#অন্তর_দহন
#লেখনিতে_আরুহি_অহি
পর্ব__১২
ভালোয় ভালোয় হলুদ অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে। চন্দ্রদের যে রুমে থাকতে দেওয়া হয়েছে সেখানে বসে চুল শুকিয়ে নিচ্ছে।এই অবেলায় আবার গোসল করতে হয়েছে স্পন্দনের ঐ ভাবে হলুদ মাখানোর জন্য।মনে মনে খুব অভিমান হয়েছে স্পন্দনের উপর।তাই মুখ ফুলিয়ে বসে আছে চন্দ্র। হঠাৎ করেই দরজায় শব্দ হতেই তাকিয়ে দেখে ওর মা দাঁড়িয়ে। চন্দ্র সালাম দিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো।ওর মা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
__এখনো রেগে থাকবি চন্দ্র?ক্ষমা করবি না তোর আব্বু আম্মু কে?
__তোমরা কোনো অপরাধ করো নি আম্মু।তাই ক্ষমা করা বা রেগে থাকার মতো কিছু হয়নি।যা হয়েছে তা আমার নিয়তি বলেই মেনে নিয়েছি।এই নিয়ে আমার অভিমান থাকলেও অভিযোগ নেই কোনো আম্মু।
__ও বাড়িতে আর আসবি না চন্দ্র?
__আসবো না কেনো?সময় হোক। তারপর আসবো।
__আমি জানি আমরা তোর মতের বিরুদ্ধ গিয়ে তোকে এভাবে জোর করে বিয়ে দিয়ে উচিত করি নি। কিন্তু বিশ্বাস কর চন্দ্র,,,,,
__বিশ্বাস বলছো কেনো আম্মু? আমি তোমাদের মেয়ে। তোমাদের যেভাবে আমি চিনি তেমন করে তো আর বাইরের কেউ চিনতে পারবে না।তাই এভাবে বলো না আমাকে।
__আমরা ভীষণ নিরুপায় ছিলাম চন্দ্র।তোর দাদিমার একটাই কথা ছিলো যেনো বিয়েটা আমরা যেভাবে হোক দিয়ে দেই।
__একটা কথা বলবা আম্মু?
__বল কি বলবি চন্দ্র।
__দাদিমা আমার সাথে এমনটা কেনো করলো?
__আমি জানিনা আম্মা এটা কেনো করেছে।তবে আমরাও তোর কাছে সমান অপরাধী।পারলেই আমরা তোর দাদিমার কথা উপেক্ষা করতে পারতাম। কিন্তু তোর আব্বু চায়নি তার আম্মার মনে কষ্ট দিতে। আজীবন তার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে এসেছে।তাই আর পিছপা দিতে পারেনি।
__মায়ের কথা রাখতে গিয়ে মেয়ের মুখটাই ভুলে গেলো আব্বু?
__চন্দ্র? এভাবে বলিস না মা।
__চন্দ্র এখন আর কাউকে দায়ী করে না আম্মু। কারণ চন্দ্র একটা মেয়ে।তার কোনো অধিকার নেই নিজের সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দেওয়ার। সেখানে দাঁড়িয়ে অন্যকে দোষারোপ করা চন্দ্রের সাজে না আম্মু।গত কয়েকদিন ধরে চন্দ্র যতটা আঘাত পেয়েছে তা যথেষ্ট তাকে শক্ত হয়ে থাকতে। তুমি আর আব্বু ও অভ্যস্ত হয়ে যাও তোমাদের মেয়ের এই পরিবর্তন দেখে।যত তাড়াতাড়ি তোমরা সত্যিটা মেনে নিবে তত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবে তোমাদের মেয়ে কেমন ছিলো আর এখন কেমন আছে।
__কিন্তু চন্দ্র?
__অনেক সময় ধরে এখানে আছি আম্মু। আমাদের এবার বাইরে যাওয়া দরকার।
__এড়িয়ে যাচ্ছিস?
__কিছুটা।
__চন্দ্র?
__আসছি আম্মু।
চন্দ্র রুম থেকে বেরিয়ে সোজা চিলেকোঠার ঘরের দিকে হাঁটতে লাগলো। পেছনে না ফিরেও স্পষ্ট বুঝতে পারলো ওর আম্মু অশ্রুসিক্ত নয়নে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। চন্দ্র চিলেকোঠার ঘরে পুরোনো আসবাবপত্রের পাশেই হাঁটু গেড়ে বসে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।আর বিরবির করে বলতে লাগলো,
__আমাকে ক্ষমা করে দাও আম্মু। আমি কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছিনা। তোমরা এই বিয়েটা কেনো দিলে আম্মু?তোমরা চাইলেই দাদিমাকে বোঝাতে পারতে। চাইলেই আমার হাসিখুশি জীবনটাকে এভাবে এলোমেলো হতে বাঁচাতে পারতে।কেনো করলে না আম্মু?আর দাদিমা?যাকে আমি সবথেকে বেশি ভালোবাসি সেই মানুষটি আমাকে বিনা অস্ত্রেই ক্ষতবিক্ষত করে দিলো। কিভাবে করতে পারলো?তোমরা সবাই স্পন্দনের জীবন সাজাতে চাইলে চন্দ্রের জীবনকে এলোমেলো করে দিয়ে।সবাই তার ভালো চাইলে, কিন্তু কেউ আমার ভালো চাইলে না।
চন্দ্র মাথায় কারো আলতো হাতের স্পর্শে মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে স্পন্দন শুষ্ক মুখে দাঁড়িয়ে আছে। খুব শান্ত ভাবে বললো,
__আমি যদি তোকে এই মুহূর্তে কোথাও নিয়ে যেতে চাই। তুই যাবি চন্দ্র?
চন্দ্র উঠে দাঁড়িয়ে চোখ মুছে স্পন্দনকে বললো,
__চলুন।
চন্দ্রের হাতটা ধরে স্পন্দন সবার চোখের আড়ালে বাইরে বেরিয়ে গেলো। গাড়িতে উঠে দু’জনেই চুপচাপ বসে আছে।গাড়ি ড্রাইভ করছে স্পন্দন। চন্দ্রের চোখ মুখ ফুলে আছে অসম্ভব ভাবে।বেশ অনেক সময় ধরে কেঁদেছে তাই হয়তো এমন লাগছে।কিছুটা পথ এগিয়ে গিয়ে একটা পার্কের পাশেই গাড়িটা থামলো।স্পন্দন নিজে নেমে চন্দ্রকেও নামতে বললো। চন্দ্র চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো।একটা ছোট্ট লেখের পাশেই পার্কটা। খুব নিরিবিলি আর গাছপালা আছে সাড়ি সাড়ি। আশেপাশে বেঞ্চ ও আছে।তার একটার কাছে এগিয়ে গিয়ে স্পন্দন বসতে বললো চন্দ্রকে।নিজেও বসে পড়লো। এরপর আবার পিনপতন নীরবতা।সূর্য কিছুটা হেলে এসেছে। গোধূলির ঠিক কিছুটা আগে হবে বোধহয়। চন্দ্র চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখতে লাগলো।মনে মনে ভাবলো,
__এখানে কেনো আনলো স্পন্দন? আবার আমাকে মে’রে টেরে গুম করে দিবে না তো? অসম্ভব!স্পন্দধ এমন করতেই পারেনা। আবার মানুষের মন কখন কি হয় বলা যায় না।হয়তো দিতেও পারে।
এসব জল্পনা কল্পনার মধ্যে স্পন্দন বললো,
__আমি তোকে এখানে মে’রে টেরে রেখে যেতে পারি এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। আমি কিছু বলার জন্য তোকে এখানে এনেছি। আমার জীবনের কিছু কথা তোর জানা দরকার চন্দ্র।
চন্দ্র কি সব উল্টাপাল্টা ভাবছিলো স্পন্দনকে নিয়ে তা আবার মনে করতে দাঁত দিয়ে জিভ কামরে ধরলো।স্পন্দন বললো,
__আমি তখন মাস্টর্স করছি। ছেলে বন্ধু থাকলেও মেয়ে বন্ধু ছিলো না বললেই চলে। স্বভাবতই আমি হৈচৈ আড্ডা এগুলো এড়িয়ে চলতে পছন্দ করতাম। নিজের মতো থাকতাম বেশিরভাগ সময়। একদিন বন্ধুগুলো অনেকটাই জোর করে অডিটোরিয়ামের কোনো একটা ফাংশানে নিয়ে যায়। সেখানে তখন স্টেজে একটা মেয়ের পারফরম্যান্স হচ্ছিলো।তার মুখের দিকে তাকিয়ে স্পন্দন থমকে গেলো। মেয়েটির চোখে মুখে অদ্ভুত একটা স্নিগ্ধ হাসি লেগেই ছিলো।সেটাই স্পন্দনকে আকৃষ্ট করছিলো বারবার।ক্ষণে ক্ষণে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছিলো স্পন্দন। অনেকটাই বিমোহিত হয়ে পড়লো মেয়েটির উপরে।মেয়েটিই ছিলো হৃদি। এরপর অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয় ওর সাথে পরিচয় করতে। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। এরপর তা ভালোবাসায় রূপ নেয়।
এটুকু বলেই স্পন্দন থেমে গেলো। চন্দ্রের বুকটা ভারী হয়ে আসছে। তবুও নিজেকে সামলে রেখেছে।স্পন্দন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আগের ন্যায় চুপচাপ বসে আছে। চন্দ্র বললো,
__হৃদি আপু কোথায় এখন স্পন্দন?
__জানিনা চন্দ্র।
__কেনো জানেন না?
__সে যে ঠিকানায় চলে গেছে সেখান থেকে তার খোঁজ নেওয়া সম্ভব হয়নি স্পন্দনের।
__কোথায় গেছে স্পন্দন?
স্পন্দন আবার নীরব। চন্দ্র আবার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বললো,
__কি হয়েছে হৃদি আপুর?
__সেদিন আমাদের দেখা করার কথা ছিল।হৃদি ফোনে খুব কান্নাকাটি করছিলো।ওর বাড়ি থেকে আমাদের সম্পর্কের কথা জেনে গিয়েছিলো।তারা রাজী ছিলোনা।তাই হৃদিকে বিয়ের জন্য প্রেসার দিচ্ছিলো। এদিকে আমি তখনও বেকার। চাকরি হয়নি। বাবার টাকায় চলছি। তবুও ওকে কথা দিয়েছিলাম যাই হয়ে যাক না কেনো আমি ওর হাতটা শক্ত করে ধরে রাখবো। কখনো ছেড়ে দিবো না তাকে।ও ভরসা করতো। কিন্তু বাবা ভাইয়ের চাপের জন্য প্রচন্ড ছটফট করতো। আমার সাথে দেখা করা কথা বলা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিলো।মাঝে মাঝে লুকিয়ে বাড়ির ফোন থেকে ফোন করতো। নিজের ফোনটা ওরা নিয়ে নেয়। আমি ও ছটফট করতে থাকতাম ওর একটা খবর নেওয়ার জন্য।একটু কথা বলার জন্য।ও ভীষণ কান্নাকাটি করতো ফোন করে।আমি অসহায় হয়ে শুধু দেখতাম।কিছুই করার ক্ষমতা ছিলো না তখন আমার।
__সেদিন দেখা করেছিলেন?
__নাহ্।ও আসেনি সেদিন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত অব্দি আমি এই বেঞ্চিতে বসে ওর জন্য অপেক্ষা করছিলাম।ভেতরে ভেতরে অস্থিরতা বাড়তে থাকে যত সময় গড়াতে থাকে ততই।ভয়ে বুক কাঁপতে লাগলো আমার।কি হয়েছে না হয়েছে এগুলো নিয়ে ভয়ংকর সব কথা মাথায় আসতে থাকে।
__এরপর কি হয়েছে?
__আমি এখনো সেই বেঞ্চিতে বসে লাস্ট দু’বছর ধরে অপেক্ষাই করছিলাম।যদি কখনো হৃদি ফিরে আসে তাই। কিন্তু আমার অপেক্ষার শেষ হয় যেদিন দাদিমাকে ওয়াদা করি তোকে বিয়ে করার জন্য। আমি দাদিমাকে কথা দেই তার বলা কথাটা আমি রাখবো।
__দাদিমাকে হৃদি আপুর কথা বলেননি কেনো?
স্পন্দন একটু হাসলো। তারপর বললো,
__বললে কি হতো চন্দ্র?
__আপনার আমাকে বিয়ে করতে হতো না। আপনার সাথে হৃদি আপুর বিয়ে হতো। আমি তখন আপনাদের মাঝে কাঁটা হয়ে আসতাম না স্পন্দন।
কিছুক্ষণ আবার শুনশান নীরবতা। চন্দ্র আবার বলে উঠলো,
__আপুকে খুব ভালোবাসেন। তাইনা স্পন্দন?
__হুম ভীষণ ভালোবাসতাম।
__এখনো ভালোবাসেন?
__এখন ভালোবাসি কি-না তা জানিনা।তবে তার স্মৃতি এখনো বুকের মধ্যে তাজা হয়ে রয়ে গেছে।
__ভালোবাসলে কি ভুলে যাওয়া যায়?
__না তা হয়তো যায় না। আমি ও পারিনি সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে।তবে,,,,,,,
__তবে কি স্পন্দন?
#চলবে,,,,,,
লেখায় ভুল ত্রুটি মার্জনা করবেন। সুন্দর করে একটা মনের কথা বলে যাবেন গল্পটা ঠিক কেমন লাগছে আপনাদের। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সকল ভাষা শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা রইলো।