অন্তঃপুরে দহন পর্ব ২৩

0
369

#অন্তঃপুরে_দহন (পর্ব-২৩)

#আরশিয়া জান্নাত

কলমিলতায় বেগুনী সাদার ফুল ধরেছে, এমন সুন্দর ফুল হয় এমন বুনোলতায় আগে দেখেনি তাইয়্যেবা। কত রকম পাহাড়ী বুনোফুল, লতাপাতা, বৈচিত্র গাছগাছালি সাথে নাম না জানা পাখির আগমন। এই পর্যন্ত সে পনেরোটা ভিন্ন পাখি দেখেছে, যাদের নাম সে জানেনা আগে কখনো দেখেনি। শহুরে দালানকোঠায় বেড়ে উঠা তাইয়্যেবা প্রকৃতির সান্নিধ্য বলতে ঐ স্কুল মাঠ, ক্যাম্পাসের খানিকটা অরণ্য আর মাঝেসাঝে লেকের ধারই বুঝে। ঐটুকুতেই কত ডুবেছিল সে, যেন এ ছোট্ট জীবনটা অনায়েসে কাটিয়ে দিতে পারবে সবুজের দিকে চেয়ে!
এখানে এসে তার উপলব্ধি হলো, সে আসলেই ক্ষুদ্র পরিসর দেখেই মরিয়া হয়েছিল। এই পৃথিবীটা যে অনেক বিশাল, হয়তো তার চিন্তার পরিসীমার উর্ধ্বে! তাইয়্যেবাকে রুমে না পেয়ে অন্তরা বাগানে চলে গেল। ঠিক যা ভেবেছে তাই, তাইয়্যেবা সামনের দিকে ভাবুক হয়ে বসে আছে। অন্তরা পাশের চেয়ারটায় বসে বলল, বৌরানী তুমি এখানে বসে আছ? আমি তোমায় হন্যি হয়ে খুঁজছি জানো!

কখন ফিরলে? আজ এতো দেরী হলো যে?

আর বলোনা রামিসা ম্যাম জোর করে উনার বাসায় নিয়ে গেল। তাই ফিরতে দেরি হলো। চা খাবে?

তুমি বসো আমি বানিয়ে আনছি

আরেহ যাচ্ছো কোথায় বসো তো। আমি বলে এসেছি খালাকে। এখুনি দিয়ে যাবে।

ফুফু এসেছেন দেখেছ?

হুম। এও শুনেছি সে তোমায় কথা শুনিয়েছে। ভাইয়া শুনলে খবর আছে। আমি বকে এসেছি একদফা।

আহা বকতে গেলে কেন? আর তোমার ভাইকে বলো না। মুরুব্বি মানুষ যা দেখেছেন তাই বলেছেন। আমিতো আহামরি কেউ নই যে প্রথম দেখায় পছন্দ করবেন। উনার রাগ করা অস্বাভাবিক না। আমাদের বিয়েটা আসলেই দ্রুত হয়েছে।

মোটেও না, মা বহুবার উনাকে আসতে বলেছিলেন। উনিই তখন বললেন একা আসতে পারবেন না। উনার ছোট ভাইয়ের এক মাত্র ছেলের বিয়ে একা আসলে মান যাবে। আমরা তো বড় আয়োজন করিনি, এত মানুষকে আনলে কি করে হবে? উনারা এটা ভাবছেন না বাবার পর সংসারটার হাল ধরতে সময় লাগছে আমাদের। মানসিকভাবে আমরা অতটা সবল নই যতটা অভিনয় করে যাচ্ছি।

তাইয়্যেবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, বিয়েটা আরো পরে করা উচিত ছিল।

আমার ভাইকে এতোবছর অপেক্ষা করিয়েও মন ভরেনি বুঝি?

কি জানি ভাই? কেমন যেন পানসে লাগছে সব।

সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো। সময়টা বয়ে যাক শুধু।


ওমর রুমে এসে বসতেই তাইয়্যেবা শরবতের গ্লাস নিয়ে হাজির হলো। তাইয়্যেবার স্নিগ্ধ মুখখানি দেখতেই ওমরের মুখে হাসি ফুটলো। তাইয়্যেবা শাড়ির আচলের কার্ণিশ ধরে ওমরের কপালের ঘাম মুছে বললো, অনেক গরম বাইরে তাই না? কষ্ট হয় অনেক?
ওমর তাইয়্যেবাকে একহাতে টানতে গিয়েও টানলো না। এমন ঘামে ভেজা শরীরে নিজেরই বিরক্ত লাগছে। তাইয়্যেবা বিষয়টা টের পেল, কালবিলম্ব না করে দু হাতে জড়িয়ে ধরলো ওমরকে। ঘর্মাক্ত বুকে নাক ডুবিয়ে বললো, ভালোবাসা বোধহয় অদ্ভুত। ভালোবাসার মানুষের সবকিছুই মাদকতা ছড়ায়।
ওমরের বুক শিরশির করে উঠলো যেন। তাইয়্যেবার তপ্ত নিঃশ্বাস বুকে পড়ছে বলে নাকি তার কথার মুগ্ধতায়?মেয়েটা যখনই কাছে আসে ওমরের সব বদলে যায়। মনটা পরম শান্তিতে ভরে যায়। ওমর তাইয়্যেবার কপালে পরম মমতায় অধর ছোঁয়ালো। তাইয়্যেবা চোখ বন্ধ করে অনুভব করলো ওমরের স্পর্শ। ওমর ওর বন্ধ চোখের ঘন পাপড়ির দিকে চেয়ে বললো, তাইয়্যেবা তুমি কি জানো তোমার চোখের পাপড়ি কতোটা সুন্দর?

তাই বুঝি?

ওমর চোখের পাপড়িতে আলতো করে আঙুল ছুঁইয়ে বললো, ঠিক তাই। তোমার অনেকগুলো সৌন্দর্যের মাঝে এটা অন্যতম। বলেই চোখজোড়ায় চুমু খেলো।

তাইয়্যেবা মুচকি হাসলো। উঠো ফ্রেশ‌ হয়ে নাও। আমি খাবার রেডি করছি।

ওমর উঠে শার্টের বোতাম খুলতে গিয়েও থেমে গেল। তাইয়্যেবা কৌতুহল দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল, ওমর ভ্রু নাচিয়ে বললো কি ব্যাপার গেলে না?

তাইয়্যেবা হকচকিয়ে মাথা নেড়ে বললো যাচ্ছি। তাইয়্যেবা একটা জিনিস খেয়াল করলো এই পর্যন্ত সে ওমরকে হাফ হাতার কিছুই পড়তে দেখে না। এই গরমেও মানুষটা দিব্যি ফুল হাতা টিশার্ট পড়ে ঘুমায়। ওর সামনে কখনোই শার্ট পাল্টায় না। ব্যাপারটা কেমন যেন অদ্ভুত লাগে তার কাছে। পরে ভাবে ওমর খুব লাজুক হয়তো তাই লজ্জা পায়। তাছাড়া এখনো তারা একে অপরের ঘনিষ্ঠতা লাভ করেনি। মনের সান্নিধ্য অনুভব করছে বেশ।

ওমর পেছন ফিরে তাইয়্যেবার দিকে দুষ্ট হাসি দিয়ে বললো, মতলবখানা কি তোমার? বরের শরীর দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে বুঝি?

তাইয়্যেবার কান গরম হয়ে গেল লজ্জায়। সেটা প্রকাশ না করতে তেতে বললো, অন্যেরটা দেখতে যাবো নাকি? দেখলে নিজের বরেরটাই তো দেখবো।

ওহ আচ্ছা তার মানে স্বীকার করলে দেখতে চাইছো?

তাইয়্যেবা জিভ কেটে ভৌদৌড় দিল। কি বলে ফেলল সে, ইশ!

তাইয়্যেবা চলে যেতেই ওমর শার্ট খুলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, কিভাবে দেখাই তোমায় এই ক্ষতবিক্ষত বুক? ভয় পেয়ে যাও যদি? আমার সব ক্ষত যে এখানেই দৃশ্যমান। যার অংশীদার কাউকে করিনি।

অন্তরার মনমেজাজ আজকাল বেশ ফুরফুরে থাকে। আবরার স্যার এতো রসিক মানুষ তার আশেপাশের কেউ মন খারাপ করে থাকতেই পারবেনা। সে সবসময় প্রাণোচ্ছল থাকে এবং অন্যকেও তাই রাখে। অন্তরার পরিবর্তনে পরিবারের সবাই স্বস্তিবোধ করে। অন্তরার সারাদিন কাটে স্কুলে। মাধ্যমিক শাখার শিক্ষিকা হবার দরুন দিনের বেশিরভাগ সময় সেখানেই ব্যয় হয়। অন্তরা বেশ উপভোগ করে সেটা। নিজের স্টুডেন্ট লাইফটা যেন চোখের সামনে ভেসে উঠে রোজ।

এক্সকিউজ মি ম্যাম।

অন্তরা খাতা থেকে মুখ তুলে বলল, কিছু বলবেন?

আগামী সপ্তাহে আমার ছোটবোনের বিয়ে শুনেছেন নিশ্চয়ই? আপনারো দাওয়াত স্বপরিবারে আসবেন।

আমি আসলে বিয়ে এটেন্ড করি না। তাই কথা দিতে পারছিনা,,

জানতাম এই কথা বলবেন। এসব বাহানা এবার শুনবোনা। আমার ভাইয়ের বিয়েতে আসেন নি কিছু বলিনি, কিন্তু এবার আসতেই হবে।

অন্তরা ম্লান হাসলো। আবরার তো জানেনা অন্তরার এখন বিয়ে বাড়ি ভয়ঙ্কর মনে হয়।

নাহিদের মন বিষাদে ভরে আছে। বুকের মাঝখানটাতে যে আসিন হয়ে আছে তার অভাব যতটা তাকে পুড়িয়েছে তার চেয়ে অধিক পোড়াচ্ছে সেই মানুষটা অন্যের হয়ে যাচ্ছে ভেবে। গতবার চিটাগং এসে সে ফের কিছু লোক সেট করে গেছে। তাদের মাধ্যমেই অন্তরার সব মনিটরিং করে। অন্তরা হাসিখুশি আছে এটা যতোটা তাকে আনন্দ দিচ্ছে তার চেয়ে অধিক পীড়া দিচ্ছে এই ভালো থাকার উৎস অন্য একজন জেনে। নাহিদের নিজেকে নিঃস্ব মনে হয়। অন্তরা কি তবে সত্যিই দূরের কেউ হয়ে যাবে? যাকে নিয়ে ভাবার অধিকারটুকুও থাকবেনা? যদি অন্তরা সত্যিই তাই চায় তবে যে নাহিদের আর কিছু করার থাকবেনা। এতোদিন মনের সব যন্ত্রণা একপাশে রেখেছে, এইটুকু ভরসা ছিল অন্তরা ওরই হবে। কিন্তু এখন সেই ভরসা পায় না। অন্তরার নির্লিপ্ততা তীব্রভাবে জানান দেয় সে নাহিদকে চায় না। নাহিদের চোখের কোণ ভরে আসে। ভিনদেশের কাচের দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে দেশে ফেলে আসা এক মায়াবতীর হাসিমুখখানী দেখার তৃষ্ণা এই জীবনে বোধহয় আর মিটবেনা। সে কি তবে ছেড়ে দিবে অন্তরাকে নিজের হালে? ওর সুখেই সুখ খুঁজে নিবে? সে কি আদৌ পারবে ওকে অন্য কারো পাশে কল্পনা করতে? অন্তরা অন্য কারো সামনে লজ্জায় অবনত থাকবে, ওর রাঙা মুখের ঐশ্বরিক সৌন্দর্য অন্য কেউ অবলোকন করে হৃদপিন্ড কম্পিত করাবে? না না এইসব নাহিদ কল্পনাও করতে পারবেনা। বুকের মাঝে তীব্র ব্যথায় কুকড়ে উঠে নাহিদ। এই ব্যথার মেডিসিন একমাত্র অন্তরা এই কথা আর কেউ না জানলেও সে জানে।

শামীমা থমথমে মুখে বারান্দায় বসে আছেন। অন্তরা মায়ের পাশে বসে পেপার হাতে নিলো। মনসুরা খালা চা দিয়ে গেলেন। কিন্তু শামীমার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। অন্তরা চা নিতে গিয়ে মাকে বলল,কিছু হয়েছে মা? চা নিচ্ছ না যে?

শামীমা গাম্ভীর্য ধরে রেখেই বললো, অন্তরা তুমি কি নাহিদকে নিয়ে কিছু ভাবছো?

অন্তরা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলো।

শামীমা ধরা গলায় বললো, নাহিদ স্ট্রোক করেছে,,,

অন্তরার হাত থেকে চায়ের কাপ টা ফসকে পড়ে যায়। গরম চায়ে পায়ের উপরটা জলসে গেলেও উহ শব্দটুকু করে না। চোখের সামনে গাঢ় অন্ধকার, যেন‌ সে তলিয়ে যাচ্ছে তিমির আধারে। দূর থেকে ভেসে আসছে অস্পষ্ট শব্দ। হয়তো তার মা কিছু বলছে,কিন্তু কি বলছে??

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here