে গেছে।

__আব্বু?

__চন্দ্র মা তুই এখানে? সত্যি সত্যি তুই এসেছিস? আমি তো ভাবতেই পারছিনা চন্দ্র।

__বড় আব্বুর সাথে স্পন্দনের এতো ঝামেলা কি নিয়ে আব্বু?

__আমি জানিনা।

__সত্যি করে বলো আব্বু। আমার মন বলছে তুমি সবকিছু জানো।

__আমি কিছু জানিনা।তবে তুই কি এগুলো শুনতেই এখানে এসেছিস?যদি তাই হয় তাহলে বেরিয়ে যা এখান থেকে। ওদের সম্পর্কে আমার কাছ থেকে তুই কিছুই জানতে পারবি না চন্দ্র।

__কিন্তু কেনো আব্বু?

__আমি চাইনা তুই ওদের এই ঝামেলায় নিজেকে জড়িয়ে নিস। আর তার জন্যেই আমি তোকে আনতে চেয়েছিলাম নিজের কাছে। আমি জানতাম এমন কিছু তোর সামনে আসবে যা তোকে ওদের মধ্যে ঢুকতে বাধ্য করবে।আর আমি বাবা হিসেবে সেটা চাইনা।

__তোমার চাওয়া না চাওয়ায় আর কিছু আসে যায় না চন্দ্রর। আমার স্পন্দনের দিকে কেউ যদি চোখ তুলেও তাকায় এই চন্দ্র কি করবে তা তুমি ভাবতে পারবে না আব্বু।সে যেই হোক না কেনো।

চন্দ্র বেরিয়ে গেলো অফিস থেকে। আবার রিকশা করে কলেজের দিকে আসতে লাগলো।চিন্তা স্পন্দন কলেজে আসার আগেই পৌঁছাতে হবে ওকে।

#চলবে,,,,,,

লেখায় ভুল ত্রুটি মার্জনীয়। গল্প পড়ে লাইক কমেন্ট করে লেখিকাকে লেখায় উৎসাহিত করুন। মূল্যবান মতামত দিয়ে ভুল গুলো তুলে ধরুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here