#অন্তঃপুরে_দহন (পর্ব-3)
#আরশিয়া_জান্নাত
বৈচিত্রতা মানব অস্তিত্বের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখানে প্রতিটা মানুষ ভিন্ন চরিত্রের অধিকারী। কেউ কারো মতো শতভাগ হয় না । ভিন্নতা থাকবেই। কেউ আগুনের মতো উগ্র তো কেউ পানির মতোই শান্ত-স্থির! এভাবেই প্রকৃতি তার ব্যালেন্স ঠিক রাখে। অনীল আর শামীমাও তারই উজ্জ্বল উদাহরণ! অনীল যতোটা উগ্র শামীমা ততোটাই শান্ত। সংসারের একক আধিপত্য অনীলের। তার পারমিশন ছাড়া শামীমা কিছুই করার সাহস রাখেনা। এমনকি কি রান্না হবে তাও তার মর্জিমাফিক। এখানে শামীমার ইচ্ছার অনিচ্ছার দাম তো দূর; আছে বলেও মনে করে না অনীল। অনীলের এই বৈশিষ্ট্যটা এসেছে কিভাবে সেটাও বলে রাখা ভালো। অনীল ছিল পরিবারের ছোট ছেলে। তার তিন বোন আর দুই ভাইয়ের মাঝে অনীল ছিল সবচেয়ে বেশি কর্মঠ। পড়াশোনার পাট চুকানোর আগেই পিতার বর্তমানে সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল তাকে। বড় ভাই অকর্মাই বলা চলে। এখনো তার সংসারের খরচ অনীল দেয়। বোনদের বিয়ে কিংবা সাংসারিক যেকোনো ফিনান্সিয়াল সাপোর্ট অনীলের দ্বারাই হয়েছে। তাই অনীলের বাবা-মা থেকে শুরু করে বড় ভাইবোনেরাও তাকে সমীহ করে চলে। পরিবারের ছোট হয়েও সে বরাবরই বড় ছেলের দায়িত্ব পালন করেছে। তাকে শাসন করার সাহস বা ক্ষমতা কারোই নেই। সেই থেকেই সে নিজের মর্জির মালিক। মেজাজ দেখানো কিংবা সবকিছুতে তার কথার দাম সবার চেয়ে বেশি এমনটাই হয়ে আসছে। তার ওপর একা শহুরের জীবনযাপন তাকে আরো বেপরোয়া করে তুলেছে। চারদিকে ইচ্ছেমতো সব করার উপকরণ, ডাক দেওয়ার কেউ নেই। তাই যৌবনের বাঁধাহীন উচ্ছাসে গা ভাসিয়েছে বহু আগেই। নিষিদ্ধ নোংরা লীলাখেলায় মেতে ওঠা তার জন্য পানিভাতের মতোই। একেকজনের যৌবনে একেকরকম নেশা তৈরি হয়। তার তৈরি হয়েছে নারীর নেশা! নারী তার কাছে ভোগ্যপণ্য ছাড়া কিছুই না। নারীর শরীরের মূল্য মাত্র দুইশো টাকা! অবশ্য অনীল টাকার ধার ধারে নি কখনো। সে এমনিই বহু শিকারী পায়। ইচ্ছেমতো ভোগ শেষে ছুড়ে ফেলে দেয়। এলাকায় বহুবছর ধরেই তার দাপুটে বিচরণ। তাই কেউ মুখ খোলার সাহস পায় না। তবে তার মা হয়তো কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই তো বড় ছেলের আগে ছোট ছেলেকে বিয়ে করিয়ে সংসার নামক শেকলে বাঁধতে চেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন সংসারের মায়ায় পড়ে ছেলের সকল বদঅভ্যাস দূর হবে। বহু খুঁজে শামীমার মতো শান্তশিষ্ট জনমদুঃখী মেয়েকেই তার মনে ধরেছিল। যতদিন তিনি বেঁচেছিলেন মা-হীন মেয়েটাকে পরম মমতায় আগলে রেখেছেন। মায়ের অভাব দূর করার চেষ্টা করেছেন সাধ্যমতো।
কিন্তু তার মৃত্যুর পর অনীল ফের তার আগের রূপেই অবতীর্ণ হয়েছে। মা নামক একমাত্র শাসনকারী হারিয়ে তার সবকিছু আগের চেয়েও বেশি হিংস্র হয়ে ওঠেছে। তবে এটা সত্যি সে এই পৃথিবীতে মায়ের পর কাউকে যদি ভালোবেসে থাকে তবে সে অন্তরা। অন্তরার মাঝে সে মাকে খুঁজে পায়। সৃষ্টিকর্তা কন্যাসন্তানের মাঝে এক আলাদা রহমত দিয়ে দেন। যা তাদের পিতাদের মনে জন্মদাত্রীর অনুভূতি জাগায়। তাই তো বাবারা মেয়েদের মা ছাড়া কথাই বলেন না। অনীলের জীবনে তার মেয়ে অন্তরার জায়গা কতখানি তা গল্পে ধীরে ধীরে জানতে পারবেন।
।
।
ওমরের ভাবভঙ্গি আজকাল কেমন যেন লাগছে শামীমার। ছেলেটা সারাক্ষণ কেমন বিষণ্ণ থাকে। অবসর পেলেই কেমন মিইয়ে পড়া গাছের মতো একপাশে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। কি হলো ছেলেটার? কি এতো ভাবে সে? শামীমা নানা ছলছুতোয় ছেলের মন পড়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু সন্তানেরা বড় হলে কেমন যেন ছদ্মবেশী হয়ে যায়। বিশ্বাসই হতে চায় না এই সন্তানটাই তার গর্ভে ছিল! শামীমা বুঝে উঠতে পারেনা এটা কি বয়ঃসন্ধির জন্য নাকি পারিবারিক অশান্তির প্রভাব! আসলে চোরের মন সর্বদাই পুলিশ পুলিশ করে। সে যে একটা নিকৃষ্ট সত্যি লুকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে তাই তার মনে প্রবল ভয় সৃষ্টি করেছে। আজকাল ওমর বাসায় কোনো মেয়ে গেস্ট আসা পছন্দ করেনা। রেগে যায়, খিটখিট করে। কিন্তু তার বাবার ভয়ে কিছু বলেনা। ওর চোখের ভাষা শামীমার দৃষ্টি এড়ায় না। এই তো সেদিন হঠাৎ বললো, মা তোমার তো কোনো বোন নেই, না বাবার অতো আত্মীয়স্বজন আছে তবে আমাদের এতো আন্টি হয় কিভাবে? তাও নিত্যনতুন সবাই কাউকেই আগে থেকে চিনি না!
শামীমা ভেতরে ভেতরে গুমড়ে গেলেও কখনোই সেটা প্রকাশ হতে দেয় না। সন্তানদের সামনে সাবলীলভাবেই মিথ্যা বলার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে তার। কত সুন্দর করেই না মিথ্যা গল্প এঁটে বুঝিয়ে দেয় “এরা ঢাকায় আসে বিভিন্ন কাজে। তোমরা তো গ্রামে যাও না তাই চিনো না। গ্রামে কি আর একজন দুজন থাকে? সবাই ই তো লতাপাতায় আত্মীয়!”
ওমর তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। আর মনে মনে ভাবে, মা তুমি অনেক বড় অভিনেত্রী। তোমার নিখুঁত অভিনয় অস্কার পাওয়ার যোগ্য! কিন্তু জানো তো মা তোমার ছেলেটি আর ছোট্ট খোকা নেই।
ওমরের ভাবনাজুড়ে কেবল এটাই কিভাবে সে তাড়াতাড়ি বড় হবে, পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করবে। মাকে এই দোজখ থেকে বের করে একটা সুস্থ সুন্দর জীবন উপহার দিবে। কথায় বলে যে একবার সত্যের সন্ধান পায় তার চোখের সামনে মিথ্যা পর্দা ততোই খসে পড়তে থাকে। ওমর যেই থেকে জেনেছে ঐ ঘরের রহস্য সেই থেকেই আরো অনেক কুৎসিত সত্য তার চোখের সামনে দিনের মতো স্পষ্ট হয়ে ধরা দিয়েছে। এইসবকিছু এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কটাকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলেছে। সে মেনে নিতে পারছে না কিছুই। মনের মাঝে অশান্ত ঝড় তার তান্ডব চালিয়ে ক্ষ্যান্ত হয় না। রুদ্রশ্বাসে আরো ফুলেফেঁপে উঠে। যেন তাকে একেবারে নিঃশেষ না করে দম নিবে না! ওমর রাতের আধারে বসে থাকে। #অন্তঃপুরের_দহনে ঘুমোতে পারেনা।
তাদের বাসাটা অনেক বড়। একেকটা রুমের মাঝে বিস্তর দূরত্ব। সে পড়ে আছে দখিনের ঘরটাতে। রাতের নিকষ কালো আধার তার আর ভয় লাগেনা। দিব্যি বসে থাকে আধারে। কত রাত যে কেঁদে ভাসাচ্ছে কেউ জানবেনা। ছেলেদের কান্না হচ্ছে সবচেয়ে গোপন বিষয়। ওমর জানে কান্না করা মেয়েদের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সে কেন না কেঁদে পারে না? ওর কেন বুক ভেঙে কান্না পায়? কেন মনে হয় মায়ের সাথে অনেক বড় অন্যায় হচ্ছে? আর সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে না পারাটা বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটার মতো যন্ত্রণা দেয়। ও পারে না কিছু করতে। আকাশের দিকে চেয়ে বলে “এতো অসহায় করে কেন পাঠালে মালিক? আমাকে শক্তি কেন দিচ্ছ না কিছু করার?”
মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে মরে যেতে। এই জীবনটা অসহনীয় মনে হয়। মৃত্যুই তখন একমাত্র সমাধান হয়ে ভেসে উঠে মনে। মরে গেলেই তো সব শেষ। না রইলো মাথা না রইলো ব্যথা। কিন্তু মরে গেলে যে পাপ হবে! মা খুব কাঁদবে,,,,
মানসিকভাবে চরম বিপর্যস্ত ছেলেটা সেইসব ভুল চিন্তার মাঝে তবুও বেঁচে থাকে তার মা কে মুক্ত করার তীব্র প্রতিজ্ঞায়। তাকে যে বাঁচতেই হবে। জীবনে অনেক বড় হতে হবে। কঠিন জেদ চেপে বসে মনে; মা-বোনকে যে এই লোকের কালো ছায়া থেকে দূরে নিতেই হবে!
এভাবেই কাটতে থাকে সময়। ধীরে ধীরে বয়ে যায় দিন, মাস, বছর। পাল্টাতে থাকে দেয়ালে ঝুলানো পুরনো ক্যালেন্ডার,,,,,
চলবে,,,